#অপ্রিয়_প্রেয়সী
#লিখা_তানজিলা
#পর্ব – ১০
একটু পর পর কাশি দিয়ে যাচ্ছে আইজা। টেবিল টা পরিষ্কার করা হলেও সেই ধুলোবালির প্রভাব এখনো রয়ে গেছে। মুখে মাস্ক পড়ে আছে ও। সীমান্ত এখনও কেবিনে আসে নি। ফিহা নিজের ফোনে তাকিয়ে অনবরত হেঁসে যাচ্ছে। হঠাৎ ফোন বেজে উঠলো আইজার। রিসিভ করে কানে দিতেই মায়ের বিধ্বস্ত কন্ঠ শুনতে পেলো ও,
-“আজ আসতে পারবি একটু?”
আইজা তড়িঘড়ি করে বলে উঠলো,
-“কিছু হয়েছে? আরফান আবার কোন…!”
ফোনের ওপাশ থেকে ক্ষীণ জোরপূর্বক হাসির শব্দে চুপ হয়ে গেলো আইজা। কপাল কুঁচকে এলো ওর।
-“আরে পাগলি, কিছু হয়নি। সিমি বায়না করছিলো। কাল থেকে বকবক করে যাচ্ছে। কি জরুরি কথা তোকে ছাড়া না-কি কাউকে বলবে না!”
-“কেন? এক মিনিট! ও আবার আমার মেক-আপ বক্স ভেঙে ফেলে নি তো!”
কন্ঠে কৃত্রিম রাগ এনে বললো আইজা। ওপাশ থেকে সিমির কথা বলার আওয়াজ শুনতে পাচ্ছে ও। আইজার মা হয়তো ফোন লাউডস্পিকারে দিয়ে রেখেছে।
-“আমি যা বলার আপুকেই বলবো। কালকের মধ্যে যদি আপু না আসে আমি কিন্তু সত্যি সত্যি আপুর মেক-আপ বক্স বিক্রি করে পুরো টাকা টা নিয়ে যাব!”
-“এই তুই না আমাকে সহ্য করতে পারিস না! সবসময় তো বলতি একবার বিয়ে হয়ে গেলে আর বাড়িতে ঢুকতে দিবি না। এখন কি হয়েছে!”
আইজার তীক্ষ্ণ কন্ঠের বিপরীতে কোন শব্দ এলো না। শুধু ফুপিয়ে কাঁদার ধ্বনি। বিষয়টা ভালো লাগছে না আইজার। নিজের ছোট বোনকে এতটা তো চেনে ও। সহজে কাঁদার মেয়ে সিমি না।
-“মা, সত্যি করে বলতো কি হয়েছে?
আইজার করা প্রশ্নে ওর মা কিছু বলার আগেই ফোন কেটে গেল। আইজা পুনরায় ফোন করেও কোন লাভ হলো না। এক মিনিট পর ফোন লাগতেই আইজার মা বলে উঠলো,
-“চিন্তা করিস না। সিমির কিছু হয়নি। তোর কথা মনে পড়ছে হয়তো। আর ফোন টাও কয়েক দিন ধরে ডিস্টার্ব দিচ্ছে!”
