“সেদিন প্রথমবারের মতো ইভান ঈশার গায়ে হাত তুলেছিল। না চাইতেও অনেক বেশী কষ্ট দিয়ে ফেলেছিল ভালোবাসার মানুষটাকে। ইভান সেদিন এতোটাই রেগে গিয়েছিল যে নিজের হিতাহিত জ্ঞান হারিয়ে ফেলেছিল। হাতের সমস্ত শক্তি দিয়ে ঈশার হাত চেপে ধরে সিঁড়ি বেয়ে টেনে নিয়ে উঠছিল। প্রথমবার ইভানের রাগের কাছে ঈশার শারীরিক যন্ত্রণাটা তুচ্ছ হয়ে দাঁড়িয়েছিল। ঈশা এতোটাই ব্যথা পেয়েছিল যে চোখ বেয়ে পানি পড়ছিল। কিন্তু ইভানের সেদিকে কোন খেয়াল ছিল না। ভেতরে এনেই সোফায় ছুড়ে ফেলেছিল ঈশাকে। সেখানে পড়ে গিয়েই আরেক দফা ব্যথা পায় ঈশা। আবারো চোখ থেকে গড়িয়ে পড়েছিলো পানি। ইভানের এমন আচরণে সেদিন বাড়ির সবাই অবাক হয়েছিলো। ইভান কে অন্তত ঈশার উপরে এতোটা রাগ করতে দেখেনি কেউ। সেদিন ঠিক কি হয়েছিলো যে ইভান এমন আচরন করেছিলো। ইভানের এমন উগ্র আচরন দেখেই ইভানের বাবা সেদিন এগিয়ে এসেছিলেন ছেলেকে তার আচরন সম্পর্কে বুঝিয়ে দিতে। তার ভুলটা ধরিয়ে দিতেই কিছুটা উচ্চ স্বরে বলেছিলেন
–ইভান….
কিন্তু বাবার কথাটা ছেলে সেদিন কানেই তোলে নি। উল্টা থামিয়ে দিয়েছিলো সেখানেই। হাত উঁচিয়ে বাবাকে থামিয়ে দিয়ে বলেছিল
–আজ না বাবা। আজ আমি কারো কথা শুনব না। কোন ভদ্র পরিবারের মেয়েরা রাত ১০ টা পর্যন্ত বাইরে থাকে না। এটা তোমাদের কাছে স্বাভাবিক ব্যাপার হলেও আমার কাছে না। আমি কোনভাবেই মেনে নেবো না।
ছেলের রাগ সামলাতে তখন ইভানের মা এগিয়ে এসেছিলেন। ছেলের হাত ধরে বলেছিলেন
–আজ ওর বন্ধুর জন্মদিন ছিল। ছোট পার্টির আয়োজন করেছিলো। তাই গিয়েছে। আর সবাইকে বলেই গিয়েছিল।
–সবাইকে? আমাকে বলেছে? আমি তো কিছুই জানি না।
ইভানের কথা সেদিন ঈশার কানে বিষের মতো লাগছিল। বন্ধুদের সামনে থেকে ওভাবে টেনে নিয়ে আসাতে তার অপমান হয়েছিলো। তার উপর আবার প্রথমবার ইভানের দেয়া ব্যাথা অসহ্য হয়ে উঠেছিল। শারীরিক কষ্টের চেয়ে মানসিক ভাবে বেশী ভেঙ্গে পড়েছিলো ঈশা। এমন আচরণের সম্মুখীন আগে কখনো না হওয়ায় মেনে নিতে পারেনি সে। নিজের ক্ষোভটা প্রকাশ করতে গিয়েই বলে ফেলেছিল এমন কিছু অনাকাঙ্ক্ষিত কথা যা হয়তো সেদিন তার বলা উচিৎ হয়নি। ঈশা কাঁদতে কাঁদতে বলেছিল
–আমাকে কি এখন প্রতি জন কে আলাদা করে বলতে হবে? আমি কি মানুষ না? আমার স্বাধীনতা নেই? সবকিছুর কৈফিয়ত আমাকেই কেন দিতে হবে?
