অপেক্ষা_সুদূর_বর্ষণের-৪
–এটা বাবা তোমাকে দিতে বলেছে।
ইভান আর কোন কথা বলতে পারলো না। ঈশার হাত থেকে আংটিটা নিয়ে সেটার দিকে তাকিয়ে থাকলো। ঈশা সেখানে আর দাঁড়ালো না। এক ফোঁটা চোখের পানি ফেলে অন্যদিকে গিয়ে একা বসে থাকলো। সে কিছুটা সময় একা থাকতে চায়। ইলহাম এগিয়ে এসে বলল
–মনে আছে যেদিন তুমি চলে যাচ্ছিলে সেদিনের কথা?
ইভান আংটিটা মুঠো বন্দি করে নিয়ে তার দিকে তাকাল। ইলহাম হয়তো অনেক কিছুই জানে। তাই মনোযোগ দিলো শুনতে। ইলহাম মুচকি হেসে বলল
–তুমি আগের দিন রাতে যখন আংটিটা ছোট বাবাকে ফেরত দিলে তখন তুমি সেখান থেকে চলে যাওয়ার পরই ছোট বাবা সিদ্ধান্ত নেয় তোমাদের বিয়ে দেয়ার। কিন্তু বাবার আপত্তি ছিল। বাবা বারবার বলছিল ঈশা আপু এই বিয়েতে সুখী হবে না। তোমার অধিকার বোধ ঈশা আপুর জন্য গলার কাঁটা হয়ে দাঁড়াবে। তাই বাবা জেনে শুনে আপুকে তোমার হাতে তুলে দিতে চায় না। আর তোমার এই সম্পর্ক এগিয়ে না নিয়ে যাওয়ার সিদ্ধান্তকে বাবা সমর্থন করে। কিন্তু ছোট বাবা কোন কথা শুনতে নারাজ। তার এক কথা যে ঈশা আপু যদি ভালো থাকে তো সেটা তোমার কাছেই থাকবে। আর ছোট বাবা তোমার হাতে তুলে দিতে পারলেই নিশ্চিন্তে মরতে পারবে। ছোট বাবার জেদের কাছে হার মানতে বাধ্য হয় বাবা। তবে বাবা তোমাদের দুজনের সাথে কথা বলার সিদ্ধান্ত নেয়। ছোট বাবা এটাতে রাজি হন না। কিন্তু বাবার তীব্র আপত্তির কাছে কিছুটা দমে গিয়ে ঈশা আপুর সাথে কথা বলার অনুমতি দেন। কিন্তু তোমাকে জানাতে না করে। কারণ ছোট বাবা বুঝে গিয়েছিল যে তুমি জানলে কখনো এই বিয়েতে রাজি হতে না। তাই ঈশা আপুকে ছোট বাবা কিভাবে যেন রাজি করিয়ে ফেলে। তারপর তো তুমি যাওয়ার আগে রেজিস্ট্রি পেপারে তোমার কাছ থেকে কৌশলে সাইন নেয়। তখন পরিস্থিতি এমন ছিল যে কাগজটা পড়ে দেখার মতো মন মানসিকতা তোমার ছিল না। সে সুযোগটাই ছোট বাবা কাজে লাগায়। তুমি চলে যাওয়ার পর বাবা অবশ্য এসব নিয়ে খুব রাগ করে। বলে ঈশা আপুকে একটা অনিশ্চিত জীবনে ফেলে দিয়েছে ছোট বাবা। আর তুমি আদৌ ফিরে আসবে কিনা সেটা নিয়েও ছিল সংশয়। কারণ তুমি তো কারো সাথে যোগাযোগ করতে না। তবে ছোট বাবা বারবার বলতো তুমি আসবে। আর যখন আসবে তখন সব দায়িত্ব নিজের মাথায় নিয়ে নেবে। ঈশা আপুকে একটা সুখী জীবন উপহার দেবে।
