#অপ্রিয়_প্রেয়সী
#লিখা_তানজিলা
#পর্ব – ২৪ (শেষাংশ)
থমথমে মুখে সোফায় বসে আছে সীমান্ত। বাইরে থেকে কারও পদচালনার আওয়াজ পেয়েও সেদিকে চোখ ফেরালো না। এক দৃষ্টিতে সামনে তাকিয়ে সামনে তাকিয়ে দাঁতে দাঁত চেপে যাচ্ছে ও। একটু আগে ঘটে যাওয়া ঘটনা মনে করতেই শরীরের সমস্ত রক্ত যেন মাথায় চড়ে উঠছে। মনে হচ্ছে আইজাকে যদি এই মুহুর্তে হাতের নাগালে পেতো তাহলে হয়তো তার পা জোড়া ভেঙে গুড়িয়ে দিতো সে!
-“দাঁড়িয়ে থেকে আর কতো তামাশা দেখবেন আপনি! চাবিটা চোখে পড়ছে না!”
রিয়াদের একই স্থানে হা করে দাঁড়িয়ে থাকা টের পেয়ে তাকে উদ্দেশ্য করে হুংকার দিয়ে উঠলো সীমান্ত। লোকটা কিছু বলতে গিয়েও সীমান্তর রক্তচক্ষুর নমুনা দেখে নিজের খোলা মুখটা বন্ধ করে ফেললো! রিয়াদ সীমান্তর হাত মুক্ত করতেই সীমান্ত হনহন করে মেইন গেট পর্যন্ত গিয়ে তবেই থামলো।
পাঁচজন গার্ডই ঘুমে কাতর অথবা বলতে গেলে অজ্ঞান অবস্থায় পড়ে আছে। ভাঙা কাপের টুকরোগুলো ছড়িয়ে আছে বেশ খানিকটা জায়গা জুড়ে। অস্বস্তি আর ক্রোধে বন্ধ হয়ে এলো সীমান্তর আঁখি জোড়া। এরপর সোজা স্টাডি রুমে গিয়ে ঢুকলো সে। চেয়ারে বসে রিয়াদকে রুক্ষ কন্ঠে আদেশ দিয়ে উঠলো,
-“পাখিকে নিয়ে আসুন!”
রিয়াদ একটু ইতস্ততভাবে তাকালেও কিছু বলে উঠলো না। নিঃশব্দে চলে গেল সে।
***
এই মুহুর্তে ড্রইংরুমে সীমান্তর সামনে কাচুমাচু হয়ে দাঁড়িয়ে আছে পাখি। সীমান্ত সময় নষ্ট না করে শক্ত গলায় প্রশ্ন করে বসলো,
-“কফি কে বানিয়েছিলো?”
-“আমি।”
পাখির ছোট্ট জবাবে যেন সন্তুষ্ট হলো না সীমান্ত। চোখে মুখে সে ভাব স্পষ্ট ফুটে উঠলো।
-“আইজা কফিতে কিছু মিশিয়েছিলো বা মেশাতে বলেছিলো আপনাকে?”
পাখি প্রথমে একটু উদ্ভটভাবে তাকালেও পরে মিনমিন করে বলে উঠলো,
-না তো!”
-“স্পষ্ট করে বলুন!!”
সীমান্তর গলার ভাজে তীক্ষ্ণতার রেশ। বলতে গেলে একপ্রকার চিৎকার করে ওঠার মতো। সীমান্তর কন্ঠে হুট করে এরূপ পরিবর্তনে কিঞ্চিৎ কেঁপে ওঠে পাখি। সামনে দাঁড়িয়ে থাকা ভীত প্রকৃতির মেয়ের ফুপিয়ে কান্নার আওয়াজে যেন আরও বিরক্তি চেপে ধরলো সীমান্তকে। তখনই রিয়াদ সীমান্তর একটু কাছে এসে বলে উঠলো,
-“স্যার কী করছেন! ও আপনার এ রূপে অভ্যস্থ না!”
