অপ্রিয় প্রেয়সী পর্ব-৪৯

0
2313

#অপ্রিয়_প্রেয়সী
#লিখা_তানজিলা
#পর্ব – ৪৯ (চশমা)

ক্রমাগত নিজের মুখে পানি ছিটিয়ে যাচ্ছে সীমান্ত। বারবার চোখের সামনে আইজার গলার কাটা দাগটা জ্বলজ্বল করছে। বেসামাল হয়ে পড়ছে ও। কোন কিছু চিন্তা না করেই আজ এতো বড় একটা পদক্ষেপ যে কতটা ভারী হতে পারে সেটা সীমান্ত বেশ ভালো করেই জানে।

আইজাকে ঢাল হিসেবে ব্যবহার করতে গিয়ে শেষ পর্যন্ত নিজেই ফাঁদে আটকে পড়ছে! সীমান্তর মনে হচ্ছে ও কোন ব্রেক ছাড়া গাড়িতে চড়ে বসেছে। চাইলেও থামতে পারছে না! প্রচন্ড ঘৃণা হচ্ছে ওর নিজের ওপর! আইজাকে এসবে টেনে আনার জন্য নিজেকে হয়তো কখনোই ক্ষমা করতে পারবে না সে!

ওয়াশরুম থেকে বেরিয়ে কেবিনে থাকা চেয়ারের দিকে এগিয়ে গেলো সীমান্ত। আজ বাড়ি যাওয়ার তেমন ইচ্ছে নেই ওর। টেবিলের ওপর রাখা ফোন সেই কখন থেকে ভাইব্রেট করে যাচ্ছে। মাথাটা প্রচন্ড ব্যথা করছে। ইচ্ছে না থাকা স্বত্বেও চোখ মুখ কুঁচকে ফোনটা হাতে তুলে নিলো সীমান্ত।

কল রিসিভ করে ওপাশে থাকা ব্যক্তির কথা কানে প্রবেশ করতেই সাথে সাথে উঠে দাঁড়াতে হলো ওকে। তবে বিস্মিত হয়নি সে। আগেই কিঞ্চিত ধারণা করেছিলো এমন কিছু হবে! কিন্তু আজই! বাবার ধৈর্য্যের পরিমাণে রাতারাতি এতোটা ঘাটতি! হতাশায় ফোন কেটে দিলো সীমান্ত। বাড়িতে যু*দ্ধ শুরু হওয়ার আগেই পৌঁছাতে হবে ওকে!!

***

কম্পিত হাতে নিচে পড়ে থাকা ব্যাগটা উঠিয়ে নিলো আইজা। পুরো শরীর ঝিরঝির করছে ওর। রুক্ষ দৃষ্টি চলে গেলো শিকদার বাড়ির দিকে। একদল গু*ন্ডা এসে তো আর এমনি এমনি আইজাকে এখানে ফেলে যাবে না! এ বাড়িরই কোন সদস্যের কাজ এটা!

ইচ্ছে তো ছিলো এখনই এ গেট পেড়িয়ে পুরো বাড়িতে হা*ঙ্গামা করে আসতে। কিন্তু আইজা সেটা করবে না। নিজেকে সকল প্রকার ঝামেলা থেকে দূরে রাখার সিদ্ধান্ত নিয়েছে ও। যতটুকু সম্ভব এ সিদ্ধান্তে অটল থাকবে আইজা। তার ওপর আরফান আর সিমি হয়তো চিন্তা করছে!

এখানে সচরাচর কোন রিকশা অথবা ট্যাক্সি পাওয়া যায়না। কিছুদূর সামনে হেঁটে যেতে হয়! আইজা এক কদম যেতে না যেতেই বেশ শব্দ করে খুলে গেলো শিকদার বাড়ির মেইন গেট। মধ্য বয়স্ক এক লোক আইজাকে লক্ষ্য করে বলে উঠলো,
-“স্যার আপনারে ভেতরে যাইতে কইছে। আপনে চইলা গেলে স্যার অনেক রাগবো!”

লোকটা হয়তো নতুন। এর আগে দেখেনি আইজা। ও কিছু বলার আগেই কোথা থেকে যেন হুট করে একটা বাইক ওর সামনে এসে থামলো। ঘটনার আকস্মিকতায় কিছুটা পিছিয়ে গেলো আইজা। নিজের বুকে হাত দিয়ে কর্কশ গলায় বলে উঠলো,
-“আপনার এই অভ্যেসটা এখনো গেলো না!!!”

