অপেক্ষার প্রহর (পর্ব- ১৯)
ফরিদারা আজ সকালে ঢাকায় এসেছেন।চারজন এসেছেন-জামিলুর সাহেব, ফরিদা, হাসান আর শেফালী। ফরিদার বাসা খুব পছন্দ হয়েছে। ছেলেমানুষ তো তাই ঘর ঠিকমতো গুছানো নেই। শেফালীকে নিয়ে আস্তে আস্তে পুরো ঘর সাজালেন। এবার ছেলের বিয়ের কথা তুলতে হবে। কয়েকটা মেয়ের ছবি এনেছেন। এক ফাঁকে ছেলেকে দেখাবেন। ফরিদা আর দেরি করতে চাননা। তাড়াতাড়ি ছেলের বিয়ে দিবেন। শফিকের বাবাকেও বললেন একই কথা। জামিলুর সাহেব শুনে বললেন, “এই যুগের ছেলে, আগে ওরে জিজ্ঞেস কর ওর কোন পছন্দ আছে কিনা। যদি পছন্দ থাকে তুমিও মেয়েটারে দেখ। শিক্ষিত- নামাজী কিনা দেখ।”
“শহরের মেয়ের সাথে বিয়া দিমু না আমি। আমার ঐসব শহরের মেয়ে পছন্দ না।”
“গ্রামের মেয়ের উপরই ভরসা কর কেমনে? খুশিরে দেখলা না?আসলে এইসব ইন্টারনেট এর যুগে সবকিছু এখন মানুষের কাছে অনেক সহজ হইয়া গেছে।আর তোমার পছন্দের চাইতে শফিকের পছন্দটা বেশি জরুরি। সারাটাজীবন তো ওরেই সংসার করতে হইব।” কথাটা ফরিদার পছন্দ হলনা কিন্তু কিছু বললেন না জামিলুর সাহেবকে।
সন্ধ্যায় শফিক ফরিদা-জামিলুর সাহেবকে পাশের বাসায় নিয়ে যায়। শিলা ফরিদার প্রেশার মাপে-লো প্রেশার। শিলা শফিককে বলে পরের দিন ফরিদাকে হাসপাতালে নিয়ে যেতে। শফিক-শিলাকে একসাথে দেখে দুজনের প্রতি দুজনের ব্যবহার অন্যরকম মনে হল। পরদিন সকালে হাসপাতালে গেলে ডাক্তার বিভিন্ন পরীক্ষা দেয়। রক্তে হিমোগ্লোবিন কম। ডাক্তার ফরিদাকে হাসপাতালে ভর্তি হতে বলে। শফিক সুদীপ্তকে রক্তের জন্য ফোন দেয়। মোট দুই ব্যাগ রক্ত লাগবে। আরেকজন ডোনার লাগবে। ইয়াসমিন ওর পরিচিত দুইজনকে বলে- অতিরিক্ত একজন রেডি রাখতে হবে। এর মধ্যে হাসানও কোচিং-এ ভর্তি হয়। ফরিদা হাসপাতাল থেকে বাসায় চলে গেলেই জামিলুর সাহেব বাড়ি চলে যাবেন।
নির্দিষ্ট দিনে সুদীপ্ত চলে আসে হাসপাতালে ফরিদাকে রক্ত দেয়ার জন্য।
“মাসীমা ভাল আছেন তো, আমার কিডনিটা ভাল আছে তো মাসীমা?” ফরিদাকে প্রণাম করতে করতে বলল সুদীপ্ত।
“এইত আছি কোনমতে। ডাক্তার তো বলছে প্রেসার নাকি কম।” ফরিদা বললেন।
“ছেলের বিয়ে দিয়ে দিন মাসীমা। ছেলের বৌয়ের যন্ত্রণায় প্রেসার হাই হয়ে যাবে দেখবেন।” ফরিদা জোরে হেসে উঠলেন, “ভালই বলেছ বাবা। তা তুমি কেমন আছ বাবা? বৌ কেমন আছে?”
“আছে ভালই।”
একটু চুপ থেকে ফরিদা বললেন, “জানিনা আমার বলা ঠিক হচ্ছে কিনা তারপরও জানতে ইচ্ছে করছে বাবা কেন করলে এমন বিয়ে।”
“বলব মাসীমা, আপনাকেই একমাত্র বলব। কারন আপনাকে আমি অনেক পছন্দ করি। আপনি আমার দেখা পৃথিবীর সেরা তিনজন মহিলার মধ্যে দ্বিতীয়।”
“প্রথম কে আর তৃতীয় কে?”
