#অপ্রিয়_প্রেয়সী
#লিখা_তানজিলা
#পর্ব – ৪৩
প্রায় দশ কী বিশ জনের মতো অ*স্ত্রধারী ব্যাক্তি ঘিরে ধরলো তাদের। এই মুহুর্তে লোক গুলোকে কোন হিংস্র হায়েনার চেয়ে কম মনে হচ্ছে না। আইজার কম্পিত হাতে থাকা ব*ন্দুক নড়বড়ে হয়ে এলো। সীমান্ত আইজার হাত ধরে সিঁড়ি থেকে সরে গিয়ে কিঞ্চিত সাইডে দাঁড়ালো। নিজে আইজার সামনে এসে ওকে আড়াল করার চেষ্টা করলো । তবে সে প্রচেষ্টায় পুরোপুরি সফল হলো না। কোনমতে পেটের ক্ষতস্থানে জ্যাকেট দ্বারা গিট বেধে নিলো সে। যদিও এভাবে কতক্ষণ! আর কিছুক্ষণ চলতে থাকলে তো জ্ঞান হারাবে সীমান্ত!
-“ঐটা ব্যবহার করার কথা মাথায়ও আনবি না! তোর হাত থেকে একটা বু*লেট ছুটলে কিন্তু আমরাও বসে বসে তামাশা দেখবো না!!”
আইজার হাতে থাকা ব*ন্দুকে ইশারা করে হু*মকি দিয়ে উঠলো আসিফ। হাতের তুলনায় তার চোখ থেকে যেন দ্বিগুণ র*ক্ত ঝড়ছে। গু*লিপ্রাপ্ত স্থানে হাত দিয়ে চেপে ধরেছে সে।
-“আপনাদের কী মনে হচ্ছে, ফাহাদ আপনাদের প্রটেক্ট করবে! একদম না! সে আপনাদের পঁচে ম*রার জন্য এখানে ফেলে গেছে! এখনো সময় আছে! পালান! আমাদের মা*রলে আপনারা বিপদেই পড়বেন।”
আসিফ সীমান্তর কথায় তেমন কান দিলো বলে মনে হলো না। উল্টো পাশে দাঁড়িয়ে থাকা একজনের কাছ থেকে ব*ন্দুক কেড়ে নিয়ে আইজার দিকে তাক করে কর্কশ গলায় বলে উঠলো,
-“দু’জনের কাছে যা অ*স্ত্র আছে নিচে রাখ! নইলে কী হবে তা নিশ্চয়ই আমার মুখে বলার প্রয়োজন নাই!”
আইজার হাত ঘেঁষে একটা বু*লেট মুহুর্তেই ওর পাশের দেয়ালে গিয়ে বিঁধলো। আসিফের দৃষ্টি জুড়ে ঘোর নি*ষ্ঠুরতার রেশ। এইবার কোন ফাঁকা হু*মকি দিচ্ছে না সে।
****
আইজার চুলের মুঠি টেনে ধরে ওর গলায় ব*ন্দুক ঠেকিয়ে আছে এক লোক। আসিফ সীমান্তকে ফ্লোরে বসিয়ে তার মাথায় পি*স্তল তাক করে আছে। আইজার দূর্বল দৃষ্টি তার চাহনি বুঝতে দেরি করলো না। লোকটাকে এতো অসহায় অবস্থায় হয়তো এর আগে কখনোই দেখে নি ও! সীমান্তর আঁখি জোড়া নিভু নিভু হয়ে এসেছে প্রায়। বাইরে পুলিশের গাড়ির সাইরেনের আওয়াজ এখনো কানে লাগছে। এতো দেরি করছে কেন তারা!
-“ওকে যেতে দিন! আমার রাগ আইজার ওপর ঝাড়বেন না..!”
এইটুকুর আর বলার সুযোগ পেলো না সীমান্ত। তার আধো আধো ভেঙে আসা কন্ঠস্বর মুখনিঃসৃত হওয়ার আগেই আসিফ সীমান্তর কোমরের সাইডে হুট করে লা*থি মেরে বসলো। মুহুর্তেই ফ্লোরে থুবড়ে পড়লো সে। তৎক্ষনাৎ জ্যাকেটে জমাট বাঁধা র*ক্তের ছোপ ছোপ দাগ গাড়ো হতে শুরু করলো। সীমান্তর উচ্চস্বরের আর্তনাদে ফুপিয়ে উঠলো আইজা। জোরপূর্বক নিজের গলা শক্ত রাখার চেষ্টা করলো ও।
-“বাহাত্তর ঘন্টা কিন্তু শেষ হয়নি। ফাহাদ নিশ্চয়ই এ সময়ের আগে আমাদের খু*ন করতে বারণ করেছে!”
