অপেক্ষা সুদূর বর্ষণের পর্ব-১৫

0
3494

অপেক্ষা_সুদূর_বর্ষণের – ১৫

বিশ্রী গরমে নাজেহাল অবস্থা। ইভান এর মেজাজ বেশ খিটখিটে। অফিসের কাজে কিছু একটা ঝামেলা হয়েছে। সেটা নিয়েই ভীষন চিন্তিত। অনেক্ষণ যাবত সেই সমস্যার সমাধান করতে চেষ্টা করছে। কোন লাভ হচ্ছে না। মাথাটাও কেমন যন্ত্রণা করছে। দরজায় খট করে শব্দ হতেই কাজে বাধা পড়লো ইভানের। এক রাশ বিরক্তিকর চাহুনি নিক্ষেপ করলো সেদিকে। ঈশা কফির কাপ নিয়ে দাড়িয়ে আছে। ইভান ভ্রু কুচকে ফেললো। এই সময় ঈশা কে সে কোনভাবেই আশা করেনি। কিছু বলার আগেই তার পেছন থেকে ছোট্ট একটা মাথা বেরিয়ে এলো। ইভান প্রথমে বুঝতে না পারলেও পরে চিনতে পেরেই হেসে ফেলে বলল
— সুপ্ত কেমন আছো?

সুপ্ত দৌড়ে এসে ইভানের কোলে বসে নরম হাতে গলা জড়িয়ে ধরে বলল
— ভালো। তুমি কেমন আছো?

— ভালো আছি। কখন এসেছো? আর কে এসেছে তোমার সাথে?

সুপ্ত ঈশার দিকে তাকাল। মুচকি হেসে বললো
— একটু আগেই এসেছি। আম্মুও এসেছে।

তারপর ভীষন অভিমানী কণ্ঠে বলল
— জানো মামা আমি তোমার কাছে আসতে চাইলাম কিন্তু খালামণি আসতে দিলো না। বলল তুমি নাকি ব্যস্ত। এখন যাওয়া যাবে না।

ইভান এক পলক ঈশার দিকে তাকাল। প্রসঙ্গ পাল্টে বলল
— তোমার আব্বু কোথায়? আসেনি?

সুপ্ত মাথা নাড়িয়ে বলল
— না আব্বুর কাজ আছে। আসতে পারবে না।

ঈশা এসে সুপ্তকে কোল থেকে নামিয়ে নিয়ে বলল
— মামা কাজ করছে। আমরা খেলবো আসো।

তারপর কফির কাপটা টেবিলে রেখে মিনমিনে সরে বলল
— কফি।

ইভান কফির দিকে তাকাল। তারপর ঈশার দিকে তাকিয়ে বলল
— আমি কি কফির কথা বলেছিলাম? মনে পড়ছে না তো।

ঈশা নিচের দিকে তাকিয়ে মিনমিনে সরে বলল
— বলোনি। আমার মনে হলো তোমার প্রয়োজন হতে পারে।

ইভান কয়েক সেকেন্ড তাকিয়ে থাকলো। আশ্চর্য্যের ব্যাপার হলেও সত্যি যে তার কফির প্রয়োজন ছিলো। এই সময় কফি পাওয়ার ব্যাপারটাই অপ্রত্যাশিত। আর এখানে তো স্বয়ং ঈশাই হাজির। বিরক্তিকর মুহূর্তটা ভালোলাগায় পরিণত হলো। শীতল হয়ে উঠলো হৃদয়। ইভান টেবিলে দুই হাত রেখে আরাম করে বসে বলল
— আমার প্রয়োজনের এতো খেয়াল? আশ্চর্য না হয়ে পারলাম না। যাই হোক কফির জন্য ধন্যবাদ।

ইভান এর কথার ধরনে তাচ্ছিল্য মেশানো। ঈশা মনে মনে আহত হলো। কিন্তু মুখে কিছু বলল না। সুপ্তর হাত ধরে বলল
— বাইরে চলো। মামা কাজ করছে।

ইভান কফির কাপে চুমুক দিয়ে ল্যাপটপের দিকে তাকিয়ে বলল
— থাক। সমস্যা নেই।

ইভান এর ইতিবাচক কথা শুনেই সুপ্ত এক দৌড়ে বিছানায় বসে আশেপাশের জিনিসপত্র নিয়ে খেলতে শুরু করে দিল। ঈশা তাকে দেখে নিয়ে একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়লো। বাইরে যাওয়ার জন্য দরজার কাছাকাছি যেতেই কানে এলো ইভানের কণ্ঠ
— সুপ্তর খালামণি থাকলেও সমস্যা নেই। আমি বিরক্ত হচ্ছি না।

