অপেক্ষার প্রহর (পর্ব-১২)
দরজা খুলে সুদীপ্তকে দেখে গোপালের মা খুশিতে বলে উঠল, “ওমা, বড় দাদাবাবু আপনি।”
সুদীপ্ত জিজ্ঞেস করল, “কেমন আছ গোপালের মা? মা কোথায়?”
“গিন্নিমা তো খেয়ে একটু বিশ্রাম নিচ্ছেন নিজের ঘরে। ডাকব?”
“না, আমিই যাচ্ছি মায়ের ঘরে” বলে সুদীপ্ত অঞ্জনার ঘরে চলে আসল। অনেক বছর পর এই বাড়িতে এসেছে সুদীপ্ত।
অঞ্জনা শুয়ে ছিলেন। সুদীপ্ত মায়ের পেছনে গিয়ে বলল, “মা”।
ছেলের গলা শুনে পেছন ফিরলেন অঞ্জনা।“খোকা তুই।”
সুদীপ্ত বিছানায় বসে জিজ্ঞেস করল, “কেমন আছ মা?” অঞ্জনার এখনও বিশ্বাস হচ্ছে না। তিন বছর পর আসল সুদীপ্ত এই বাড়িতে। সুদীপ্ত বাইরের জামায় বিছানায় বসেছে। অন্য সময় হলে সুদীপ্তকে বকা-বাদ্যি করতেন। এত বছর পর ছেলে এসেছে। তাই আর কিছু বললেন না।
“ভাল। তুই কেমন আছিস? এতদিনে বাড়িতে আসার সময় হল ছেলের আমার। একটু জানিয়ে আসবি না?”
“তুমিও তো না বলে চলে গিয়েছিলে আমার বাসায়।” অঞ্জনা এই কথায় একটু দমে গেলেন। একটু চুপ থেকে জিজ্ঞেস করলেন, “বৌমা কেমন আছে?”
“ভাল।” সুদীপ্তর মনে হল অঞ্জনা একটু অস্বস্তিতে পড়ে গেছে।
“তা কি বলল শাশুড়ি সম্পর্কে? নিশ্চয়ই বলেছে শাশুড়ি অনেক খারাপ।”
“না তো, খারাপ কেন বলবে? বলেছে তুমি ওর জন্য শাড়ি-গয়না নিয়ে গেছ। নিজের হাতে গয়না পড়িয়ে দিয়েছ, পায়েস খাইয়ে দিয়েছ।”
“আর কিছু বলেনি?”
“না তো। ও হ্যাঁ বলেছিল তোমাকে থাকার জন্য। ঐদিন আমাদের বিয়ের দিন ছিল কিনা। তোমার অন্য কোথাও কাজ ছিল তাই তুমি থাকতে পারনি।এইত।”
“আর কিছু বলেনি?” অঞ্জনা বিশ্বাস করতে পারছে না।
“না তো। কেন? আরও কিছু বলার ছিল নাকি?” অঞ্জনা চুপ করে রইলেন। “যদি থাকেও ইয়াসমিন হয়ত বলতে চায়না বা মনেও রাখতে চায় না। ও যদি কিছু মনে রাখতে না চায় তাহলে তুমি বা কেন মনে রাখতে চাইছ?” অঞ্জনা চুপ করে রইলেন। হয় মেয়েটা সুদীপ্তকে কিছু জানায়নি নতুবা সুদীপ্ত নিজেই চায়না ব্যাপারটা নিয়ে নতুন করে আর কোন কথা হোক।
“তা শাশুড়ি মার কেমন লেগেছে তার বৌমাকে?” সুদীপ্ত জিজ্ঞেস করল।
“ভাল।” একটু চুপ থেকে অঞ্জনা বলল, “অনেক ভাল লেগেছে। আমার ছেলে যেমন ভাল আমার বৌমাও তেমন ভাল।”
“তাই নাকি?”
“হুম। আমি তো চাই ভগবান প্রতি জন্মে তোকে আমার ছেলে করে পাঠাক।”
“আর ইয়াসমিনকে চাও না?”
একটু চুপ থেকে অঞ্জনা বললেন, “আমার ছেলে আর ছেলের বৌকে কেউ আলাদা করতে পারবে না।” সুদীপ্ত কি বলবে কিছু বুজতে পারছে না। প্রসঙ্গ পাল্টানোর জন্য বলল, “মা একটা দরকারে এসেছিলাম।”
“কি দরকারে?”