“প্রথম আমার মা আর তৃতীয় আমার স্ত্রী।” একটু চুপ থেকে বলল, “মাসীমা ইয়াসমিন এমন একটা মেয়ে যাকে দেখে যে কেউ পছন্দ করবে। আমিও তার ব্যতিক্রম ছিলাম না। আমি ওকে প্রথম দেখে পছন্দ করে ফেলি। কিন্তু ওকে বিয়ে করার চাইতে ঐ অন্ধকার পরিবেশ থেকে ওকে রক্ষা ইচ্ছেটা প্রবল হয়ে যায়। দুই রাত চোখের পাতা এক করতে পারিনি। ভেবে পাচ্ছিলাম না কি উপায়ে ওকে ঐখান থেকে সরিয়ে আনব। যে মেয়ের কোন পরিবার নেই একা একা তার এই পৃথিবীতে টিকে থাকাটা অনেক কষ্টকর। তার উপর মেয়েটা যদি অনেক সুন্দরী হয় তাহলে তো আরও বেশি কঠিন হয়ে পড়ে তার টিকে থাকা। বুজতে পারছিলাম ওর একজন অভিভাবক প্রয়োজন। কিন্তু কার উপর বিশ্বাস করব ঠিক করতে পারছিলাম না। তখনি ওকে বিয়ের সিদ্ধান্ত নেই। সত্যি বলতে ও যদি আমাদের মত পরিবারের মেয়ে হত আমি কখনই ওকে বিয়ে করার জিদ করতাম না।” একটু চুপ থেকে আবার বলল, “একটা ব্যপার জানেন মাসীমা, আমাদের বিয়েটা সবার কাছে এত সমস্যা হলেও আমাদের দুইজনের কাছে তা সমস্যা মনে হয়নি। ইয়াসমিন ওর মত করে ধর্ম পালন করছে আর আমি আমার মত করে ধর্ম পালন করছে।”
“সবই তো বুজলাম বাবা, কিন্তু যে আসছে তাকে কোন ধর্মে দীক্ষিত করবে ঠিক করেছ?”
“না মাসীমা তা ঠিক করতে পারিনি, তবে যে ধর্মই পালন করুক না কেন তাকে মানবধর্ম পালন করতে হবে তা জানি।” ফরিদা কিছু বললেন না।
“মাসীমা আমি ইয়াসমিনকে নিয়ে এসেছি। আপনি যদি অনুমতি দেন তা হলে ওকে ভিতরে নিয়ে আসতাম।”
“তুমি ওকে বাইরে দাঁড় করিয়ে রেখে এখানে বসে গল্প করছ? যাও ওকে নিয়ে আস, আবার অনুমতির জন্য অপেক্ষা করছ?” সুদীপ্ত ইয়াসমিনকে নিয়ে আসে। ইয়াসমিন ফরিদার পা ধরে সালাম করে।
“আয় মা, এদিকে আয়।” ফরিদা ইয়াসমিনকে জড়িয়ে ধরলেন। ইয়াসমিনকে দেখে উনি মুগ্ধ। কি সুন্দর দেখতে মেয়েটা আর তার ছেলেটা একটা কালো মেয়েকে পছন্দ করল।
“ও আপনার কথা বলে, আপনাকে খুব পছন্দ করে। ওর একবার আপনাদের বাসায় যেতে যেতে রাত তিনটা বেজে গিয়েছিল। আপনি রাত তিনটা পর্যন্ত ওর জন্য না খেয়ে অপেক্ষা করেছিলেন।” ইয়াসমিন বলল।
“আর তোর স্বামীটি আমার জন্য কি করেছে তা বলেনি?” ইয়াসমিন মাথা নিচু করে হ্যাঁ সুচক মাথা নাড়ল।
“এই বেকুব, ব্যাগটা এদিকে আন।” ফরিদা সুদীপ্তকে বললেন। সুদীপ্ত ব্যাগ নিয়ে আসলে ফরিদা ব্যাগ থেকে সোনার চেইন বের করে ইয়াসমিনকে পড়িয়ে দিলেন।
