#অপ্রিয়_প্রেয়সী
#লিখা_তানজিলা
#পর্ব – ৪৪ (পার্সেল)
রায়হানের জ্ঞানহীন দেহ ফ্লোরে বাঁধা অবস্থায় পড়ে আছে। চেয়ারে বসে এ পর্যন্ত প্রায় তিনটে সিগা*রেট শেষ করেছে ফাহাদ। পুরো ইন্টারনেট জুরে ক্লাবের চর্চা। যদিও লাইভে সাহিল নিজের চেহারা প্রকাশ করেনি তবুও তাকে চিনতে দেরি হয়নি ফাহাদের! এক হাতে সিগা*রেট আর আরেক হাতে পি*স্তল নিয়ে সেটাকে মনোযোগ সহকারে পর্যবেক্ষণ করে যাচ্ছে ফাহাদ।
-“প্রিয়াকে আমি মে*রেছি।”
নিষ্প্রভ কন্ঠে বলে উঠলো ও। আসিফ এতোক্ষণ শুকনো মুখে সামনে দাঁড়িয়ে ছিলো। ছেলেটার মধ্যে কোন অনুশোচনা ছিলো কি-না জানা নেই ওর। কিন্তু ফাহাদের মুখে এমন সোজাসাপটা স্বীকারোক্তিতে প্রথমে বিস্ময় অতঃপর ক্রোধদৃষ্টিতে তাকালো সে। তবে কিছু বলার সুযোগ পেলো না। মুহুর্তেই ফাহাদের হাতে থাকা পি*স্তলের গু*লি আসিফের মাথার আড়পার হয়ে গেলো। আফসোস হচ্ছে ভিষণ; ওর জীবনের বাহাত্তরতম খু*নের স্বীকার আইজা না, আসিফ হয়েছে।
সীমান্তকে গু*লি করার অনুমতি আসিফকে দেয়নি ফাহাদ।অতিরিক্ত কোন কিছুই পছন্দ না ওর। প্রিয়াকে মে*রেছিলো কারণ এতে আসিফকে দলে নেয়া সহজ হবে। প্রতিশো*ধের নেশায় হলেও সীমান্তর বিরুদ্ধে সাহায্য পাওয়া যাবে। এখন আর আসিফকে প্রয়োজন নেই ফাহাদের। কয়েকদিনের জন্য গা ঢাকা দেবে। তারপর ঐ সাহিলকে মা*রবে ও!!
ফাহাদ সবসময়ই শত্রুপক্ষের থেকে একধাপ আগে থাকতে স্বস্তি পায়। তাই রায়হানকে কথামতো বাড়ি পৌঁছে দেয়নি ও। ব্যপারটা খুব মজার। এক ভাই ফাহাদকে খুঁজতে খুঁজতে অস্থির হচ্ছিলো, আরেক ভাই ওরই সামনে সমানে ড্রা*গস করে গেছে। যদিও রায়হানকে এখানে ফাহাদের ভাড়া করা লোকেরাই এনেছিলো। বলতে গেলে নাজিম শিকদারের ছেলেদের নাচানোর মজাই আলাদা!!
-“এবার হয়তো খবরে তোর আসল মৃ*ত্যু ছাপা হবে।”
হঠাৎ দরজার সামনে নাজিমকে দেখে কিঞ্চিত আঁতকে উঠলো ফাহাদ।
-“তুই!”
-“কেন! আমাকে এতো দ্রুত এখানে আশা করিসনি তাই না! কী করবো বল, তুই আবারও আমার ছেলেদের দিকে নজর দিয়েছিস। তাই না এসে শান্তি পাচ্ছিলাম না! বলতে হবে, তুই আমাকে বেশ বোকা বানালি! ওদিকে আমি তোকে মৃ*ত ভেবে আরামে বসে ছিলাম!”
নাজিমের কন্ঠে কৃত্রিম আফসোসের রেশ। ফাহাদের তাক করা পি*স্তলের দিকে ধীর গতিতে এগিয়ে যাচ্ছে ও। তৎক্ষনাৎ ফাহাদের মাথার পেছনের অংশে আরেকজন এসে ব*ন্দুকে ঠেকালো।
-“তোর সাঙ্গপাঙ্গদের কেউই বেঁচে নেই!”
নাজিমের গলায় ব্যঙ্গার্ত্বক ভাব। চারিদিকে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে চোখ বুলালো ফাহাদ।
-“তুই নিজেকে যতটা চালাক ভাবিস, অতটা চালাকও না তুই! আরমান কী সুন্দর তোকে ধোঁকা দিয়ে গেলো। আমার সাজানো মিথ্যা এক্সি*ডেন্টটাও বিশ্বাস করে নিলি তুই! তোর থেকে সীমান্ত হাজার গুণ বেশি এগিয়ে!”
