#অপ্রিয়_প্রেয়সী
#লিখা_তানজিলা
#পর্ব – ১৭(সুযোগ এবং সমাপ্তি)
-“ভুলে যাবেন না, এটা কিন্তু আসল পিস্তল!
আইজার কম্পিত কন্ঠে সীমান্ত ভিষণ উৎসাহী মনোভাব চেহারায় এনে শান্ত গলায় বলে উঠলো,
-“কোন সন্দেহ!”
সীমান্তর ভ্রু জোড়া উঁচু হয়ে আছে। আইজা নিজের গলায় যথাসম্ভব কঠোরতার ভাব এনে বললো,
-“পাগল হয়ে গেছেন! নিজের ওয়াইফের সাথে কেউ এরকম আচরণ করে না-কি! সরান এটা!!”
-“আচ্ছা! আপনার মনে আছে যে আপনি আমার স্ত্রী। তাহলে একটা কথা বলুন তো মাই ডিয়ার ওয়াইফ, এই জঙ্গলে একজন পরপুরুষের সাথে একা কী করছিলেন আপনি? কী এমন জরুরি মিটিং ছিলো এর সাথে যে জানালা টপকে এ পর্যন্ত চলে এলেন! তাও কম, আপনি থানায় কল করে ঐ গোডাউনকে ড্রাগসের আড্ডাখানা বলে কমপ্লেন করেছেন!”
স্বাভাবিক মুখভঙ্গিতে কথাগুলো বলে উঠলো সীমান্ত। ঠোঁটের এককোণে ফুটে আছে ক্রোধ হাসির রেখা। আইজা সীমান্তর হাতে থাকা পিস্তলের গতিবিধি লক্ষ্য করে কৃত্রিম বিস্মিত চাহনি নিয়ে বলে উঠলো,
-“আমি সত্যি বুঝতে পারিনি পুলিশ স্টেশনে আমার একটা কল এতটা সিরিয়াসলি নিয়ে নেবে। আর আপনি এখানে কী করছেন নিজের সিক্রেট প্লেস না সামলে! এখন তো একজনকে গুলি করেও বসে আছেন। এইমুহুর্তে আমাকে এসব বলে সময় নষ্ট করবেন না। লোকটার চিকিৎসা দরকার।”
আইজার কথাটা শেষ হতে না হতেই নিজের হাত নামিয়ে ফেললো সীমান্ত। ধীর পায়ে মাটিতে লুটিয়ে থাকা ব্যাক্তির দিকে এগিয়ে গেলো সে। পায়ের গুলিপ্রাপ্ত স্থানের প্রায় এক কী দুই ইঞ্চি দূরত্বে নিজের পা দ্বারা কিঞ্চিৎ জোরালো ভাবে পাড়া দিতেই সশব্দে আর্তনাদ করে উঠলো লোকটা। সীমান্ত তার পাশে এতোক্ষণ নিঃশব্দে দাঁড়িয়ে থাকা রিয়াদকে উদ্দেশ্য করে দাঁতে দাঁত চেপে বলে উঠলো,
-“রিয়াদ, লোকটার ভালো চিকিৎসার ব্যবস্থা করুন। আপনার ভাবির এর জন্য কলিজা পুড়ে ছাই হচ্ছে!”
সীমান্তর দৃষ্টি পুনরায় আইজার ওপর গিয়ে পড়লো। রিয়াদ আর ঐ জখমপ্রাপ্ত লোকটাকে রেখেই আইজার হাত চেপে ধরে টেনে নিয়ে যেতে শুরু করলো সে। আইজা নিজের হাত হেঁচকা টানে ছাড়িয়ে নিতেই সীমান্ত বিনাবাক্যে সাথে সাথেই আইজার দুই বাহু চেপে ধরলো। অধৈর্য কন্ঠে বলে উঠলো,
-“আপনার মাথায় কী ন্যুনতম কমনসেন্স নেই! এখন যদি ওর কাছে কোন আসল হাতিয়ার থাকতো! লোকটা একজন ড্রাগ এডিক্ট! আপনাকে সাহায্য কে করতো এখানে! কী মনে করে একা এরকম একটা জায়গায় নাচতে নাচতে চলে এলেন!”
-“আপনি কথা ঘুরাচ্ছেন। এসব মিথ্যা কেয়ার আজ দেখতে চাই না আমি! আপনিই রিয়াদকে বলেছেন না আমাকে ঐ লোকের সাথে একা ছেড়ে দিতে! কী ভেবেছেন, একবার ভয় দেখালেই দমে যাবো! সেটা তো শুধু আপনার স্বপ্নেই সম্ভব। আপনি একজনকে কিডন্যাপ করেছেন আবার গুলি করেছেন সেটাও আমার সামনে! ঐ লোকটার সাথে কথা শেষ না করে আমি এক পা ও নড়বো না। না আপনার সাথে কোথাও যাবো। একজন ক্রিমিনালের সাথে আমি একই ছাদের নিচে সংসার করতে পারবো না!”