“অপু একটা ছেলেকে পছন্দ করে। প্রত্যয় নাম। বুয়েট থেকে পাস করা। মেকানিক্যাল ইঞ্জিনিয়ার। লেকচারার হিসেবে এখন আছে। বাইরে একটা স্কলারশিপ হয়েছে। ওর বাসা থেকে চাচ্ছে প্রত্যয় বাইরে যাওয়ার আগে অপু আর প্রত্যয়ের আশীর্বাদটা সেরে ফেলতে।”
“শুনে তো ভালই মনে হচ্ছে। কিন্তু দেখতে কেমন আর ফ্যামিলি কেমন?”
“আমার সাথে ছেলের দেখা হয়েছে। ভালই । আমি খবরও নিয়েছিলাম। ছেলে ভাল। তোমরা যদি আরও খবরাখবর নিতে চাও তো নিয়ে দেখতে পার।”
“ঠিক আছে। তোর বাবার সাথে কথা বলে দেখি। অপুর জন্যই বুঝি এসেছিস বাড়িতে?”
একটু হেসে সুদীপ্ত বলল, “না মা। শুধু অপুর ব্যাপার থাকলে তো ফোনেই বলতে পারতাম।” অঞ্জনার হাত ধরে বলল, “তোমাকে দেখতে ইচ্ছে করল, বাসায় আসতে ইচ্ছে করল। তাই ভাবলাম এক ঢিলে দুই পাখি মারি।”
“খোকা একদিন বৌমাকে বাড়িতে নিয়ে আয়না।”
“আসা তো যায়ই। সরকার মশায় আবার রাগ করবেন নাতো?”
“তোর বাবা সামনে গ্রামে যাবেন কি কাজে। তখন না হয় নিয়ে আসলি।”
“ঠিক আছে নিয়ে আসব। এখন কিছু খেতে দাওতো। কথা বলতে বলতে খিদে পেয়েছে।”
“ওমা আমি তো একটুও খেয়াল করিনি। ভাত দেই?”
“না মা, ভাত টাত খাব না। নাস্তা টাস্তা কিছু থাকলে দাও।”
অঞ্জনা উঠে খাবারের আয়োজন করতে গেলেন। অপর্ণা মায়ের ঘরের বাইরে দাঁড়িয়ে সব শুনেছে। মেয়ের সাথে মুখোমুখি হলে অঞ্জনা বলে উঠেন, “নিজের মুখে মাকে বলা যায়না, ভাইকে দিয়ে বলাতে হল।” অপর্ণা চুপ করে রইল। অঞ্জনা রান্নাঘরে চলে গেলে অপর্ণা এসে ভাইয়ের হাত ধরে বলল, “থ্যাঙ্ক ইউ দাদাভাই।”
“ঠিক আছে। প্রত্যয়কে নিয়ে একদিন বাসায় আসিস। একটু আলাপ পরিচয় হোক।” একটু চুপ থেকে সুদীপ্ত বলল, “কৌশিক কই রে?”
“ছোড়দা তো এই সময় বাসায় থাকেনা। জানিস দাদাভাই ছোড়দা পুরোপুরি পাল্টে গেছে ইদানিং। হলে থাকে না। বাসায়ই থাকে। একদিন জিজ্ঞেস করছিল তোর আর বৌমনির ব্যাপারে।”
সুদীপ্ত সব জানে। মায়ের সাথে মিথ্যে বলেছে সুদীপ্ত। কৌশিকের জন্যই আজ সে এই বাড়িতে এসেছে। কৌশিক ড্রাগস নেয় শুনে প্রচণ্ড আঘাত পেয়েছিল সুদীপ্ত। কৌশিকের আজকের এই অবস্থার জন্য সুদীপ্ত নিজেও কি কিছুটা দায়ী নয়? ছোটবেলা থেকে বাসার মানুষের কাছ থেকে একটু ভালবাসা, একটু গুরুত্ব পেতে চেয়েছিল কৌশিক। কৌশিকের এই চাহিদা তো সুদীপ্ত তো আগে থেকেই সব জানত। তবু কি করে পেরেছিল ব্যাপারটা নিয়ে এত নিষ্ক্রিয় থাকতে? মাকে কি একটু বলতে পারত না কৌশিকের দিকে একটু খেয়াল দিতে। সে নিজে কি পারত না ভাইকে সময় দিতে । এই তিন বছরে তো দরকার ছাড়া একবারও ফোন দেয়নি কৌশিককে। সুদীপ্ত অপরাধবোধে জর্জরিত হচ্ছিল বারবার। সেদিন আর কিছু বলেনি কৌশিককে। ফোন করেছিল কৌশিকের বন্ধু নয়নকে।
“নয়ন, তুমি তো কৌশিকের সবচেয়ে ভাল বন্ধু। তুমি জান কৌশিক যে ড্রাগস নিচ্ছে?”