ইলহাম থেমে গেলো। ইভান হাতের মুঠো আরও শক্ত করে ফেললো। রাগে মুখ থমথমে হয়ে গেলো। এটা কোনভাবেই হতে পারেনা। এতো কিছু হয়ে গেলো অথচ তাকে কিছুই জানানো হল না। সে তো এমনটা চায়নি। তার বাবা ঠিকই বলেছিল ঈশা তার সাথে কোনদিনও ভালো থাকতে পারবে না। কিন্তু ঈশার বাবা এভাবে জেদ করে কাজটা একদম ঠিক করে নি। নিশ্চয় তিনি ঈশাকে বাধ্য করেছিলেন সাইন করতে। এই জোর করে তৈরি হওয়া সম্পর্কের কোন ভিত্তি নেই। ইভান প্রচণ্ড বিরক্ত হল। এই সম্পর্ক কিভাবে এগিয়ে যাবে? আর কিভাবেই বা বের হবে সেখান থেকে? ঈশা কোনদিনও মন থেকে মেনে নিতে পারেনি। আর হতো পারবেও না। একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে সেখান থেকে চলে গেলো ঈশার কাছে। তার সাথে কথা বলা দরকার। কিন্তু ঈশার কাছে যেতে পারলো না ইভান। দূর থেকেই চোখে পড়লো ঈশা এক পাশে একা একা বসে দুই হাতে মুখ ঢেকে কাঁদছে। শব্দ হচ্ছে না কিন্তু শরীর কেঁপে উঠছে। ইভান দেয়ালে জোরেশোরে হাত দিয়ে আঘাত করলো। দরজার খিল লেগে হাত কেটে গেলো। রক্ত বের হচ্ছে। কিন্তু সেদিকে তার খেয়াল নেই। ঈশার দিকে তাকিয়েই আহত সরে বলল
–তুমি কেন এটা করলে ছোট বাবা? বুঝে শুনে আমাকে কেন এতো বড় শাস্তি দিলে? আমি যে অনেক কষ্টে নিজেকে এই সবকিছু থেকে দূরে রেখেছিলাম। তুমি আবারো সেই অনুভুতিতে আঘাত করলে। একদম ঠিক করনি। আমি নিজের সুখের জন্য ঈশাকে কষ্ট দিতে পারবো না। কখনই না। তোমার কথা রাখতে গিয়ে ঈশা এতোটা কষ্ট পাচ্ছে। আমি যে কোনভাবে সহ্য করতে পারবো না। কেন আমার সাথে এই অন্যায়টা করলে?
ইভান থেমে যেতেই কেউ একজন তার ধরে ফেললো। চমকে পেছনে তাকাতেই দেখল রিহাব তার হাতের দিকে তাকিয়ে আছে। ইভানের দিকে তীক্ষ্ণ দৃষ্টি ফেলে গম্ভীর সরে বলল
–রুমে আয়।
ইভান উত্তর দেয়ার আগেই টেনে নিয়ে গেলো। হাতটা ব্যান্ডেজ করে দিয়ে তার সামনে চেয়ার টেনে বসে পড়লো। ইভান নিচের দিকে তাকিয়ে ভাবছে। রিহাব শীতল কণ্ঠে ডাকল
–ইভান।
চমকে তাকাল ইভান। বলল
–বল।
–ঘটনা যত সহজ মনে হচ্ছে ততটা নয়। আমাকে খুলে বলবি?
ইভান একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললো। আনমনেই বলল
–কি জানতে চাস?
