অপেক্ষা_সুদূর_বর্ষণের – ১৮
ইভান এর যখন ঘুম ভাঙলো তখন সূর্য ডুবু ডুবু। সারা শরীর কেমন নিস্তেজ হয়ে পড়েছে। হালকা ব্যাথা অনুভূত হচ্ছে। নিজেকে গুছিয়ে নিয়ে বিছানা ছাড়তেই জানালার বাইরে চোখ পড়লো। রক্তিম আভা ছড়িয়ে পশ্চিম আকাশে সূর্যটা হেলে পড়েছে। মাথাটা চট করেই সূক্ষ্ম ব্যথায় টনটন করে উঠলো। তিন দিনের ঘুম মনে হয় একদিনেই ঘুমিয়েছে। কিন্তু আশ্চর্য কেউ তাকে ডাকেনি। মানুষের বাড়িতে এসে এতক্ষণ ঘুমানোটা একদম শোভা পায়না। ঘর থেকে বেরিয়ে ওয়াশ রুমে গিয়ে ফ্রেশ হয়ে বারান্দায় দাড়ালো। উঠোনের মধ্যখানে দাড়িয়ে একটা বয়ামের ঢাকনা খোলার চেষ্টা করছে ঈশা। চোখে মুখে বিস্তর বিরক্তি। বেশ কিছুটা সময় ইভান সেদিকে তাকিয়ে থাকলো। খুলতে না পেরে ঈশা বিরক্তির শেষ সীমা অতিক্রম করতেই ইভান মুচকি হেসে সেদিকে এগিয়ে গেলো। ঈশার হাত থেকে বয়াম টা নিয়ে একবারেই খুলে ফেললো। ঈশা প্রথমে চমকে গেলেও ইভানকে দেখে ঠোটের কোন প্রসারিত হলো। কিন্তু পরক্ষণেই অভিমানের কথা মনে পড়তেই তীক্ষ্ণ দৃষ্টি ফেললো তার উপরে। মিলি প্রশস্ত হেসে বললো
— বাহ্! ভাইয়া আপনি তো সুপারম্যান! কখন থেকে সবাই চেষ্টা করছে। আর আপনি একবারেই খুলে ফেললেন!
ইভান মুচকি হেসে ঈশার হাতে দিয়ে বলল
— সবার দ্বারা সবকিছু হয়না। সেটা বুঝতে পারলেই কাজগুলো সহজ হয়ে যায়।
ঈশা কোন উত্তর না দিয়ে বয়াম থেকে লবণ বের করে কাঁচা আমে মাখিয়ে মুখে তুলতে যাবে ঠিক তখনি ইভান হাত ধরে ফেললো। হাত থেকে সেটা ফেলে দিয়ে গম্ভীর আওয়াজে বলল
— ভদ্রভাবে কথা না শুনলে অভদ্র হয়ে কিভাবে শোনাতে হয় সেটা আমি খুব ভালো করেই জানি। ভুলে যাস না।
ঈশা অসহায়ের মতো আমের টুকরার দিকে তাকাল। মুখটা কালো করে সেখান থেকে চলে গেলো। ইভান হতাশ নিশ্বাস ছাড়লো। এই মেয়ে কোনদিন ভালো হবে না। তাদের পাশেই দাড়িয়ে ইরা আর মিলি পুরো দৃশ্য নিশ্চুপ অবলোকন করছিলো। মিলি ইভানের এমন আচরণ দেখে ইরাকে জিজ্ঞেস করে বসলো
— আপু তো আমটা খাওয়ার জন্য নিয়েছিলো। ভাইয়া সেটা এভাবে ফেলে দিলো কেনো?
