অপেক্ষার প্রহর (পর্ব- ১৭)
“হা কর।” শিলা ছেলেটাকে বলল। ছেলেটা হা করল, আবার হাসি পেয়ে মুখ বন্ধ করে ফেলল। প্রায় দশ মিনিট ধরে এসব কাজকর্ম চলছে। ছেলেটা একবার হা করে, হেসে আবার হা বন্ধ করে। রতনের কাছে পুরো ব্যাপারটা খুব হাস্যকর লাগছে। শফিক- শিলা আজ একসাথে বেড়িয়েছে পথশিশুদের সাথে কথা বলার জন্য। শিলা গাড় নীল রঙের শাড়ি পড়েছে। শফিকের খুব ইচ্ছে করছে শিলার দিকে তাকিয়ে থাকতে কিন্তু কেন জানি খুব সংকোচ হচ্ছে তাকিয়ে থাকতে। মেয়েটা কি মনে করবে কি জানি। শিলা তার ডাক্তারির জিনিসপত্র নিয়ে বেড়িয়েছে। শফিক অবাক হয়ে গিয়েছিল।“এগুলো কেন?”
“কেন আবার? আজ হবে পথশিশুদের চিকিৎসা সেবা। আমি ডাক্তার আর আপনি আমার সহযোগী।” দিনটা ভালই কেটেছে। সারাদিন ঢাকা শহরের এখানে ঐখানে ঘুরে বেড়িয়েছে। ফার্মগেট, ধানমণ্ডি-২৭ বিভিন্ন জায়গা ঘুরে ঘুরে শিশুদের সাথে কথা বলেছে। শিলা তাদের চেকআপ করেছে, ভিটামিন ওষুধ দিয়েছে। ব্যাপারটা সম্পূর্ণ অন্যরকম অভিজ্ঞতা ছিল বাচ্চাগুলোর জন্য, শিলাদের জন্য। খুব হাসি পাচ্ছিল তাদের। এদেরই একজন রতন। রতনকে ওরা ধানমণ্ডি-২৭ এ পেয়েছে। এই জায়গাটা খুব কষ্টের একটা জায়গা শফিকের কাছে। এখানে মায়েরা তাদের ছেলেমেয়েদের দিয়ে ভিক্ষা করায়, ফুল বিক্রি করায়। এই দৃশ্য দেখলে এক অস্বস্তিকর অনুভূতি হয়। কিছু কিছু ছেলেপেলেকে দেখা যায় বড় বাসের উপর উঠে গাড়ির গ্লাস পরিষ্কার করে। দুটো পয়সা রোজগারের জন্য জীবনের ঝুঁকি নেয় বাচ্চাগুলো।
“হাসছ কেন?” শিলা রতনকে জিজ্ঞেস করল। রতন কিছু না বলে হাত দিয়ে মুখ বন্ধ করে হাসতে লাগল। “হাঁ কর।” এবার একটু কঠিন গলায় বলল শিলা। রতন ভয় পেয়ে হাঁ করল।“হুম, দাঁতে পোকা হয়েছে আর গন্ধও অনেক। এই নাও টুথব্রাশ আর টুথপেস্ট। প্রতিদিন রাতে ঘুমাবার আগে দাঁত ব্রাশ করবে। ঠিক আছে?” রতন মাথা নিচু করে ব্রাশ আর পেস্ট নিল।
দুপুরে কয়েকজনকে নিয়ে একটা হোটেলে খেয়েছে দুজন মিলে। সে এক জমজমাট অবস্থা।সবাইকে লাইনে দাঁড় করিয়ে সাবান দিয়ে হাত ধোয়ান হয়েছে। সবাই পেট পুরে খেয়েছে। এদের মধ্যে কয়েকজন গরীব বৃদ্ধ-বৃদ্ধা ছিলেন।