ফাহাদের কথায় হো হো করে হেঁসে উঠলো নাজিম। ধীর কন্ঠে বলতে শুরু করলো,
-“আরমান শুধু আমাকে না তোকেও ধোঁকা দিয়েছে। মনে আছে, আরমান সেদিন ওর মেয়েকে নিয়ে তোদের ক্লাবে গিয়েছিলো। তোর ফ্রিজার রুমে সেদিন কি যেন টেকনিক্যাল সমস্যা হয়েছিলো। ঐদিন নেহা আর সীমান্তকে তোরা অন্য একটা জায়গায় ফেলে এসেছিলি মৃ*ত ভেবে। সেখান থেকেই পুলিশ উদ্ধার করে ওদের। আরমান সেগুলো ইচ্ছে করে করেছিলো। সে হয়তো অনুশোচনায় ভুগছিলো।”
ফাহাদের মুখের রঙ মুহুর্তেই উড়ে গেলো। পরক্ষণেই বিস্মিত গলায় জিজ্ঞেস করলো,
-“তুই কী করে জানলি?”
-“আরমান নিজেই আমাকে বলেছে। দুই মাস আগে ও আমার সাথে দেখা করে। আইজার জন্য চিন্তিত ছিলো বলে নিজের মুখে সব স্বীকার করে।”
-“তার মানে আরমানের এক্সি*ডেন্ট তুই করিয়েছিস!”
-“সেদিন ওর ভাগ্যে মৃ*ত্যু লেখা ছিলো না বলে বেঁচে গেছে! ইচ্ছে ছিলো তখনই তোকে মে*রে দেই। শুধু জাফর ভাইয়ের কেসটার জন্য ব্যস্ত হয়ে পড়েছিলাম। ঐ জামিল মাহমুদ তো আবার কম না! সাসপেন্ড থাকা অবস্থায়ও দমে নেই সে!”
শেষের কথাটা আপনমনেই বললো নাজিম। দরজার ওপাশ থেকে আরো কিছু লোক এসে জড়ো হলো। তাদের মধ্যে দু’জন এসে রায়হানকে উঠিয়ে নিয়ে গেলো। ফাহাদের ক্ষুব্ধ চাহনির বিপরীতে এক ভয়ংকর ক্রুর হাসি উপহার দিয়ে বসলো ও। ট*র্চার কাকে বলে সেটা আজ বিস্তারিতভাবে ফাহাদকে বুঝিয়ে দেবে নাজিম!
***
সময় যেন আজ কচ্ছপের গতিতে যাচ্ছে। হাতে দুটো খাবারের প্লেট নিয়ে পাখি আর রাজিয়ার সামনে রেখে দিলো রিয়াদ। এতোক্ষণ ক্ষুব্ধ চোখে রিয়াদকে দেখে যাচ্ছিলো রাজিয়া। পরক্ষণেই রিয়াদের অনুভূতি শূন্য চোখে তাকিয়ে রুক্ষ গলায় বলে উঠলো,
-“গরিব দেইখা যা মন চায় তাই করবেন! আমাগো এমনে আটকায় রাখার মানে কী!!”
-“এখন এসব ভেবে কী লাভ! আপনাদের প্রতিটা পদে কারো না কারো নজর ছিলো। নাজিম শিকদার কী এমনিই ঐ বাড়িতে আপনাদের ঢুকতে দিয়েছে না-কি! আপনাদের মধ্যে হয়তো কেউ একজন তাকে প্রতিনিয়ত ব্ল্যাক*মেইল করে যাচ্ছে। অথবা দু’জনই! নাজিম শিকদারের কিড*ন্যাপ করার ভঙ্গি আলাদা। তিন বছর আপনাদের একপ্রকার জি*ম্মি করে রেখেছিলো সে। চিন্তা করবেন না, সীমান্ত তার বাবার মতো সা*ইকো না। আপনাদের কোন ক্ষতি করবে না সে।”
নির্লিপ্ত কন্ঠে বলে উঠলো রিয়াদ। ওর কথায় রাজিয়ার কপাল কুঁচকে গেলেও পাখি কিছুটা শব্দ করে হেঁসে উঠলো। বেশ অদ্ভুত হাসি তার ঠোঁটে। যার মধ্যে নম্রতার একটা ভাব বিদ্যমান। যদিও রিয়াদ জানে সেটা পুরোটাই বানোয়াট। এই মেয়ে আর যাই হোক নম্র তো একদমই না। তবে পাখির এ হাসির বিপরীতে কিছু বললো না রিয়াদ। নিঃশব্দে উঠে দাঁড়ালো ও। একটু আগেই সীমান্তকে রক্ত দিয়ে এসেছে। একটা ডিম সিদ্ধ খেতে হবে এখন।
-“আপনিও কী আমাদের দলে পরেন না! সীমান্ত আপনার ব্যপারে সব কিছু জানে তো! লোকটা কত ভরসা করে আপনাকে!”