ইরা মুচকি হেসে বললো
— আপুর পেপটিক আলসার হয়েছিলো। এখন সেই সমস্যা তেমন নেই। তবে ডাক্তার টক জাতীয় ফল খেতে বারণ করেছে। এতে আবারও সমস্যা হতে পারে।
মিলি কথাটা শুনেই ইভানের দিকে তাকাল। ইভান ঈশার যাওয়ার দিকেই তাকিয়ে আছে। মিলির মনে হলো মানুষটা খুব ভালো। নিজের অজান্তেই মনের কথাটা মুখে উচ্চারণ করেই ফেললো
— যে মানুষটা তার কাজিনের জন্য এতটা ভাবে তার কাছের মানুষটা না জানি কতটা ভাগ্যবতী হবে। কতো খেয়াল রাখবে তার। আপনি সত্যিই খুব ভালো মনের মানুষ।
কথাটা কানে যেতেই ইরা মিলির দিকে তাকাল। ইভান সরু চোখে তাকিয়ে তার কথা বোঝার চেষ্টা করছে। সেদিক থেকে দৃষ্টি ফিরিয়ে ইরার দিকে তাকাতেই সে ইভানের দিকে তাকিয়ে ঠোঁট চেপে হাসলো। আবারও মিলির দিকে ফিরতেই তার নিস্পলক দৃষ্টি দেখেই অসস্তিতে পড়ে গেলো। দ্রুত চোখ সরিয়ে এক রাশ বিরক্তি নিয়ে চলে গেলো সেখান থেকে। ইভান এর প্রতিচ্ছবি সম্পূর্ণ মিলিয়ে যেতেই মিলি মুচকি হাসলো। ইরা পুরো ঘটনা বুঝে মুচকি হাসলো। ইভান ঘরে এসেই বিছানায় হেলে চোখ বন্ধ করে ফেললো। মেয়েটাকে তার মোটেই সুবিধার মনে হচ্ছে না। কথা বার্তা আচরণ কেমন অদ্ভুত। মেজাজ টা বিগড়ে যাচ্ছে। পুরো রাগটা ঝাড়তে মন চাচ্ছে ঈশার উপরে। এই মেয়েটাও কেমন অদ্ভুত আচরণ করছে। এতদিন পর দেখা হলো। কোথায় একটু বসে কথা বলবে তা না উল্টা ভাব দেখাচ্ছে। এতো জেদ মেয়েটার। ঈশার এমন জেদ দেখে ইভানের মাঝে মাঝে নিজেকে অসহায় মনে হয়। না কিছু বলতে পারে না সহ্য করতে পারে।
———
সন্ধ্যা বেলায় উঠোনে মোমবাতি জ্বালিয়ে মাদুর পেতে সেখানে বসে আড্ডা দিচ্ছে সবাই। শহরের সেই যান্ত্রিক পরিবেশ ছেড়ে এখানে এসে যেনো হাফ ছেড়েছে সবাই। নিজেদের মতো বসে আড্ডায় মত্ত। বড়রা একদিকে। ছোটরা উঠোনে। আর ছেলেরা বাড়ির বাইরে। গ্রামের পরিবেশটাই যেনো অদ্ভুত এক প্রশান্তি। শিরশিরে হাওয়া। কাঁচা আমের গন্ধ। প্রতিটা নিশ্বাসে যেনো মাদকতা মিশে আছে। ইভান আর ইলহাম বাইরে থেকে এসেই উঠোনে জটলা পাকিয়ে বসে থাকতে দেখে দাড়িয়ে গেলো। ঈশা একবার সেদিকে তাকিয়ে আবার সামনে ফিরে মাটির দিকে তাকাল। এমন ভাবে তাকিয়ে আছে যেনো সেখানে কোন গুরুত্বপূর্ণ জিনিস আছে। চোখ ফেরালেই হারিয়ে যাবে। ইভান বুঝলো তাকে ইগনোর করার চেষ্টা মাত্র। মেজাজ টা আবারও খারাপ হয়ে গেলো। তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে ঈশার দিকে তাকিয়ে থাকলো। ইলহাম মায়ের কাছে গিয়ে বলল
— ভাইয়া সেই সন্ধ্যা থেকে এতো হাটিয়েছে। কি আর বলবো। খুব ক্লান্ত হয়ে পড়েছি। তোমার ছেলে শহর থেকে কি আমার উপরে অত্যাচার করতে এসেছে নাকি।
শেষের কথাটা খুব ধীরে বললেও ইভানের কানে পৌঁছালো। সে তীক্ষ্ণ চোখে তাকাল ইলহাম এর দিকে। ইলহাম সেই দৃষ্টি দেখে শুকনো ঢোক গিলে মিনমিনে কণ্ঠে বলল
— রাগ করছ কেনো? মজা করলাম তো।
ইভান কোন উত্তর না দিয়ে ঘরে চলে গেলো। ঈশা লম্বা একটা শ্বাস টেনে আবারও গল্পে মশগুল হয়ে গেলো। অল্প সময়ের ব্যবধানে ইভানের গলা শোনা গেলো। ঈশা কে ডাকছে। এতো জোরে যে পুরো বাড়ির সবাই শুনতে পেয়েছে। ঈশা কিছুটা ভরকালো। এভাবে ডাকার মানে কি? কোন কারণে ইভান কি রেগে আছে? এভাবে চিৎকার করার তো কথা নয়। তার ভাবনার মাঝে আবার চিৎকার করতেই ঈশা চমকে উঠলো। ইভান এর মা বলল
— ঈশা? কখন থেকে ছেলেটা তোকে ডাকছে? শুনে আয় কি বলে।
ঈশা মাথা নেড়ে উঠে গেলো। ঈশা উঠে যেতেই মিলি মিনমিনে কণ্ঠে বললো
— ভাইয়ার কি কিছু লাগবে? কেনো ডাকছে?