সারাদিন শহরের এজায়গা-ঐজায়গা ঘুরে শেষে দুজনে ঘরের কাছের বেড়িবাঁধে আসে। হঠাৎ বৃষ্টি শুরু হয়। শফিক তাড়াতাড়ি একটা টঙ্গের দোকানের নীচে চলে যায়। শিলা মুগ্ধ হয়ে দুই হাত ছড়িয়ে বৃষ্টিতে ভিজতে থাকে। শফিক আরেকদিন এই দৃশ্য দেখেছে। মুগ্ধ হয়ে দেখেছিল সেদিন শিলাকে। মেয়েটার গায়ের রঙ একটু কালোর দিকে। কিন্তু চেহারাটায় কেমন একটা মায়া মায়া ভাব আছে। শফিকের লজ্জা করতে লাগল। এসব ও কি চিন্তা করছে। দৌড়ে শিলার কাছে গিয়ে বলল, “আপনি বৃষ্টিতে ভিজছেন কেন? ঠাণ্ডা লাগবে তো।”
“শফিক সাহেব, আমার বৃষ্টি খুব ভাল লাগে জানেন। আমার খুব নাচতে ইচ্ছে করছে। ছোটবেলায় নাচ শিখেছিলাম। অনেকদিন প্র্যাকটিস নেই নাচের। কিন্তু এখানে নাচাটা ঠিক হবে না তাইনা?” একটু চুপ থেকে বলল, “আচ্ছা, আপনি বৃষ্টির কোন গান জানেন?”
শফিকের একটা গানই শুধু মনে পড়ছে, “এই মেঘলা দিনে একলা ঘরে থাকেনা তো মন”। কিন্তু গানটার কথা বলা যাবে না। মেয়েটা অনেক রাগী।কি মনে করে আল্লাহই জানে। শফিক ইতস্তত করতে লাগল।
“কি আশ্চর্য? আপনি কোন গানই জানেন না? আপনি গান শুনেন না?” শফিক কি বলবে কিছু বুজতে পারছে না। এই গানটা ছাড়া অন্য কোন গান মনে পড়ছে না কেন? নিজের উপর নিজেরই বিরক্ত লাগছে।
শফিক ঠিক বলেছে। বৃষ্টিতে ভেজা ঠিক হয়নি। শিলা একের পর এক হাঁচি দিতে লাগল।আদা দিয়ে চা তৈরি করল।শওকত সাহেবের জন্যও চা বানিয়ে আনল।
“তোর মেজো খালা এসেছে আজ” শওকত সাহেব বললেন।
শিলা দীর্ঘশ্বাস ফেলল। মা মারা যাবার পর থেকে আত্মীয়-স্বজনরা তাদের বাসায় আসা প্রায় ছেড়েই দিয়েছে। সবাই নিজের নিজের জীবন নিয়ে ব্যস্ত। অবশ্য তার জন্য শিলা তাদের উপর রাগ করে থাকতে পারে না। সে নিজেও তো আত্মীয়-স্বজনের খবর নিতে পারেনা।
“কেমন আছে খালা? কি বলল?”শিলা জিজ্ঞেস করল।
“আছে ভালই। তোর জন্য একটা প্রস্তাব এনেছে। ছেলে ইঞ্জিনিয়ার। বাইরে থাকে। পিএইচডি করছে। তোর খালাদের বাড়িওয়ালার ছেলে। ছেলের পরিবারের অবস্থাও ভাল। ছেলের বাবা রিটায়ার্ড সরকারী অফিসার। মা ও সরকারী চাকরি করছে। ছোট পরিবার। ছেলেরা এক ভাই এক বোন। বোনটা কলেজে পড়ে।” শওকত সাহেব একটু থামলেন। শিলা মাথা নিছু করে বাবার কথা শুনছে। শওকত সাহেব আবার বলতে লাগলেন, “মা রে, আমি জানি কথাটা আমার আরও আগে চিন্তা করা দরকার ছিল। মনে হয় স্বার্থপর হয়ে গেছি। তাই তোর বিয়ের কথাটা এত দিন বলি বলি করেও বলা হল না। সরি মা।”
শিলা শওকত সাহেবকে জড়িয়ে ধরে বলল, “না বাবা, তোমার সরি বলার কিছু নেই এতে। তুমি খালাকে কি বলেছ?”