পাখির কথায় তৎক্ষণাৎ পদচালনা থামিয়ে দিলো রিয়াদ। তবে পেছনে ফিরে তাকালো না। নিঃসংকোচ কন্ঠে বলে উঠলো,
-“ভুল বললেন আপনি। সীমান্ত কখনোই আমাকে পুরোপুরি ভরসা করেনি।”
আর দাঁড়ালো না রিয়াদ। হনহন করে বেড়িয়ে এলো ও। চুলোয় ডিম সিদ্ধ করতে বসিয়ে দিলো। অতঃপর চুলো থেকে কয়েক কদম পরে রাখা কাঠের চেয়ারটায় গিয়ে বসে পড়লো। অনেক ধকল গেছে আজ। খেয়েই আবার হসপিটালে যেতে হবে। ডিমটা সেদ্ধ হতে হতেই চেয়ারে মাথা এলিয়ে চোখটা বন্ধ রাখার সিদ্ধান্ত নিলো ও।
পাখি আর রাজিয়ার ব্যপারে মোটামুটি ধারণা আছে রিয়াদের। কিন্তু এই দু’জনের মধ্যে কে গত পাঁচ বছর যাবৎ নাজিমকে হুমকি দিয়ে যাচ্ছে তা এখন অব্দি নাজিম শিকদার বের করতে পারেনি। প্রতিবছরই নাজিমের অফিসে একটা কালো রঙের পার্সেল আসে। প্রত্যেক বাক্সেই থাকে একটা ছোট চিরকুট। আর তাতে লেখা,
-“আমি জানি তুই একজন খু*নি!”
অতঃপর নাজিম শিকদার তার সন্দেহের তালিকায় থাকা ব্যক্তিদের নিজের বাড়িতেই কাজে রাখেন। যাদের মধ্যে আছে রাজিয়া, পাখি আর ও নিজেই। তবে এতো চতুর ব্যাক্তি হয়েও এখনো নাজিম সেই পার্সেল পাঠানো ব্যক্তিকে খুঁজে পেলো না!
হুট করেই চোখ খুললো রিয়াদ। চুলোটা নিভিয়ে দিলো ও। তারপর টেবিলে রাখা ছোট বাক্সটা কালো রঙের প্যাকেটে মুড়িয়ে নিলো। এ বছর বাক্সটা এখনো নাজিম শিকদারকে পাঠানো হয়নি। লোকটা হয়তো ছেলের শোকে ভুলেই গিয়েছে। কিন্তু শোক তো আর তার একার না!
***
চোখ খুলতেই সামনে ঝাপসা আলোয় সাদা বর্ণ ছাড়া আর কিছুই দেখতে পাচ্ছিলো না সীমান্ত। সাইডে তাকিয়ে দেখে রিয়াদ বসে বসে ঝিমাচ্ছে। সীমান্তর মনে হচ্ছে ওর হাত পা যেন কেউ বেঁধে রেখেছে। নিজ থেকে ওঠার চেষ্টা করেও ব্যর্থ হচ্ছে প্রতিবার। কণ্ঠনালী পেড়িয়ে আওয়াজ পর্যন্ত বের হতে চাইছে না।
-“আপনি নড়বেন না! আমি আসছি!”
রিয়াদ যে কখন উঠে গেলো টের পায়নি সীমান্ত। ঝড়ের গতিতে বেড়িয়ে গেলো সে। তবে সীমান্ত ওর চেষ্টা থামায়নি। যদিও শরীর সঙ্গ দিচ্ছে না। পেটে অসহ্য রকমের যন্ত্রণা অনুভব করছে ও। কয়েক সেকেন্ডেই ডাক্তার হাজির। সে এসে সীমান্তকে চেক করতে শুরু করলো। ও অনেক কষ্টে দূর্বল কন্ঠে জিজ্ঞেস করে উঠলো,
-“আইজা কেমন আছে?”
ডাক্তার সীমান্তর কথার কোন জবাব দিলো না। এক সাইডে দাঁড়িয়ে থাকা রিয়াদের মুখটা কেমন যেন ফ্যাকাশে মনে হচ্ছে সীমান্তর কাছে। ওর বুকটা ধক করে উঠলো। সীমান্তর এসব একদম সহ্য হচ্ছে না। বুঝতে পারছে না কেউ ওর প্রশ্নের কোন জবাব কেন দিচ্ছে না!
-“আইজা কোথায়?”
চলবে…