অপেক্ষা_সুদূর_বর্ষণের-৩
অপারেশন থিয়েটারের সামনে রাখা বেঞ্চ গুলতে সারিবদ্ধভাবে বসে আছে সবাই। আশেপাশে নানা মানুষের আনাগোনা হলেও তাদের সেদিকে খেয়াল নেই। সবার মাঝেই অস্থিরতা কাজ করছে। রাত ১১ টা বাজে। বিকেল থেকে এখন পর্যন্ত কারো পেটে এক ফোঁটা পানিও পড়েনি। কারণ সেই বিকেলে ঈশার বাবাকে অপারেশন থিয়েটারে নিয়ে গেছে। ওনার মাথার খুলিতে একটা বড় টিউমার ধরা পড়েছে। দিনদিন তার আকার বেড়েই চলেছে। চোখে পড়ার মতো কোন লক্ষণ ছাড়াই একদিন তিনি হঠাৎ করেই অসুস্থ হয়ে পড়েন। আর তৎক্ষণাৎ তাকে হাসপাতালে নেয়া হয়। ডাক্তার অনেক পরীক্ষা নিরিক্ষা করার পর রিপোর্ট দেখে জানিয়ে দেয় যে ওনার মাথার খুলিতে টিউমার। যত তাড়াতাড়ি সম্ভব অপারেশনটা করে ফেলতে। না হলে বড় বিপদ হয়ে যাবে। এমনকি ওনার মৃত্যুও হতে পারে। কিন্তু তিনি কিছুতেই অপারেশন করাতে চান নি। বারবার একই কথা বলছিলেন যে ইভান না ফেরা পর্যন্ত তিনি অপারেশন করাবেন না। কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত ঠিক সেদিনের পর থেকেই ইভানের কোন খবর পাওয়া যাচ্ছিল না। ডক্টর এদিকে বারবার তাড়া দিচ্ছিল। কিন্তু তিনি নিজের জেদ থেকে কিছুতেই বের হচ্ছিলেন না। ইভানের সাথে যোগাযোগের অনিশ্চয়তার মাঝেই একদিন হুট করে বাংলাদেশের একটা নাম্বার থেকে ইলহামের নাম্বারে ফোন আসে। ইলহাম ফোন ধরেই জানতে পারে ইভান দুইদিন আগে দেশে এসেছে কিন্তু ব্যস্ততার কারণে কাউকে জানাতে পারে নি। আর সে এখনই জানাতে চায়নি কারণ জানলেই তাকে বাড়িতে আসার জন্য জোর করবে। আর সে বাড়িতেই যেতে চায় না। তাই ইরার সাথেও যোগাযোগ করেনি। কিন্তু ইলহামের কাছে যখন সবটা জানতে পেরেছে তখন আর এক মুহূর্তও দেরি করেনি। চলে এসেছে হাসপাতালে। ঈশার বাবার সাথে দেখা করে তার অপারেশনের ব্যাবস্থা করতে। এসেই জানতে পারে যে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছে সেটা তারই বন্ধু রিহাবের বাবার। তাই তো সে সমস্ত দায়িত্ব নিজের মতো করে পালন করছে। এসব নিয়ে আর কাউকে ভাবতে দেয়নি। ইভানের কথা মতোই রিহাব বড় বড় ডাক্তারদেরকে নিয়ে একটা মেডিকেল টিম গঠন করে অপারেশনের যাবতীয় ব্যাবস্থা করে ফেলে। খুব দ্রুত সিদ্ধান্ত নিয়েই আজ বিকেল থেকে অপারেশন শুরু করে। দীর্ঘ সময় ধরে চলা এই অপারেশন কখন শেষ হবে বাইরে অপেক্ষমাণ ব্যাক্তিদের জানা নেই। সবাই এক জায়গায় থাকলেও ইভান কে দেখা যাচ্ছে না। সে খুব ব্যস্ত। ঈশা এতক্ষন চেয়ারে মাথা এলিয়ে দিয়ে চুপচাপ বসে ছিল চোখ বন্ধ করে। কিন্তু যত সময় যাচ্ছে তার ভেতরের অস্থিরতা ততই বেড়ে যাচ্ছে। সে জানে না তার বাবা ঠিক সুস্থ হয়ে ফিরবে নাকি হারিয়ে ফেলবে সে বাবাকে। বুকের ভেতরে কেমন চিনচিন করে উঠে চোখের কোণে পানি জমে গেলো। পানি চোখের কোন বেয়ে গড়িয়ে পড়লো। সে উঠে দাঁড়িয়ে অপারেশন থিয়েটারের দরজার সামনে দাঁড়ালো। চিৎকার করে কাঁদতে ইচ্ছা করছে তার। মুখে হাত দিয়ে নিঃশব্দে চোখের পানি ফেলেই যাচ্ছে। ঠিক সেসময় পেছন থেকে ইভানের আওয়াজ কানে এলো। পেছন ফিরে তাকাতেই দেখল ইভান ঈশার মায়ের সাথে কথা বলছে। তার মায়ের সামনে হাঁটু গেড়ে বসে হাত চেপে ধরে কিছু একটা বলছে আর তার মা কেদেই যাচ্ছে। ঈশা একটু এগিয়ে আসতেই ইভান বলল