“বলেছি তোর সাথে কথা বলে জানাব। একটা সিভি দিয়ে গেছে ছেলের। সাথে ছবিও আছে। আমার কাছে ভাল লেগেছে। তুই একবার দেখ।”
“ছবি-সিভি কিছু দেখা লাগবে না।তুমি খালাকে না করে দাও বাবা। আমি তোমাকে ছাড়া কোথাও যাব না।”
“পাগলি মেয়ে। বাবা অসুস্থ বৃদ্ধ বলে কি মেয়ের বিয়ে আটকে থাকবে?” একটু চুপ থেকে জিজ্ঞেস করল, “হ্যাঁ রে, তোর পছন্দের কেউ আছে? কোনদিন তো বলিসনি কারো কথা।”
“বলিনি কারন তেমন কেউ নেই বাবা। তোমার মেয়ে কাল তো, তাই কেউ পছন্দ করল না আজ পর্যন্ত।”
“আজ যে সেজে-গুজে শফিকের সাথে বের হলি, শফিককে বুঝি তোর পছন্দ?”
শিলা অবাক হয়ে গেল, “বাবা, সেজে-গুজে কারো সাথে বের হলে বুঝি তাকে পছন্দ হয়ে যায়? এমনি একটা কাজ ছিল। ওনার অফিস ছুটি ছিল, ফ্রি ছিলেন। তাই ওনাকে নিয়ে গেলাম।” বাবার সাথে পথশিশু, শিশুশ্রম এসব নিয়ে আলোচনা করতে ইচ্ছে করছে না। তাই এ ব্যাপারে কোন কথা বলল না।
“উনি তোমাকে কিছু বলেছেন?” শিলার মনে একটু সন্দেহ হচ্ছে।
“না, ও আমাকে কিছু বলেনি। বরং আমিই ভাবছিলাম ওকে বলব। অবশ্য তোর যদি ওকে অপছন্দ হয় তাহলে কিছু বলব না।তবে ছেলেটাকে আমার ভালই লেগেছে।” শিলা কিছু বলল না। চুপ করে বাবার কথা শুনছে।
“ভেবে দেখ। ওর সাথে তোর বিয়ে হলে খারাপ হবে না কিন্তু। আমার থেকে বেশি দূরে থাকতে হবে না। পাশের বাসায় থাকবি। যখন ইচ্ছে হবে আমার কাছে চলে আসবি। ঝগড়া করে আর মন খারাপ করে থাকতে হবেনা। বাবার কাছে চলে আসবি।” এই বলে শওকত সাহেব জোরে জোরে হাসতে লাগল।
“মানে কি? আমি কি সারাদিন ওনার সাথে ঝগড়া করি? উনি মাঝে মাঝে উল্টাপাল্টা কথাবার্তা বলেন। তখন একটু কঠিন করে কথা বলে ফেলি।” শিলা লজ্জা পেয়ে গেল। শওকত সাহেবের চোখ এড়াল না।
“কিরে, কথা বলব ওর সাথে?” শওকত সাহেব জিজ্ঞেস করলেন।
“জানিনা, কাপটা দাও তো, তুমিও তো ওনার সাথে মিশে মিশে উল্টাপাল্টা কথা বলা শুরু করেছ।” বাবার কাছ থেকে দূরে সরে এসে হাঁপ ছেড়ে বাঁচল যেন।
শফিক সাহেব? রাতে শুয়ে শুয়ে চিন্তা করতে লাগল শিলা। মানুষটাকে যতটুকু দেখেছে, চিনেছে শিলার ভালই মনে হয়েছে। মাঝে মাঝে একটু উল্টাপাল্টা মনে হয় লোকটাকে কিন্তু এইটুকু না থাকলে জীবনটা কি পানসে মনে হত না? আচ্ছা মানুষটা পরে অন্যরকম হয়ে যাবে? শফিক সাহেব কে চমকে দিতে খুব ইচ্ছে করছে। শফিক সাহেবকে ফোন করে বলবে, “কি করছ? ঘুম আসছে না।তুমি কি আমার জন্য এক কাপ চা করে আনবে? চা না, কফি বানিয়ে আনবে? কিন্তু ব্ল্যাক কফি না, দুধ- চিনি মেশানো কড়া করে এক কাপ কফি। বানাতে পারোতো? না পারলে ইউটিউব দেখে শিখে বানিয়ে আন।”
