অপ্রিয়_জনাব #Mehek_Enayya(লেখিকা) #পর্ব_০৪+০৫

0
365

#অপ্রিয়_জনাব
#Mehek_Enayya(লেখিকা)
#পর্ব_০৪+০৫

নিত্যদিনের মতো সকাল হতেই কাজে লেগে পরলো জমিদার বাড়ির গিন্নিরা। উপমা জমিনে বসে রুটি বানাচ্ছে ছায়া ভাঁজছে। পাশেই বসে ফাতু সবজি কাটছে। তুলসী নিজ হাতে উটের মাংস রান্না করছেন আর তুলি তাকে সাহায্য করছে। গৃহে মেহমান এসেছে রান্নাবান্নার জড়তর দেখেই বুঝা যাচ্ছে। সাইয়েরা মাত্র রসইকক্ষে পা রাখেন। মাংসের সুবাসে মন ভোরে উঠে তার। দৃষ্টি নত করে একবার সেদিকে তাকিয়ে বলল,
-কোনো মেহমান আসবে আজ?
-আসবে না এসেছে! ইয়াশার এসেছে গতরাতে। গ্রামের পাশ দিয়ে যাচ্ছিলো হটাৎ বৃষ্টি হওয়ায় এখানে চলে এসেছে।
রুক্ষ স্বরে বলল তুলসী। সাইয়েরা থমথমে যায়। কোনো কাজ না পেয়ে ফাতুর সাথে সবজি কাঁটতে বসে। তুলসী রান্না শেষ করে সকলের উদ্দেশ্যে বলল,
-অনেকদিন পর এসেছে ছেলেটা ভালোমতো আপ্যায়ন করতে হবে। কোনোরূপ ক্রুটি আমি দেখতে চাই না সকলে এটা মাথায় রেখো।

উপমা তুলসীর কথা শুনে নীরব ভণিতায় কাজ করতে থাকে। আজ আবার সোহরাবও আসবে। তাই উপমার মস্তিকে এখন অন্য চিন্তা ঘুরছে। রান্না শেষে ভোজনশালায় খাবার পরিবেশন করতে ব্যস্ত হয়ে পরে। উপমাকে খামখেয়ালি করতে দেখে ছায়া জিগ্যেস করে,
-তুমি ঠিক আছো উপমা?
-জি আপা।
অপ্রস্তুত ভঙ্গিতে উত্তর দেয় উপমা। একে একে সবাই উপস্থিত হয়। সবার শেষে আসে ইয়াশার। মামাজানদের সাথে সাক্ষাৎ করে খাবারের জন্য বসে। ভৃত্যরা পরিবেশন করছে। মহিলারা কিনারে দাঁড়িয়ে দেখছেন। উপমা একদম পিছনে তাই ইয়াশারের দৃষ্টি তখনও তার ওপর পৌঁছায়নি।
খাওয়া শেষে অন্দরের ভিতরের বৈঠকখানায় বসে সকলের সাথে কথা বলছিলো ইয়াশার। তুলসীকে দেখে মুখে প্রশস্ত হাসি ফুঁটিয়ে বলল,
-মামীজান ছোট ভাবিজানের সাথে পরিচয় করাবেন না?
-অবশ্যই করাবো। তাহেরা রে তোর ছোট ভাবিজানকে ডেকে নিয়ে আয়।

তাহেরা উপমাকে ডাকতে তার কক্ষে যায়। আসতে না চাওয়ার সত্ত্বেও মনের সাথে যুদ্ধ করে আসে উপমা। কাঁপা কাঁপা পায়ে সিঁড়ি বেঁয়ে নিচে নেমে আসে। রুমকি আর ইয়ামিনের সাথে দুষ্টামি করতে করতে তার নজর পরে সিঁড়ি দিয়ে আসা তরুণীর ওপর। ধীর পায়ে সামনে আসতেই ইয়াশারের মাথায় যেনো আকাশ ভেঙে পরে। চিত্তে কেমন জানো একটা চুর্ণবিচুর্ণ ধ্বনি শুনতে পায় সে। সকলের সামনে স্বাভাবিক ভাবে বসে থাকলেও মনের ভিতরে বৈশাখমাসের ঝড় চলছে সেটা শুধু উপমাই উপলব্ধি করতে পারছে।

তুলসী উপমাকে ধরে এগিয়ে নিয়ে এসে বলে,
-এইযে তোমার ছোট ভাবিজান ইয়াশার বাবা। উপমা ও হলো তোমার ফুঁপ্পাতো দেওর।
তুলসীর কথায় জমিনের দিকে দৃষ্টি নিবন্ধ রেখে সালাম দেয় উপমা। ইয়াশারও মুচকি হেসে সালামের উত্তর দিয়ে বলল,
-ভালো আছেন ছোট ভাবিজান?
ইয়াশারের কণ্ঠের এক অন্যরকম টান অনুভব করলো উপমা। কোনোরকম শুকনো ঢোক গিলে বলে,
-আলহামদুলিল্লাহ ভালো আছি ভাই।

__________________
দুপুরে উপস্থিত হয় সোহরাব। এতদিন পর ভাইকে পেয়ে দুইজনের কথার আর শেষ নেই। সন্ধ্যার পর তাহেরার কক্ষে গল্প করছিলো উপমা, ছায়া। এমন সময় কক্ষে উপস্থিত হয় ইয়াশার। তাকে দেখা মাত্রই তিনজন রমণী ঠিক করে বসে। ইয়াশার আগাগোড়া পরোক্ষ করে বলল,
-আমি কী ভুল সময়ে আসলাম?
-একদম না। ভিতরে আসো ইয়াশার ভাই।
তাহেরার কথায় ভিতরে প্রবেশ করে। চেয়ারে বসে ভাবুক স্বরে বলে,
-শুনলাম আগামীকাল নাকি চন্দ্রপুর গ্রামের স্কুল মাঠে মেলা বসবে! বড় ভাবিজান মনে আছে আমরা আগেরবার গিয়েছিলাম?
-হ্যাঁ। মনে আছে ভাই।
-চলেন তাহলে এবারও যাই। আমাদের নতুন ভাবিজানও দেখতে পারবেন এখানকার মেলা।
শেষের কথা বলে উপমার দিকে তাকায় ইয়াশার। মুখে কুটিল হাসি তার। উপমাকে জব্দ করার জন্য যে বার বার “ভাবিজান” বলছে সেটা ভালোই বুঝছে উপমা। তাই নিজ থেকেই বলল,
-আমি বেশি হাঁটাহাঁটি পছন্দ করি না ভাই তাই আপনারা নাহয় যেয়েন।
কথা শেষ করেই উঠে দাঁড়ায় উপমা। কিছু না বলে বড় বড় পা ফেলে চলে যায়। তাহেরা বুঝতে পারলো না হটাৎ উপমার হলো কী!

