অপেক্ষা_সুদূর_বর্ষণের – ২০
ঝকঝকে আকাশে সচ্ছ রংধনু। এক পশলা বৃষ্টি শেষে দুপুরের আকাশে রংধনু উঠেছে। শহরের রংধনু আর গ্রামের রংধনুর মাঝে বিস্তর ফারাক মনে হলো ঈশার। উচু উচু বিল্ডিং এর ফাঁকে এক ঝলক দেখা যায় মাত্র। কিন্তু গ্রামে সবুজের সমারোহে সাত রঙের বাহার মন কেড়ে নিয়েছে। সেখান থেকে দৃষ্টি যেনো ফেরাতেই পারছে না সে। মন খারাপের মাঝেও এক রাশ মুগ্ধতা। সচ্ছ অনুভূতি। প্রগাঢ় ভালোলাগা।
— আপু।
ভাবনার জগতে এতটাই ডুবে ছিলো যে ইরার ডাকটাও শুনতে পেলো না। ইরা কিছুক্ষণ অপেক্ষা করলো। কিন্তু কোন প্রতিক্রিয়া দেখতে না পেয়ে ঘাড়ে হাত রাখলো। ঈশা চমকে পেছনে তাকাতেই বলল
— তোমাকে ডাকছিলাম।
ঈশার মন খারাপটা ভেসে উঠলো আবার। মলিন কণ্ঠে বললো
— বুঝতে পারিনি। রংধনু দেখছিলাম।
ইরা বুঝতে পেরেও সেটা নিয়ে আগ্রহ দেখাল না। বলল
— আজ বিকেলে আমরা বাসায় যাবো। বাবা বলেছে সবাইকে রেডি হতে।
ঈশা ছোট্ট করে ‘ওহ ‘ বলল। ইরা আবার বলল
— তোমার সবকিছু গোছায় নাও। আমরা মোটামুটি রেডি।
ঈশা মাথা নাড়তেই ইরা চলে যাওয়ার জন্য পা বাড়ালো। তারপর আবার থেমে গিয়ে বলল
— ভাইয়ার জ্বর এসেছে। তুমি জানো?
ঈশা তাকাল। কিছু একটা বলতে গিয়েও থেমে গেলো। এই কারণেই ইভানের চেহারা এমন দেখাচ্ছিলো। কিন্তু কিছুই তো বলল না। কিছুটা সময় নিয়ে বলল
— কোথায় আছে?
ইরা হতাশ শ্বাস ছেড়ে বলল
— ঘরে।
ঈশা অপেক্ষা করলো না। দ্রুত সেদিকে গেলো। ঘরের কাছে যেতেই একটা মেয়েলী মৃদু আওয়াজ কানে এলো। ঈশা দাড়িয়ে গেলো সেখানেই। কান খাড়া করে ফেললো। কেউ একজন ফুপিয়ে কেঁদে উঠে বলছে
— নিজের অজান্তেই আমি দুর্বল হয়ে পড়েছি। কিভাবে সেটা জানিনা। আমার খুব কষ্ট হচ্ছে। আপনাকে জড়িয়ে ধরতে ইচ্ছা করছে। একবার সেই সুযোগটা পাবো না?
