অপেক্ষা_সুদূর_বর্ষণের – ১৭
পুরো একটা সপ্তাহ কেটে গেলো গ্রামেই। এই সাত দিন সবার মাঝে কাটলেও ঈশার মন মস্তিষ্ক অন্য খানে আবদ্ধ। কথা ছিলো ছুটি নিয়ে আসবে ইভান। কিন্তু এত বেশি ব্যস্ত হয়ে পড়ে যে ফোনটা ধরার সময়টাও হয়ে ওঠেনি। আর গ্রামে বেড়াতে আসা তো দূরের কথা। ঈশা ইভানের ফোনের অপেক্ষায় ছিলো। কিন্তু ইভান ফোন না করায় সে বাধ্য হয়ে নিজেই ফোন করেছিলো ইভানকে। কিন্তু দুর্ভাগ্য বশত তখন ইভান জরুরী একটা মিটিং এ থাকায় ফোনটা বন্ধ করে রাখতে হয়েছিলো। ঈশা বেশ কয়েকবার ফোন দিয়েও খুঁজে পায়নি। খুব বেশি অভিমান জমে গেছে মনের মাঝে। সীমানার ননদ মিলি পুরো একটা সপ্তাহে গ্রামের সব জায়গা ঘুরে বেড়িয়েছে তাদের নিয়ে। পুরো গ্রাম দেখা শেষ। তবুও আজ সকাল বেলা নাস্তা সেরেই তারা আবারও বেরিয়েছে। বিশেষ কোন উদ্দেশ্য নেই। নদীর ধারে বসে ফুরফুরে বাতাসে মন ভালো করার জন্য। সব অভিযোগ অভিমান বাতাসে মিশিয়ে দেয়ার চেষ্টা। কিন্তু সেটা সম্ভব হলো না। নদীর ধার অব্দি পৌঁছার আগেই আকাশ অন্ধকার করে মেঘ ডেকে উঠলো তীব্র শব্দে। এই আলোর ঝলকানি আর দুনিয়া কাঁপানো শব্দের ভয়টা গাঢ় হতেই কিছুটা অস্থিরতা নিয়ে ঈশা বলল
— খুব বৃষ্টি হবে মিলি। চলো বাসায় যাই।
মিলি আকাশের দিকে তাকাল। মুচকি হাসলো। ঈশা ভীত চোখে তার সেই হাসির অর্থ খুঁজতে লাগলো। মিলি আকাশের দিকে তাকিয়েই মুগ্ধ কণ্ঠে বললো
— তোমার বৃষ্টি ভালো লাগেনা আপু?
ঈশা কথাটার উত্তর দিতে পারলো না। বৃষ্টি ভালো লাগে না ঠিক সেরকম কোন ব্যাপার নয়। কিন্তু এই মেঘের গর্জন সে ভয় পায়। প্রচন্ড ভয় পায়। কথাটা ভাবতে গিয়ে উপলব্ধি করলো খুব ভরসার কেউ যদি পাশে থাকে তাহলে তার মাঝে এই ভয়টা থাকে না। এই মেঘের ডাক, আলোর ঝলকানি সব কিছুর মাঝেই এক অন্যরকম ভালোলাগা খুঁজে পায়। প্রিয় মানুষটার অনুপস্থিতিতে মুহূর্তেই মনটা বিষাদে পূর্ণ হলো। আকাশের দিকে তাকিয়ে অভিযোগ করলো ভীষন। চোখের কোনে পানি জমে উঠলো। দ্রুত পলক ফেলে সেই পানি লুকাবার চেষ্টা করলো ঈশা। ফোঁটা ফোঁটা বৃষ্টি গায়ে পড়তেই ইরা বলল
— বৃষ্টি পড়ছে। ফিরে যাই।
কেউ কোন প্রতিউত্তর না করে ফিরে আসলো বাসার দিকে। তারা অল্প পথ পেরিয়ে যখন বাসার ভেতরে ঢুকে গেলো তখনই মুষল ধারে বৃষ্টি নামলো। টিনের চালের ঝমঝম শব্দ। মোহনীয় পরিবেশ দেখেই মিলি নিজেকে সামলে রাখতে পারলো না। হারিয়ে গেলো বৃষ্টির মাঝে। বারান্দায় দাড়িয়ে সবাই বৃষ্টি দেখছে কিন্তু মিলি দ্রুত উঠোনে নেমে পড়লো বৃষ্টিতে ভিজতে। উঠোনের মাঝখানে দাড়িয়ে দুই হাত প্রশস্ত করে মুখটা উচু করে চোখ বন্ধ করে আছে। বৃষ্টিকে অনুভব করছে। ঈশা সেদিকে তাকিয়ে মুচকি হাসলো। মেয়েটা বৃষ্টি বিলাসী। তীব্র আলোক রেখা ঝলকে উঠতেই সবাই থেমে গেলো। এরপর প্রচন্ড শব্দে কেপে উঠবে ধরণী। ঈশা কানে হাত দিয়ে চেপে ধরলো। তীব্র শব্দে সবকিছু কেপে উঠতেই চোখ খিচে বন্ধ করে ফেললো। খানিকবাদেই আবার নিস্তব্ধতা। অল্প সময় পরেই ইরার মিহি কণ্ঠ কানে এলো
— ইভান ভাইয়া!