তার কথাটা শুধু পাশে থাকা ইরাই শুনতে পেলো। মুচকি হেসে বললো
— ভাইয়ার কিছু লাগলে আপুকেই বলবে। এতো ভাবতে হবে না।
কথার অর্থ মিলি কি ধরে নিলো সেটা সেই জানে। ইরা আর গুরুত্ব দিলো না সেদিকে। ঈশা ধীর পায়ে দরজার সামনে গিয়ে দাঁড়ালো। ভেতরে উকি দিয়ে বোঝার চেষ্টা করলো ইভান কি করছে। কোলে একটা বালিশ নিয়ে বিছানায় বসে আছে। ঈশার দিকে পিঠ থাকায় মুখটা দেখা যাচ্ছে না। রেগে আছে কিনা বুঝতে পারছে না। ইভান পেছনে না তাকিয়েই বলল
— ভেতরে আসেন ম্যাডাম।
ঈশা একটু ভয় পেলো। কারণ ইভানের গলার আওয়াজ অনেক কিছুই বলে দিচ্ছে। সে ভয়টা সম্পূর্ণ দমিয়ে পাশে এসে দাড়ালো। ইভান তার দিকে তাকিয়ে চোখের ইশারায় সামনে বসতে বলল। ঈশা সামনে এসে দাড়ালো। বসলো না। কিছুটা গম্ভীর গলায় বলল
— কি সমস্যা?
— সমস্যা অনেক। শুনতে হলে বসতে হবে।
ইভান এর তৎক্ষণাৎ উত্তরে ঈশার সম্পূর্ণ ভয়টা কেটে গেলো। কারণ তার কণ্ঠস্বর বলে দিচ্ছে ইভান রেগে নেই। তাই নিজে কিছুটা রাগ দেখিয়ে বলল
— এভাবে চিৎকার করছো কেনো?
ইভান শান্ত দৃষ্টিতে তাকাল। বলল
— মুখ বন্ধ করে ডাকতে শিখিনি তাই বাধ্য হয়ে চিৎকার করতে হলো।
ঈশা কিঞ্চিৎ ভ্রু কুচকে ফেললো। কি উত্তর দেবে বুঝতে পারলো না। ইভান আবারও বলল
— বসতে বলেছিলাম।
ঈশা ভ্রু জোড়ায় গাঢ় ভাঁজ ফেলে বলল
— বসতে হবে না। যা বলার বলো।
ইভান জেদ ধরে বলল
— না বসলে তো বলা যাবে না।
ঈশা কিছুটা বিরক্ত হয়ে বলল
— আসলেই কি কিছু বলতে ডেকেছো না এমনিতেই? আর এভাবে চিৎকার করার কি আছে? সবাই কি ভাবলো?
ইভান ভীষন সাভাবিক ভাবে বলল
— আশ্চর্য! আমার বউকে আমি ডাকতে পারিনা? ভাবার কি আছে? আমি এই মুহূর্তে বউকে জড়িয়ে ধরে শুয়ে থাকলেও কেউ কিছুই ভাববে না। বরং খুশি হবে। প্রমাণ দেখাবো?
ঈশা বুঝে গেলো ইভান কোন কথা বলতে নয় অযথা তাকে বিরক্ত করতে ডেকেছে। তাই রাগ করে চলে যাওয়ার জন্য পা বাড়ালো। কিন্তু ইভান হাত টেনে তাকে কোলে বসিয়ে নিলো। আচমকা এমন হওয়ায় ঈশা চমকে গেলো। ঘটনা বুঝতে পেরে নিজেকে ছাড়াতে চেষ্টা করলো। ইভান এতক্ষণ আলতো করেই ধরে ছিলো। কিন্তু ঈশার এমন আচরণ দেখে এক হাত কোমরে দিয়ে গভীর ভাবে চেপে ধরলো। ঈশা অসস্তিতে শুকনো ঢোক গিলে বলল
— কি করছো এসব?
ইভান ঈশার চোখের মাঝে নিজের মুগ্ধ দৃষ্টি স্থির করে বলল
— এটা বাড়াবাড়ি ঈশা। আমি ডেকেছি অথচ আমার অনুমতি ছাড়াই তুই চলে যাচ্ছিস। তোর কি মনে হচ্ছে না তুই সমস্ত সীমা অতিক্রম করে ফেলেছিস? তাহলে তো আমাকেও আমার সীমা অতিক্রম করতে হবে যা আমি করতে চাই না। কিন্তু তুই আমাকে বাধ্য করলি। বিষয়টা তোর জন্য খারাপ হয়ে গেলো। খুব খারাপ। এখন যা হবে সেটাকে সামলাবি কিভাবে?
চলবে…..