তারপর কিছু সময় নীরবতা। অল্প সময়ের ব্যবধানে ভেসে এলো ইভানের কণ্ঠ। ভীষন অসহায় হয়ে বলল
— তোমার আবদারটা রাখতে পারলে হয়তো আমার ভালো লাগতো। কিন্তু আমি অপারগ। এই পৃথিবীতে আমি ঠিক তোমার মতই আরেকজনকে নিজের সাথে জড়িয়ে ফেলেছি। আর কাউকে জড়ানো সম্ভব নয়। তবে তুমি খুব ভালো মেয়ে। তোমার সাথে কথা বলে ভালো লাগলো। আমি মন থেকে চাই তুমি জীবনে অনেক দূর এগিয়ে যাও।
ইভান এর কথা থেমে গেলো। আবারও নীরবতা। ভেতরে কি হচ্ছে সেটা বোঝা সম্ভব হলো না। কিন্তু ভেতরের ঘটনা বুঝতে ঈশা ছটপট করে উঠলো। ওড়নার মাথা খামচে ধরে নিশ্বাস বন্ধ করে দাড়িয়ে আছে। ইভানের এমন কথা শুনে ঈশার ভেতরটা কেনো জানি কেপে উঠেছে। পায়ের শব্দটা ক্রমশ স্পষ্ট হচ্ছে। ঈশা নিজেকে সামলে দাড়িয়ে গেলো। মিলি বের হলো ঘর থেকে। ঈশা কে দেখেই থেমে গেলো। চোখের কোনে এখনো পানি চিকচিক করছে। চেহারা বিদ্ধস্ত। মলিনতার ছাপ পুরো চেহারায়। ঈশার ভেতরে সূক্ষ্ম যন্ত্রণা হলো। এই মেয়ে তাহলে এতক্ষণ ইভানের সাথে কথা বলছিলো। তাহলে কি এই মেয়ে ইভান কে ভালোবাসে। মিলি ঈশার সাথে কথা না বলেই পাশ কাটিয়ে চলে গেলো। ঈশা আত্মসম্মানে আঘাত পেলো যেনো। কিছুটা যন্ত্রণাময় অনুভূতি নিয়েই চলে গেলো ভেতরে। ইভান বিছানায় বসে ফোনের দিকে তাকিয়ে আছে। ঈশা দাড়াতেই চোখ তুলে তাকাল। এমন এলোমেলো অবস্থায় দেখে কিছুটা চিন্তিত হয়ে বলল
— কি?
ঈশা তাকিয়েই থাকলো। কোন কথা বলল না। ইভান আবার বলল
— কিছু বলবি?
ঈশা এবারও উত্তর দিলো না। মাথার ভেতরে চিনচিন করে ব্যথাটা বাড়তেই ইভান মেজাজ হারিয়ে ফেললো। রেগে গিয়ে বললো
— এখন এসব ভালো লাগছে না। কথা না বলতে চাইলে এখানে দাড়িয়ে থাকার কোন প্রয়োজন নেই। চলে যা।
ইভান এর কথাটা তার ভেতরের যন্ত্রণাটা বাড়িয়ে দিতে যথেষ্ট ছিলো। তাচ্ছিল্য করে বলল
— এখন আর আমাকে ভালো লাগছে না। সেটা তো লাগবেই না। কথা বলার অনেক মানুষ আছে যে।
ইভান ভ্রু কুঁচকে তাকাল। শরীরের উত্তাপ অতি মাত্রায় বেড়ে যাওয়ায় নিজেকে সামলে রাখতে কষ্ট হচ্ছে। আর ঈশার এমন কথাগুলো মাথার যন্ত্রণা যেনো আরো বাড়িয়ে দিচ্ছে। কঠিন গলায় বলল
— উল্টা পাল্টা কথা বললে থাপ্পড় দিয়ে সোজা বানিয়ে দেবো। তোর কথা আমার ভালো লাগছে না। এখন যা প্লিজ।
ঈশার চোখে পানি চলে এলো। কাপা কাপা কণ্ঠে বললো
— আমি কথা বললেই তোমার ভালো লাগে না। আর অন্যকারো সাথে কথা বলতে খুব ভালো লাগে। আমাকে বিরক্ত লাগে আর অন্যকারো আবদার রাখতে পারলে তোমার ভালো লাগে। এতটা চেঞ্জ হয়ে গেলে?
