#অপ্রিয়_প্রেয়সী
#লিখা_তানজিলা
#পর্ব- ২৪ (প্রথমাংশ)
ক্রমাগত সামনে আগানোর চেষ্টা করছে সীমান্ত। কিন্তু প্রতিবারই দুই কদম এগিয়ে তারপর আটকে যাচ্ছে সে।
-“আইজা! আপনি কিন্তু লিমিট ক্রস করছেন!”
-“শুরুটা আপনি করেছেন!”
আইজার সোজাসাপটা জবাব। বেশ প্রফুল্লতার সাথেই সীমান্তর ছটফট করতে থাকা প্রচেষ্টা দেখে যাচ্ছে ও। যেন কোন হিংস্র বাঘকে খাঁচায় বন্দী করেছে আইজা। না! বাঘ না কুমির! অন্ধ কুমির!
পরক্ষনেই কী যেন মনে করে আইজা হুট করে সীমান্তর চোখের সামনে একটা ছোটখাটো চাবি তুলে ধরলো। তাতে যেন সে আরও ভয়ংকর রূপ ধারণ করলো। সীমান্তর ক্ষুব্ধ দৃষ্টির তীব্রতা বাড়ায় মুখে কৃত্রিম আতঙ্কিত ভঙ্গি এনে তাকালো আইজা। ড্রইং রুমে রাখা একটা টুল সীমান্তর কাছ থেকে বেশ খানিকটা দূরত্বে রেখে আরামে বসে সেই চাবিটার দিকে নজর রেখে বললো,
-“এতো রাগ দেখালে শরীরের সব এনার্জি হয়তো এখনই শেষ হয়ে যাবে। পরে সারারাত এখানে থাকবেন কী করে মাই ডিয়ার হাসবেন্ড!”
সীমান্তর ক্রোধান্বিত চাহনি মুহূর্তেই শান্ত হয়ে উঠলো। তা দেখে একটু সতর্ক হয়ে বসলো আইজা। কেন যেন সীমান্তর রাগী রূপের থেকে তার শান্ত রূপটাকেই বেশি ভয় পায় ও! তবে সে ভয় আইজা সীমান্তর সামনে প্রকাশ করলো না। উল্টো টাটকা ঘা’য়ে লবন ঘষে দেয়ার মতো তার চোখের সামনে সেই চাবিটা সীমান্তর ফোনের কাছে রাখলো ও যেটা এই মুহূর্তে সীমান্তর ধরা ছোঁয়ার বাইরে।
সীমান্তর দৃষ্টি একবার নিজের হাতে থাকা হ্যান্ডক্যাপ অতঃপর সেই চাবির দিকে গিয়ে ঠেকলো। তারপর কী যেন মনে করে একদম শান্ত ভঙ্গিতে সোফায় নিজের শরীরটা এলিয়ে দিলো সে। ধীর কন্ঠে বলে উঠলো,
-“আপনার কী মনে হয়, আপনি এ বাড়ি থেকে পালিয়ে গেলে আমি আপনাকে ধরতে পারবো না! যা করছেন ভেবে করছেন তো!”
আইজা সীমান্তর কথায় মৃদু হাসলো মাত্র। নিজের ফোন বের করে আরফানকে কল করলো ও। আগেই কথা হয়েছিলো ওদের। আইজা কল করতেই আরফান ওপর থেকে সিমিকে নিয়ে সোজা বাইরে দাঁড়িয়ে থাকা কালো গাড়িটায় গিয়ে চড়বে।
এদিকে আইজার নির্লিপ্ততা যেন সহ্য হলো না সামনে বসে থাকা ব্যাক্তির।
-“আশা করি আপনাদের খুঁজে বের করা আমার জন্য ওতটা সহজ হবে না! যেখানেই যান না কেন দরজা লক করতে ভুলবেন না।”
ঠান্ডা গলায় বলা সীমান্তর কথাগুলো কানে যেতেই দাঁড়িয়ে পড়লো আইজা। সীমান্তর কথায় কথায় হুমকি দেয়ার অভ্যেসে অভ্যস্থ হয়ে গেছে ও। আইজা মুখে হাসি নিয়ে সীমান্তর চোখে চোখ রেখে বলে উঠলো,
-“আমাদের খুঁজে বের করতে হয়তো তেমন কষ্ট হবে না আপনার। কিন্তু এবার আমার ভাইবোনকে এ বাড়িতে টেনে আনতে পারবেন কি-না সেব্যপারে আমি নিশ্চিত নই!”
