অপেক্ষা_সুদূর_বর্ষণের – ২১
কলিং বেলের বিরক্তিকর আওয়াজটা থামছেই না। ঈশা বিরক্ত হয়ে ঘর থেকে বেরিয়ে এলো। বাসায় কি কেউ নেই? দরজা খুলছে না কেন? কিছুটা গলা তুলে চেচিয়ে উঠলো
— রহিমা?
কোন আওয়াজ এলো না। আশেপাশে তাকিয়ে কাউকে দেখতে না পেয়ে হতাশ হলো। নিজেই গিয়ে দরজা খুলে দিলো। সম্পূর্ণ অপরিচিত একটা মানুষকে দাড়িয়ে থাকতে দেখে জিজ্ঞেস করলো
— কাকে চান?
লোকটা সামনের মানুষটাকে বোঝার চেষ্টা করলো। কয়েক সেকেন্ড পর জবাব দিলো
— মিস ঈশা?
ঈশা কিছুটা অবাক হলো। অবাক কণ্ঠে বললো
— আমাকে? কিন্তু আমি তো আপনাকে চিনিনা। কে আপনি?
লোকটা হাসলো। তার হাসি দেখেই বোঝা সম্ভব সে ঈশা কে দেখে যেনো প্রাণ ফিরে পেয়েছে। ক্লান্ত কণ্ঠে বললো
— ম্যাম অনেক খুঁজে তারপর আপনাকে পেলাম। আপনার জন্য একটা সারপ্রাইজ আছে।
ঈশা বিরক্ত হলো। কথায় বিরক্তি প্রকাশ করে বলল
— আমার কাজ আছে। যা বলার একটু দ্রুত বলবেন প্লিজ।
— সিওর ম্যাম।
লোকটা কথা শেষ করতেই আরো দুজন লোক নীচ থেকে সিড়ি বেয়ে উপরে উঠছে। তাদের হাতে বিশাল এক বক্স। সেটা দেখেই ঈশার চোখ বড় হয়ে গেলো। কিছু বোঝার আগেই লোক দুটো বড়ো বক্সটা নিয়ে ঠিক ঈশার সামনে দাড়ালো। ঈশা কিছুটা সরে দাঁড়াতে তারা সেটা নিয়ে একদম ভেতরে ঢুকে গেলো। রেখে কোন কথা না বলে বেরিয়ে আবার সিড়ি দিয়ে নেমে গেলো। ঘটনা এতো দ্রুত ঘটে গেলো যে ঈশা কিছুই বুঝে উঠতে পারল না। ফ্যাল ফ্যাল করে তাদের দিকেই তাকিয়ে আছে। তার সামনে যে আরো একজন দাড়িয়ে আছে সেটার কথা ভুলেই গিয়েছিল। আচমকাই তার ধ্যান ভাঙলো লোকটার কথা শুনে।
— হ্যাপি বার্থডে ম্যাম! স্যার আপনার জন্য গিফট পাঠিয়েছেন। আপনার জন্মদিন শুভ হোক।
ঈশা চমকে তাকাল। লোকটার মুখে বিস্তর হাসি। ঈশার কাছ থেকে কাঙ্ক্ষিত কোন উত্তর না পেয়ে লোকটা বোধ হয় একটু হতাশ হলো। তাই আর দেরি না করে চলে গেলো। আসলে ঈশা উত্তর দেয়ার মতো অবস্থায় ছিলো না। আজ যে তার জন্মদিন সেই কথাটাই ভুলে বসেছে। এতো কিছুর মাঝে দরজাটা বন্ধ করে দিতেই ভুলে গেলো। এলোমেলো পায়ে বক্সটার সামনে এসে দাড়ালো। অবাক