আইজা নিজেও জানেনা ও কী বলছে। কিন্তু পুলিশ আসা অব্দি সীমান্তর পেটের র*ক্তপাত নিয়ন্ত্রণ বেশ জরুরি। আইজার কথায় ভ্রু জোড়া উঁচু করে তাকালো আসিফ। কিছু একটা ভাবার ভঙ্গিতে দ্রুত পায়ে এগিয়ে গেলো আইজার দিকে।
-“হুমম..! আমি তো ভুলেই গেছিলাম। থ্যাঙ্কস ম্যাম! মনে করিয়ে দেয়ার জন্য!”
ধূর্ত কন্ঠে বলে উঠলো আসিফ। আসিফের হাতের অবস্থাও তেমন সুবিধার না। তবুও যন্ত্রণার একবিন্দু ছাপও নেই তার চোখে। সে স্থলে শুধুই হিং*স্রতা।
-“আসিফ! আইজাকে ছাড়্!”
ফ্লোর থেকে উঠে দাঁড়ানোর প্রবল প্রচেষ্ঠায় প্রতিবারই ব্যর্থ হচ্ছে সীমান্ত। পেটের ক্ষতস্থানের রক্তপাত এতোক্ষণ মিহি থাকলেও এই মুহুর্তে সে বাধ ভেঙে গেছে। মেঝেতে রক্ত গড়াতে শুরু করেছে। তাও দেহে জমে থাকা অবশিষ্ট শক্তি যুগিয়ে আইজার দিকে এগোতে গেলেই চার কী পাঁচ জনের মতো এসে ওদিকেই আটকে ধরলো সীমান্তকে।
-“আমাদের কাছে সময় কম। তবে আপনার এই কথাটা আমি ফেলবো না। না আমি সীমান্তকে মা*রবো আর না আপনাকে!”
চোখের পলকেই যেন সবকিছু ওলটপালট হয়ে গেলো। আসিফের শীতল কন্ঠ আইজার কান ভেদ করতে না করতেই মুহূর্তেই লোকটা ওকে হেঁচকা টানে জমিনে ছিটকে ফেললো।
-“আইজা!”
সীমান্তর উচ্চকণ্ঠেও থামলো না আসিফ। আইজার পেট বরাবর সজোরে লা*থি মারতেই প্রশান্তির ছাপ ফুটে উঠলো মুখে।
মেয়েটার গগনবিদারী চিৎ*কার যেন গরম সীসার ন্যায় সীমান্তর কান ভেদ করছে আর তাতে জ্ব*লসে যাচ্ছে ওর হৃদপিণ্ড। শরীরের সমস্ত শক্তি প্রয়োগ করে ওকে ঝাপটে মাটির সাথে মিশিয়ে রাখা লোক গুলোকে সরানোর চেষ্টা করে যাচ্ছে সীমান্ত। কিন্তু পারছে না। এই মুহুর্তে নিজেকে পৃথিবীর সবচাইতে নিকৃষ্ট পুরুষ মনে হচ্ছে সীমান্তর। ওরই সামনে ওর স্ত্রী তীব্র যন্ত্রণায় কাতরাচ্ছে। শেষ পর্যন্ত না তাকে সুরক্ষিত রাখতে পারলো না ওর বাচ্চাকে!
আইজার মনে হচ্ছে ওর দেহের প্রতিটা অঙ্গ প্রত্যঙ্গ বিচ্ছিন্ন হয়ে যাচ্ছে। পায়ে গড়িয়ে যাওয়া তরল পদার্থ অনুভব হতেই ওর আর্তনাদ যেন আরো জোরালো হয়ে উঠলো। এ আর্তনাদ শারিরীক পীড়ার উর্ধ্বে। আইজা জানে কী হয়েছে। কী হারিয়েছে ও! আশে পাশে কী হচ্ছে, কে আছে, কারা আছে সবকিছুই ওর বোধগম্যের বাইরে চলে গেছে। ঝাপসা আঁখি জোড়া ক্রমশ বন্ধ হয়ে আসছে! গলার স্বরও হয়ে আসছে ক্ষীণ।
তৎক্ষনাৎ আইজার অসাড় দেহের সামনেই ছেড়ে দেয়া হলো সীমান্তকে। তার শরীর থেকে গড়িয়ে পড়া রক্তে ফ্লোর ভিজে যাচ্ছে। কোনমতে নিজেকে টেনে আইজার দিকে এগিয়ে যেতে লাগলো ও। এতোক্ষণ ছটফট করতে থাকা মেয়েটা কেমন শান্ত হয়ে পড়ে আছে। না! এখনই হার মানলে চলবে না। ওরা ওদের ছেড়ে এতো দ্রুত বেড়িয়ে গেছে মানে পুলিশ হয়তো ক্লাবে প্রবেশ করেছে। কোনমতে তাদের সিগনাল দিতে হবে!
