অপেক্ষার প্রহর পর্ব-২১ শেষ পর্ব

0
1730

অপেক্ষার প্রহর (শেষ পর্ব)
সুদীপ্তর মড়া পোড়ান হবে। চিতা সাজান হচ্ছে। ইয়াসমিনের শরীর খারাপ থাকায় ইয়াসমিনকে একটা চেয়ার দেয়া হয়েছে বসার জন্য। চিতা সাজানোর সময় অপর্ণা এসে শফিককে বলল, “শফিক ভাই, বৌমনির এখন কি হবে? একা বাসায় থাকাটা কি ঠিক হবে?”
“সুদীপ্ত সেদিন বলল ওরা নাকি তোমাদের বাসায় যাবে। কিন্তু এখন যা অবস্থা তাতে মনে হচ্ছে কয়েকদিন পর ঐ বাসায় গেলে ভাল। আপাতত ও আমাদের বাসায় থাকুক। মা চলে আসবে বাসায় দুই একদিনের মধ্যে। মা থাকবে, পাশের বাসায় ডাক্তার আছে, সমস্যা হবে না মনে হয়।” শফিক বলল।
“সেই ভাল। আপাতত আপনাদের বাসায় থাকুক। মা একটু স্থিতি হোক, তারপর না হয় আমাদের বাসায় আনা যাবে।” একটু চুপ থেকে অপর্ণা বলল, “বৌমনির প্রফেসর ফোন করেছিলেন। বৌমনির লেখাটা ওনার খুব পছন্দ হয়েছে। লেখাটা অনেক বেশি তথ্যবহুল। ওনার এক বন্ধু আছে বাংলা একাডেমীতে। প্রফেসর চেষ্টা করছেন যাতে বাংলা একাডেমী এটাকে বই আকারে প্রকাশ করে। উনি খুব তাড়াতাড়ি একটা গবেষণা শুরু করবেন। প্রফেসর চাচ্ছেন বৌমনি ওনার সাথে কাজ করুক। বৌমনিকে এজন্য সেলারিও দিবেন বলেছেন। দাদাভাইয়ের কথা শুনে কি বলল জানেন, বললেন ওনার একটা মেয়ে ছিল অবিকল বৌমনির মত দেখতে। ওনার এক মেয়েকে উনি হারিয়েছেন, আরেক মেয়েকে উনি হারিয়ে যেতে দিবেন না।”
একটু চুপ থেকে অপর্ণা আবার বলল, “দাদাভাই আমার বিয়ের কথা ঠিক করে গেছে। ছোড়দার জীবনটা পাল্টে দিল। বৌমনির ভাগ্যটাও পাল্টে গেল। দাদাভাই আমাদের সবার জীবনটা সেট করে দিয়ে গেছে।”
“পৃথিবীতে কিছু কিছু মানুষের জন্ম হয় অন্যের জীবনটাকে সেট করে দেয়ার জন্য।” শফিক বলল। শফিকের পছন্দের কথাটাও তো সুদীপ্তই তুলেছে শিলার কাছে।
সুদীপ্তকে পোড়ানোর সময় অঞ্জনা হাহাকার করে উঠল। আত্মীয়-স্বজনরা এসে ধরলও। ইয়াসমিন ডুকরে কেঁদে উঠল। অপর্ণা শক্ত করে ইয়াসমিনকে ধরে রইল। পোড়ান শেষে পুলিশের লোক এসে সুদীপ্তর কাপড়চোপড়- পড়নের জিনিষগুলো তুলে দিল ইয়াসমিনের হাতে। ঘড়ি, মানিব্যাগ, রুমাল- রুমালে লেখা “ভুলো না আমায়”।
অঞ্জনা অসুস্থ হয়ে পড়েছিলেন। কৌশিক মাকে নিয়ে চলে গেল। বিনয়বাবু ইয়াসমিনের কাছে এসে বললেন, “অঞ্জুর কথায় কিছু মনে করো না মা। ছেলেকে হারিয়েছে তো, তাই বেচারার মাথা ঠিক নেই। দেখবে দুদিন পর সব ঠিক হয়ে যাবে।”
“সন্তানের জন্ম দিইনি এখনও, কিন্তু আমিও তো মা হতে চলেছি বাবা। মায়ের কষ্টটা আমি বুঝি। মায়ের কথায় আমি কিছু মনে করিনি।”
“আমাদের সাথে বাসায় চল মা।”
“সুদীপ্তর সাথে আমি তিন বছর একসাথে ছিলাম বাবা। ওর আদর্শ, জীবনবোধ কিছুটা হলেও ধারন করেছি নিজের মধ্যে। দেখি তাই দিয়ে কিছু করতে পারি কিনা। না পারলে অবশ্যই যাব বাবা। আপনারা ছাড়া আমার আর কে আছে বলুন? আর সুদীপ্তর সন্তানকে আপনাদের কাছ থেকে আলাদা করব কোন অধিকারে?”