সীমান্তর কিছু বলার অপেক্ষা না করেই বেরিয়ে এলো আইজা।
মেইন গেটের দিকে গার্ডগুলোর নাক ডাকার আওয়াজে ভ্রু কুঁচকে এলো ওর। সবগুলো ঘুমের দেশে চলে গেছে। ডোজ টাও তো বেশ কড়া ছিলো!
মেইন গেট থেকে কিছুদূর দাঁড়িয়ে থাকা ঐ কালো গাড়ির সামনে দাঁড়িয়ে আরো একবার পেছনে ফিরে তাকালো আইজা। কোন একসময় যে বাড়িটায় নিজের অস্তিত্ব প্রমান করাই ওর মূল উদ্দেশ্য ছিলো আজ সে বাড়ি থেকেই পালাচ্ছে ও! এতো অল্প সময়েই যে ওর জীবন এতটা ঘুরে আসবে কখনো কল্পনা করেনি আইজা!
-“এতো দেরি করলি কেন? তাড়াতাড়ি আয়!”
আরফানের কন্ঠে টনক নড়লো আইজার। চোখের এককোণে জমে থাকা অসহ্য অশ্রুকণা ঝেরে ফেললো ও। এসবের কোন মানে নেই। দ্রুত গতিতে গাড়িতে উঠে দরজা আটকে দিলো ও। তখনই বাইরে রিয়াদকে ট্যাক্সিসহ নামতে দেখে কিছুটা অবাক হলো আইজা। সে তো আজ ছুটি নিয়েছিলো! রিয়াদকে দেখে আরফান ড্রাইভিং সীটে বসে থাকা লোকটাকে তাড়া দিতেই দ্রুত গতিতে ছুটে চললো সে গাড়ি!
গত দুইমাস যাবৎ লোকটাকে অর্থাৎ ওর মায়ের সো কল্ড ভাইকে ঐ বাড়ির আশেপাশে ঘুরঘুর করতে দেখেছে আইজা। প্রথম প্রথম ব্যাপারটা উপেক্ষা করছিলো ও। কিন্তু পরবর্তীতে ঐ বাড়ি থেকে বের হওয়ার জন্য আর কোন উপায় চোখে পড়েনি আইজার।
আইজার মামা গাড়ি চালানোর পাশাপাশি একটু পর পর ঘাড় ঘুড়িয়ে দেখে যাচ্ছে ওদের। হয়তো ওরা এভাবে হুট করে গাড়িতে চড়ে বসবে কল্পনা করেনি সে। অবাক হওয়ারই কথা!
-“আমাদের পরে দেখলেও চলবে! এখন গাড়ি চালনায় মন দিন!”
আরফানের কথায় যেন থতমত খেয়ে গেলো লোকটা। একবার শুকনো কেশে বলে উঠলো,
-“এভাবে পালিয়ে আসার কারণ টা জানতে পারি!”
-“এভাবে প্রতিদিন ঐ বাড়ির সামনে গাড়ি নিয়ে দাড়িয়ে থাকার কারণটা আগে জানতে চাই!”
আরফানের পাল্টা প্রশ্নে যেন লোকটা এবার রেগেই গেলো। হুট করে ব্রেক কষলো সে।
-“মজা করছো আমার সাথে বেয়াদব কোথাকার। একদম নিজের মায়ের মতো হয়েছে!!”
লোকটার শেষের কথায় এবার আইজার রাগ উঠে গেলো। শক্ত কন্ঠে বলে উঠলো,
-“একদম আমাদের মাকে নিয়ে কোন কথা বলবেন না! আর আপনি তো আমাদের দেখতেই আসতেন তাই না! আজকে থেকে সে সুযোগ অনেক পাবেন আপনি! কষ্ট করে আর রাতে ঐ বাড়ি যেতে হবে না!”
আইজার কথা শুনে পাল্টা কোন জবাব দিলো না ওর মামা। পুনরায় গাড়ি স্টার্ট করলো সে!
*****
বেশ অনেকক্ষণ যাবৎ অন্ধকার এক ঘরে উল্টো লটকে আছে সাহিল। শরীরের সব রক্ত মাথায় চড়লো বলে! কে বা কারা ওকে ধরে এনেছে জানা নেই ওর। তরতর করে ঘামছে ক্রমাগত। হঠাৎ সামনে থাকা জঙধরা দরজাটা খুলতেই কিছুটা সতর্ক হয়ে উঠলো সাহিল। দরজা ভেদ করে প্রবেশ করা ব্যাক্তিকে দেখতেই এতো কষ্টেও মাঝেও মুখে বাঁকা হাসি ফুটিয়ে তুললো ও। মৃদু কন্ঠে বললো,
-“আরে নাজিম স্যার! কতদিন পর আপনার দেখা পেলাম! এতো কষ্ট করে কিডন্যাপ কেন করতে গেলেন? একবার ফোন করলেই আমি ছুটে চলে আসতাম! এখন বলুন আমার চাকরিটা কবে ফেরত পাচ্ছি? এতোদিন পর শুধু শুধু তো আর এখানে আনা হয়নি আমাকে! নিশ্চয়ই কোন কাজ আছে!”