“মাসীমা, আপনি হাসপাতালে সোনা নিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছেন। আপনার তো অনেক সাহস।” সুদীপ্ত বলল।
“হু, কারন আমি জানতাম আমার ছেলে তার বৌ নিয়ে আসবে।” সুদীপ্ত কি বলবে বুজতে পারছিল না। ইয়াসমিনের দিকে তাকিয়ে বলল, “তুমি মাসীমার কাছে বস, আমার বাইরে একটা কাজ আছে। আমি ঘণ্টাখানেকের মধ্যে আসছি।”
ইয়াসমিন বলল, “তাড়াতাড়ি এসো।”সুদীপ্ত অবাক হয়ে গেল। ইয়াসমিন তো কখনও এভাবে বলে না। ওর কি খারাপ লাগছে? দেরি না করে বের হয়ে গেল।
হাসপাতাল থেকে বের হওয়ার আগে মনে হল শিলার সাথে কথা বলা দরকার। শিলাকে ওর রুম থেকে ডেকে নিল।
“শিলা আমি জানি জায়গাটা এ ধরনের কথা বলার জন্য উপযুক্ত জায়গা না, কিন্তু তারপরও কোন ভুমিকা না করে বলছি। আসলে শফিক আপনাকে পছন্দ করে।” শিলা লজ্জা পেয়ে গেল কি বলবে বুজতে পারছিল না।
“আপনি অপ্রুস্তুত হবেন না প্লিজ। জানি এই জায়গাটা এ ধরনের কথা বলার মত না, তবু আপনার কাছ থেকে কনফার্মেশান পেলে আমি মাসীমার সাথে কথা বলতাম।”
একটু চুপ থেকে শিলা বলল, “দেখুন আমার পছন্দটাই তো বড় কথা না, বাবা যেহেতু আছে বাবার সাথেই এই ব্যাপারে কথা বলাটাই ভাল।”
“মাসীমা আঙ্কেল এর সাথে কথা বলবেন তবে তার জন্য আপনার রাজি থাকাটা বেশি প্রয়োজন।”
“আপনার বাবার সাথে কথা বলতে পারেন” শিলা সলজ্জ জবাব দিল।
“আমার বন্ধু বলে বলছি না, শফিক আপনাকে ঠকাবে না।”
“আপনার এটা কেন মনে হচ্ছে যে আমি আপনার বন্ধুকে ঠকাব?”
“”না না আমার বলার উদ্দেশ্য তা ছিল না, বন্ধুর পক্ষ হতে কথা দিলাম এই আর কি।”
“আমি ও আপনাকে কথা দিচ্ছি আপনি না আসা পর্যন্ত আমি ইয়াসমিনের খেয়াল রাখব।” শিলা হেসে জবাব দিল।
হাসপাতাল থেকে বের হয়ে শফিককে ফোন দিল। “কিরে অফিসে নাকি?”
“হু, দুইদিন অফিস থেকে ছুটি নিয়েছিলাম, অনেক কাজ জমে গেছে। তুই হাসপাতালে পৌঁছে গেছিস?”
“হু, ইয়াসমিন আমার সাথে এসেছে। ওকে মাসীমার কাছে রেখে আমি একটু বের হলাম। ঘণ্টাখানেকের মধ্যে চলে আসব। শিলার সাথে কথা বলে আসলাম।”
“কি কথা?”
“বলব আর কি? মেয়ের মুখ দেখলাম ঘন কাল অন্ধকার। একবার বিয়ের কথা বলতেই রাজি হয়ে গেল। শিলা যে ধরণের মেয়ে তাতে তো এক কথায় রাজি হবার কথা না। নিশ্চয়ই তুই কোন অঘটন ঘটিয়েছিস। নইলে তো এমন হবার কথা না।”
“কি বললি? ও রাজি?”