আইজার শেষের কথাটা কানে যেতেই এক ঝটকায় আইজাকে নিজের থেকে দূরে সরিয়ে দিলো সীমান্ত। তখনই সীমান্তর ক্ষনস্থায়ী বিষন্ন মুখটা হুট করেই গেঁথে গেলো আইজার মস্তিষ্কে। মনে হচ্ছে কয়েক সেকেন্ডের জন্য ধোঁকা খেয়ে গেলো আইজার দৃষ্টি। যদিও সীমান্তর সেই বিষন্ন চোখের চাহনি আদৌও দেখেছে কি-না এই মুহুর্তে কিছুতেই নিশ্চিত হতে পারছে না আইজা। কারণ এই মুহুর্তে সম্পূর্ণ অনুভূতিহীন চোখে রূপান্তরিত হয়েছে সীমান্তর দৃষ্টি।
-“যতদিন আমি অন্ধ থাকবো, ততদিন আপনার জন্য সুযোগ!”
কথাগুলো বলেই বাঁকা হেঁসে আইজার বিভ্রান্তের রেখা নিয়ে তাকিয়ে থাকা আঁখি জোড়ায় ব্যাঙ্গাত্বক দৃষ্টি নিক্ষেপ করলো সীমান্ত। আইজার চোখ মুখ কুঁচকে আছে। ওর স্পষ্ট মনে আছে সেদিন রাতে আইজার মাথায় হাত বুলিয়ে কথাটা বলেছিলো সে। কিন্তু সেদিন এ উদ্ভট কথার মানে জানতে চায়নি ও। রিয়াদ আর সাথে আরেকজন এসে ইতিমধ্যে লোকটাকে হুইল চেয়ারে বসিয়ে সেই কুঁড়ে ঘরের দিকে নিয়ে গেছে। চক্ষুগোচর হয়ে গেছে তারা।
একজন ধুর্ত শিকারীর মতো ধীর পায়ে আইজার দিকে এগিয়ে আসছে সীমান্ত। হাতে থাকা পিস্তল টার দিকে একবার চোখ রেখে আইজার দিকে তাকালো সে। আইজার চোখে চোখ রেখেই পিস্তলটা কিছুদূর ছূড়ে ফেললো সীমান্ত। আইজা আর তার মধ্যে এই মুহুর্তে যেন কোন বাধা নেই। আইজা এক পা পিছিয়ে বলে উঠলো,
-“আপনার স্পষ্ট কথা বলার অভ্যাসটা আমার ভিষণ ভালো লাগতো। কিন্তু ইদানিং প্রচুর ঘুরিয়ে কথা বলছেন আপনি! যা বলার সোজাসাপ্টা ভাষায় বলুন!”
সীমান্তর মুখভঙ্গিতে কোন পরিবর্তন নেই। আইজার চিবুকে তার হাত স্পর্শ করতেই ক্রোধ দৃষ্টি নিয়ে সে হাত ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে দিলো আইজা। তবে সীমান্ত থামলো না। মুহুর্তেই শক্ত করে চেপে আইজার গাল। ঠান্ডা গলায় বলে উঠলো,
-“সে সুযোগ আর আপনার নেই আইজা। আমার অন্ধত্বের সমাপ্তি এখানেই। সাথে আপনার মুক্তির সুযোগও! যতদিন প্রাণ থাকবে এভাবেই বিষাক্ত কাঁটা হয়ে বিঁধে থাকবো আপনার জীবনে। আপনার কোন বাড়াবাড়ি আমি আর উপেক্ষা করবো না।”
-“ভালোবাসেন আমাকে?”
আইজার প্রশ্নে কিছু মুহূর্তের জন্য শান্ত চোখে তাকালো সীমান্ত। তবে আইজার প্রশ্নের কোন জবাব দিলো না। সীমান্তর নিরবতার বিপরীতে আইজা আরও বললো,
-“বিয়ের পর আমি আপনাকে ভালোবাসার ব্যর্থ চেষ্টা কম করিনি। সেটা না পেরে প্রেমের মিথ্যে অভিনয়ে স্বস্তি খুঁজেছি। আপনি আমাকে ভালোবাসেন কিনা তা নিয়ে বিন্দুমাত্র মাথাব্যথা ছিলো না আমার। এখনও নেই। তাই আমার ফেলা প্রেমের ফাঁদে আমাকেই ফাঁসানোর চেষ্টা করে লাভ নেই। আমাদের সম্পর্কে না ভালোবাসা ছিলো আর না আছে!”