সাহিলের কথা শুনে নাজিম শিকদারের মুখ ক্রমশ লাল হয়ে উঠলো। কর্কশ গলায় বলে উঠলো,
-“শেষবার যে কাজ দিয়েছিলাম সেটা তো হলো না তোর দ্বারা! এখন আবার চাকরি চাওয়ার সাহস কী করে হয় তোর!”
সাহিল বিস্মিত চোখে বললো,
-“সে তো বহুমাস আগের কথা! আপনার এখনো মনে আছে! এই বয়সেও স্মৃতিশক্তি বেশ চলে তো দেখছি! সে ঘটনার পরও আমার চাকরি থাকায় মনে করেছিলাম আপনি হয়তো সব ভুলে গেছেন!”
নাজিম শিকদার মুখে কিছু বললো না। পাশে দাড়িয়ে থাকা লম্বা চওড়া এক লোককে কী যেন ইশারা করলো মাত্র। লোকটা সাথে সাথেই সাহিলের বাঁধন খুলে ওকে নিচে নামালো। ছাড়া পেয়ে মুখের একপাশে লেগে থাকা রক্তের চিহ্ন মুছে নিলো সাহিল।
নাজিম সামনে রাখা চেয়ারে বসে বলে উঠলো,
-“কী এমন কাজ দিয়েছিলাম তোকে! শুধু বলেছিলাম সীমান্তর সাথে আইজার বিয়ের আগেই আইজাকে নিয়ে পালাতে! কিন্তু তুই আমার নাম্বার ব্লক করে গা ঢাকা দিলি। আর কয়েকদিন পর এমনি অফিসে চলে এলি যেন কিছু হয়নি!!”
সাহিল তো এই মুহুর্তেরই অপেক্ষা করছিলো। লম্বা একটা শ্বাস ছাড়লো ও। অতঃপর জোড়ালো কন্ঠে বলতে শুরু করলো,
-“এতোদিন পর এই প্রশ্ন করছেন আমাকে! আমি কখনও গা ঢাকা দেইনি স্যার। যা করার আপনার ছেলে করেছে। বিয়ের দিন আইজা নিজে না এলে আমি ওকে তুলে নিয়ে আসতাম। কিন্তু আপনার ছেলে আমাকে আটকে মেরে হসপিটালে পাঠিয়েছে। সেটাতেও ক্ষান্ত হয়নি! মাথায় বন্দুক তাক করে আইজাকে ফোন করিয়ে নিজের মুখে সব সত্যি বলতে বাধ্য করেছে তাও হাসতে হাসতে। শুধু আপনার ব্যপারটা চেপে গেছে সে! সীমান্তর মাথার তারটা আপনার মতোই ছেড়া! একেতো আমি হাত পা ভেঙে হসপিটালের বেডে পড়ে ছিলাম। আর সে আমাকে বলছিলো হাসতে হাসতে আইজাকে সব সত্যি বলতে!!! মনে পড়লেও শরীর কাটা দিয়ে যায়!!”
সাহিলের চোখে মুখে কৃত্রিম ভয়ের রেখা ফুটে উঠলো। পরক্ষণেই উচ্চস্বরে হেসে উঠলো সে। নাজিম মুখে থমথমে ভাব এনে তাকিয়ে আছে সাহিলের দিকে। সাহিল হাসি বন্ধ করে সামনে বসে থাকা নাজিম শিকদারের নিস্তব্ধ মুখে তাকিয়ে ব্যঙ্গার্ত্বক ভঙ্গিতে বলে উঠলো,
-“আমার ধারণাই তাহলে সঠিক ছিলো! আপনার ছেলের মতিগতি আপনি কিছুই জানেন না! সে আপনার পেছনে আপনাকেই বাঁশ দিয়ে যাচ্ছে! আপনাকে ধোঁকা আমি দেইনি বরং আপনার ছেলে দিয়েছে!”
চলবে…
আগের পর্ব
https://m.facebook.com/groups/371586494563129/permalink/525751835813260/