শফিক অবাক হয়ে বলবে, “আমি তোমার জন্য রাত সাড়ে ১১ টার সময় ইউটিউব দেখে কফি বানিয়ে আনবে?” শফিক ও তাকে তুমি করে বলবে? আচ্ছা শিলা এসব কি ভাবছে? শফিককে নিয়ে ও এত চিন্তা করছে কেন? পাশ ফিরে শুয়ে বলল, “বুদ্ধু একটা।” বলে নিজেই অবাক হয়ে চিন্তা করতে লাগলো কথাটা কাকে উদ্দেশ্য করে বলল- শফিককে নাকি নিজেকে। Feeling very confused।
ভালোলাগার ঢেউ শুধু এই ফ্ল্যাটেই না, পাশের ফ্ল্যাটেও আছড়ে পড়েছিল। বাইরে থেকে আসার পর থেকে শফিকও আনমনে হয়ে ছিল। বাড়ি থেকে ফরিদা ফোন করেছিলেন। মায়ের কথাগুলো মাথায় ঢুকছিল না ঠিকমত। শুধু এটুকু বুজতে পেরেছিল এই সপ্তাহের শেষ দিকে ফরিদারা ঢাকায় আসবেন।
শফিক সুদীপ্তকে ফোন দিল। “ঘুমিয়ে পড়েছিস?”
“হ্যাঁ, ঘুমিয়ে পড়েছি। একটা ভয়ঙ্কর দুঃস্বপ্ন দেখছি। তুই আমাকে ফোন করেছিস।”
“শোন না, আমার মনে হয় তুই ঠিক কথাই বলেছিস।”
“আমি সব কথাই ঠিক বলি। স্পেসিফিক করে বল কোন কথা?”
“আমি মনে হয় শিলাকে পছন্দ করে ফেলেছি।”
“এখনও মনে হচ্ছে? শিউর হওয়ার জন্য আর কি কি করতে চাস তুই?”
“বাজে কথা বলিস না। কিন্তু ওর কাউকে পছন্দ আছে কিনা তাতো জানি না। মনে হয় নেই। যতক্ষণ একসাথে ছিলাম কারও সাথে তো কথা বলতে দেখলাম না। আচ্ছা তুই ইয়াসমিনকে কিভাবে প্রপোজ করেছিলি?”
“আমি ইয়াসমিনকে সরাসরি বিয়ের প্রস্তাব দিয়েছিলাম। তুই এই কাজ করবি না। করলে সোজা দুই নম্বরি বেতের বাড়ি ছাড়া কিছুই জুটবে না বলে রাখলাম।”
“কি করব এখন?”
“শিলা তো রবীন্দ্রসঙ্গীত পছন্দ করে, গান গেয়ে দেখতে পারিস। ঐ গানটা গাইতে পারিস-মাঝে মাঝে তব দেখা পাই চিরদিন কেন পাই না । তোরা তো দুইজনই অনেক ব্যস্ত, মাঝে মাঝেই তোদের দেখা হয়। এই গানটাই তোদের জন্য পারফেক্ট। কিংবা বৃষ্টির গানও গাইতে পারিস, তবে ভুলেও বাচ্চাদের Rain Rain go away গাবি না, তাহলে রাশি কিন্তু উল্টো দিকে ঘোরা শুরু করতে পারে।”
“তোকে ফোন করাটাই আমার ভুল হয়ে গেছে।” বিরক্ত হয়ে শফিক ফোন কেটে দিল।(চলবে)