–তুমি এতো ভেঙ্গে পড় না। ছোট বাবা ঠিক হয়ে যাবে। এখন অন্তত বাসায় যাও। আমি তোমাকে সব জানাবো তো। তোমার প্রেশার বেড়ে গেছে।
ঈশার মা কিছুতেই বাসায় যেতে রাজি হচ্ছিল না। ইভান এক পর্যায়ে কিছুটা কঠিন হয়েই বলে এতো মানুষ একসাথে থাকা হাসপাতালের নিয়ম বহির্ভূত যার কারণে তাদেরকে বাড়িতে যেতেই হবে। ইভানের বাবা তার কথা বুঝতে পেরে সবাইকে নিয়ে বাড়িতে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেন। কিন্তু এবার জেদ ধরে বসে ঈশা। সে কিছুতেই বাসায় যাবে না। ইভানের বাবা কিছু বলতে গেলেও ইভান থামিয়ে দেয়। বাবাকে আশ্বস্ত করে বলে
–থাক বাবা। আমি আছি তো। ভেব না। সকালেই বাসায় পাঠিয়ে দেবো।
কেউ আর কোন আপত্তি করেনি। কারণ সবাই জানে ইভান আছে বলেই আর কোন চিন্তা নেই। রাতে ইলহাম ইভান আর ঈশা হাসপাতালে থেকে গেলো। অপারেশন যখন শেষের দিকে তখন রিহাব বেরিয়ে এলো। সবাই তাকে দেখেই ব্যস্ত হয়ে পড়লো। সে ইভানের সামনে দাঁড়িয়ে স্থির ভাবে বলল
–অপারেশন সাকসেসফুল করার যথেষ্ট চেষ্টা করা হয়েছে। কিন্তু ৭২ ঘণ্টার আগে কিছুই বলা সম্ভব হচ্ছে না। ততক্ষন নিবিড় পর্যবেক্ষণে রাখা হবে। সব ঠিক থাকলে ভালো কোন খবর আশা করতে পারি।
এমন কথা শুনে আরেকদফা হতাশ হল তারা। রিহাবের এমন কণ্ঠস্বর শুনেই ইভান বুঝে গেলো এখনো অনেকটা জটিলতা আছে। এখনো অনিশ্চয়তা আছে। যা আদৌ ঠিক হবে কিনা সেটা নিয়ে সংশয়। একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলতেই রিহাব বলল
–কিছুক্ষণের মধ্যেই বের করে আইসিইউ তে দেয়া হবে। এখনই দেখা করতে পারবি না। জ্ঞান ফেরা পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হবে।
ইভান মাথা নেড়ে পাশ ফিরে ঈশার দিকে তাকাল। তার চোখে বেয়ে অঝরে পানি পড়ছে। থেমে থেমে শরীর কেঁপে উঠছে। এই মুহূর্তে মান অভিমানের থেকেও গুরুত্বপূর্ণ ঈশাকে সামলানো। তার মনের অবস্থাটা ইভান ভালোভাবেই বুঝতে পারছে। এগিয়ে গিয়ে আলতো করে হাত ধরে ঈশাকে চেয়ারে বসিয়ে দিলো। ঈশা অনুভুতিশুন্য। সে তার আশেপাশের বর্তমান পরিস্থিতি কোনভাবেই অনুভব করতে পারছে না। ইভান পাশে বসেই পানির বোতলের ঢাকনা খুলে ঈশার দিকে এগিয়ে দিলো। ঈশা কোনরকমে একটু পানি খেয়ে আবারো কান্নায় ঢলে পড়লো। ইভান এবার মাথায় হাত রেখে আদুরে কণ্ঠে বলল
–কাদিস না। সব ঠিক হয়ে যাবে।
ঈশা কোন কিছু ভাবতে পারছে না। তার খুব কষ্ট হচ্ছে। ইভানের এক হাত চেপে ধরে জোরে কেঁদে উঠলো। তার কান্নার আওয়াজ শুনেই পাশ থেকে একজন নার্স বলল