যাওয়ার সময় বারান্দায় দেখা হয় সোহরাবের সাথে। একদম মুখোমুখি দেখা হওয়ায় ইতস্ততবোধ করতে থাকে উপমা। পাশ কাটিয়ে যেতে উদ্যত হতেই সোহরাব পিছন থেকে বলে উঠে,
-দাঁড়ান উপমা।
স্টান হয়ে দাঁড়িয়ে যায় উপমা। এক অদৃশ্য বন্ধনে পা’জোড়া থেমে যায় তার। সোহরাব এগিয়ে এসে দাঁড়ায় উপমার স্মুখীন। বুকে দু’হাত গুঁজে গম্ভীর স্বরে বলল,
-আপনার সাথে আমার কিছু কথা ছিল।
-শুনছি?
-থাক এখন নয় আগামীকাল বলি। এখন আসতে পারেন।

উপমার মেজাজ গরম হলো। সোহরাব কী তার সাথে কোনোভাবে মজা নিলো! বিয়ের এতদিন পর আজ প্রথম কথা বলেছিলো সে। একহাতের মুঠোয় শাড়ীর কুচি ধরে দ্রুত গতিতে চলে যায়। সোহরাব এক ধেনে তাকিয়ে রইলো উপমার যাওয়ার পানে। তার মনে হলো উপমা একটু বেশিই চিকন বাতাস আসলেই উড়ে যাবে! আনমনে হাসলো সে।

অশান্ত মনে কক্ষে পায়চারি করছে উপমা। রাতের খাবারের সময় সুযোগ বুঝে ইয়াশার তাকে ছাদে আসতে বলেছে। এখন সে চিন্তায় পরে গিয়েছে কিভাবে ইয়াশারের স্মুখীন দাঁড়াবে!গৃহের কেউ দেখলে বিরাট কেলেঙ্কারি লেগে যাবে। এখন সময় রাত দশটা। উপমার জানা মতে সকলেই ঘুমের দেশে পাড়ি জমিয়েছে। দীর্ঘশ্বাস নিয়ে দ্বার খুলে। বড় একটি ঘোমটা দিয়ে হাঁটা ধরে। যত সামনে এগোচ্ছে ততই হৃদপিন্ডে তোলপাড় বাড়ছে।
শেষ সিঁড়ি ডিঙিয়ে ছাদে আসতেই এক ধমকা হাওয়া ছুঁয়ে যায় উপমার সর্বাঙ্গ। কিছু দূরেই দেয়াল ধরে দাঁড়িয়ে তামাক ধোঁয়া উড়াচ্ছিলো ইয়াশার। উপমাকে দেখতে পেয়ে ওষ্ঠ থেকে সি’গা’রেট সরিয়ে ফেলে। বড় একটি হাসি দিয়ে বলল,
-ভাবিজান, আসেন আসেন দাঁড়িয়ে কেনো আছেন?
চোখ, মুখ খিঁচে দু কদম এগোয় উপমা। ইয়াশার এগিয়ে এসে নাটকীয় ভঙ্গিতে উপমা চারপাশে ঘুরে ঘুরে দেখতে থাকে।
-মাশাআল্লাহ! শাড়ীতে তোমাকে সুন্দর লাগছে।
-আমি এসব শুনতে আসিনি ইয়াশার। আপনের যা বলার জলদি বলেন।
ওষ্ঠকোণে ক্রুটি হাসি ফুটতেই পরমুহূর্তেই সেটা গায়েপ হয়ে যায়। দেয়াল ঘেঁষে দাঁড়িয়ে দৃষ্টি নিক্ষেপ করে উপমার ওপর। অতি অসহায় কণ্ঠে জর্জরিত হয়ে বলল,
-তুমি থেকে এখন আপনি! বাহ্! আমার সাথে এমনটা কেনো করলে হুমাশা?