ঈশার এমন ভাবে কথা বলাটা ইভানের পছন্দ হয়নি সেদিন। রাগের মাথায় করে ফেলেছিল একটা ভুল। এগিয়ে গিয়ে ঈশার সামনে দাঁড়িয়েছিল। শীতল কণ্ঠে বলেছিল
–যদি বলি দিতে বাধ্য। তারপর আর কি বলবি শুনি?
ঈশা আরও রেগে গিয়েছিল। ইভান তার সাথে এভাবে কেন কথা বলবে সেটাই ছিল তার জেদ। চিৎকার করে বলেছিল
–আমাকেই কেন? আমাকে কেউ বাধ্য করতে পারেনি। আর কখনো করতে পারবেও না। যদি চেষ্টা করে তাহলে কিন্তু আমি খারাপ কিছু করে ফেলবো।
ঈশার কথাটা বলতে দেরি হয়েছিলো কিন্তু থাপ্পড়টা তার গালে পড়তে দেরি হয়নি। খানিক সময়ের জন্য সবকিছু স্তব্ধ হয়ে গিয়েছিল। ইভানের একের পর এক আঘাতে ঈশা দিশেহারা হয়ে পড়েছিলো। নতুন করে সেদিন ইভান কে চিনেছিলো সে। ইভানের এমন আচরণের সাথে সে পরিচিত ছিল না। তাই মেনে নিতে পারেনি। ইভান প্রথমবার ঈশার গায়ে হাত তুলেই থমকে গিয়েছিল। ব্যাথাতুর দৃষ্টি ফেলে তাকিয়ে ছিল ঈশার দিকে। রাগের মাথায় বড় ভুল করে ফেলেছিল সেটা বুঝতে পারলেও অনেক দেরি হয়েছিলো। যার মাশুল দিতে হয়েছিলো তাকে। ইভানের মা ছেলের এমন আচরণে ক্ষুব্ধ হয়ে এগিয়ে এসে ছেলেকে টেনে ধরে গালে থাপ্পড় দিয়েছিলেন। আর বলেছিলেন
–তুই এতো নিকৃষ্ট কি করে হলি? আমার ছেলে এমন কাজ করতে পারে ভাবতেই আমার খারাপ লাগছে? শেষ পর্যন্ত তুই ঈশাকে মারলি? আমি এটা মেনে নিতেই পারছিনা।
একের পর এক ঝাঁঝালো কথা আসছিল সবার কাছ থেকে। ইভানের আচরন কাররই ভালো লাগেনি। কিন্তু সবাই জানত ইভান কারণ ছাড়া কোন কাজ করে না। হয়তো সেদিনও করে নি। কিন্তু এভাবে ঈশার গায়ে হাত তোলার ব্যাপারটা কেউ ভালভাবে নেয়নি। ইভান নিজেও বুঝেছিল সে ভুল করে ফেলেছে। তাই মাথা নিচু করে সবটা সহ্য করে নিয়েছিলো। কোন প্রতিউত্তর করেনি। কিন্তু সবার কথার প্রশ্রয়ে এবার ঈশা করে ফেলেছিল বড় ভুল। চেচিয়ে উঠে বলেছিল
–আমার এই বাড়িতে কোন দাম নেই। আমার কোন স্বাধীনতা নেই। আমি নিজের ইচ্ছাতে খেতে পারি না। কারো সাথে কথা বলতে পারি না। নিজের মতো কোথাও যেতে পারি না। সবকিছুতেই কৈফিয়ত! এতো কৈফিয়ত ইরাকে তো দিতে হয়না? তাহলে কি ধরে নেবো ইরা কোন ভুল করেই না। সব ভুল আমি করি। এমন ভুলের জীবন আমার দরকার নেই। এমন ভুলে ভরা জীবনের থেকে আমি মরে যাওয়া শ্রেয় মনে করবো। আমি সত্যিই এমন বাধাধরা নিয়মের মধ্যে হাপিয়ে উঠেছি। আর পারছি না। খুব তাড়াতাড়ি এই জীবনের সমাপ্তি হতে চলেছে। তোমরা দেখে নিও।