বিনয়বাবু ইয়াসমিনের মাথায় হাত দিয়ে বলল, “জানিনা কিসের জোরে কথাগুলো বলছ মা। তবু ভাবতে ইচ্ছে করছে তুমি সফল হবে। শুধু এই বাচ্চাটার জন্য না, তুমি আমার কাছে ঠিক ততটাই গুরুত্বপূর্ণ যতটা খোকা আর অপর্ণা গুরুত্বপূর্ণ। যে কোন প্রয়োজনে এই অধম বাবাটাকে মনে করো মা।”
ইয়াসমিন মাথা নিচু করে বলল, “অবশ্যই বাবা।”
সবাই চলে গেল। শুধু ইয়াসমিন আর শফিক রয়েছে। শফিক ইয়াসমিনের কাছে গিয়ে বলল, “ইয়াসমিন, এই অবস্থায় তোমার একা থাকাটা ঠিক হবে না। তুমি আমার সাথে আমাদের বাসায় চল। মা আছেন, শিলা আছে, তোমার অযত্ন হবে না। সুদীপ্তর বাবাকে তুমি ফিরিয়ে দিয়েছ, আশা করি আমায় তুমি ফেরাবে না।”
“কিন্তু” ইয়াসমিন আমতা আমতা করতে লাগলো।
“ভাইজান বলে ডেকেছ, ভাইয়ের বাসায় থাকতে সমস্যা?” ইয়াসমিন কাঁদতে লাগলো। এই ভালবাসাগুলো ইয়াসমিনের নিজের অর্জিত না, সুদীপ্তর অর্জন এসব। এত মানুষ যে মানুষটাকে ভালবাসত সেই মানুষটা ইয়াসমিনকে ভালবেসেছে। ইয়াসমিনের চাইতে বড় ভাগ্যবতী আর কে আছে?
জামিলুর সাহেব বাড়ি গেছেন। জসিম ক্যাশ-বাক্স ভেঙ্গে সব টাকা-পয়সা আর দোকানের দামি দামি জিনিষগুলো নিয়ে পালিয়েছে। হাসান মায়ের কাছে আছে। শিলাকে ফোন দিয়ে যাচ্ছে শফিক। ফোন বন্ধ।
বাইরে এসে গাড়ি ঠিক করছিল শফিক। এমন সময় মনিরকে দেখতে পেল শফিক।“কি ব্যপার মনির কই যাচ্ছিস?”
“ভাইজান মার খুব অসুখ। পাশের বাড়ির খালায় ফোন দিছে। কি অসুখ, কিচ্ছু কয়নাই। খালি কইছে তাড়াতাড়ি যাইতে।” মনিরের যে অবস্থা তাতে তো একলা যেতে পারবে বলে মনে হয়না।শফিক ঠিক করল সে সাথে যাবে। ইয়াসমিনকে একটা গাড়িতে উঠিয়ে দিতে হবে।
“ইয়াসমিন তুমি একটু দাঁড়াও। আমি আসছি।” বলে পাশের একটা দোকান থেকে কাগজ, কলম আর খাম কিনল। একটা চিঠি লিখল শিলাকে। তারপর চিঠি হাতে ইয়াসমিনকে একটা সিএনজিতে তুলে দিল।
“তুমি বাসা চিনবে তো?” ইয়াসমিন মাথা নেড়ে হ্যাঁ বলল। “পাশের বাসায় চাবি রাখা আছে। মামা একটু সাবধানে যাবেন।”
“অবশ্যই সাবধানে যামু। আপনি চিন্তা কইরেন না মামা।” সিএনজির ড্রাইভার বলল।
পাশের বাসায় চাবির খোঁজ নিতে গিয়ে ইয়াসমিন জানতে পারল শিলার বাবা মারা গেছে। শওকত সাহেবকে কবর দেয়া হয়ে গেছে। শওকত সাহেবকে বিদায় দেয়ার পরই শিলা চাবি নিয়ে শফিকদের বাসায় চলে আসে। “তুই এই সময়ে অন্যের বাসায় গিয়ে থাকবি?” মিলা বলল।
শিলা একটু চুপ থেকে বলল, “আপা, তোকে একটা কথা বলা হয়নি, বাবা ঠিক করেছে শফিকের সাথে আমার বিয়ে হোক।”
“তা ঠিক আছে। কিন্তু তুই বিয়ের আগেই ঐ বাসায় গিয়ে থাকবি?”