এই একটা প্রশ্নই যথেষ্ট ছিল উপমার চিত্তকে দুর্বল করে দিতে। কী করুণ সেই কণ্ঠস্বর! উপমা সাবধান দৃষ্টিতে এদিকসেদিক তাকিয়ে বলল,
-আমি উপমা। আপনার হুমাশা মৃত্যুবরণ করেছে বহু আগেই।
-সেটা আমিও দেখছি! কী কমতি ছিল আমার ভালোবাসায়?
উপমা প্রতিউত্তরে কিছু বলল না। মস্তিকে উচ্চারণ করার মতো কোনো বাক্যই খুঁজে পেলো না সে। শুধুই নির্বোধ চোখে তাকিয়ে রইলো।ইয়াশার উপমাকে মৌন থাকতে দেখে ঈষৎ হেসে বলল,
-ভালোবাসো নিজের স্বামীকে? আপন করে নিতে পেরেছো?
-নির্বোধের মতো কথা বলিয়েন না ইয়াশার ভাই।
-ভাই না বলে আমার এই হৃপিন্ডে ছুরি ঢুকিয়ে দেও তবেও এতো পীড়া হবে না।
উপমা আর কঠিন্য বজায় রাখতে পারলো না।যাওয়ার জন্য উদ্যত হতেই ইয়াশার আকস্মিক তার বাম হস্ত চেপে ধরে। উপমা চমকিত নয়নে তাকাতেই সহসা ইয়াশার তার দিকে ঝুঁকে তীক্ষ্ণ দৃষ্টি নিক্ষেপ করে জিগ্যেস করলো,
-এই কোমল হাত ছুঁয়েছে তোমার স্বামী? নাকি পুরো কায়াই নিজের চিহ্ন দিয়ে দিয়েছে?
এক ঝটকায় হাত ছাড়িয়ে নেয় উপমা। সে বুঝতে পারে ইয়াশার তার এবং সোহরাবের মধ্যকার সম্পর্ক জানতে চাচ্ছে। ক্রোধিত কণ্ঠে উপমা বলল,
-কথায় লাগাম টানুন ইয়াশার। আপনি ভুলে যাচ্ছেন আমি আপনার ভাইয়ের স্ত্রী।
-ভাইয়ের স্ত্রী পরে আগে তো আমার প্রিয়সী ছিলে সেটা তুমি কিভাবে ভুলে যাচ্ছ?
-আমাকে আমার থেকে ভালো তো আপনি চেনেন তাহলে আমাকে কেনো একের পর এক প্রশ্ন করছেন?
উপমা চলে যেতে পা বাড়ায়। কয়েক পা এগিয়ে যেতেই পিছন থেকে শুনতে পায় অশোভনীয় একটি বাক্য। নিজের কানকে নিজেই যেনো বিশ্বাস করতে পারলো না সে।
ইয়াশার অসন্তোষে ঝাঁঝালো স্বরে বলে,
-তোমার স্বামী তোমাকে ছুঁবে, রজনী অন্ত করবে তোমার দেহের উত্তাপে! কিন্তু তোমার দেহ, মনে তো শুধু আমার অধিকার। কিভাবে আমি সয্য করবো তোমার গায়ে অন্যকারো ছোঁয়া? বলে যাও হুমাশা?
উপমা ঘাড় বাঁকিয়ে একবার পিছনে ফিরে। ছলছল আঁখিজোড়া দিয়ে পলকহীন ইয়াশারকে দেখে দ্রুত পায়ে চলে যায়। এক প্রকার দৌড়ে সিঁড়ি থেকে নেমে আসে। পিছনে তাকে ভুত তাড়া করেছে এমনই অবস্থা! গাল বেঁয়ে অবহেলায় অশ্রু গড়িয়ে পরছে। দুমড়েমুচড়ে যাচ্ছে বক্ষস্থল। ছুটতে থাকা অবস্থায় মাথা থেকে সরে যায় শাড়ীর আঁচল। সুবিশাল বারান্দা আজ যেনো শেষ হচ্ছে না।
গ্রন্থাগার থেকে বই পড়ে নিজ কক্ষে যাচ্ছিলো সোহরাব। ঠিক সেই মুহূর্তেই সোহরাবের বুকে এসে ধাক্কা খেলো উপমা। সুঠাম, শক্ত মজবুত বুঁকের আকস্মিক ধাক্কা খেয়ে পুরো শরীর শিরশির করে উঠলো উপমার। নিজের ক্ষুদ্র দেহখানি ঠিক রাখতে না পেরে চিৎ হয়ে জমিনে পরে যায় সে।
বৈদ্যুতিক হলুদ আলোয় সোহরাব স্পষ্ট উপমাকে দেখতে পেলো। এলোমেলো অবস্থায় উপমাকে দেখে কিছু সময়ের জন্য থমকে গেলো সে। অশ্রুসিদ্ধ লাল আঁখিজোড়া দিয়ে ভয়াত দৃষ্টিতে তার দিকেই তাকিয়ে আছে। ক্ষণে ক্ষণে শরীর কম্পন পর্যবেক্ষণ করতে পারছে সে। সোহরাব দিকবেদিক ভুলে উপমাকে তুলতে যাবে তার পূর্বেই দেয়াল ধরে উঠে দাঁড়ায় উপমা। কোমরে ব্যাথা পাওয়ায় টান টান হয়ে দাঁড়াতে পারছে না তবুও সোহরাবকে উপেক্ষা করে পা আগে বাড়ায়।
কিঞ্চিৎ রাগ হলো সোহরাবের। চোয়াল শক্ত করে উপমার কাছাকাছি এসে দাঁড়ায়। দাঁতে দাঁত চিবিয়ে বলল,
-ঠিক ভাবে দাঁড়াতে পারছেন না অথচ যাওয়ার জন্য এতো তাড়া! আমি বাঘ ভাল্লুক নই।
উপমা শিউরে উঠলো। শাড়ী ঠিক করে সরে দাঁড়ালো। ভয়জড়িত কণ্ঠে বলল,
-আমি ঠিক আছি।
-আমি একজন ডাক্তার। রোগীকে দেখেই বলে দিতে পারি সে অসুস্থ নাকি সুস্থ।
-আমার আপনার চিকিৎসার প্রয়োজন নেই।
কথা শেষ করতে দেরি স্থান ত্যাগ করতে দেরি নেই। থমথমে মুখে দাঁড়িয়ে রইলো সোহরাব। ক্রোধে হাত মুঠিবদ্ধ করে ফেললো। কয়েকবার বড় বড় নিঃশাস নিয়ে নিজ কক্ষে চলে যায়।
__________________
পরেরদিন সবার আগে ঘুম থেকে উঠে উপমা। কোমরের ব্যাথায় সোজা হয়ে দাঁড়াতে পারছিলো না সে। তাই ভাবলো কুসুমগরম পানি কোমরে ঢালবে তাহলে যদি একটু আরাম অনুভব হয়। আস্তে আস্তে হেঁটে রসইকক্ষে আসে। পানির কলসি উনুনে বসিয়ে জানালা ধরে দাঁড়িয়ে থাকে। এখনও স্পষ্ট ভাবে আলো ফুঁটেনি। নীরব নির্জন জমিদার গৃহ।
পানি গরম হয়ে যাওয়ার পর উপমা পরে আরেক জ্বালায়। এই ভাঙা কোমরে কিভাবে নামাবে কলসি! দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে কলসি নামানোর জন্য প্রস্তুত হয়। আচমকা কলসি বাঁকা হয়ে উপমা পায়ের পাতায় পানি পরতে নিবে ঠিক সেই সময়েই একজোড়া হাত এসে ধরে ফেলে কলসি। উপমা ভীত চোখে সামনে তাকায় ছায়া দাঁড়িয়ে। উনুন থেকে কলসি নামিয়ে ধমকের স্বরে বলল,
-সাবধানে কাজ করবে তো এখনই গরম পানি পায়ে পরে যেত! লেগেছে কোথায়ও?
উপমা স্তব্ধ নয়নে শুধু তাকিয়ে রইলো। মাথা দু’পাশে নাড়ালো। ছায়া উপমাকে দেখে প্রশ্নবোধক চাহনি নিক্ষেপ করে বলল,
-গরম পানি দিয়ে কী করবে? আর কোমরেই বা কী হয়েছে? আঘাত পেয়েছো?
-একটু ব্যাথা পেয়েছিলাম তাই কোমরে ঢালতে গরম পানি করেছিলাম।
-ওহ।
ছায়া একজন ভৃত্যকে বলে পানি পুকুরপাড়ে দিয়ে আসতে। উপমা আর দাঁড়ালো না।
উপমা ঘাটে পা ডুবিয়ে বসে বসে ভাবছে সেই সময়ের কথা। ছায়া কিভাবে জিগ্যেস করলো! কেমন একটা বড় বোন বড় বোন অনুভূতি হচ্ছে তার! মনে এক অন্যরকম ভালো লাগা কাজ করছে। উপমা ভেবেছিলো সেদিন রাতের আক্রমণকারি ছায়া। তার স্বামীকে ছিনিয়ে নেওয়ার জন্য তাকে শেষ করে দিতে চেয়েছিলো। কিন্তু আজ ছায়ার প্রতি উপমার চিন্তাভাবনা পরিবর্তন হয়ে গেলো। সে শুধুই তাকে সন্দেহ করছিলো। ছায়ার প্রতি উপমার সম্মান আরো যেনো বেড়ে গেলো। মৃদু হেসে উপমা মনে মনে প্রতিজ্ঞা করলো, সে যে কাজের উদ্দেশ্যে জমিদার গৃহে ও সোহরাব মির্জার জীবনে এসেছে সে কাজ সম্পূর্ণ হলেই তাঁদের সকলের জীবন থেকে অনেক দূরে চলে যাবে।
পুকুরপাড় থেকে আসার সময় গৃহের প্রবেশ দ্বারে দেখা হয় ইয়াশারের সাথে। ইয়াশার বেহায়াপানা নজরে তাকিয়ে রইলো। অতঃপর ইয়ামিনকে নিয়ে পুকুরপাড়ে চলে যায়।
দুপুরে খাওয়ার সময় বাচ্চাকাচ্চারা মেলায় যাওয়ার বায়না করলো সোহরাবকে। তাঁদের সাথে সা’মিল হলো তাহেরা এবং ইয়াশার। সোহরাব প্রথমবার বারণ করলো। তাঁদের শত্রুর অভাব নেই। যদি মেলায় তাঁদের ওপর আক্রমণ করে তাহলে তাঁদের পাশাপাশি সাধারণ মানুষদেরও ভোগান্তি। তাহেরা তো ভাইজানের কাছে জেদ ধরে বসেছে যাবে তো যাবেই। ইয়াশার চোখ টিপ দিয়ে তাহেরাকে অভাবেই বায়না করতে বলে। তুলসীও বাচ্চাদের মন রক্ষার্থে সোহরাবকে যেতে বলল। অতঃপর সোহরাব রাজি হয় যাওয়ার জন্য। কিন্তু শর্ত ছিল সন্ধ্যার পূর্বে গৃহে ফিরে আসতে হবে আর সবাই একসাথে থাকতে হবে।
খুশিতে বসা থেকে উঠে দাঁড়ায় তাহেরা। উপমাকে জড়িয়ে ধরে বলে,
-ছোট ভাবিজান, বড় ভাবিজান আপনারাও আমাদের সাথে যাবেন।
তুলসী বিরক্ত হলো মেয়ের কথায়। বাড়ির বউদের এতো কেনো মাথায় তুলতে হবে! ইয়াশার একই স্বরে বলল,
-অবশ্যই বড় ভাবিজানকে তো যেতেই হবে।
-আপনারা যান ইয়াশার ভাই। আমাদের তো ঢের কাজ আছে।
-সেটা পরেও করা যাবে ভাবিজান। বিকেলে আমরা সবাই মিলে মেলায় যাবো। দেওরের এইটুকু আবদার রাখবেন না?
ছায়া আর উপমা তুলসীর দিকে তাকায়। তুলসী অনিচ্ছা সত্ত্বেও বলে,
-হ্যাঁ বউমা তোমরাও যেয়েও। ঘুরে আসলে মনদিলও ভালো হয়ে যাবে।
সবার আড়ালে চোরা চোখে ছায়া সোহরাবের দিকে তাকায়। এই একটা মুখ আজ পর্যন্ত প্রাণভরে হাসতে দেখেনি সে। সবসময়ই কী মুখে রুক্ষ ভাব এনে রাখা প্রয়োজন! সোহরাব সবার সাথে রাগ দেখালেও আজ পর্যন্ত একবারও তার সাথে উঁচু স্বরে কথা বলেননি। ছায়া আনমনে হেসে ফেলে।