ঈশার তিক্ত কথাগুলো ইভান হজম করে ফেললেও শেষের কথাগুলো হয়তো হজম করতে পারেনি। কষ্ট পেয়েছিল খুব। কোন কথা না বলে শান্ত চোখে ঈশার দিকে তাকিয়েছিল কয়েক সেকেন্ড। এই কয়েক সেকেন্ডেই তার চোখে পানি টলমল করছিলো। খুব স্বাভাবিক ছিল এমন হওয়াটা। যাকে নিজের জীবনের থেকেও ভালবাসে তার জীবনের কষ্টের কারণ সে নিজেই। সেটা কি মেনে নেয়া যায়? বুকের ভেতর ঝড় উঠেছিল তার। সেটা পুরোটা চেপে গিয়ে সেখান থেকে চলে গিয়েছিল নিজের ঘরে। ঘরের দরজা বন্ধ করে নিজের রাগ কমাতে সব ভেঙ্গে ফেলেছিল। কিন্তু কেউ কিছুই বলেনি। ঈশাও নিজেকে তার ঘরে বন্ধ করে রেখেছিল। প্রায় ঘণ্টা দুয়েক পরে ইরা এসে ঈশার ঘরের দরজায় কড়া নেড়েছিল ব্যস্তভাবে। প্রথমে খুলবে না ঠিক করলেও ইরার আহাজারির কাছে হার মেনে খুলতে রাজি হয়। দরজা খুলতেই ইরা দৌড়ে ঘরের ভেতরে ঢুকে ব্যস্তভাবে ফার্স্ট এইড বক্সটা নিয়ে যাচ্ছিল। কৌতূহল বশত ঈশা জিজ্ঞেস করেছিলো
–ওটা কোথায় নিয়ে যাচ্ছিস? কার কি হয়েছে?
ইরা তার দিকে না তাকিয়েই উত্তর দিয়েছিলো
–ভাইয়ার হাত কেটে গেছে।
কথাটা ঈশার কানে যেতেই সে আঁতকে উঠেছিল ঠিকই কিন্তু সেটা সম্পূর্ণরূপে চেপে গিয়ে নিজের জেদটাকে প্রাধান্য দিয়ে ছোট্ট করে কঠিন ভাবে বলেছিল ‘ওহ’। ঈশার অমন কণ্ঠস্বর ইরার কেমন যেন ঠেকেছিল। বোনের মনের অবস্থা বুঝতেই তাকিয়েছিল কয়েক মুহূর্ত। অসহায়ের মতো বলেছিল
–অনেক বড় কেটেছে। অনেক রক্ত পড়ছে আপু।
ঈশা সেদিন শুনেও কোন প্রতিক্রিয়া দেখায় নি। কঠিন গলায় বলেছিল
–আমি কি করতে পারি? আমি তো ডক্টর না। হাসপাতালে গেলেই ট্রিটমেন্ট দেবে। তুই হাসপাতালে নিয়ে যাওয়ার ব্যাবস্থা কর।
বোনকে সেদিন দুনিয়ার সবথেকে নিষ্ঠুর মানুষের উপাধিটা দিয়েছিলো ইরা। আর কোন কথা না বলেই ছলছল চোখে বেরিয়ে এসেছিলো ঘর থেকে। ঈশা দরজা বন্ধ করে অনেক কেঁদেছিল। ইভানের কষ্টটা সে উপলব্ধি করতে পারলেও নিজের জেদের কাছে হার মানতে রাজি ছিল না। তাই আর বের হয়নি ঘর থেকে। ইরা আর ইলহাম মিলেই ইভানের হাতে ব্যান্ডেজ করে দেয়। কিন্তু খুব একটা কাজে দেয়না। তারা জেদ করেও হাসপাতালে নিয়ে যেতে পারে না। তাই ইলহাম ভাইয়ের উপরে কিছুটা রাগ করেই বের হয়ে যায় ঘর থেকে। ইরাও বের হতে গেলে ইভান তাকে ডাকে। থেমে যায় সে। ইভান হাতের ইশারায় পাশে বসতে বলে। ইরা মেঝেতে ইভানের পাশে বসে পড়ে। ইভান শান্ত কণ্ঠে বলে