ইভান নিজের মেজাজ হারিয়ে ফেললো। কোনকিছু না ভেবেই ঈশার গালে দ্বিতীয়বার থাপ্পড়টা মেরে বসলো। ঈশা স্তব্ধ হয়ে গেলো। দ্বিতীয়বার ইভানের এমন আঘাতে সে ভেংগে পড়লো। ইভান কিছুটা চিৎকার করে বলল
— কথা বলার সময় ভেবে বলবি কার সাথে কথা বলছিস। আমার সাথে এভাবে দ্বিতীয়বার কথা বলার সাহস করবি না।
ঈশা চোখের পানি ছেড়ে দিলো। বুকের ভেতরটা অসহনীয় যন্ত্রণায় ছটপট করে উঠলো। ঈশা আর কথা না বলেই ঘর থেকে বেরিয়ে এলো। বাইরে এসেই দেখা হলো ইভানের বাবার সাথে। তিনি এতক্ষণ দরজার বাইরে দাঁড়িয়ে ভেতরের সব কথা শুনছিলেন। সবটাই বুঝে গেছেন তিনি। কোন কথা বললেন না। ঈশা সেখান থেকে চলে গেলো। ইভান এর বাবা ছেলের সাথে কথা বলতে এসেও আর ভেতরে গেলেন না।
————
পুরো দুইদিন পার হয়ে গেছে বাড়ি ফেরা। এই দুইদিন ইভান ঈশা কেউ কারো সাথে কথা বলেনি। এতদিন বাইরে কাটিয়ে দিয়ে এসে অফিসের কাজ গোছাতে ব্যস্ত হয়ে পড়েছে ইভানের বাবা আর ঈশার বাবা। সন্ধ্যায় অফিস থেকে ফিরে এসে ইভানের বাবা সবাইকে বললেন খাবার টেবিলে উপস্থিত থাকতে। সবার সাথে নাকি জরুরী কথা আছে। ইভান এখনো বাইরে থেকে ফেরেনি। তার জন্য অপেক্ষা করছে সবাই। ইভান অনেক্ষণ পর বাইরে থেকে ফিরে আসলো। বাসায় ঢুকেই প্রথম ঈশার মুখোমুখি হলো। কিন্তু কোন কথা বলল না।ইভান সোজা নিজের ঘরে চলে গেলো। কিছুটা সময় নিয়ে ফ্রেশ হয়ে বেরিয়ে এলো। সবাইকে এভাবে বসে থাকতে দেখে কিছুটা চিন্তিত হলো। এগিয়ে এসে জিজ্ঞেস করলো
— কি হয়েছে? কোন সমস্যা?
ঈশার বাবা চোখ তুলে তাকালেন। গম্ভীর আওয়াজে বলল
— বসো।
কথার ধরন শুনেই ইভান বুঝে গেলো কিছু একটা ব্যাপার আছে। সামনের সোফায় বসে পড়লো। ঈশার বাবা বললেন
— তোমার সাথে একটা গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে কথা আছে। আমার কথা একটু মনোযোগ দিয়ে শোন। ঈশা তুমিও এখানে বসো।
ঈশা দ্বিধাদ্বন্দ্ব ফেলে বাবার পাশে বসলো। ইভান তার বাবার দিকে একবার তাকাল। তিনি নিচের দিকে তাকিয়ে আছেন। এখন পর্যন্ত কোনো কথা বলেনি। ঈশার বাবা গম্ভীর আওয়াজে বললেন
— আমার মনে হয় তোমার আর ঈশার সম্পর্কটা জটিলতায় ভরপুর। এই মুহূর্তে আমার মনে হচ্ছে আমার সিদ্ধান্ত ভুল ছিলো। আর সেটাই এখন শুধরে নিতে চাই।
ঈশা শক্ত করে ওড়না খামচে ধরলো। গলা শুকিয়ে আসছে। তার বাবা কি বলতে চায়। কথার ইঙ্গিত কোনদিকে যাচ্ছে। শুকনো ঢোক গিলে ফেললো। ঈশার বাবা আবারও বললেন
— আমার মনে হয় তোমাদের আলাদা হয়ে যাওয়াই ভালো। বিয়েটা এমনিতেও শরীয়াহ মোতাবেক হয়নি। তাই খুব সহজেই ডিভোর্স হয়ে যাবে। কোন ঝামেলা হবে না। আমি সব ব্যাবস্থা করে ফেলেছি। দুই একদিনেই সব হয়ে যাবে।
ঈশা ইভানের দিকে তাকাল। সে অতি সাভাবিক ভাবে নিচের দিকে তাকিয়ে আছে। ওর চেহারা দেখে তেমন কিছুই বোঝা যাচ্ছে না। কিন্তু কেনো? কিছুটা সময় পর ইভান মুখ খুললো। স্বাভাবিক ভাবে বলল
— বলেছিলাম ছোটো বাবা। আমি এখন থেকে তোমাদের কোন সিদ্ধান্ত নিয়েই দ্বিমত পোষণ করবো না। তোমরা যা বলবে তাই মেনে নিবো। এক্ষেত্রেও ব্যতিক্রম হবে না।
চলবে….
( রিচেক করা হয়নি। ভুল থাকলে ক্ষমা চেয়ে নিচ্ছি।)