_____________________
দুপুরে খাওয়া-দাওয়ার পর বিশ্রাম নিয়ে সকলে তৈরি হওয়া শুরু করে। উপমা নিজ কক্ষে হাটু মুড়ে বসেছিলো। তাহেরা তৈরি হয়ে উপমাকে ডাকতে এসেছিলো। বিছানায় বসে থাকতে দেখে কোমরে হাত দিয়ে বলল,
-ছোট ভাবিজান এখনও তৈরি হননি আপনি? ভাইজান তো সবাইকে নিচে ডাকছে।
-তাহেরা তোমরা যাও আমার একটু অসুস্থ লাগছে।
-আপনের সাথে যাওয়ার আশায় বসে আছি আমি। দোয়েয়া করে চলুন না।

উপমা পারলো না তাহেরাকে ফিরিয়ে দিতে। তাহেরা নিজ উদ্যেগে আলমিরা খুলে গোলাপি রঙের একটি কাতান শাড়ী বের করে। উপমার হাতে ধরিয়ে দিয়ে বলে,
-এটা আপনাকে অনেক মানাবে।
-কিন্তু এই শাড়ী পরে আমি হাঁটতেই তো পারবো না!
-পারবেন পারবেন। দ্রুত উঠেন।

কয়েক মিনিটের মধ্যে তাহেরা, উপমা নিচে আসে। ইয়ামিন দৌড়ে আসে উপমার কাছে। ত্বরিত দেখিয়ে বলে,
-আপনাদের দুইজনকে নিতে আমি এখানে দাঁড়িয়ে আছি। বাকি সবাই গৃহের বাহিরে।
উপমা মৃদু হেসে ইয়ামিনের গাল টেনে দিয়ে বলল,
-আমাদের ভালো ইয়ামিন বাবু। চলুন তাহলে এবার যাওয়া যাক।
-হ্যাঁ।