–তোর আপুর রাগ কমলে খাইয়ে দিস। সেই দুপুরে খেয়েছে। তারপর থেকে আর কিছু খাওয়া হয়নি।
ইরা ইভানের দিকে তাকায়। এই মানুষটার প্রতি তার শ্রদ্ধা দিনদিন বেড়েই চলেছে। এমনভাবে ভালবাসতে কেউ পারে তার জানা ছিল না। ইভানের কাছেই যেন ভালোবাসা নতুন করে সঙ্গা পায়। পরিবর্তন হয়ে যায় ভালোবাসার পুরনো সঙ্গা। নিঃস্বার্থ ভালোবাসার পরিচয় মেলে তার কাছেই। ইরা সেদিন প্রতিজ্ঞা করেছিলো নিজের সাথে ইভানের মতো কাউকে পাওয়া হয়তো সম্ভব না। কিন্তু ইভানকে দেখেই সে ভালবাসতে শিখেছে। আর তার জীবন সঙ্গীকে সেভাবেই ভালবাসবে। ইভানের মতোই ভালোবাসার মানুষের ছায়ার সঙ্গী হয়ে থাকবে। চোখ বেয়ে পানি গড়িয়ে পড়তেই সে কাঁপা কাঁপা গলায় বলেছিল
–তুমিও তো খাওনি।
ইভান মৃদু হেসেছিল তার কথা শুনে। উত্তরে বলেছিল
–আমি নিজের খেয়াল রাখতে পারি। কিন্তু ঈশা পারে না। আসলে ওর কোন দোষ নেই। আমিই ওকে এমন হতে বাধ্য করেছি। পরনির্ভরশীল।
একটা ছোট্ট শ্বাস ছেড়ে ইরার মাথায় হাত দিতেই ইরা তার হাতের দিকে তাকিয়ে বলেছিল
–রক্তটা কিন্তু এখনো বন্ধ হয়নি ভাইয়া। হাসপাতাল গেলে ভালো হতো।
ইভান হাতের দিকে তাকিয়ে পৈশাচিক হেসেছিল। তার সেদিন মনে হয়েছিলো ঈশার সাথে এমন আচরণের শাস্তিটা তার জন্য যোগ্য হয়েছিলো। তাই নিজের এমন আঘাতে মানসিকভাবে শান্তি পেয়েছিল সে। ইরার জবাব দিতেই তার মাথায় রাখা হাতটা আদরের ভঙ্গীতে নাড়িয়ে বলেছিল
–তুই বড় হয়ে গেছিস। তোর আপুর থেকেও পরিস্থিতি ভালো বুঝিস। চিন্তা করিস না ঠিক হয়ে যাবে।
নিচের দিকে তাকিয়ে থেমে থেমে বলেছিল
–ভালো করে পড়ালেখা করিস। কোন ফাঁকি দিবি না। নিজের খেয়াল রাখবি। সাথে সবার। তোর আপুর একটু বেশীই খেয়াল রাখবি।
ইরার মস্তিস্ক সেদিন ইভানের কথার অর্থ ধরতে পেরেছিল। ইভান কে জড়িয়ে ধরে কেঁদে ফেলে বলেছিল
–আপুর উপরে রাগ করো না ভাইয়া। তুমি তো জানো আপুর জেদ। রাগ করলে ঠিক ভুল সব ভুলে যায়। রাগের মাথায় অনেক কথাই বলে ফেলেছে। তুমি তো অন্তত বোঝ।