রিয়াদের কথায় নিজেকে একটু সামলে নিলো সীমান্ত। নরম চোখে সামনে তাকাতেই ভ্রু কুঁচকে এলো ওর। পাখি সামনে নেই। এত কম সময়ে কোথায় গেলো মেয়েটা!
ভাবনার মাঝেই হঠাৎ হাতে তীক্ষ্ণ ব্যথা অনুভুত হওয়ায় একপ্রকার লাফিয়ে উঠলো সীমান্ত। পাশেই লাঠি হাতে ওর দিকে রক্তআঁখি নিয়ে তাকিয়ে আছে পাখি। সীমান্তর মনে হচ্ছে এই মুহুর্তে সে বিস্ময়ের শেষ সীমানায় পৌঁছে গেছে।
-“রিয়াদ আমি কী ভুল দেখছি! প্লিজ বলুন এই মেয়েটা মাত্র আমার হাতে লাঠির আঘাত করেনি!”
সীমান্তর এ কথা বলতে দেরি পাখির পুনরায় সীমান্তর দিকে লাঠিচার্জ করতে দেরি হলো না। তবে এবার সীমান্ত লাঠিটা ওর মাথায় পড়ার আগেই ধরে ফেললো। বিস্মিত কন্ঠে জিজ্ঞেস করে বসলো,
-“আপনার মাথা ঠিক আছে! কী করছেন এসব….!”
-“তোর সাহস কী করে হয় আমার ওপর চিৎকার চেচামেচি করার! তোর বউ কী করেছে সেটা তোর বউকেই জিজ্ঞেস কর না! আমাকে ধমকাচ্ছিস কেন!”
যে মেয়েটাকে আজ পর্যন্ত কারো দিকে চোখ তুলে তাকাতে দেখেনি সীমান্ত সে আজ ওকে তুইতুকারি করছে! রিয়াদের হয়তো এতোক্ষণে টনক নড়লো। পাখিকে টেনে হিঁচড়ে লাঠি থেকে আলাদা করলো সে। তবে এবার সীমান্তর স্থানে পাখির টার্গেট হয়ে উঠলো রিয়াদ। লাঠি থেকে আলাদা হওয়ার সাথে সাথেই সজোরে রিয়াদের চুল টেনে ধরলো মেয়েটা।
রিয়াদ এই মুহূর্তে নিজের মাথার চুল বাঁচাতে ব্যস্ত! সীমান্ত ভ্রু কুঁচকে মনোযোগ সহকারে দুই হাত বুকে ভাজ করে সবটা দেখে যাচ্ছে। শেষমেশ সহ্য করতে না পেরে রিয়াদ পাখিকে একপ্রকার ছুড়ে ফ্লোরে ফেলতেই ওখানে অজ্ঞান হয়ে পড়ে রইলো সে। রিয়াদ নিজের উষ্কখুষ্ক এলোমেলো চুলগুলো ঠিক করতে করতে বললো,
-“স্যার এই মেয়ের মনে হয় মানসিক সমস্যা আছে! আপনারা কাউকে কাজে রাখার আগে খোঁজ খবর নেন না? পাগল একটা!”
সীমান্ত পাখির জ্ঞানশূণ্য শরীরের দিকে তাকিয়ে কিছু একটা চিন্তা করে বলে উঠলো,
-“একে রাজিয়ার ঘরে ফেলে আসুন। সকালে দেখছি!”
***
বারান্দায় প্রবেশ করতেই শীতল হাওয়ার স্পর্শ অনুভব করছে সীমান্ত। আজকের আবহাওয়াটা মন্দ না। বারান্দার এক সাইডে রাখা লম্বা কেবিনেটে চোখ গেলো সীমান্তর। নিজের রুমে কোন ক্যামেরা না থাকলেও বারান্দার এ কেবিনেটে ছোট একটা ক্যামেরা সেট করা আছে! প্রয়োজন হলেই সেই সিসি ক্যামেরা চেক করে ও!