–তোর আর ঈশার ব্যাপারটা।
ইভান হাতের মুঠো খুলে ফেললো। আংটিটার দিকে তাকিয়ে বলল
–দাদু মারা যাওয়ার কয়েক মাস আগে আমরা সবাই একবার গ্রামের বাড়ি যাই। কোন একটা প্রোগ্রাম হচ্ছিল সেখানে। আমি তখন ভার্সিটিতে আর ঈশা এইচ এস সি পরীক্ষা দেবে। ছোটবেলা থেকেই ঈশার প্রতি আমার অনুভূতিটা সবার থেকে আলাদা ছিল। সেটা হয়তো আচরনেও অনেকের চোখে পড়েছিলো। তার মধ্যে একজন ছিল দাদু। সেই সময় কি ভেবে যেন দাদু সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন ঈশা আর আমার এঙ্গেজ করিয়ে রাখতে। পড়ালেখা শেষ হলেই আমাদের বিয়ে হবে। কিন্তু ঈশার এতে আপত্তি ছিল। হয়তো আমার প্রতি তার সেরকম অনুভূতি ছিল না। কিন্তু ছোট বাবা আর বাবা কেউই দাদুর কোন সিদ্ধান্তে আপত্তি জানান নি। আর ঈশার এমন আপত্তি জানানো টা মেনে নিতে পারলো না। মোটামুটি তাকে বাধ্য করলো আমাকে আংটি পরাতে। আমি সবটাই বুঝতে পেরেছিলাম। কিন্তু তখনও কিছু বলিনি। ভেবেছিলাম হয়তো ঈশা বুঝতে পারবে আমার অনুভূতিটা। সময়ের সাথে ঠিক হয়ে যাবে। কিন্তু আমি ভুল ছিলাম। আর যাই হোক আমার অনুভূতি ঈশার কাছে একদম আলাদা ছিল। সে সেসবের মধ্যে কোনদিন ভালোবাসা দেখতেই পায়নি। বরং শুধু অত্যাচার খুঁজে পেয়েছিল। ঈশা কোন কাজ করার সময় গভীর ভাবে ভাবেনা। ভুল করে বসে। আমি চেষ্টা করি নিজের মতো সেগুলো ঠিক করার। কিন্তু মাঝে মাঝে একটু বেশী রিয়াক্ট করে ফেলি। যার ফলে ঈশা আমার কাছ থেকে শুধু কষ্টই পায়।
রিহাব সবটা শুনে বলল
–তুই বিদেশে কেন চলে গেলি?
ইভান তাচ্ছিল্য হেসে বলল
–ঈশা আমার কাছ থেকে মুক্তি চেয়েছিল। সেটাই দিতে চেয়েছিলাম। সে ভালো থাকলেই যে আমিও ভালো থাকব। কিন্তু পরিস্থিতি আজ আমাকে এমন একটা জায়গায় এনে দাঁড় করিয়ে দিলো কি করবো ঠিক বুঝতে পারছি না।
রিহাব বেশ সময় নিয়ে ভাবল। বলল
–ঈশা না চাইলে এই সম্পর্ক এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার কোন মানে হয়না। আমার মনে হয় তোর ঈশার সাথে কথা বলা দরকার। ঈশাকে সরাসরি জিজ্ঞেস করবি সে কি চায়। তার উত্তরের উপরে ডিপেন্ড করেই একটা সিদ্ধান্ত নিয়ে নে। এভাবে টানা পোড়েনের মাঝে জীবন চলে না ইভান।
ইভান একটা হতাশ শ্বাস ছেড়ে বলল
–ঈশাকে আমি খুব ভালো মতো চিনি। সে কোনদিনও এই বিষয়ে কথা বলতে রাজি হবে না। আগে হলেও হয়তো একটা চান্স ছিল কিন্তু ছোট বাবার অপারেশনের পর তো কোনভাবেই আর কথা বলবে না। যে আংটি আমি সইচ্ছায় ৫ বছর আগে খুলে দিয়েছিলাম সেই সম্পর্কে নতুন করে জড়াতে নিজে হাতেই আমাকে আংটিটা দিলো। শুধু মাত্র ছোট বাবা দিতে বলেছে বলে।
রিহাব হতাশ হয়ে বলল
–অদ্ভুত কথা তো। এভাবে কি জীবন চলে। দুটো জীবন খামাখা নষ্ট হয়ে যাবে।
–আমি আমাকে নিয়ে ভাবী না। আমার ভাবনা ঈশাকে নিয়ে। আমি অন্তত ওর জীবনটা নষ্ট হতে দেবো না। ওকে ভালো রাখাই আমার জীবনের মূল উদ্দেশ্য।