চোখে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে সেটা খুলে ফেললো। খুলতেই ভেতর থেকে বেরিয়ে এলো কতগুলো বেলুন। ঈশা আরো অবাক হয়ে সেগুলোর দিকে তাকিয়ে আছে। রং বেরংয়ের বেলুন গুলো সারা ঘরময় উড়ে ক্লান্ত হয়ে মেঝেতে লুটিয়ে পড়ছে। বেলুনের দিক থেকে দৃষ্টি ফিরিয়ে বক্সের মধ্যে উকি দিলো। ভেতরে কিছু একটা আছে। কৌতুহল বশত সেটা বের করে কভারটা খুলতেই চোখ ধাঁধিয়ে গেলো। বুকের ঢিপঢিপ আওয়াজটা ক্রমশ বাড়ছে। পর মুহূর্তেই চোখ ছলছল করে উঠলো পানিতে। ঈশার ছোটো বেলার খুব পছন্দের একটা ছবি বড়ো করে বাঁধাই করা। ছবিটা তার নিজেরই খুব ভালো লাগে। কোন একদিন হয়তো কথার ছলে বলেছিলো ছবিটা বাঁধাই করতে চায়। ঠিক মনে করতে পারছে না। পুরো ছবিতে একবার আলতো করে হাত বুলিয়ে দিলো। একটা ছোট্ট নিশ্বাস ফেলে সেটা বুকে চেপে ধরে চোখ বন্ধ করে ফেললো। কিছুক্ষণ বুকে জড়িয়ে রেখে চোখ খুললো। সেটার সাথেই একটা ছোট্ট চিরকুট। ঈশা হাতে নিয়ে খুললো।
” হৃদয়ের আকাশে অবিরত বিচরণকারী মেঘেরাও আজ ক্লান্ত। পুরো আকাশ জুড়ে তারা বিশ্রামে মত্ত। তাই আকাশের আজ মন খারাপ। গুমোট আঁধারে ছেয়ে আছে। এই তপ্ত হৃদয় বর্ষণের অপেক্ষমান। হবে কি বর্ষণ? শেষ হবে কি এই অপেক্ষা_সুদূর_বর্ষণের?”
— হ্যাপি বার্থডে জান!
মুহূর্তেই চোখ তুলে তাকাল। কেটে গেলো সমস্ত ঘোর। পাশ ফিরে দরজার দিকে তাকাতেই হাস্যোজ্বল ইভানকে দেখতে পেলো। কাঙ্ক্ষিত মানুষটাকে দেখে এতক্ষণের আটকে রাখা চোখের পানি টা গড়িয়ে পড়লো গাল বেয়ে। ইভান ঈশার কাছে এসে হাত বাড়িয়ে পানি মুছে দিয়ে বলল
— পৃথিবীতে এই একটা জিনিষ আমার অসহ্য। আমি সব কষ্ট হাসি মুখে সহ্য করতে পারি। কিন্তু তোর কষ্ট আর চোখের পানি আমি কখনোই সহ্য করার সাহস রাখিনা। সব সময় চেষ্টা করেছি তোকে ভালো রাখার। হয়তো কখনো ব্যর্থ হয়েছি। তবুও তোকে সামলে রাখার চেষ্টা করেছি। সারাটা জীবন তাই করে যাবো। নিজেকে গুছিয়ে তোকে আগলে রাখবো।
ঈশা ছবিটা বুকে জড়িয়ে নিয়েই সরে দাঁড়ালো। চোখের পানি মুছে ফেলে কিছুটা রুষ্ট কণ্ঠে বললো
— কেনো এসেছো এখানে?