উঠানে দুইটা ঘোড়ার গাড়ি রাখা। ঘোড়া গুলোকে ঘাস খাওয়াচ্ছিলো সোহরাব। উপমা শুনেছিলো জমিদার গৃহের সকলে ঘোড়ার গাড়ি দিয়ে যাতায়াত করে। তার ভীষণ ইচ্ছে ছিল ঘোড়ার গাড়িতে উঠার। আজ বোধয় তার স্বপ্ন পূরণ হতে যাচ্ছে! ইয়াশারের সাথে কথা বলছিলো ছায়া। উপমাকে দেখা মাত্রই তার আঁখিজোড়া সেদিকে আটকে যায়। সোহরাব ভুল করেও উপমার দিকে তাকালো না। প্রথম গাড়িতে বসলো ইয়াশার, ছায়া, তাহেরা আর সাইফা। ছায়া উস্কখুস্ক করতে থাকে। সে সোহরাবের সাথে যেতে চেয়েছিলো কিন্তু এখন যেহেতু বসে পরেছে তাই আর নামতে পারলো না। সোহরাবের ইশারায় গাড়ি চালক ঘোড়া টগবগিয়ে ছুটে যায়। দ্বিতীয় গাড়িতে বসলো উপমা, রোমানা, ইয়ামিন আর সোহরাব। একদম মুখোমুখি বসেছে সোহরাব ও উপমা। গাড়ি চলতে শুরু করলো আঁকাবাঁকা রাস্তায়। স্থির হয়ে বসতে পারছে না উপমা। বারে বারে এক জায়গা থেকে আরেক জায়গায় সরে যাচ্ছে। উপমার অবস্থা দেখে না চাওয়ার সত্ত্বেও সোহরাব উপমার একহাত ধরে ঘোড়ার গাড়ির ছোট জানালার ওপর রাখে যাতে সেখানটায় ভর দিয়ে আরাম করে বসতে পারে। উপমা আড়চোখে সোহরাবের দিকে তাকিয়ে তেমন কোনো প্রতিক্রিয়া করলো না।
কয়েক মিনিটের মধ্যেই তাঁদের গাড়ি থেমে যায়। উপমা জানালা দিয়ে উঁকি দিয়ে দেখতে পায় তারা মেলায় এসে পরেছে। এতো ভীড় দেখে উপমার বাহিরে পা রাখতে মন চাইলো না। তবুও সবার দেখা দেখি বের হয়।
এক ঘন্টার মতো ঘুরাঘুরি করে, সকলে টুকটাক কেনাকাটা করে ফিরে যাওয়ার জন্য প্রস্তুত হয়। উপমা ইয়াশারের জন্য এমনেই বিরক্ত তাই সবার আগে সে-ই ঘোড়ার গাড়িতে উঠে বসে।
বাড়ির উদ্দেশ্যে গাড়ি চলতে থাকে। এখন এক গাড়িতে বসেছে ছায়া, উপমা, ইয়ামিন আর সোহরাব। আরেক গাড়িতে বাকি সবাই। সূর্য ডুবে যাচ্ছে পশ্চিম আকাশে। মাটির রাস্তা ধরে পথ চলছে। ইয়াশারদের গাড়ি অনেক দূর চলে গিয়েছে। আচমকা ছায়া অসুস্থ হয়ে পরে। বমি করে দেয়। সোহরাব চালককে গাড়ি থামাতে বলে। উপমা ছায়াকে ধরে বাহিরে নিয়ে আসে। সোহরাবের ষষ্ঠইন্দ্রিয় বলছে এখানে কিছু গন্ডগোল আছে। আরেকদিকে ছায়ার অবস্থা করুণ। বমি করতে করতে নিস্তেজ হয়ে পরেছে তার শরীর। সোহরাব সতর্ক চোখে আশেপাশে দেখে উপমার উদ্দেশ্যে বলল,
-আপনি ছায়াকে নিয়ে দ্রুত গাড়ির ভিতরে বসুন।
-কিন্তু আপায় তো বমি করেই যাচ্ছে। এমন্ত অবস্থায় গাড়িতে বসবে কিভাবে?
সোহরাব উপমাকে ধমকের স্বরে বলে,
-যেটা বলছি সেটা করুন উপমা।
উপমা মাথা নত করে ফেলে। ছায়াকে ধরে এক পা দু পা গাড়ির দিকে এগোতে নেয় এমন সময় উপমার ঠিক বামপাশ দিয়ে বাতাসের গতিতে ছুটে যায় ব’ন্দু’কের গু’লি। নিশানা ভুল হওয়ায় কারো গায়েই লাগে না। আঁতকে উঠে উপমা। সোহরাব বুঝতে পারে এরা আর কেউ নয় মুহিব চৌধুরীর সৈন্যদল। ক্ষণেই তাঁদের তিনজনকে ঘিরে ধরে শত্রু। সোহরাব ওপর দিয়ে শক্ত অটল থাকলেও ভিতর ভিতর সে ভয় পাচ্ছে। সে কোনো চলচ্চিত্রের নায়ক নয় যে এতগুলো লোকের সাথে একাই যুদ্ধ করে বিজয়ী হবে। একা হলেও নাহয় পালিয়ে যাওয়া যেত কিন্তু বাকিদের কী হবে!
অপ্রস্তুত অবস্থায় সোহরাবের পানে তাকায় উপমা। সোহরাব ইশারায় তাকে বলে সুযোগ পেলেই যেনো গাড়িতে যেয়ে বসে। উপমা ধীরে মাথা নারায়। শত্রুগণ ঝাঁপিয়ে পরবে তার আগেই সোহরাব তার পাঞ্জাবীর পকেট থেকে নিজের বন্দুক বের করে। একে একে সই করতে থাকে। উপমার ভীত মুখশ্রী রূপ নেয় বিস্ময়। সোহরাবেরও বন্দুক আছে!
তাঁদের চোখে ফাঁকি দিয়ে সামনে যেতে নেবে তখনই একজন বাঁশ দিয়ে উপমার পিঠে আঘাত করে। ব্যাথায় জর্জরিত হয়ে আর্তনাদ করে উঠলো উপমা।
নিজেকে ধরে রাখতে না পেরে উঁবু হয়ে মাটিতে পরে যায়। আরেক পাশে ছিটকে পরে ছায়া। সোহরাবের বন্দুকের গুলি শেষ প্রায়। তাকেও বাঁশ দিয়ে আঘাত করে। উপমা গাড়ির চালককে চোখের ইশারায় বলে একটা লাঠি তার দিকে এগিয়ে দিতে। চালক বুঝতে পেরে সকলের চোখে ফাঁকি দিয়ে উপমাকে একটি লাঠি দেয়। সোহরাব একবার আঘাত খাচ্ছে তো আরেকবার দিচ্ছে। সহজে হার মানার পাত্র সে নয়। উপমা লাঠি নিয়ে উঠে দাঁড়ায়। কোমরে শাড়ীর আঁচল পেঁচিয়ে সোহরাবের সাথে মিলে লোকদের ইচ্ছে মতো পিটাচ্ছে। সোহরাব ঠোঁটের পাশের র’ক্ত মুছে সহসা একবার উপমা পানে তাকায়। চালক সুযোগ বুঝে ছায়াকে ধরে গাড়িতে নিতে উদ্যত হয় তার আগেই বন্দুকের গুলি ছায়ার পিঠ চিরে বুক দিয়ে বেরিয়ে আসে। নিম্নস্বরে গো’ঙা’তে গো’ঙা’তে মাটিতে লুটিয়ে পরে নিথর দেহ। একবার উপমা তো একবার সোহরাব কে ডাকতে চাইলো কিন্তু কণ্ঠনালী দিয়ে কোনো শব্দই উচ্চারণ করতে পারলো না। র’ক্তে রঞ্জিত হয়ে উঠে ভূমিতল।
উপমা প্রথমে সেদিকে খেয়াল করেনি। এতক্ষনে দুইজনকে মেরে মাটিতে ফেলে দিয়েছে। তার শরীরও দুর্বল হয়ে পরে। পিছনে ঘোড়ার ডাক শুনতে পেয়ে উপমা পিছনে তাকায়। জমিদার গৃহের সৈন্যদল এসেছে। তাঁদের দেখতে পেয়েই পালিয়ে যায় সবকয়টা। সোহরাব ক্ষেপা বাঘের মতো গর্জন করছে। পরিহিত পাঞ্জাবী ছিঁড়ে জায়গায় জায়গায় র’ক্ত ভেসে উঠেছে। ভয়ংকর কোনো দানবের মতো লাগছে তাকে! উপমা দুর্বলচিত্তে ধপ করে জমিনে বসে পরে। বিধ্বস্ত দু’চক্ষু ছায়াকে খুঁজতে থাকে। একটু দূরেই অবচেতন হয়ে পরে আছে চালক। তার ঠিক পাশে নজর পরতে বীভৎস এক আর্তচিৎকার করে উঠলো উপমা।
-আপা!