রিহাব হেসে ফেলে বলল
–তুই কি বুঝিস ঈশার মনে তোর জন্য একটু হলেও দুর্বলতা কাজ করে। বিষয়টা আমি খেয়াল করেছি।
এবার ইভান হেসে ফেললো। ঠোঁটের হাসিটা প্রশস্ত রেখেই বলল
–ঈশা সৃষ্টিকর্তার দেয়া আমার জীবনের সবথেকে মুল্যবান উপহার। আমি সারা জীবন তার যত্ন করে রেখেছি একদম ফুটন্ত গোলাপের মতো। আজ অব্দি ওকে একটা আঁচড়ও লাগতে দেই নি। ঈশার ভালোবাসার ধরনটা আলাদা। ভালো তো বাসে কিন্তু প্রকাশ করতেই তার যতো আপত্তি। আমার এতো কিছুর দরকার নেই। আসলে কি জানিস ভালোবাসা টা উন্মুক্ত হওয়া উচিৎ। তাকে তার মতোই ভালোবাসা উচিৎ। তার সব অনুভূতি আমাকে ঘিরে। হোক সেটা রাগ জেদ কিংবা ঘৃণা। অথবা অভিমান। সবকিছুই শুধু আমার জন্যই। স্বার্থপরের মতো আমি শুধু ভালোবাসা টা নিয়ে বাঁচতে চাই না। আমার যে পুরো ঈশাকেই প্রয়োজন। বেঁচে থাকতে এই সম্পর্ক থেকে এ জীবনে আর হয়তো মুক্তি মিলবে না। কিন্তু ঈশাকেও আমি ভালো থাকতে দেখতে চাই। ওকে এতো বছর যেভাবে দেখে এসেছি। এখনো সেভাবেই দেখে রাখবো। যদি কোনদিন সে আমার ভালোবাসা বুঝতে পারে তাহলে আমার জীবনে সেদিনই তাকে গ্রহন করবো। আমি অপেক্ষা করবো ঈশার জন্য। সারাজীবন।
ইভান কথা শেষ করে হাতে ধরে থাকা আংটিটার দিকে তাকাল। একজন নার্স এসে জানিয়ে দিলো ঈশার বাবাকে অপারেশন থিয়েটার থেকে বের করে আই সি ইউ তে দেয়া হয়েছে। দুজনেই বের হয়ে গেলো। সেখানে গিয়ে দাঁড়াতেই দেখল ইলহাম দেয়ালে হেলানি দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। ঈশা চেয়ারে বসে কাঁদছে। তার চেহারার দিকে তাকান যাচ্ছে না। রিহাব বলল
–আমি দেখে জানাচ্ছি কি অবস্থা।
ইভান একটা জরুরী কাজে গভির ভাবে ফোনের দিকে তাকিয়ে আছে। সম্পূর্ণ মনোযোগ সেদিকে। ঈশা তার দিকে তাকাতেই হাতের দিকে দৃষ্টি গেলো। উঠে এসে সামনা সামনি দাঁড়িয়ে বলল
–হাতে কি হয়েছে?
ইভান এক পলক তার দিকে তাকিয়ে আবার নিজের কাজে ব্যস্ত হয়েই বলল
–কিছু না।
ঈশা হাত ধরে ফেললো। থমথমে কণ্ঠে বলল
–কিভাবে কাটল?
ইভান কিছু বলার আগেই ঈশা তার চোখের দিকে তাকাল। বলল
–আমি তোমাকে খুব ভালো করে চিনি। এমন কোন কথা বলবে না যা আমার বিশ্বাস করতে কষ্ট হয়।
ঈশার কথা শুনে ইভান হেসে ফেললো। ঈশা কিছুটা বিরক্ত হয়ে বলল
–হাসছ কেন?
ইভান মুখে হাসি রেখেই কথাটা বলল
–কিছু না।
ঈশা হাতের দিকে তাকিয়ে আরও কিছু বলতে চাইল কিন্তু বলা সম্ভব হল না। আংটিটার দিকে চোখ পড়তেই সমস্ত কথা থেমে গেলো তার। আংটিটা দেয়ার সময় ঈশা ভেবেছিলো একবার খুলে দিয়েছে মানে ইভান আর সেটা হয়তো পরবে না। কারণ ইভানের আচরন সম্পর্কে ঈশা খুব ভালভাবে অবগত। একবার যেটা না বলে সেটা আর কখনো হ্যা হয়না। আবারো সেই আংটি পরার অর্থ ঠিক কি হতে পারে। তাহলে কি তাদের সম্পর্কটা ইভান স্বাভাবিক ভাবে মেনে নিলো নাকি ঈশার বাবার কথা ভেবেই দায়িত্ব পালন করছে শুধু।
চলবে……