একটু সময় নিয়ে নয়ন বলল, “ভাইয়া ও আজকাল আমাকে এভয়েড করছে। তাই ওর খবরাখবর কমই জানতাম। কিছুদিন আগে আমাদের আরেক কমন ফ্রেন্ড এর মাধ্যমে জানলাম ওর ড্রাগস নেয়ার কথাটা।”
“জেনেও আমাকে একবারও জানানোর প্রয়োজন মনে করলে না? তোমার কাছে আমার ফোন নম্বর আছে। আমার সাথে তোমার ফেসবুকে কন্টাক্ট আছে তারপর ও আমাকে জানানোর প্রয়োজন মনে করলে না?”
“জানাতাম ভাইয়া। কিন্তু কৌশিক কি মনে আপনাকে জানালে তাই ভেবে আর জানানো হয়নি।”
“কি মনে করে মানে? তোমার কাছে ওর মনে করাটা বড় নাকি ওর লাইফটা?”
“সরি ভাইয়া, ভুল হয়ে গেছে। আমি ওর সাথে কথা বলছি।”
“কিছু করতে হবে না এখন। আমি দেখছি। আর ভবিষ্যতে কোন অঘটন ঘটলে আমাকে জানিও প্লিজ।”
সুদীপ্ত ডাক্তারের এপয়নমেন্ট নিয়ে কৌশিককে আসতে বলে। “তুই শুধু শুধু ঝামেলা করছিস দাদাভাই। আমি ডাক্তার দেখাব না। তুই সবার কাছে দেবতা হ। প্লিজ আমার কাছে দেবতা হতে চাস না।”
“আমি তোর কাছে দেবতা হতে চাইনা। আমি তোর ভাই হিসেবেই থাকতে চাই। আমি ডাক্তারের কাছ থেকে এপয়নমেন্ট নিয়েছি। সন্ধ্যা সাড়ে ছটায়। চলে আসিস।” পরপর ৫ দিন ডাক্তারের এপয়নমেন্ট নিয়ে অপেক্ষা করেছে সুদীপ্ত। কৌশিক আসেনি। ষষ্ঠ দিনের দিন কৌশিক এসেছিল।
ডাক্তারের কাছে যাওয়ার পর কৌশিক ডাক্তারকে বলল, “আমি কখনও ভাল হতে চাইনি। কিন্তু আজ চাইছি। কিন্তু নিজের জন্য না। আমার দাদাভাইয়ের জন্য। দাদাভাইকে সবাই খুব ভালবাসে। তাই আমি এই মানুষটাকে অপছন্দ করতাম। কিন্তু এই দাদাভাই আমার জন্য পুরো ৫ দিন সন্ধ্যা ৬টা থেকে রাত ১০টা পর্যন্ত অপেক্ষা করেছে। ঘরে বৌমনি প্রেগন্যান্ট অবস্থায় তার জন্য অপেক্ষা করছে। কিন্তু দাদাভাই ওদের কথা চিন্তা না করে তার এই অপদার্থ ভাইটাকে ভাল করার জন্য অপেক্ষা করেছে। আমাকে আমার দাদাভাইয়ের জন্য আমাকে ভাল করে দিন প্লিজ।” কৌশিক হঠাৎ করে কাঁদতে শুরু করল।
“এই কৌশিক এসব কি বলছিস? তোর কি কষ্ট হচ্ছে ডাক্তারকে খুলে বল। না হলে উনি চিকিৎসা করবেন কি করে?”
কৌশিক হঠাৎ করে সুদীপ্তকে জড়িয়ে ধরে কাঁদতে কাঁদতে বলল, “দাদাভাই আমাকে মাফ করে দে। আমি তোর সম্পর্কে, বৌমনির সম্পর্কে অনেক বাজে কথা বলেছি। আমি অপুর কাছ থেকে বৌমনির সম্পর্কে সব শুনেছি। তোরা সত্যি অনেক ভাল দাদাভাই। সারাজীবন তোকে শুধু হিংসে করেছি। আজ বুজতে পারছি তোর মত বড় আমি কখনও হতে পারব না। শুধু এই ৫ দিন না, আমি জানি তুই আমার জন্য আজীবন অপেক্ষা করতে পারতি।আমাকে ক্ষমা করে দে দাদাভাই।” সুদীপ্তর চোখেও পানি চলে এসেছে। গলাটা ভারি হয়ে উঠেছে। কিছু বলতে পারছে না। ডাক্তার সেলিনাও মুগ্ধ হয়ে দুই ভাইয়ের মিলন দৃশ্য দেখছেন। (চলবে)