ঈশা ঘুরে তাকাল। ইভান এর দৃষ্টি তখনো ল্যাপটপে নিবদ্ধ। ঈশা কয়েক সেকেন্ড তাকিয়ে থেকে মুচকি হেসে টেবিলের কাছে এসে দাড়ালো। ইভান ল্যাপটপের দিকে তাকিয়েই পাশের চেয়ারটা পা দিয়ে এগিয়ে দিলো। ঈশা সেদিকে তাকিয়ে ঠোঁট এলিয়ে নিঃশব্দে হাসলো। চেয়ারে বসে সুপ্তর দিকে তাকাল। সে নিজের মতো খেলাতেই ব্যস্ত। ঈশা চুপচাপ বসে আছে। ইভান কাজের ফাঁকে ফাঁকে আড় চোখে ঈশা কে দেখছে। একদম চুপচাপ নিচের দিকে তাকিয়ে আছে। চঞ্চলতা কোথায় যেনো হারিয়ে গেছে। সেই অস্থির ছেলেমানুষী সব নিস্তেজ হয়ে পড়েছে। চেহারায় বিষন্নতার ছাপ। ঈশার এভাবে চুপ করে থাকা ইভানের ভালো লাগলো না। সেই আগের ঈশা কে ভীষন মিস করছে। ল্যাপটপে চোখ রেখেই বলল
— সীমানা আপু কখন এসেছে?

আচমকা ইভানের কথা শুনে ঈশা চোখ তুলে তাকাল। আবার দৃষ্টি নামিয়ে মলিন কণ্ঠে বলল
— অনেক্ষণ হলো।

এবার ইভান চরম বিরক্তি নিয়ে ঈশার দিকে তাকাল। অনেক্ষণ তাকিয়ে থেকে এক পর্যায়ে মেজাজ হারিয়ে ল্যাপটপটা শব্দ করে এক পাশে রেখে দাতে দাঁত চেপে বলল
— কি সমস্যা?

ঈশা প্রথমে বুঝতে না পেরে তাকাল। কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে বলল
— কি সমস্যা হবে?

— সেটাই তো জানতে চাচ্ছি।

ঈশা একটা শ্বাস ছেড়ে বলল
— কোন সমস্যা নেই।

ইভান কোন উত্তর দিলো না। নির্বাক তাকিয়ে থাকলো কিছুক্ষণ। তারপর হুট করেই ঈশার চেয়ারটা টেনে কাছে এনে কিছুটা ঝুঁকে বলল
— তোকে আমি ভালোভাবে চিনি। আমাকে নতুন করে চেনানোর কোন প্রয়োজন নেই। কোন সমস্যা আছে কি না সেটা তো আমি বুঝতেই পারছি। না বলতে চাইলে আলাদা কথা।

শেষের কথাটা ভীষন অভিমানী শোনালো। ঈশা কয়েক সেকেন্ড তাকিয়ে থাকলো। ইভান দুই হাতে মাথা চেপে ধরে চোখ বন্ধ করে আছে। ঈশা একটা তপ্ত নিশ্বাস ফেলে আলতো করে চুলের ভাঁজে হাত ঢুকিয়ে দিলো। ইভান চোখ মেলে তাকাল। ঈশা চুলের ভাঁজে হাত বুলিয়ে দিয়ে বলল
— মাথা ব্যাথা?

ইভান কথা বলতে পারলো না। আরাম বোধ হচ্ছে তার। এতক্ষণ মাথার ভেতরে যন্ত্রণাটা অসস্তি ধরিয়ে দিচ্ছিলো। ঈশার হাতে যাদু আছে। দুই হাতের ভাঁজে টেবিলে মাথা রেখে চোখ বুজে আছে ইভান। অনেক্ষণ হয়ে গেছে ঈশা তখনো মাথা টিপেই যাচ্ছে। সুপ্তর চিৎকার শুনে পেছনে ঘুরে তাকাল। খেলতে খেলতে ব্যাথা পেয়েছে বলে চিৎকার করে কান্না করছে। ঈশা উঠে গিয়ে সুপ্ত কে কোলে তুলে নিলো। যে হাতে ব্যাথা পেয়েছে সেটাতে ফু দিয়ে ব্যাথা সরানোর চেষ্টা করছে। কিন্তু সুপ্ত কোনভাবেই থামছে না। কান্নার রেশ যেনো আরো বাড়ছে। শেষ পর্যন্ত সামলাতে না পেরে ঈশা ওকে নিয়ে বাইরে চলে এলো। ইভান মাথা তুলে ক্লান্ত চোখে তাকাল। কথা বলতে ইচ্ছা করছে না। ক্লান্তিতে চোখ বন্ধ হয়ে আসছে। ঈশা চলে যেতেই ইভান উঠে বিছানায় হাত পা ছড়িয়ে শুয়ে পড়লো। নিমেষেই গাঢ় ঘুমে আচ্ছন্ন হয়ে গেলো।