মাথা থেকে হেলমেটটা খুলে ফেললো সে। বাইক থেকে নেমে আইজার হাত ধরে বলে উঠলো,
-“বাইরে দাঁড়িয়ে তামাশা করে লাভ নেই!”

-“আপনি বলেছিলেন, আমার ওপর কোন জোর করা হবে না! না-কি এটাও মিথ্যে ছিলো!”
এক ঝটকায় নিজের হাত সরিয়ে নিলো আইজা।

-“আপনাকে কেউ জোর করবে না! আমি আপনাকে বাড়ি পৌঁছে দিচ্ছি! চলুন!”
নিজের বাইকের দিকে ইশারা করে বলে উঠলো সীমান্ত।

-“আইজা কোথাও যাবে না!”

মেইন গেটের সামনে দাঁড়িয়ে আছে স্যুট টাই পড়া এক লোক। আইজার চোখ প্রথমেই চলে গেলো তার মুখে থাকা লম্বা কাটা দাগে।
এই লোকটাকে আইজা আগে দেখেছে বলে মনে পড়ছে না! কিন্তু সে যে সীমান্তর কতটা অপ্রিয় সেটা তার চাহনি দেখেই বুঝতে পারছে আইজা। মুহুর্তেই আইজার হাত শক্ত করে চেপে ধরলো সীমান্ত!

-“আঙ্কেল! আমাদের বিষয়ে আপনার নাক না গলালেও চলবে!”

সীমান্তর মুখে আঙ্কেল শুনতেই আইজার আর বুঝতে বাকি নেই লোকটা কে! চোখ মুখ শক্ত হয়ে এলো আইজার। মস্তিষ্কের একাংশে ভেসে উঠলো ওর মায়ের মুখ! লোকটা তো পালিয়ে গিয়েছিলো!

সীমান্তর ক্রোধ দৃষ্টি উপেক্ষা করেই আইজার দিকে এগিয়ে এলো সেই খু*নি। মৃদু হেসে বলে উঠলো,
-“একদম নিজের মায়ের মতো হয়েছে!”
লোকটার মুখে ক্রু*র হাসি! আইজা নিজের মাথায় ঘটে চলা রক্তক্ষরণকে যেন আর ভুলে থাকতে পারছে না। খু*নিটা কেমন নির্লজ্জের মতো হেঁসে যাচ্ছে। সহ্য হচ্ছে না আইজার! মুখ ফুটে তীক্ষ্ণ কন্ঠে কিছু একটা বলতে গিয়েও চুপ হয়ে গেলো ও! এই ধরনের মানুষগুলোকে কিছু বলে লাভ নেই! উল্টো আইজার অসহায়ত্ব আরো প্রানভরে উপভোগ করবে সে!

-“আমি এখানেই থাকবো!”
সীমান্তকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে নিজেই বলে উঠলো আইজা। এই কয়েক সেকেন্ডে ওর মধ্যে যে কী হয়ে গেলো জানা নেই ওর! তবে এই মুহুর্তে আর পিছু হাঁটবে না সে! সবকিছু ভুলে চোখ বন্ধ করে থাকা আর হবে না ওর দ্বারা!

সীমান্তর দৃষ্টি জুড়ে বিস্ময়। যদিও সে চাহনি তার আঁখি জোড়ায় বেশিক্ষণ স্থায়ী হলো না। সেকেন্ডের মধ্যেই ক্রোধান্বিত রূপ ধারণ করলো,
-“আপনি এখানে না ফিরলেও হবে! চলুন আমার সাথে!”

-“আমি কোথাও যাবো না!”
আইজার তীর্যক দৃষ্টি জাফর শিকদারের ওপর স্থির হয়ে আছে। ঠোঁটের কোণে স্মিথ হাসি ঝুলিয়ে রেখেছে ও! তৎক্ষনাৎ সীমান্ত হেঁচকা টানে আইজাকে নিজের দিকে ঘুরিয়ে নিলো। তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে সে। যেন বেশ ভালো করেই বুঝতে পারছে আইজার উদ্দেশ্য!

-“আপনার সাথে কিন্তু আমার এখনো ডিভোর্স হয়নি! তাই আমার যখন ইচ্ছে আমি তখন এ বাড়িতে ফেরত আসবো!”
সীমান্তর থেকে নিজের হাত ছাড়িয়ে হনহন করে বাড়ির ভেতরে চলে গেলো ও!

আইজা চলে যেতেই সীমান্তর তীক্ষ্ণ দৃষ্টি জাফর শিকদারের ওপর পড়লো। কিন্তু মুখে কিছু বললো না ও। আইজার পিছু পিছু ছুটলো শিকদার বাড়ি!

-“আইজা!!!”