আইজাকে মিথ্যে বলেছিলো সীমান্ত। আরফান আর সিমিকে এ বাড়িতে আনার মূল উদ্দেশ্য আইজাকে কন্ট্রোলে রাখা ছিলো না। বরং আইজার বাবা আরমানকে গুহা থেকে বের করার জন্য ছিলো! যদিও সীমান্তর এ পরিকল্পনা সেরকম ফলপ্রসু হয়নি। না লোকটা নিজের স্ত্রীর মৃত্যুর খবরে এসেছে আর না ছেলে মেয়েদের খবর নিতে!
সে রাতে আইজাকে সাহিলের ফ্ল্যাটের নিচ থেকে বের হতে দেখে ইচ্ছে হচ্ছিলো ওদিকেই দুটোকে একসঙ্গে মাটি চাপা দিয়ে আসতে! কিন্তু সীমান্ত তা করেনি। নিজেকে সামলে নিয়েছিলো। সব অনুভূতিকে প্রশ্রয় দিতে নেই।
যদিও সীমান্তর মনে একটা খটকা লেগেই ছিলো। আইজা সে রাত বারান্দার দরজা আটকে বেশ অনেকক্ষণ দাড়িয়ে ছিলো। বাইরের সিসিটিভি পরেরদিন চেক করেছিলো ও। আইজার হয়তো বারান্দায় থাকা ক্যামেরা সম্পর্কে জানা ছিলো না। তখনই সীমান্ত জানতে পারে যে আইজা সে রাত সাহিল না বরং আরমানের সাথে দেখা করতে বাইরে গেছিলো!
সীমান্ত চেয়েছিলো আইজাকে ব্যবহার করে আরমান আজাদের মুখ থেকে সত্যিটা বের করতে! সীমান্তর মায়ের খুনির সাথে আরমানের যোগসূত্রতা আছে সে বিষয়ে সীমান্ত শতভাগ নিশ্চিত। শুধু কে সেটাই জানা বাকী! আরমান খুব বেশি হলে হয়তো তার সহযোগী ছিলো। আর শুধুমাত্র কোন অনিশ্চিত সহযোগীকে ধরলেই তো সব কিছুর সমাধান হয়ে যাবে না! মূল মাথাটাই যদি ধরা ছোঁয়ার বাইরে চলে যায় তাহলে তো এসব কিছু অযথাই রয়ে যাবে !
একবার পেছনে ফিরে খালি ঘরটার দিকে চোখ বুলালো সীমান্ত। মনের অজান্তেই ঠোঁটের কোণে জায়গা করে নিলো সুক্ষ হাসির ঝলক। নেশা জিনিসটা বড্ড অস্বস্তিদায়ক। হৃদপিণ্ড ক্ষতবিক্ষত হয়ে যাওয়ার ভয়েও তা ছেড়ে থাকা মুশকিল! প্রেম যতটা শান্ত নেশা ঠিক ততটাই অশান্ত! ধীর পায়ে আয়নার সামনে গিয়ে দাঁড়ালো সীমান্ত। আজ সে আইজার দেয়া পাঞ্জাবি পড়ে ছিলো সারাদিন। এই পাঞ্জাবি সেট ছাড়া আর কিছু তো সে আস্ত রাখেনি! সব জ্বালিয়ে ছারখার করে দিয়েছে।
কখনো কখনো নিজের আচরণ দেখে সীমান্ত নিজেই কৌতুহলী হয়ে ওঠে। ও আসলেই আইজাকে ভালোবাসে না তো! ওর জায়গায় অন্য কেউ হলে এতোক্ষণে তার জায়গা হসপিটালের বেডে হতো! কিন্তু আইজার সে হাল তো সীমান্ত এখনও করেনি! নিজের অনুভূতির জালে অন্যদের বিভ্রান্ত করতে করতে এই মুহুর্তে ও নিজেই সে জালে বন্দী হয়ে গেছে!