ঈশা চোখ খুলে ফেললো। সামনের দৃশ্য দেখার জন্য প্রস্তুত ছিলো না। ইভান এর এক হাত মিলির কোমরে আর এক হাতে মিলির হাত শক্ত করে ধরে আছে। মিলি নিস্পলক তার দিকে তাকিয়ে আছে। ইভান সোজা করে দাড় করিয়ে দিয়ে বলল
— আপনি ঠিক আছেন?
মিলি রোবটের মত মাথা নাড়িয়ে জানিয়ে দিলো সে ঠিক আছে। তারপর আর এক মুহুর্ত সেখানে দাড়ালো না। বাড়িতে ঢুকেই এমন একটা পরিস্থিতির সম্মুখীন হয়ে ইভান খেই হারিয়ে ফেললো। কি করবে সেটা বুঝে উঠতে একটু সময় লাগলো। তখনই ইরা চেচিয়ে উঠলো
— ভাইয়া। এইদিকে আসো।
ইভান দৃষ্টি ফিরিয়ে সেদিকে তাকাতেই ঈশার সেই অগ্নি দৃষ্টি দেখেই তার ভেতরের পিপাসা বেড়ে গেলো। অনিচ্ছাকৃত বিষয়টাকে ঈশা না জানি কি ভেবে বসে। তবে ঈশা যদি প্রথম থেকে সেখানেই দাড়িয়ে থাকে তাহলে অবশ্যই দেখেছে বিষয়টা একেবারেই অনাকাঙ্ক্ষিত ছিলো। ইভান ধীর পায়ে এগিয়ে আসলেও ঈশার দৃষ্টির কোন পরিবর্তন হলো না। ইভান গভীর ভাবে তাকাল সেই চোখে। রাগ অভিমান সাথে হাজারো অভিযোগ। এলোমেলো অনুভূতি। কারণটা ধরতে পারলো না ইভান। ইরা এগিয়ে এসে বলল
— ভাইয়া। সেই একটা সারপ্রাইজ ছিলো। আগে বলনি কেন তুমি আসছো? আমি তো ভেবেছিলাম তুমি আসবেই না। তোমাকে অনেক মিস করেছি।
ইভান মাথার চুল গুলো ঝেড়ে ফেললো। দুই হাতে ভেজা চুলগুলো ঠিক করতে করতে ঠোঁটের আগায় অস্থির হাসি ঝুলিয়ে বললো
— আসার কথা ছিলো না। কিন্তু আমার সবটাই তো তোরা সাথে এনেছিস। শুধু এই দেহটা নিয়ে আমি কি করতাম। তাই বাধ্য হয়ে চলে এসেছি।
কথাটা বলেই ঈশার দিকে তাকাল। অর্থ ধরতে পেরেও ঈশা কিছুই বলল না। পিটপিট করে কয়েকবার চোখের পলক ফেলে ঘরে চলে গেলো। ইভান ভ্রু কুঁচকে ফেললো। ঈশার এমন আচরনের অনেক কারণ থাকতে পারে। কিন্তু এই মুহূর্তে কি সেটা ধরতে পারলো না। হতাশ নিঃশ্বাস ফেলতেই ইলহাম পেছনে ছাতা মাথায় দিয়ে ইভানের ব্যাগ নিয়ে এলো। ইরা অবাক হলো। তার মানে সে জানতো ইভান আসছে। তাই সকাল থেকে তার কোন খোঁজ নেই। কিছুটা রাগ দেখিয়ে বলল
— তুমি জানতে ভাইয়া আসছে বলোনি কেনো?