“হ্যাঁ, তবে খুশি হয়ে রাজি না। কিসব করে বেড়াস চিন্তা করতেই ভয় করে।”
শফিকের সাথে কথা বলে সুদীপ্ত রাস্তার ধারে আসে রিক্সা নেয়ার জন্য। হঠাৎ একটা মাইক্রোবাস এসে সামনে দাঁড়ায়। দুইজন লোক এসে সুদীপ্তর দুইদিক দিয়ে ধরে গাড়িতে ওঠায়।সুদীপ্ত কিছু বুঝে ওঠার আগে সুদীপ্তর চোখ, মুখ, হাত কাপড় দিয়ে বেঁধে ফেলে।
একটা জায়গায় এসে গাড়িটা থামায়। সুদীপ্তকে গাড়ি থেকে নামিয়ে চোখের বাঁধন খুলে।
“কিরে চিনতে পারছস?” ।হঠাৎ চোখ খোলায় সুদীপ্তর তাকাতে কষ্ট হচ্ছিল। আলোটা চোখে সয়ে গেলে সামনে দেখতে পেল জামালকে।
“অনেক কষ্ট হইছে তোরে খুইজা পাইতে। আব্বায় তোর লাইগা আমারে দুই মাস ঘরের মধ্যে আটকাইয়া রাখছে। হালার পুত আইজকাই তোর শেষ দিন” বলে সুদীপ্তকে একটা লাথি মারে।
“তোরে মাইরা তোর বৌয়ের লোগে আমরা বাসর করুম।” হিংস্রভাবে হেসে উঠল সবাই। ছয়জন ছিল অপহরণকারীরা। “ঐ হাবিব্বা, চল ওর বৌরে তুইলা লইয়া আই।”
“সরকারী হাসপাতাল থেইকা ঐ মাইয়ারে তুইলা আনন যাইব না। তাছাড়া মাইয়া পোয়াতি। ওরে তুইলা আনা অনেক কষ্ট হইব। কথা আছিল পোলারে তুইলা আইনা মাইরা ফেলনের, কোন মাইরা তুইলা আননের না।” চারপাশে তাকিয়ে হাবিব বলল, “আর সময় নষ্ট করন যাইব না, দেরী করলে মানুষজন চইলা আইব। তাড়াতাড়ি কাম সারতে হইব।” ছয়জন মানুষ মিলে সুদীপ্তকে হকিস্টিক দিয়ে এলোপাথাড়ি মারতে থাকে। যখন মনে হয় সুদীপ্ত মারা গেছে তখন স্টিক ফেলে গাড়িতে করে পালিয়ে যায়।
না, সুদীপ্ত তখনও মারা যায়নি। আরও কিছুক্ষণের জন্য বেঁচে ছিল সুদীপ্ত। মৃত্যুর আগপর্যন্ত সম্পূর্ণ সুস্থ মস্তিষ্কে ছিল সুদীপ্ত। আকাশের দিকে চেয়ে দেখল সূর্যটা হেলে পড়ছে পশ্চিমে। নিজের মনে বলতে লাগল, “ঠাকুর কোন দিন তোমার কাছে তেমন কিছু চাইনি। আজ চাইছি। পরের জন্ম বলে কিছু আছে কিনা জানি না ঠাকুর, যদি থাকে এই পরিবারটাকে আমায় দিবে তো জনম জনম? ইয়াসমিনকে আমার বৌ করে পাঠিয়ো। অনেক স্বপ্ন ছিল ওকে নিয়ে। ও অনেক বড় মানুষ হয়ে উঠবে, আমি দেখব। ওকে নিয়ে হেঁটে হেঁটে পুরো পৃথিবী দেখব। আমার ইচ্ছেটা পূরণ হল না ঠাকুর। আমার অপূর্ণ ইচ্ছেগুলোকে পূর্ণ করার জন্য কোন বিশ্বস্ত হাত দিবে ওর হাতে? ওকে দেখ ঠাকুর, যে অন্ধকার থেকে মেয়েটা ফিরে এসেছে সেই অন্ধকার পরিবেশে ওকে যাতে আর ফিরে যেতে না হয়। আমার পুটুটাকে দেখার বড্ড ইচ্ছে ছিল, ওকে ভাল রেখ ঠাকুর। ও যাতে আমার মত স্বল্পআয়ু নিয়ে না আসে ঠাকুর। ও যাতে অনেক বড় হয়, পিতা হারানোর কষ্ট ছাড়া অন্য কোন কষ্ট যাতে ওকে না স্পর্শ করে ঠাকুর। সবাইকে ভাল রেখ ঠাকুর।”
নিহত বা খুনি ব্যাক্তিরা কেউই টের পেল না অদূরেই একটা ঝোপের আড়ালে জয়া নামের একটি মেয়ে পুরো হত্যাকাণ্ডটি ভিডিও করেছে।(চলবে)