“ভাল লাগছে না আপা। এত মানুষজনের ভিতর থাকতে ইচ্ছে করছে না। আমাকে একটু একা থাকতে দে।” মিলা বিরক্ত হল।
শিলা দরজা খুলে ইয়াসমিনকে দেখতে পেল। কিছু বলল না। ইয়াসমিন ভিতরে ঢুকার পর দরজা বন্ধ করে দিল। দুজনে পাশাপাশি বসে ছিল। হাত ধরে। একজন স্বামীহীনা নারী আর আরেকজন পিতা হারানো নারী- দুজন দুজনকে কি ভাষায় সান্ত্বনা দিবে বুজতে পারছিল না। তাই স্পর্শটুকু বড় সান্ত্বনা হয়ে রইল।
ইয়াসমিন ফ্রেশ হয়ে খাওয়া- দাওয়া করে নিল।অনেক চেষ্টা করেও শিলাকে কিছু খাওয়াতে পারল না। ইয়াসমিন বিছানায় একটু গড়িয়ে নিল। রাতে নামাজের পর সূরা ইয়াসিন পড়ল। রাতে অনেক বলার পর শিলা একটু খেল। ইয়াসমিনের খুব ক্লান্ত লাগছিল। বিছানায় যাওয়ার সাথে সাথে ঘুমিয়ে পড়ল।
শিলা লাইট অফ করে বসে আছে। বেশি আলো সহ্য হচ্ছে না। চার্জার লাইট জ্বালাল। শফিকের চিঠিটা দিনের বেলা পড়া হয়নি। চিঠিটা পড়তে বসল, “শিলা, কেমন আছ? অনেকবার তোমার মোবাইলে ট্রাই করেছি। কিন্তু বন্ধ পেয়েছি। মায়ের অবস্থা কি? ইয়াসমিনকে পাঠালাম। আমি ঠিক করেছি ইয়াসমিন আর ওর সন্তানকে আমি কোন বিপদে পড়তে দিব না। সুদীপ্তর সন্তান আমাদের মত সুযোগ- সুবিধা পেয়ে বড় হবে, কোন পথশিশুর মত ওর জীবনটা যাতে না হয়। অবশ্য আমি কিছু না করলেও ইয়াসমিন ঠিক সামলে উঠতে পারবে বলে আমার মনে হয়। তবুও আমি তো আমার মাতৃঋণ শোধ করার সুযোগ পেলাম। আমি জানি তুমি না করবে না, তারপর ও আমার ঘরের যে কর্ত্রী হবে তার অনুমতি নেয়াটা প্রয়োজন। কি আপত্তি করবে? ঢাকা ফিরে তোমার বাবার সাথে কথা বলতে বলব বাবা- মাকে। তোমার বাবা আপত্তি করবেন নাতো আমাদের ব্যাপারে? বলবেন নাতো, ছেলেটা তো আচ্ছা! চালডাল, আলু- পটল চাইতে চাইতে ছেলেটা আমার মেয়েটাকে চেয়ে ফেলল? হা হা হা। তোমাকে খুব দেখতে ইচ্ছে করছে। ভাল থেকো। অপেক্ষায় থেকো।”
চিঠি শেষ করে খামটা বন্ধ করল শিলা। ইয়াসমিন ঘুমুচ্ছে।ইয়াসমিনের দায়িত্ব শুধু শফিকের একার নয়, শিলার নিজেরও। সে যে সুদীপ্তকে কথা দিয়েছিল সুদীপ্ত না আসা পর্যন্ত সে ইয়াসমিনের খেয়াল রাখবে। ইয়াসমিনের গর্ভে থাকা সুদীপ্ত- ইয়াসমিনের সন্তান অপেক্ষা করছে এই পৃথিবীতে আসার। শিলা দীর্ঘশ্বাস ফেলল। শওকত সাহেব এতদিন অপেক্ষা করত শিলার জন্য। আজ শিলা অপেক্ষা করছে শফিকের জন্য। শফিক অপেক্ষা করছে এই পৃথিবীর সমস্ত শিশু একদিন সুস্থ-স্বাভাবিকভাবে জীবন কাটাবে। যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশগুলো অপেক্ষা করছে স্থায়ী যুদ্ধ বিরতির। এই অপেক্ষার প্রহর কবে শেষ হবে? এরপর কি কোন অপেক্ষার প্রহর আছে? মহাকাল কি অপেক্ষা করে আছে সেই প্রহরের?
বাইরে বৃষ্টি পড়ছে। শিলা জানালার কাছে গিয়ে দাঁড়াল। শিলার চোখ দিয়ে পানি পড়ছে। শিলা অশ্রুটুকু মোছার চেষ্টা করল। শিলা গান গেয়ে উঠল, “বরিষও ধারা মাঝে শান্তিরও বারি”।
গান শুনে ইয়াসমিনের ঘুম ভেঙ্গে যায়। খুব ভাল গান গায় শিলা। ইয়াসমিনের চোখেও পানি চলে এসেছে। অশ্রুটুকু শুষে নেবার মানুষটা চিরকালের জন্য হারিয়ে গেছে। ইয়াসমিন সন্তর্পণে অশ্রুটুকু মুছে নিল।
(সমাপ্ত)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here