-“আপনি ভিষণ বোকা আইজা! আপনাকে প্রেমের ফাঁদে ফেলার প্রয়োজনবোধ আমি কখনোই করিনি। এসব বাচ্চামো! আপনি আমার কাছে শুধুমাত্র একটা দায়িত্ব। এরচেয়ে বেশি কিছু না।”
-“তাহলে আমাকে ছাড়তে চাইছেন না কেন?”
-“আপনি আমার জীবনে খুবই বাজে ভাবে জড়িয়ে গেছেন। আজ অনেক কিছুই জেনে গেছেন আপনি! তাই এখন আর আপনাকে যেতে দেয়া আমার পক্ষে সম্ভব না। এতোদিন যে মিথ্যে অভিনয়ে নিজেকে স্বস্তিতে রেখেছেন এখন সেই অভিনয়ের মাঝেই মৃত্যু পর্যন্ত আঘাতপ্রাপ্ত হবেন আপনি! নিজের স্বার্থে আমাকে ব্যবহার করেছেন আপনি। আমিও তাই করেছি! আমার বাবার ভরসা পাওয়ার জন্য তার ইচ্ছে অনুযায়ী আপনাকে বিয়ে করেছি আমি। আপনার প্রতি আমার কোন অনুভূতিই ছিলো না। আমাদের মধ্যে পার্থক্য কতটুকু বলতে পারেন! একবার নিজের মধ্যে জমে থাকা অন্ধকারকে দেখার চেষ্টা করুন। আমার জীবনে কী চলছে সেটা নিয়ে নিজের সময় নাহয় পরে নষ্ট করবেন।”
সীমান্তর কথাগুলো স্তব্ধ হয়ে শুনে গেলো আইজা। নিজের ফেলা প্রতিটা পদক্ষেপই যেন বিষাক্ত ছোবলে জর্জরিত করছে ওকে। সত্যি বলতে সীমান্তকে ঘৃণা করেনা আইজা। নিজেকে ঘৃণা করে। কারণ সেদিন যদি জেদের তাড়নায় বিয়ে করার মতো এতো বড় একটা সিদ্ধান্ত না নিতো, খুব কী ক্ষতি হয়ে যেতো! এসব ভাবনার মাঝেও আইজা নিজেকে শক্ত রেখে বলে উঠলো,
-“যদি আপনার করা কোন কাজ আমার পরিবারে প্রভাব ফেলে আমি সেটা ইগনোর করবো না!”
সীমান্ত আইজার গাল ছেড়ে দিয়ে শক্ত কন্ঠে জিজ্ঞেস করলো,
-“কী প্রভাব পড়ছে আপনার পরিবারে?”
-“ঐ লোকটার সাথে আমার পাপা জড়িত! তাকে আপনি এভাবে বেঁধে রাখছেন। আর আমাকে জিজ্ঞেস করছেন কী প্রভাব পড়ছে!”
কথাটা বলে আইজা আর দাঁড়ালো না। সোজা সেই কুঁড়ে ঘরের দিকে এগোতে পা বাড়ালো। যদিও দুই কদমও যেতে পারলো না। তার আগেই সীমান্তর কোলে নিজেকে আবিষ্কার করলো ও।
-“নিচে নামান আমাকে! আমি আপনার সাথে কোথাও যাবো না!”
আইজার কথাকে সম্পূর্ণভাবে উপেক্ষা করেই হেঁটে যাচ্ছে সীমান্ত। মেইন রোডে গাড়ির সামনে এসেই আইজাকে নামিয়ে দিলো সে।
-“আরফান আর সিমি অলরেডি বাড়িতেই আছে। আপনাদের প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র কালকের মধ্যে নিয়ে আসা হবে।”
-“আপনি কাকে জিজ্ঞেস করে আমার ভাইবোনদের নিজের বাড়িতে নিয়ে গেছেন। ওরা ওখানে থাকবে না।”
জোরালো কন্ঠে বলে উঠলো আইজা। আইজার উৎকন্ঠিত চোখগুলো যেন সীমান্তর আনন্দের খোরাক হয়ে দাঁড়িয়েছে।
-“আপনার গজিয়ে ওঠা পাখা কাটতে আমার এই ছোট্ট প্রচেষ্টা। আপনার ভাইবোন আমার বাড়িতেই থাকবে। কারণ কান টানলে মাথা তো আসবেই! আজ থেকে আমার আসল রূপ দেখবেন আপনি, মাই ডিয়ার ওয়াইফ!”
চলবে…