সীমান্ত নিজের গুলিবিদ্ধ শরীরটাকে সম্পূর্ণরূপে উপেক্ষা করতে চাইলেও সে সামর্থ ওর হলো না। ক্রমশ অন্ধকার হয়ে আসছে চারিদিক। অবাধ্য দেহটা আইজার পাশে গিয়েই ফ্লোরে আছড়ে পড়লো। রক্ত রাঙা হাত স্পর্শ করলো সেই মানবীর গাল। কিন্তু আইজা একদমই বিরক্ত হচ্ছে না। আর না বরাবরের মতো ভ্রু জোড়া কুঁচকে যাচ্ছে।
এই প্রথম তার অঙ্গে এ লাল রঙটা এতো বিভ*ৎস মনে হচ্ছে সীমান্তর কাছে! এখান থেকে জীবিত বের হতে পারলে ওদের জীবন কেমন হতো জানা নেই সীমান্তর। হয়তো কখনো জানতেও পারবে না! জীবনে প্রথমবারের মতো বাবা হওয়ার অনুভূতিটাও জানা হলো না ওর!
নিজের পেট হাত দিয়ে চেপে ধরে আবারও উঠতে চেষ্টা করলো সে। তাতে যেন রক্তপাত আরো বেড়ে গেলো। রক্ত-মাংসে গড়া এ শরীরের সীমাবদ্ধতা কোনমতেই পেড়োতে পারছে না সীমান্ত। ধীরে ধীরে বাঁচার আশা ক্ষীণ থেকে ক্ষীণতর হয়ে যাচ্ছে। হাজার প্রচেষ্টা স্বত্বেও হুট করে চোখের সামনে চলে আসা নিকষ কালো আঁধার কাটিয়ে ওঠা হলো না আর!
****
হাতে থাকা ট্যাব স্ক্রীনে ভাসমান লোকেশন অনুযায়ী একটা ছোট দরজার সামনে এসে দাঁড়িয়ে পড়লো নাজিম আর রিয়াদ।
পুলিশরা দেয়াল ভাঙতে ব্যস্ত। আর বাকিরা পুরো বিল্ডিং ছান মারছে। এ পর্যন্ত আসতে যে কিছুদূরে বয়ে চলা ড্রেনের সাথে সংযুক্ত বিল্ডিংয়ের নিম্নাংশে থাকা মাঝারি সাইজের জঙভরা ময়লা লোহার খাঁচার মতো বস্তুটা পেড়িয়েও আসা যায় সে পথ তাদের অজানা। বলতে গেলে আন্ডারগ্রাউন্ড রাস্তা!
ক্লাবের এন্ট্রি সিস্টেমে এসেই আটকে গেছে পুলিশ বাহিনী। সীমান্ত নিজ ফোন দ্বারা সেই দেয়াল রূপী দরজার দরজার ভিডিও রিয়াদকে সেন্ড করায় তা দ্বারা ওয়ারেন্ট পাওয়া সহজ হয়েছে। কারণ কোন প্রমান ছাড়া থানায় রিপোর্ট করলেও লাভ হতো না। এ দিকে কেউ ফিরেও তাকাতো না। রিয়াদ আইজার মামা জামিল মাহমুদকে সব আপডেট দিচ্ছে। তিনি বাকিটা সামলে নেবেন। যদিও সে এখন সাসপে*ন্সনে থাকায় এই অপারেশনের সাথে সরাসরি যুক্ত না।
একজন ব্যাক্তি হুট করেই রিয়াদকে পাশ কাটিয়ে গেলো। হঠাৎ খুব কাছ থেকে পুলিশ সাইরেনের আওয়াজে থেমে গেলো সে। পুলিশ এ পথটাও ঘেরাও করে ফেলেছে। নাজিম ট্র্যাকারের লোকেশন অনুযায়ী ছুটে চললো হল জুড়ে। সে জানে পুলিশ ঢুকে পড়লে তাদের আর থাকতে দেবে না।
হঠাৎ শেষ দিকে এসেই থমকে দাঁড়ালো নাজিম। তার পিছু পিছু রিয়াদও থেমে গেলো। ওদের সামনে থাকা ছোট্ট সিঁড়িটার একাংশ লাল রঙে রাঙা। ওপরেই দু’জন মানুষের নিথর দেহ পড়ে আছে!
চলবে…