মায়ের এমন করুন কন্ঠস্বরে কিছুটা মিয়িকে গেলো আইজা। এসবে সবচেয়ে বেশি কষ্ট তো ওর মায়েরই হচ্ছে। ছোটবেলা থেকে নিজের মাকে রানীর আসনে দেখে এসেছে ও। আর নিজেকে প্রিন্সেস। রাজকীয় মহলে ছিলো তাদের বসবাস। তখন সে জীবন টাকে কিছুই মনে হতো না। তবে জীবন নিয়ে হতাশা তখনও ছিলো আর এখনও আছে। শুধু প্রেক্ষাপট টা ভিন্ন। এখন মাকে কি করে বলবে প্রতিবারই ঐ নাজিম শিকদারের অনুমতিতে ঐ বাড়িতে যায় ও। নিজের জীবন নিয়ে এতোটাই জড়িয়ে গেছে যে পরিবারের দিকে খেয়ালই যায়নি আইজার।
পাশের টেবিল থেকে খটখট শব্দে টনক নড়লো আইজার। ফিহা পা নাড়িয়ে যাচ্ছে ক্রমাগত। একটু পর পর বাইরে তাকাচ্ছে। কারও জন্য অপেক্ষা করছে হয়তো। বিরক্তি নিয়ে কিছু বলতে যাবে তার আগেই ফিহার দিকে এগিয়ে আসা ব্যক্তিকে দেখে থমকে গেলো আইজা। সাহিলের দৃষ্টি ফিহার দিকে।
অবাক কেন হচ্ছে আইজা! ও তো জানতো সাহিল এখানে জব করে। ফিহার থেকে চোখ সরে আইজার ওপর পড়তেই মুখটা শক্ত হয়ে গেলো সাহিলের। আইজাও নিজের দৃষ্টি সরালো না। তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকালো ও। আবার পরক্ষণেই ফিহার দিকে তাকাতেই আইজার ঠোঁটের এক পাশে ফুটে উঠলো বক্র হাসির রেখা। আইজার দৃষ্টি হয়তো বুঝতে পেরেছে সাহিল। তাই তো কিঞ্চিৎ ভয় নামক বস্তুটা তার চোখে ভেসে উঠলো।
***
পনেরো বছর বয়সী আইজার মনে জায়গা করে নিতে বেশি কষ্ট করতে হয়নি সাহিলকে। একদমই সিনেমেটিক ভঙ্গিতে তার আগমন। বান্ধবীর বাসা থেকে ফেরার পথে এক দল গুন্ডা এসে হামলা করলো আইজার ওপর। সেদিন একদম হিরোর বেশে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিয়েছিলো সাহিল। না, একদল গুন্ডাদের সাথে লড়াই করতে যায়নি সে। আইজার হাত ধরে দৌড়ে পালিয়েছে বেশ খানিকটা সময়। সাহিল ছিলো তখন কলেজ পড়ুয়া।
সেই যে বোকামি শুরু করলো আজও তার ফল নিজের হৃদয়ে বয়ে বেড়াচ্ছে। আইজা ছোট বেলা থেকেই জেদি প্রকৃতির। একেবারে মনে প্রানে এই সিদ্ধান্ত নিয়েছিলো ও। জীবনে বিয়ে করলে সাহিলকেই বিয়ে করবে। অন্য কোন পুরুষকে সে জায়গায় স্থান দেয়া কল্পনাতেও বিচরণ করতো না।
পরে জানতে পেরেছিলো সেদিন গুন্ডা গুলো সাহিলেরই বন্ধু । সাহিল নিজেই বলেছে আইজাকে সবকিছু। আইজা আর সীমান্তর বিয়ের দিনই শেষ কথা হয়েছিলো ওদের। সেদিনই সাহিল গর্ব করে বলেছিলো তার সাজানো গেম।
আইজা যে গাড়িতে এসেছিলো সেটাও সাহিল চালাকি করে অন্য কোথাও লুকিয়ে ফেলেছিলো যাতে ড্রাইভার চা খেয়ে এসে গাড়ি খুঁজতে লেগে পড়ে। এসব ভাবতেই মনে হচ্ছে পৃথিবীতে সবচেয়ে ডাম্ব মানবীর অ্যাওয়ার্ড টা ওরই! গুন্ডা গুলো হাজার সুযোগ পেয়েও সাহিলের গায়ে হাত তোলেনি। একটু মনোযোগ দিলেই হয়তো বুঝতে পারতো ও সবটা! কয়েক দিন পর পর মায়ের চিকিৎসার নাম করে টাকা নেয়া!!