#অপ্রিয়_জনাব
#পর্ব_০৫

সন্ধ্যা পরেছে। আঁধারে ঢেকে গিয়েছে চারপাশ। দূর থেকে শিয়ালের ডাক শোনা যাচ্ছে। বিধ্বস্ত অবস্থায় উপমা ছুটে যায় ছায়ার নিথর দেহের কাছে। শব্দ করে জমিনে বসে পরলো। ছায়ার দেহ নিজ কোলে নিয়ে কয়েকবার ডাকলো। মৃদু চাপর দিলো গালে। সোহরাব ততক্ষনে তাঁদের কাছে চলে এসেছে। ছায়ার হাতের শিরা পরীক্ষা করে দ্রুত তাকে শহরে নিয়ে যাওয়ার ব্যবস্থা করা হলো। কয়েকজন থেকে বাকি সৈন্যদল ছুটে পরলো শত্রুর তালাশে। সোহরাব যাওয়ার পূর্বে তাঁদের উদ্দেশ্যে বলল,
-আমাদের সাথে দুইজন চলো আর দুইজন গৃহে যাও। গৃহের সবাইকে বলবে আমরা ছায়াকে নিয়ে শহরে যাচ্ছি ওর অবস্থা শোচনীয়। বাদ বাকি তোমরা তাঁদের পিছু নেও।

গৃহের বৈঠকখানায় চিন্তিত ভঙ্গিতে বসে আছে সকলে। তুলসী থেমে থেমে কাঁদছে। একবার ছায়ার জন্য তো একবার নিজ পুত্রের জন্য বুক ধকধক করছে তার। তার ওপর মায়া হচ্ছে উপমা নামক যুবতীর জন্য। কিছুক্ষন আগেই খবর এসেছে উপমার আম্মা আর দুনিয়ায় নেই। বিকালে ঘুমিয়েছিল বেশ সময় ঘনিয়ে আসার পরও যখন উঠছিলো না তখন পাশের বাড়ির এক মহিলা তাকে ডাকতে আসে। জানালা দিয়ে দেখতে পায় মাটির ঘরের চকিতে অবচেতন হয়ে পরে আছে সে। কয়েকবার ডাকলো সকলে মিলে। যখন দেখলো কোনো সাড়াশব্দ নেই তখন কাঠের দ্বার ভাঙতে হলো। গ্রামের এক বৃদ্ধ মহিলা এগিয়ে এসে শ্বাসপ্রশ্বাস পরীক্ষা করে দেখলো সে আর জীবিত নেই। যেহেতু তাঁদের পরিবারের আর তেমন কোনো সদস্য নেই তাই গ্রামবাসীরা জমিদার গৃহে খবর পাঠালো।
এখন উপমাকে বলতে তো হবেই। তাই ইয়াশার আর আলাউদ্দিন ত্বরিতগতিতে হাসপাতালের উদ্দেশ্যে বেরিয়ে পরেছেন।

তাহেরা আম্মার পাশে বসে ভাঙা স্বরে বলল,
-আম্মাজান আমার ভাবিজানদের জন্য চিন্তা হচ্ছে। ছোট ভাবিজান কিভাবে সয্য করবে তার আম্মার মৃত্যুর খবর!
-আমিও সেটাই ভাবছি রে মা। ছায়ার আম্মা আব্বা রওনা দিয়েছে। মেয়ের এই অবস্থায় কোন আম্মা আব্বার বসে থাকতে মন চায়!
ফুঁপিয়ে উঠে তুলসী। মিনা তার পাশে বসে সান্ত্বনা দিচ্ছে। সাইয়েরা ইয়ামিনকে নিয়ে বসে আছে। সেইসময় সোহরাবদের গাড়িতে সেও ছিল। মারামারি, র’ক্ত দেখে ভীষণ ভয় পেয়েছে সে।
-আম্মাজান নিজেকে শক্ত করো। দেখিও বড় ভাবিজানের কিছু হবে না।
আম্মাকে জড়িয়ে ধরে তাহেরা। তুলসী এবার শব্দ করে কেঁদে দেয়। বিলাপ স্বরে বলল,
-তোর কথাই যেনো আমার খোদা রাখে মা।

হাসপাতালের বারান্দায় পায়চারি করছে সোহরাব। ললাটে, ওষ্ঠে বিন্দু বিন্দু র’ক্ত জমে শুকিয়ে আছে। পাতানো বসনিতে বসে আছে উপমা। পিঠের আঘাতটা মোটামুটি ভালোই লেগেছে যার জন্য সোজা হয়ে বসতে বা দাঁড়াতে পারছে না সে। উপমার মস্তিকে বারবার ভেসে উঠছে ছায়ার চিত্র। মন বলছে আজ নিশ্চই কোনো খারাপ কিছু হবে। অকারণেই অস্থির অনুভব করছে উপমা। বুক ভার ভার লাগছে তার।