সীমান্তর কন্ঠ এক কানে ঢুকিয়ে অপর কান দিয়ে বের করে দিলো আইজা। ড্রইং রুমের সোফায় বসে টিভি দেখতে থাকা ব্যক্তির সামনে গিয়েই থামলো সে! আইজাকে টের পেতেই সামনে চলতে থাকা টেলিভিশনের পর্দা থেকে চোখ সরলো তার।

-“বাড়ির বৌ শেষ পর্যন্ত বাড়ি ফিরেই এলো!”

নাজিম শিকদারের কথায় স্পষ্ট বুঝতে পারছে আইজা যে আজ ওকে কিড*ন্যাপিং এর স্বীকার কার জন্য হতে হলো! ভেতরে ভেতরে দাঁতে দাঁত চেপে গেলেও নিজের মুখ থেকে হাসি এক মুহূর্তের জন্যও সরায়নি ও!

-“শিকদার বাড়ির বৌ’দের যে কতো সম্মান তাতো আজ টেরই পেলাম! নতুন যে আসবে তারও তো বিয়ের আগে এটা জানা দরকার! তাই ফিরে না এসে পারলাম না!”

আইজার ব্যঙ্গাত্মক ভঙ্গিতে বলা কথাগুলো একদমই পছন্দ হলো না নাজিমের। হুট করে বসা থেকে উঠে আইজার দিকে তেড়ে আসলো সে। তবে আইজার সামনে আসার আগে সীমান্ত নিজেই নাজিম শিকদারের সামনে দাঁড়িয়ে পড়লো!

-“রায়হানের বিয়েতে আইজার এখানে থাকার কোন প্রয়োজন নেই বাবা! আমি আগেও বলেছি, এখনো বলছি; আমি আপনার ছেলে, আমাকে যা ইচ্ছে করুন, আইজাকে না! মা’র সাথে যা হয়েছে তাতে আইজার কোন দোষ ছিলো না। তাই প্লিজ, আমার ভরসাটা ভাঙবেন না!”

সীমান্ত হয়তো শক্ত গলায় কথাগুলো বলতে চেয়েছিলো। কিন্তু পারেনি সে! আইজা জানে সীমান্ত নিজের বাবাকে ঠিক কতটা সম্মান করে! সীমান্তর এ অনুভূতিকে তারই সামনে অপমান করতে আর ইচ্ছে হলো না আইজার। নিঃশব্দে সীমান্তর রুমের দিকে পা বাড়ালো ও!

ঘরটা এখনো আগের মতোই আছে। আইজা যেভাবে ফেলে গিয়েছিলো ঠিক সেরকম! কিছুই পরিবর্তন করেনি সীমান্ত। অথচ আইজা যখন পুরো রুমের নকশা পাল্টে দিয়েছিলো কতটা বিরক্ত হয়েছিলো সে!

***

বিধ্বস্ত মুখে নিজের রুমে ফেরত এসে দরজা আটকে দিলো সীমান্ত। আইজাকে বোঝাতে হবে ওর! জাফর শিকদার যেহেতু এ বাড়িতে আছে সীমান্ত চায় না আইজা এখানে থাকুক! মেয়েটা নিশ্চয়ই আবারও কিছু প্ল্যান করছে!

আইজা বারান্দায় দাঁড়িয়ে ফোনে কারো সাথে কথা বলছে! নিঃশব্দে তাকে দেখে যাচ্ছে সীমান্ত। এই মানবীর মন পাল্টে যেতে কয়েক মুহূর্তই যথেষ্ট! ফোন কেটে পেছনে ঘুরতেই সীমান্তর মুখোমুখি হলো সে! মৃদু হেসে বলে উঠলো,

-“আমাকে যখন ছাড়তেই চাইছেন না, তখন সাথে রাখলে ক্ষতি কী!”

আইজার কন্ঠ জুড়ে একরাশ ধীরতা। সীমান্তকে কাবু করার উপায় বেশ ভালো করেই জানে সে। সাথে সাথেই আইজার কোমর জড়িয়ে নিজের দিকে টেনে নিলো ও। ঠান্ডা গলায় বলে উঠলো,
-“আপনি নিশ্চয়ই আমার জন্য এ বাড়িতে ফেরত আসার সিদ্ধান্ত নেননি! আপনার এসব টেকনিক আমার ওপর কাজ করবে না আইজা।”

এক টানে সীমান্তর চোখের চশমা খুলে নিলো আইজা। বাঁকা হেঁসে বলে উঠলো,
-“আপনার এই চশমাটা কাজ করলেই চলবে!”

চলবে…

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here