ইভান কয়েক সেকেন্ড পর উত্তর দিলো
— আমার সবকিছু তো এখানেই পড়ে আছে।
অভিমানী ঈশা তাকাল ইভানের চোখে। ইভান অসহায়ের মতো বলল
— তোকে ছাড়া আমি শুন্য। একদম একা। আর এরকম থাকতে চাই না। প্লিজ জান।
ঈশা তাচ্ছিল্য হাসলো। বলল
— এসব নাটক অনেক দেখেছি। এখন আর দেখতে চাই না। নিজেকে গুছিয়ে নিয়েছি। তোমাকে মানা করেছিলাম এখানে আসতে। তবুও নির্লজ্জের মতো চলে এসেছো।
ইভান কোন উত্তর দিলো না। চোখ বন্ধ করে থাকলো কিছুক্ষণ। তারপর চোখ খুলে উত্তর দিলো।
— আমাকে নির্লজ্জ বল আর যাই বল তাতে কিছুই যায় আসেনা। ভালোবাসি তোকে। সবকিছুর থেকেও বেশী। আমার কাছে এটাই যথেষ্ট।
ঈশা ছলছল চোখে তাকাল। ইভান এর কথাগুলো তাকে দুর্বল করে দিতে যথেষ্ট। কিন্তু সে দুর্বল হতে চায়না। নিজেকে বরাবরের মতোই কঠিন রাখার চেষ্টা করে যাচ্ছে। কতক্ষণ থাকতে পারবে কে জানে। তাই ইভান কে বেশিক্ষণ এখানে থাকতে দেয়া যাবে না। কিছুটা কঠিন গলায় বলল
— এখান থেকে চলে যাও তুমি। আমাকে বিরক্ত করবে না। আমি একা থাকতে চাই। আমার কাউকে লাগবে না।
এতক্ষণ ইভান নিজের রাগটাকে সংবরণ করতে চেষ্টা করলেও ঈশার এই কথাটা তাকে খুব বেশি রাগিয়ে দিলো। নিজেকে আটকে রাখা সম্ভব হলো না। ঈশার হাত শক্ত করে চেপে ধরে বলল
— অনেক হয়েছে। আর না। আমি ভেবেছিলাম তোর অভিমান হয়তো কমে গেছে। তাই আজ এই জন্মদিনে বাকি অভিমান টুকু নিঃশেষ করে দিয়ে তোকে একবারেই নিজের করে নিয়ে বাসায় ফিরবো। আজকের পর থেকে আমাদের মাঝে আর কোন বাধা থাকবে না। কিন্তু না। তুই সেরকম মেয়ে নয়। সব ক্ষেত্রে তোর জেদ আগে। কারো অনুভূতির মূল্য তোর কাছে নেই।
ইভান এর কথা শেষ হতেই ঈশা চেচিয়ে উঠলো। চিৎকার করে বলল
— আমার কাছে অনুভূতির মূল্য নেই তাই না? আর তোমরা? তোমরা সবাই মিলে কি করেছো আমার সাথে? আমাকে বিয়ের রেজিস্ট্রি পেপারে সাইন করতে বাধ্য করেছো। তারপর তুমি আমার কথায় অভিমান করে নিজের মতো দূরে থেকেছ ৫ বছর। সেখান থেকে ফিরে কখনো জানতে চাওনি আমার কেমন কেটেছে এই ৫ বছর। একা আমি কেমন ছিলাম। তুমি নিজের একাকীত্ব নিয়েই ব্যস্ত ছিলে। অথবা ভেবেছিলে আমার মতো সার্থপর মেয়ের একাকীত্ব অনুভব করতে পারাটাই হাস্যকর। তারপর ফিরে এসে আমার জীবনের সেই একাকীত্বের প্রতিটা মুহূর্তের কষ্ট ভুলিয়ে দিতে নতুন করে ভাবতে বাধ্য করলে। তোমার ভালোবাসার জালে জড়ালে। আর আমি যখন সেটাতে আস্টে পৃষ্টে জড়িয়ে গেলাম তখনি বাবার সাথে মিলে ডিভোর্স এর নাটক করলে। বাহ্! এর মাঝে একবারও মনে হয়নি আমি কেমন থাকবো। একবারও ভাবনায় আসেনি আমার কতটা কষ্ট হচ্ছে। তা কেনো হবে? তুমি তো সব সময় ভাবো আমি রাগী, জেদী। সব সময় নিজের কথা ভাবি। তারপর কি হলো যে এরকম একটা সার্থপর মেয়েকে নিজের করে নিতে উঠে পড়ে লেগেছ।