———–
সারা রাত ভারী বর্ষণের পর ঝরঝরে শীতল হাওয়ায় মাতানো এক সকালের শুরু হলো। ফুরফুরে মেজাজে অফিসের উদ্দেশ্যে বের হচ্ছে ইভান। গত দুইদিন যাবত বাসায় মেহমানের আনাগোনা। ফুপুত বোন সীমানা আর তার বাচ্চা সুপ্ত সারা ঘর মেতে রেখেছে। সবাই অনেক উৎফুল্ল। ঈশার সাথে খুব বেশী কথা না হলেও সম্পর্কটা মোটামুটি সহনীয় পর্যায়ে এসেছে। ব্যস্ততা আর লোকজনের ভিড়ে ঈশার সাথে এই দুইদিন ইভানের কথা হয়নি বললেই চলে। যা না বললেই নয় সেরকম কথা হয়েছে। ইভান নিজের ঘর থেকে বের হয়েই আশেপাশে তাকাল। সবাইকে চোখে পড়লেও ঈশা কোথাও নেই। কপালে কিঞ্চিৎ ভাঁজ পড়ে গেলো তার। ঈশা কি বাসায় নেই? এতো সকালে কোথায় গেলো? এদিক সেদিক তাকাতেই ইরা এসে বলল
— ভাইয়া খাবে না?

ইভান ইরার দিকে দৃষ্টি ফিরিয়ে বলল
— খাবো না এখন। অফিসে খেয়ে নিবো।

ইরা কিছু বলল না। চলে যেতে নিলে ইভান আবার বলল
— তোর আপু কোথায়?

— বাইরে গেছে।

ইরার কথা শুনে ইভানের কপালের ভাঁজ গাঢ় হলো। ইরা নিজের কাজে চলে গেলো। জিজ্ঞেস করা হলো না কোথায় গেছে। ইভান কিছুটা চিন্তিত হয়ে বের হলো। ফোনের দিকে তাকিয়েই সিড়ি বেয়ে নিচে নামছে। ঈশা উপরে উঠছিলো। ইভান কে বেখেয়ালি ভাবে নামতে দেখে থেমে গেলো। একদম সামনে দাড়িয়ে গেলো। ইভান একবারও চোখ তুলে সামনে তাকাল না। সে ঈশার কাছাকাছি চলে আসতেই ধাক্কা খেয়ে পড়ে যেতে নিয়েও নিজেকে সামলে নিলো। ফোনটা হাত থেকে পড়ে গেলো নীচে। ইভান একহাত দেয়ালে ভর দিয়ে আরেক হাতে ঈশা কে ধরলো। ঘটনা বুঝতে কিছুটা সময় লাগলো ইভানের। মাথায় ঢুকতেই ঈশা কে সোজা দাড় করিয়ে দিয়ে রেগে বলল
— মাথায় কি সমস্যা হয়েছে? পড়ে গেলে কি হতো?

ঈশা উপরের একটা সিড়ি পেরিয়ে ইভানের একদম কাছে এসে দাড়ালো। ঠোঁট এলিয়ে হেসে বলল
— পড়ে যেতাম না তো। জানতাম তুমি ধরে ফেলবে।

ইভান উত্তর দিতে পারলো না। শান্ত দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকলো কিছুক্ষণ। আপাদমস্তক দেখে নিয়ে বলল
— এতো সকালে কোথায় গেছিলিস?

ঈশা মুচকি হেসে বলল
— কোথাও যাইনি। তোমার জন্য অপেক্ষা করছিলাম।

ঈশার কথা শুনে ইভান বিস্ময়ের চরম সীমায় পৌছে গেলো। অবাক কণ্ঠে বলল
— আমার জন্য অপেক্ষা করছিস মানে?

— তোমার সাথে তো বাড়িতে কথাই হয়না। তাই ভাবলাম…

পুরো কথাটা শেষ করলো না ঈশা। ইভান অবাক হয়ে তাকিয়ে আছে তার দিকে। কথার অর্থ মস্তিষ্ক ধরতেই ঠোটের কোন প্রসারিত করে হাসলো। ঈশা কিছুটা লজ্জা পেলো। দৃষ্টি নামিয়ে নিতেই ইভান আচমকা তাকে দেয়ালের সাথে চেপে ধরলো। ঈশা চোখ বড় বড় করে তাকাল। তাকে ছেড়ে দুই পাশে দেয়ালে হাত রেখে ঝুঁকে গেলো ইভান। ঈশা অসস্তিতে কাটা হয়ে একদম দেয়ালে লেগে গেলো। ইভান কণ্ঠে গাম্ভীর্য এনে বলল
— আমি ভিষন ব্যস্ত। কথা বলতে চাইলে অপেক্ষা করতে হবে।

বলেই সরে দাড়ালো। এক পলকে পুরো ঈশা কে দ্বিতীয়বার দেখে নিয়ে দ্রুত সিড়ি বেয়ে নিচে নেমে গেলো। নামতে নামতেই ভীষন স্বাভাবিক ভাবে বলল
— এভাবে বাইরে দাড়িয়ে অপেক্ষা না করে এই বাড়িতে আমার জন্য বরাদ্দকৃত ঘরটায় গিয়ে কথা বলাটা আরো সহজ। এই অধিকারটুকু দেখানোর জন্য কেউ কোন শাস্তি দেবে না।

চলবে….

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here