ইরার কথা শুনে ইভান শব্দ করে হেসে ফেলেছিল। বলেছিল
–তোর কি মাথা খারাপ? আমি ঈশার উপরে রাগ করবো? ঐ একটা মানুষ যার উপরে আমি কখনো রাগ করতে পারি না। যার সাথে জেদ করতে পারি না। ঈশা না বুঝেই ভুল করে ফেলে। ওর ভুলগুলো গুছিয়ে উঠতেই আমি হাপিয়ে যাই। শাসন করার সাহসটা হয়ে ওঠেনি কখনো। বারবার মনে হয়েছে ওর ভুল ঠিক করে দেয়ার জন্য আমি তো আছিই। ওকে কেন কষ্ট দেবো? ওর কষ্ট সহ্য করার ক্ষমতা যে আমার নাই। আজ হয়তো একটু বেশীই হয়ে গিয়েছিল। আসলে ভুলটা আমারই ছিল। অনেক রাগ হয়েছিলো। আর যে রেস্টুরেন্টে গিয়েছিল ওখানকার পরিবেশ ভালো ছিল না। ঐ রেস্টুরেন্টের আবাসিকে অনৈতিক কাজকর্ম হয় প্রতিনিয়ত। এতরাত অব্দি ওখানে থাকলে লোকজন বাজে কথা বলতো। এটা হয়তো বললে বোঝানো সম্ভব হতো। কিন্তু আমি কিছু না বলেই বেশী রিয়াক্ট করে ফেলেছি।
ইরা কোন কথা বলেনি আর শুধু বলেছিল
–ভালো থেকো ভাইয়া। নিজের খেয়াল রাখবে।
প্রতি উত্তরে ইভান শুধু হেসেছিল। হয়তো তার কথা শেষ হয়ে গিয়েছিল। আর কিছুই বলার মতো খুঁজে পায়নি।“
চোখের পানি মুছে ফেললেন ঈশার বাবা। এতক্ষন হাসপাতালের কেবিনে শুয়ে ডাক্তারকে গল্প শোনাচ্ছিলেন তিনি। ডাক্তার কৌতূহলী হয়ে জিজ্ঞেস করলেন
–ইভান ঈশা এখন কোথায়?
ঈশার বাবা ক্লান্ত হেসে বললেন
–ঈশা বাইরে বসে কাঁদছে। আর ইভান…
থেমে গেলেন তিনি। দীর্ঘশ্বাসটা ছেড়ে দিয়ে বললেন
–সেই ঘটনার ৫ বছর হয়ে গেছে। ছোটবেলা থেকে ঈশাকে কখনো শাসন করতে দেয়নি ইভান। তার প্রশ্রয়ে ঈশা হয়ে ওঠে অভিমানী, জেদি আর রাগী। রাগ সবসময় তার নাকের ডগায়। ইভান হয়তো বুঝতে পেরেছিল যে এভাবে প্রশ্রয় দিয়ে সে ঈশাকে একদম অন্যরকম বানিয়ে ফেলেছিল। যেটা তার ভুল। আর সেই ভুলের মাশুল আজও দিয়ে যাচ্ছে। ৫ বছর হল সে দেশের বাইরে। আর ঈশাও জেদ ধরে আছে। রাগের মাথায় কি না কি বলে দিয়েছে বলে কি ইভান কে এভাবে চলে যেতে হবে? দুজনের এই অভিমান আজ তাদেরকে আলাদা করেছে।
ডাক্তার হতাশ শ্বাস ছেড়ে বললেন
–দেখুন আপনার কিন্তু দেরি হয়ে যাচ্ছে। যত তাড়াতাড়ি সম্ভব অপারেশনটা করে ফেলতে হবে। নাহলে বিপদ হয়ে যাবে।
ঈশার বাবা কঠিন চোখে তাকিয়ে বললেন
–অপারেশন করে আমি যে সুস্থ হয়ে যাবো আপনি সেটা বলতে পারবেন?