— জাস্ট শাট আপ! আর একটাও কথা না। যেটা আমার সেটা আমার। বাকি সবকিছু একদিকে থাকলেও তোর সাথে কোন কিছুর তুলনা হয়না। কারণ বাকি সবকিছু আমার জীবনের অংশ মাত্র। আমি প্রয়োজনে সেগুলোকে ছেড়ে দিতে পারি। কিন্তু এই ঈশা আমার জীবন। আমি নিজের বিনিময়ে হলেও তার কোন ক্ষতি হতে দিবো না। কিন্তু এতক্ষণ তুই যে কথা গুলো বললি। সবটাই সত্যি। কিন্তু সেটা তোর দৃষ্টিকোণ থেকে। আমার দিক থেকে একবারও ভাবিস নি তুই। আমি ৫ বছর দূরে থেকেছিলাম। কিন্তু অভিমান করে নয়। তোকে ভালো রাখার জন্য। কারণ তোর উপরে আমার অধিকার বোধ এতটাই বেড়ে গিয়েছিলো যে আমি নিজেও বুঝতে পারছিলাম সেটা ঠিক হচ্ছে না। অন্তত আমাদের ভালো থাকার কারণে হলেও নিজেকে একটু সময় দেয়া দরকার। ফিরে এসে যে আমি তোর একাকীত্ব অনুভব করতে পারিনি সেটা একদম ভুল। আমি তোর কষ্টটা বুঝতে পেরেছিলাম বলেই তোর কাছে আসার চেষ্টা করেছিলাম। ভেবেছিলাম আমাদের মাঝে হয়তো সব ঠিক হয়ে গেছিলো। কিন্তু সেদিন সীমানা আপুর শশুর বাড়িতে যা হয়েছিলো সেটা সত্যিই আন এক্সপেকটেড ছিলো। তুই না বুঝেই সিন ক্রিয়েট করেছিস। আর আমিও না বুঝেই তোকে আঘাত করেছি। বাবা সেদিন সবটা শুনেছিল। সেই আগের মতই ভেবেছিলো আমি তোকে ভালো রাখতে পারবো না। তাই ছোটো বাবার সাথে আলোচনা করে। ছোটো বাবা কথাটা আমাকে জানায়। আর নিজেই বলে সবার সামনে ডিভোর্স এর কথা বলতে। যাতে এই কথা শুনে তুই অন্তত সবার সামনে নিজের মনের কথাটা বলিস। আর আমার সাথেই থাকার সিদ্ধান্ত নিস। সেটা তোর মুখে শুনলেই হয়তো বাবা নিজের দ্বিধাগ্রস্ত মনটাকে শান্ত করতে পারতো। কিন্তু তুই কোন কথা না বলেই সিদ্ধান্ত মেনে নিলি। তারপর ছোটো বাবা যখন সবটা স্বীকার করে বলল এটা শুধু মাত্র একটা নাটক ছিলো। তখন তুই নিজেকে প্রাধান্য দিয়ে সেই বাড়ি থেকে বের হয়ে এলি। পুরো ৬ টা মাস আমি তোকে নিজের মত মানাতে চেষ্টা করছি। কিন্তু কোন লাভ হচ্ছে না। তুই বরাবরের মতো তোর জেদেই স্থির। কিন্তু এখন আর সম্ভব না ঈশা। আমি ক্লান্ত। এবার আমি আর তোর কোন কথা শুনবো না।
বলেই ঈশা কে টানতে টানতে বাইরে নিয়ে যাচ্ছে। ঈশা নিজেকে ছাড়াতে চেষ্টা করে বলল
— আমাকে কোথায় নিয়ে যাচ্ছো? আমি কোথাও যাবো না। ছেড়ে দাও আমাকে।
ইভান থেমে পেছন ফিরে তীক্ষ্ণ দৃষ্টি ফেললো ঈশার দিকে। দাতে দাঁত চেপে বলল
— যেতে না চাইলে জোর করবো। এটা আমি ভালই পারি। জানিস তো।
ঈশা কোন কথা বলতে পারলো না। কারণ এরপর আর কোনো কথা বলে লাভ নেই। তাই চুপচাপ দেখতে লাগলো কি হচ্ছে।
চলবে…
(গল্পটা পড়তে আপনারা যতনা বিরক্ত লিখতে গিয়ে আমি তার থেকেও বেশী বিরক্ত। ভীষন ব্যস্ত সময় কাটছে। এই ব্যস্ততায় গল্প লিখতে পারছি না। রিচেক করা হয়নি। ভুল থাকলে ক্ষমা চেয়ে নিচ্ছি।)