-ভাইজান।
অপরিচিত নারীর কণ্ঠস্বর শুনে ঘাড় বাঁকিয়ে তাকায় উপমা। সুশীল পোশাক পরিহিত, মাথা ওড়না দিয়ে ঢাকা বেনুনি করা কেশ বুকে ছড়িয়ে আছে। অতিরিক্ত ফর্সা স্বচ্ছ মুখশ্রী। মুখের গড়ন অনেকটা সোহরাবের মতোই মনে হলো উপমার।
সোহরাবের দিকে এগিয়ে এসে চিন্তিত, ভয়াত কণ্ঠে বলল,
-ভাইজান আপনে এই অবস্থায় এখনও এখানে দাঁড়িয়ে আছেন! দ্রুত আসেন মুখ পরিষ্কার করে ঔষধ লাগিয়ে নিন।
-এগুলো তেমন কিছু না বোন।
পাশে ফিরতেই সোহরাবের নজর পরে এলোমেলো অবস্থায় বসে থাকা উপমার পানে। তাহসিয়াকে দৃঢ় স্বরে বলল,
-তুমি বরং উনাকে নিয়ে যাও। পিঠে বড়োসড়ো আঘাত পেয়েছেন।
-কে সে? আর বড় ভাবিজানের শরীর এখন কেমন?
-ডাক্তার কিছু বলেনি এখন পর্যন্ত। আর উনি উপমা।

তাহসিয়া আর কিছু জিগ্যেস করলো না। উপমা নাম শুনেছে সে তাহেরার মুখে। অকারণেই এই মেয়ের ওপর অনেক রাগ তার। কেনো সেটা সেও জানে না। ভাইয়ের কথা মতো এগিয়ে যায় উপমার কাছে। আগাগোড়া পরোক্ষ করে বলল,
-আপনি আসুন আপনার চিকিৎসার প্রয়োজন।
-আমি ঠিক আছি।
খানিকটা বিরক্ত হলো তাহসিয়া। দেখাই যাচ্ছে ঠিক নয় তবুও কেনো বলছে ঠিক আছে! বিরক্তমাখা গম্ভীর স্বরে বলল,
-তর্ক আমার পছন্দ নয়। আসুন দ্রুত।
উপমা উঠে দাঁড়ালো। তরুণীর কথা শুনে সে বুঝে গিয়েছে এটা সোহরাবের বোন তাহসিয়া। তার মতোই গম্ভীর আর রুক্ষ স্বভাবের মানুষ। তাহসিয়ার সাথে সামনে এগিয়ে যাচ্ছিলো সেই সময় উপস্থিত হয় ইয়াশার আর আলাউদ্দিন। উপমা দ্রুত এলোমেলো শাড়ী ঠিক করে মাথায় ঘোমটা তুলে। ইয়াশার সোহরাবের উদ্দেশ্যে বলল,
-ভাইজান ঠিক আছে আপনারা?
-এইতো।
ছোট উত্তর দেয় সোহরাব। ইয়াশার দুর্বলচিত্তে একবার উপমা একবার সোহরাবকে দেখে শান্ত স্বরে বলল,
-ছোট ভাবিজানকে এখন আমাদের সাথে যেতে হবে ভাইজান।
ইয়াশারের কথার আগামাথা বুঝলো না সোহরাব ও উপমা। উপমা ছোট ছোট চোখে তাকিয়ে রইলো। সোহরাব প্রশ্নবোধক দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলল,
-মানে? সেও সুস্থ নয় চিকিৎসার প্রয়োজন এখন কিভাবে যাবে?
-ছোট ভাবিজানের আম্মা মারা গিয়েছে ভাইজান।
কম্পিত ধ্বনি উচ্চারণ করে কথাটা বলল ইয়াশার। বাক্য শেষ হতেই ধপ করে জমিনে বসে পরলো উপমা। মস্তিক কেমন ফাঁকা হয়ে বক্ষস্পন্দন থেমে গেলো তার। ঝাপসা নয়নে ইয়াশারের দিকে তাকিয়ে রইলো শুধু।
তাহসিয়ার ভীষণ মায়া হলো মেয়েটির ওপর। এমনিতেই তো দুর্বল ছিল, এখন এইরকম একটি বাক্য শুনে মেয়েটি সম্পূর্ণ ভেঙে পরেছে। সোহরাব নিস্পলক উপমার পানে তাকায়। মনের ভিতরের ঝড় বুঝার প্রয়াস করলো মাত্র মা হারা মেয়েটির।

সোহরাব এগিয়ে আসতে নিলে উপমা সবাইকে অবাক করে দিয়ে উঠে দাঁড়ায়। যে মেয়ে কিছুক্ষন পূর্বে ব্যাথায় সোজা হয়ে দাঁড়াতে পারছিলো না সেই মেয়ে এখন টানটান হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। মনের পীড়ায় কী মানুষ শরীরের পীড়ার কথা ভুলে যায়! ভাবলো সোহরাব। উপমা ভীতিকর ভাঙা কণ্ঠে বলল,
-আমাকে আমার মায়ের কাছে নিয়ে চলুন।

চমকিত ভঙ্গিতে দৃষ্টি তুলে উপমাকে দেখলো সোহরাব। রুদ্ধ শ্বাস ছেড়ে ইয়াশারকে বলল,
-তাকে নিয়ে যাও ইয়াশার। আমি এখানে থাকি।
-ঠিক আছে ভাইজান।
-ভাইজান আমিও যাই তাঁদের সাথে?
তাহসিয়ার কথায় হ্যাঁ বোধক মাথা নারায় সোহরাব। যাওয়ার পূর্বে সোহরাবের কথা মতো তাহসিয়া উপমাকে জোর করে একটা ব্যাথার ঔষধ খাইয়ে দেয়। অতঃপর তারা বেরিয়ে পরে। হাসপাতালে রয়ে যায় সোহরাব আর আলাউদ্দিন।