–এখানে এভাবে কাঁদা নিষেধ। চুপ করুন।
ইভান মাথাটা আলতো করে বুকে চেপে ধরল। চুলের ভাজে হাত গলিয়ে বলল
–এভাবে কাঁদে না। শান্ত হ।
এই মুহূর্তে ঠিক কি বলে সান্ত্বনা দেয়া উচিৎ সেটা ইভান নিজেও জানে না। কারণ সে নিজেও ভেতর থেকে বিদ্ধস্ত। তবুও ঈশাকে সামলাতে চেষ্টা করছে। অস্থির ঈশা কি বুঝল কে জানে। অল্প সময়ের ব্যবধানেই নিস্তেজ হয়ে ইভানের উপরেই সমস্ত শরীরের ভার ছেড়ে দিলো। ইভান আরও শক্ত করে তাকে জড়িয়ে নিলো নিজের সাথে। কয়েক মিনিট পরেই ইলহাম এসে বলল
–ভাইয়া। রিহাব ভাইয়া তোমাকে ডাকছে।
ইলহামের কথা শুনেই ঈশা সোজা হয়ে বসলো। চোখের পানি মুছে চেয়ারে মাথা ঠেকিয়ে চোখ বন্ধ করে ফেললো। ইভান কয়েক সেকেন্ড তার দিকে তাকিয়ে থেকে উঠে গেলো রিহাবের কাছে। কিছুটা দূরেই দাঁড়িয়ে তাদেরকে দেখছিল রিহাব। ইভান সামনে গিয়ে দাঁড়াতেই ঈশার দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করলো
–কে ও?
ইভান ঘাড় বেকিয়ে এক পলক ঈশাকে দেখে নিয়ে সামনে তাকাল। বলল
–ঈশা। আমার চাচার বড় মেয়ে।
রিহাব অদ্ভুত ভাবে উচ্চারন করলো
–ওহ! ওর বাবার অপারেশন?
ইভান ক্লান্ত স্বরে বলল
–হ্যা। আসলে ওর সাথে ছোট বাবার এটাচমেন্ট টা একটু বেশীই। তাই এতো ভেঙ্গে পড়েছে।
–শুধুই কি কাজিন?
রিহাবের সন্দিহান কথা শুনে ইভান সরু চোখে তাকাল। বলল
–মানে?
রিহাব মৃদু হেসে বলল
–যেভাবে সামলাচ্ছিস বিষয়টা কিন্তু একটু অন্যরকম।
ইভান রিহাবের এই কথার উত্তর দিতে চায়না। তাই বিষয়টাকে সম্পূর্ণ এড়িয়ে গিয়ে বলল
–তুই কি কাজ রেখে আমাকে নিয়ে গবেষণা করতে শুরু করলি?
রিহাব হেসে উঠলো। বলল
–গবেষণা করতে হয়না বন্ধু। অনেকদিন তো চিনি তোকে। এর আগে কখনো কোন মেয়ের ধারের কাছেও দেখিনি। আর এখন চোখের সামনে যা দেখছি তাতে যে বিষয়টা কাজিন পর্যন্ত সীমাবদ্ধ নয় সেটা বোঝার ক্ষমতা আমার আছে। তুই মুখে যাই বল না কেন তোর চোখ কিন্তু অন্য কথা বলছে। তোর গার্ল ফ্রেন্ডের মতো গভীর ভাবে বুঝতে না পারলেও কিছুটা বুঝতে পারছি।
ইভান হসে ফেলে বলল
–তুই ঠিক হবি না। আগের মতোই আছিস।
রিহাব হাসল। হাতের ফাইলটা তুলে বলল
–কিছু ফর্মালিটিজ আছে সেগুলা পুরন করতে হবে। হাসপাতালে আনার সময় যে ফর্ম ফিলাপ করেছিলো তার কিছু সাইন লাগবে।
ইভানের ফোন বেজে উঠলো উচ্চ শব্দে। হালকা মাথা নেড়ে ফোনটা তুলে কানে ধরল সে। রিহাব ফাইলটা খুলে কিছু বলতে গিয়েও থেমে গেলো। ইভান ফোনে কথা বলতে বলতেই তার দিকে খেয়াল করছে। কিছুটা ভ্রু কুচকে ফাইলের কাছাকাছি মুখটা নিয়ে গিয়ে গভীর ভাবে তাকাল। মুহূর্তেই চোখ ভর্তি বিস্ময় নিয়ে ইভানের দিকে তাকাল। ইভান সবটাই খেয়াল করছিলো কিন্তু কিছুই বুঝতে পারছিল না। আরও কিছুক্ষন ফাইলের দিকে তাকিয়েই বিস্ময়কর কণ্ঠে কিছুটা উত্তেজিত হয়েই উচ্চারন করলো
–মিসেস ইভান!