সে তো ছিলো ওর বোকামি। বাবা মা এতোটা আগলে রেখেছিলো যে বাইরের জগতের ভয়াবহতার কোন জ্ঞান ছিলো না। প্রেম হিসেবে সাহিল যে অনুভূতি নিয়ে খেলেছিলো তাতেই ক্রমাগত জড়িয়ে গেছে ও। সাহিলকে আর কী বলবে! নিজের ভেতরে জমে থাকা অন্ধকারটাও তো জানা ছিলো না আইজার।
গোল্ডডিগার! এই নামেই পরিচিতি পেয়েছে ও। কি করে বড়লোকের ছেলেকে ফাঁসিয়ে বিয়ে করেছে। এসব শুনলেই প্রথম প্রথম রাগ হতো আইজার।
নাজিম শিকদার নিজে এসে প্রস্তাব রেখেছে। আইজার বাবাও বন্ধুকে বিশ্বাস করে নিজের মেয়েকে সীমান্তর হাতে তুলে দিতে রাজি হলো। তখনও কেস কাচারি চলছিলো। প্রতিদিন হাজিরা দিয়ে আসতে হতো তাকে। কয়েকমাস তো পারলে লুকিয়ে থাকতে হয়েছে ওদের। বাবার এতো শত্রু জানা ছিলো না আইজার। ভার্সিটিও ঠিকমতো যাওয়া হয়নি। বেশ কয়েকবার চাকরির চেষ্টা করেও লাভ হয়নি। একবার তো জয়েন করার একদিন পরই বিনাকারণে চাকরি থেকে বের করে দেয়া হয়েছিলো ওকে।
তখনও সাহিলের সাথে সম্পর্ক শেষ করেনি ও। যদিও আইজার বাবার ফ্রড আর দূর্নীতির কেসে ফেঁসে যাওয়ার পর সাহিল নিজেই আইজাকে এড়িয়ে চলতে শুরু করেছিলো।
আর সেদিন সীমান্তর সাথে বিয়ের কথা বলতেই সাহিল বলেছিলো যদি মায়ের সব গয়না নিয়ে পালিয়ে আসে তবেই সে বিয়ে করবে আইজাকে। খুব অসহ্য মনে হচ্ছিলো নিজেকে আইজার। ঘৃণা হচ্ছিলো খুব। সাহিলের ওপর সাথে নিজের ওপর! কিন্তু চোখ দিয়ে এক ফোঁটা পানি ও বের হয়নি। সাহিলের প্রতি মনে জমে ভালোবাসাটা এক বিষাক্ত কাঁটার মতো বিঁধে আছে গলায়। সে কাঁটা নিয়েই সীমান্তকে বিয়ে করে নিলো আইজা।
বিয়ের পর শ্বশুর বাড়িতে এসে নিজেকে এক অন্য জগতে আবিষ্কার করতে শুরু করলো আইজা। বিয়ের দ্বিতীয় দিনই সীমান্তর ছোট ভাই রায়হানকে তো ফোনে কোন এক বন্ধুর কাছে আইজাকে গোল্ডডিগার বলতে শুনেছে ও! এ বাড়িতে কতটা সম্মান আইজার টের পাচ্ছিলো ধীরে ধীরে!
তবে সীমান্তর ওপর সে সময় কোন রাগ ছিলো না আইজার। শুধু রাগ কেন কোন অনুভূতিই কাজ করতো না। তখনই আইজা বুঝে নিয়েছিলো এ কারণেই হয়তো সীমান্ত আইজার প্রতি উদাসীন। নিজ স্বার্থে বিয়ে করেছে ও সীমান্তকে। কিন্তু সীমান্ত নিজে তো বিয়েটা ভেঙে দিতে পারতো! আইজা তো জোর করে বিয়ে করেনি! আইজা বাদে বাকি সবার হিরো সে!
সীমান্তর এই উদাসীনতা আইজার জীবনে বেশ বাজেভাবে প্রভাব ফেলতে শুরু করলো। কার কার মুখ বন্ধ করবে ও! এতো গুলো মানুষের নজরে নীচ হয়ে থাকাটা সহ্য হয়নি আইজার। আর না এই কারণে চোখের পানি ফেলে বাড়ির এক কোণায় পড়ে থাকবে ও। নিজেকে সম্পূর্ণ মাসুম হিসেবে দাবি করতো না আইজা। কখনও করবেও না।
তারপর থেকেই নিজের মতো করেই বাঁচতে শুরু করলো ও। ঠিক আগের মতো। শপিং ঘুরাঘুরি আরও কত কী! গোল্ডডিগার পদবি যখন পেয়েই গেছে তখন সীমান্তর টাকা না উড়ালে মনে স্বস্তি পাবে না। সীমান্তকে প্রথম প্রথম এড়িয়ে চলতে চাইতো আইজা। কিন্তু পরক্ষনেই মনের ভেতর পুষে থাকা লোভ আরও বাড়তে শুরু করলো। সীমান্ত যদি ওকে গুরুত্ব দেয় তবে এ বাড়িতে দাঁড়িয়ে কারও সাহস হবে না যে ওকে অপমান করার। ক্রোধের তাড়নায় জেগে ওঠা চরিত্র টা সত্যিই মিশে যাচ্ছে আইজার স্বত্বায়! এই চার মাসও যেন চার বছর মনে হচ্ছে ওর কাছে!
চলবে…