______________________
নিজ গৃহের দ্বারে পা রাখতেই সর্বাঙ্গ কেঁপে উঠে উপমার। যেই বাড়ি সবসময় নির্জন নীরব থাকতো আজ সেই বাড়িতে মানুষের সমাগম। উপমাকে দেখে সকলে দূরে সরে যায়। রাস্তা বানিয়ে দেয় তার যাওয়ার জন্য। তাঁদের ছোট উঠানের মধ্যখানে পাটিতে শুয়িত মাকে দেখে বুকের পাঁজরে ব্যাথা অনুভব করলো। হাত পা গুটিয়ে মায়ের মৃত দেহের পাশে বসে পরে। নরম স্বরে ডাকলো,
-মা, ও মা। উঠো না মা। দেখো তোমার মেয়ের বুকে ব্যাথা করছে অনেক, মনে হচ্ছে কেউ ছু’রি চালাচ্ছে। তুমি না তোমার মেয়ের কষ্ট সহ্য করতে পারো না! উঠো না।

অঝোরে কেঁদে দিলো উপমা। মায়ের বুকে মাথা রেখে অশ্রু বিসর্জন দিতে থাকলো। আশেপাশে দাঁড়ানো সকলে করুণ নয়নে দেখতে থাকলো সদ্য এতিম হওয়ার মেয়ের বেদনা। কয়েকজন নিম্নস্বরে নিজেদের মধ্যে আলোচনা করলো,
-মাইয়াডারে বিয়া দিয়া ভালো করছিলো নইলে অহন কী হইতো।
-হো। এতিম যুবতী মাইয়াডারে বেডারা নিজে গো ভোগের জিনিস বানাইতো।
তাঁদের কথায় তাল মিলিয়ে আরেকজন বলল,
-কিন্তু মাইয়ার জামাইর বাড়ি থেইকা কেউ আহে নাই? হুনছিলাম জমিদারের বড়ো পুলার লগে বিয়া দিছিলো।
-হো। বুঝো না বুইন(বোন), বড়োলোক গো কাসে(কাছে) কী আর গরিব গো দাম আছে নি।
-তাও তো মাইয়াডার রাজ কপাল!কয়জনের নসিব এমন ওহে।

উপমা বুক থেকে মাথা তুলে কাপড় সরিয়ে মুখ দর্শন করে। গালে হাত বুলিয়ে দিয়ে বলল,
-মা গো তুমি তো জানো তুমি ছাড়া এই দুনিয়ায় আমার আপন কেউ নেই। আজ স্বার্থপরের মতো তুমিও আমাকে রেখে চলে গেলে! একা আমি কী করবো? কার সাথে মনের কথা বলবো? কে আমাকে আদর করে ভালো ভালো বুঝ দিবে?

নিঃশাস নিলো উপমা। মায়ের ললাটে চুম্বন করে কানের কাছে মুখ নিয়ে বলল,
-আমি জানি আমি তোমার নাড়ি ছেঁড়া ধন নই, তুমি আমায় জন্মও দেওনি, তবুও তোমার প্রতি আমার ভালোবাসার যে শেষ নেই মা। মা শব্দের মানেই যে আমি তোমাকে বুঝি। কেনো আমাকে এতো ভালোবাসা দিয়েছো মা? কেনো নিজের প্রতি এতো দুর্বল করেছো আমায়? দেখো তোমার তিলে তিলে তৈরি করা কঠিন, বর্বর মেয়েও আজ চুর্ণবিচুর্ণ হয়ে পরেছে।

ব্যথাহত হয়ে আর্তচিৎকার করে কান্না করতে থাকলো উপমা। ছিটকে কিছুটা দূরে সরে গেলো। সকলের বক্ষ কেঁপে উঠলো উপমার ক্রন্দনরত্ব স্বরে। তাহসিয়ার মতো কঠিন চিত্তের মানুষও দাঁড়িয়ে অশ্রু ঝরাচ্ছে।
উপমা নিজের দুইগাল খামচে ধরে চিৎকার করে বলল,
-মা গো ছেড়ে যেও না আমায়। একা করে দিও না।

আকাশের চাঁদটাও আজ উপমার দুঃখে দুঃখিত। কিছুক্ষন পর পরই সাদা মেঘের আড়ালে নিজেকে লুকিয়ে ফেলছে। একসময় কাঁদতে কাঁদতে উপমার চোখের সামনের সবকিছু ঝাপসা হয়ে এলো। শরীরের ভার হারিয়ে লুটিয়ে পরলো জমিনে।
________________________

রাত কয়টা বাজে জানা নেই। দম বন্ধ, হাঁসফাঁস অবস্থায় আঁখিজোড়া খুলে ফেলে উপমা। মাথায় ভারী বস্তা রয়েছে এমন অনুভূতি হচ্ছে তার। ঘোলাটে নয়নে আশেপাশে তাকায়। বৈদ্যুতিক বাতির আলোয় উপমা বুঝতে পারে সে জমিদার গৃহে নিজ কক্ষে শুয়ে আছে। চট করে উপমার মনে পরে যায় তার মা আর পৃথিবীতে নেই পরকাল গমন করেছেন। ডুকরে উঠে সে। তৎক্ষণাৎ বিছানায় উঠে বসে।
পাশেই বসা ছিল তাহেরা আর সাইয়েরা। উপমাকে বিছানার নিচে নামতে দেখে তাহেরা তাকে ঝাপ্টে ধরে। উপমা পাগলের মতো কাঁদতে থাকে। তাহেরাকে ধাক্কা দিয়ে সরানোর চেষ্টা করে বলল,
-আমি আমার মায়ের কাছে যাবো। তোমরা আমাকে যেতে দেও। আটকিও না আমায়।
তাহেরাও উপমার সাথে কান্নায় ভেঙে পরে। সাইয়েরা উপমার মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বলল,
-নিজেকে সামলাও বউমা। তোমার আম্মাকে কবর দিয়ে দেওয়া হয়েছে। তিনি বেহেশতবাসি হবেন। এখন না কেঁদে আল্লাহকে ডাকো আম্মার জন্য দোয়া পড়ো।

সাইয়েরার কথা মানতে পারলো না উপমা। বুক ফাটিয়ে চিৎকার করে কাঁদতে থাকে। হঠাৎই তার নাকে গোলাপজলের ঘ্রাণ আসে। বাহিরে কয়েকজনের আজহারী, ক্রন্দনধ্বনি কর্ণকুহর হয় তার। উপমার কান্না থেমে যায়। র’ক্তলাল ফোলা ফোলা নেত্রপল্লব নিক্ষেপ করে সাইয়েরার ওপর। তাহেরা তাকে বুকে জড়িয়ে আরো জোরে শব্দ করে কেঁদে দেয়। উপমা কম্পিত স্বরে বলল,
-আ আপা, আপা কেমন আছে?
সাইয়েরা চোখ মুছে নিস্তরঙ্গ গলায় বলল,
-বড় বউমা আর বেঁচে নেই মা।

>>>চলবে.

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here