–হতেও পারেন। বিশ্বাস রাখতে হবে। ভরসা রাখতে হবে।
–নাও তো হতে পারে। চান্স ফিফটি ফিফটি। তাই আমি যা বলেছি সেটা নাহলে কোনভাবেই অপারেশন হবে না।
ডাক্তার হতাশ হয়ে বের হয়ে এলেন। বাইরে ইভানের বাবাকে দেখেই বললেন
–উনি কিন্তু অজথা জেদ করছেন। ওনার অবস্থা খুব একটা ভালো না। দিনদিন খারাপ হচ্ছে। টিউমারটা বেড়ে যাচ্ছে। খুব তাড়াতাড়ি অপারেশন না করলে খারাপ কিছুও হতে পারে।
কথাটা শুনেই সবাই সচকিত দৃষ্টিতে তাকাল। ইভানের বাবা ভীত কণ্ঠে বললেন
–আমরা চেষ্টা করছি তো। কিন্তু…
ডাক্তার তাকে থামিয়ে দিলেন। বললেন
–কিন্তুর জন্য কোন সময় নেই। তাড়াতাড়ি ইভানের সাথে যোগাযোগ করার ব্যাবস্থা করুন। তাকে আসতে বলুন। সে না আসলে উনি কোনভাবেই অপারেশন থিয়েটারে যাবেন না। স্পষ্ট বলে দিয়েছেন। আমাদের হাতে আর করার কিছুই নাই।
ডাক্তার চলে যেতে নিয়েও থেমে গেলেন। ঘুরে বললেন
–ঈশা কে?
ঈশা দাঁড়িয়ে গেলো। বলল
–আমি।
মাঝ বয়সী ডাক্তার ঈশাকে আপাদমস্তক দেখে নিলো। কিন্তু কোন কথা বলল না। মুচকি হেসে চলে গেলো নিজের কাজে। যেতে যেতেই ভাবল এই মেয়েটাকে ঠিক কি বলে আখ্যা দেয়া যায়। ভাগ্যবতী, অভাগা নাকি নিষ্ঠুর। তবে যাই হোক ভালোবাসার ভাগ্যটা তার মতো হয়তো কারো হয়না। এমন ভাবে কেউ কাউকে ভালবাসতে পারে না। ঈশাকে এভাবে দেখতে চাওয়ার অর্থটা কারো কাছেই স্পষ্ট হল না। সেটা নিয়ে কিছুক্ষন ভেবেই ইভানের বাবা ইরার দিকে তাকালেন। তার তাকানোর অর্থ বুঝেই ফোনটা তুলে নিলো ইরা। কল লিস্টের সবথেকে উপরের নাম্বারটা ডায়াল করলো। তিন দিনের মতো আবারো ধির স্থির কণ্ঠে বলে উঠলো “দুঃখিত এই মুহূর্তে কাঙ্ক্ষিত নাম্বারে সংযোগ দেয়া সম্ভব হচ্ছে না।“ হতাশ চোখে তাকাল সে। তার তাকানোর অর্থ সবার বোধগম্য হতেই আবারো চিন্তার সমুদ্রে ডুবে গেলো তারা। সবার চিন্তা একরকম হলেও ইরার মাথায় এখন ভিন্ন চিন্তা। গত ৫ বছর ধরে এই নাম্বারে প্রতিদিন কথা হয়েছে তার। অথচ গত তিনদিন ধরে এই নাম্বার বন্ধ। ৫ বছরে এমন কখনো হয়নি। তাহলে কি ইভানের কোন বিপদ হল? ইভান ঠিক আছে তো? জানালার বাইরে আকাশের দিকে তাকিয়ে মনে মনে আওড়াল
“তুমি কোথায় ভাইয়া? একবার জানিয়ে দাও প্লিজ। সবাই তোমার অপেক্ষা করছে।”
চলবে…
অপেক্ষা_সুদূর_বর্ষণের-১
(আজ ইভান ঈশার জন্মদিন। এইদিনেই শুরু হয়েছিলো তাদের যাত্রা। পাঠকদের সাথে তাদের পরিচয়। একটা অনুগল্প লিখেছিলাম তাদের নিয়ে তারপর ধীরে ধীরে একের পর এক লিখতেই থাকি। তবুও পাঠকদের মন ভরেনা। মাঝে মাঝেই ইনবক্সে নক দিয়ে জানতে চান তারা কেমন আছে। কেমন কাটছে তাদের দিনকাল। তাদের জন্মদিনে তাই পাঠক মহলের সাথে আরও একবার আসলো দেখা করতে। এই গল্পটা আগামি পর্বেই শেষ হয়ে যাবে। এর থেকে বড় করতে আমি অপারগ। আশা করছি পাঠক মহল আমার কথা বুঝবেন।)