ইভান থমকে গেলো। বিস্ময়ে তার মুখ হা হয়ে গেলো। বিষয়টা ভালভাবে বুঝতেই রিহাবের দিকে তাকাল নিস্পলক। রিহাব ইভানের দিকে তাকিয়ে চেচিয়ে বলল
–পেশেন্ট এর ভর্তি ফরমে মিসেস ইভানের সাইন?
ইভান কিছু বলার আগেই পেছন থেকে ঈশার মিহি কণ্ঠ কানে এলো
–জি?
রিহাব ইভানের ঘাড়ের উপর দিয়ে সোজা পেছনে ঈশার দিকে তাকাল। বিস্ময়কর কণ্ঠে বলল
–আপনি মিসেস ইভান?
ঈশা আবারো মিহি কণ্ঠে বলল
–জি।
বলেই এগিয়ে এসে ইভানের পাশে দাঁড়ালো। ইভানের হাত থেকে ফোনটা নীচে পড়ে গেলো। ঈশা এক পলক তার দিকে তাকিয়ে ফোনটা তুলে নিয়ে হাত বাড়িয়ে ইভান কে বলল
–নাও।
ইভান নিস্পলক ঈশার দিকে তাকিয়ে আছে। সবকিছু তার মাথার উপর দিয়ে চলে যাচ্ছে। ঈশা আবারো বলল
–ফোনটা নাও।
ইভান সম্ভিত ফিরে পেলো। ফোনটা হাত থেকে নিতেই ঈশা রিহাবের দিকে তাকিয়ে বলল
–কিছু বলবেন?
রিহাব রোবটের মতো বলল
–আপনার সাইন লাগবে।
ঈশা ফাইলটা নিয়ে পুরো নামটা গোটা গোটা করে লিখে ফেললো “মিসেস ইভান মাহমুদ“। ঈশা ফাইলটা রিহাবের হাতে ধরিয়ে দিয়েই আর অপেক্ষা করলো না। সেখান থেকে চলে গেলো। ইভান রিহাবের হাত থেকে ফাইলটা এক প্রকার ছিনিয়ে নিলো। সেদিকে অবাক চোখে তাকাতেই রিহাব কলার চেপে ধরে বলল
–তুই বিয়ে করে ফেলেছিস অথচ আমাকে বলার প্রয়োজন মনে করিস নি? আমি অবাক হয়ে যাচ্ছি ইভান। আগেই আমার সন্দেহ হয়েছিলো।
ইভান হতাশ শ্বাস ছেড়ে ফাইলটা রিহাবের হাতে ধরিয়ে দিয়ে দাঁতে দাঁত চেপে বলল
–আমি যে বিবাহিত সেটা আমি নিজেই আজ জানলাম।
বলেই দ্রুত পায়ে হেটে ঈশার সামনে গিয়ে দাঁড়ালো। ঈশা এক পলক তার দিকে তাকিয়ে আবার নিচের দিকে তাকাল। ইভান ঈশার দুই বাহু চেপে ধরে রাগী সরে বলল
–কি হচ্ছে এসব ঈশা? তুই এসব করে ঠিক কি প্রমান করতে চাইছিস?
ঈশা ইভানের দিকে তাকাল। কাঁপা কাঁপা গলায় বলল
–বাবা যদি ফিরে আসে তাহলে তোমার এই প্রশ্নের উত্তর তার কাছ থেকেই নিয়ে নিও। আমি কিছুই প্রমান করতে চাইনি। এটাই সত্যি। যদি বাবা সুস্থ হয় তাহলে তোমার সব প্রশ্নের উত্তর তুমি পাবে।
ইভান ছেড়ে দিলো ঈশাকে। ঈশা নিজের হাত বাড়িয়ে ইভানের সামনে ধরল। তার হাতে আংটিটা দেখে ইভান চমকে গেলো। এটা সেই আংটি যা এঙ্গেজমেন্টের সময় ঈশা ইভান কে পরিয়ে দিয়েছিলো। কিন্তু ৫ বছর আগে বাড়ি থেকে বের হওয়ার সময় ইভান সেটা খুলে ঈশার বাবার হাতে ধরিয়ে দেয় আর বলে সে এই সম্পর্ক আর এগিয়ে নিতে চায় না।
চলবে…