ইলহাম ভারী ব্যাগটা ইরার হাতে ধরিয়ে দিতেই সে ব্যাগের ভারে পড়ে যায় অবস্থা। ছাতাটা বন্ধ করে ঝুলিয়ে দিয়ে একটা হাই তুলে ঘুম জড়ানো কন্ঠে বলল
— ভাইয়াকে জিজ্ঞেস কর। সকাল বেলা ঘুমটা ঠিক মত হয়নি। আমি এখন ঘুমাবো।
ইভানকে অত্যধিক ক্লান্ত দেখায় ইরা আর কথা বাড়ালো না। ওয়াশরুম দেখিয়ে দিলো। ইভান ফ্রেশ হয়ে ঘরে গিয়ে বিছানায় গা এলিয়ে দিলো। গত তিন রাত যাবত সে ঘুমায়নি। প্রচুর চাপ নিয়ে অফিসের কাজ শেষ করেছে এই তিনদিনে। কারণ একটাই ঈশার কাছে আসার। যদিও বা সে বলেছিলো কাজের ব্যস্ততায় আসতে পারবে কিনা সঠিক জানে না। কিন্তু এতগুলো দিন ঈশার কাছ থেকে দূরে থাকা সম্ভব হলো না। মনটা অস্থির হয়ে উঠতেই সব কাজ শেষ করে ছুটি নিয়ে চলে আসে। চোখে ভরপুর ঘুম। হালকা ঘুম আসতেই ইলহাম এর কণ্ঠ শোনা গেলো। মৃদু স্বরে ডাকছে
— ভাইয়া।
ইভান ক্লান্ত চোখ মেলে তাকাল। ইলহাম বুঝতে পারেনি ইভান ঘুমিয়ে পড়েছিল। এভাবে ঘুম থেকে ডেকে তোলার কারণে কিছুটা ভয় পেলো। একটু হকচকিয়ে বলল
— তোমাকে বাইরে ডাকছে।
ইভান ভ্রু কুঁচকে ফেললো। কঠিন গলায় বলল
— কে ডাকছে? তুই না ঘুমিয়েছিলি?
— মা ডাকছে। আর চাইলেই কি ঘুমানো সম্ভব। যখন তখন ডেকে দেয়। কতদিন শান্তিতে ঘুমাই না।
শেষের কথাটা অসহায়ের মতো শোনালো। ইভান কথা বাড়ালো না। উঠে বসলো। দুই হাতে মাথাটা চেপে ধরে কিছুক্ষণ চোখ বন্ধ করে থেকে বের হয়ে গেলো। বাইরে বের হয়েই দেখলো সবাই এক পাশে একটা বড়ো চৌকির উপর বসে আছে। ক্লান্ত ইভান সেখানে গিয়ে মায়ের পাশে বসলো। ইভান কে দেখেই তার মা মাথায় হাত দিয়ে বলল
— চেহারাটা এমন লাগছে কেনো? ঘুম হয়নি?
ইভান মাথা নাড়লো। মা আবারও জিজ্ঞেস করলেন
— কাজের চাপ?
ইভান আবারও মাথা নাড়লো। আশেপাশে চোখ বুলিয়ে নিলো। ঈশা কে কোথাও দেখা গেলো না। ইভান কিছুটা বিরক্ত হলো। সে এসেছে মেয়েটা জানে অথচ নিজের মতো ঘুরে বেড়াচ্ছে। কোন খবর নেই। একবার কথাও বলল না তার সাথে। ঈশার মা খাবার এনে দিলো। ইভান এর একদম খেতে ইচ্ছা করছে না। ক্লান্ত গলায় বলল
— এখন খাবো না ছোটো মা। পারলে এক কাপ চা দাও। আমি এখন একটু রেস্ট নেবো।
ইভান কথা শেষ করেই উঠে গেলো ঘরে। শরীরটা আর সায় দিচ্ছে না। ক্লান্তি ভালোভাবেই গ্রাস করেছে। বিছানায় আবারও হেলে চোখটা বন্ধ করতেই কারো উপস্থিতির আওয়াজ এলো। ইভান চোখ খুলে দেখলো মিলি চায়ের কাপ নিয়ে দাড়িয়ে আছে। তাকে দেখেই কিছুটা অবাক হলো। ঈশা কে আশা করেছিলো সে। আওয়াজ পেয়ে ধরেই নিয়েছিলো ঈশা এসেছে। কিন্তু এই মেয়েকে দেখে বিরক্ত হয়েই কাপটা হাতে নিয়ে বলল
— ধন্যবাদ।
এই ছোট্ট শব্দটাই মিলির ভেতরে আলোড়ন সৃষ্টি করলো। এলোমেলো হয়ে গেলো সবকিছু। মুগ্ধতা নিয়ে তাকাল ইভানের দিকে। এমন নিস্পলক দৃষ্টি দেখে ইভানের অসস্তি হলো। চোখ নামিয়ে চায়ে চুমুক দিলো। কয়েকবার চায়ে চুমুক দেয়ার পরও মিলির দৃষ্টির পরিবর্তন হলো না। এবার ইভান খুব বিরক্ত হলো। বাধ্য হয়েই তাকাল তার দিকে। বলল
— কিছু বলবেন?
মিলি সম্ভিত ফিরে পেলো। চমকে উঠে বললো
— না।
লাজুক হেসে বেরিয়ে গেলো। এমন আচরণ দেখে ইভান আশ্চর্য হয়ে গেলো। ভ্রু কুঁচকে কিছুক্ষণ বাইরের দরজার দিকে তাকিয়ে থাকলো। চা শেষ করে বিছানায় গা এলিয়ে দিতেই ঘুমিয়ে পড়লো।
চলবে….
(আপনাদের অনুরোধে ব্যস্ততার মাঝেও ছোটো করে লিখে ফেললাম। একটু অগোছালো হয়েছে হয়তো। ক্ষমা চেয়ে নিচ্ছি)