পরক্ষনেই শব্দ করে হাসতে শুরু করলো সীমান্ত। বিছানার একপাশে আরামে বসে পড়লো ও। আজকাল মাথায় উদ্ভট খেয়াল বেশি আসছে! নিজের বলা একটা কথা মনে পড়লো সীমান্তর। মানুষ যাকে ভালোবাসে তাকে সে সুরক্ষিত রাখার চেষ্টা করে। যেমন টা আইজা করছে ওর ভাইবোনদের জন্য। কিন্তু সীমান্ত কখনো আইজার সুরক্ষার ব্যপারে ভাবেনি। বরং এ বাড়িতে আইজা সুরক্ষিত না জেনেও এখানেই আটকে রাখতে চেয়েছিলো সীমান্ত ওকে!
চোখদুটো মরিচের মতো জ্বলছে। বালিশে মাথা রেখে চোখ টা বন্ধ করলো সীমান্ত। জীবনের এতগুলো বছর একা ঘুমিয়েছে। কিন্তু বিগত ছয় মাসেই সেই অভ্যেস এতোটা গুরুতর ভাবে কেন বদলে গেলো বুঝতে পারছে না সে।
না চাইতেও মস্তিষ্কে ভেসে বেড়াচ্ছে সে মুখ। সীমান্তর স্পষ্ট মনে আছে ওর বিয়ের দিন। রক্তলাল বর্ণের শাড়িটা তার অঙ্গে বেশ ভয়ানক ভাবে মিশে ছিলো। মনে হচ্ছিলো এই শাড়িটা হয়তো তাকে ছাড়া অন্য কারও গায়ে কখনোই মানাতো না! অন্তত সীমান্তর চোখে তো না-ই।
বিষন্ন চাহনিতে সীমান্তর চোখে চোখ রেখেছিলো সে একবার। নিজের দৃষ্টি ঐ নিষ্ঠুর মানবী থেকে সরাতে গিয়ে রীতিমতো যুদ্ধ করতে হয়েছিলো ওকে নিজের সাথে!
বেশ হেলাফেলায় সেই শাড়িটা কিনেছিলো সীমান্ত। আইজাকে বিয়ে করা নিয়ে তেমন কোন উৎসাহই ছিলো না ওর মাঝে। ইচ্ছে ছিলো বিয়ের পরও তার কাছে ঘেঁষবে না সীমান্ত। কিন্তু নিজের সে প্রচেষ্টায় শেষমেশ অসফলই রয়ে গেলো সে। মেয়েটা সীমান্তর কাছ থেকে একটু মনোযোগ পাওয়ার আশায় কতসব উদ্ভট কান্ড করে বেড়াতো! যদি সে সীমান্তর অন্তরের হাল একটু হলেও বুঝতো তাহলে হয়তো এতো কষ্ট করে নিজেকে হাসির পাত্রী বানানোর প্রয়োজনবোধ করতো না সে!
-“অসহ্য!”
আনমনেই বিড়বিড় করে উঠলো সীমান্ত। চেয়েছিলো যা করার সকালে করবে। আজ রাতটা ম্যাডামকে তার ক্ষনস্থায়ী বিজয়ের খুশিতে ঘুমোনোর সুযোগ দিতে চেয়েছিলো ও। কিন্তু না! হবে না ওর দ্বারা। আজ আইজার সামনে দূর্বল হওয়ায় যত ঝামেলা হলো! নিজের ওপরই যত রাগ হচ্ছে ওর!
দ্রুত শোয়া থেকে উঠে বসলো সীমান্ত। আইজা চায় সীমান্ত যেন আরফান আর সিমিকে এ বাড়িতে জোর করে না আনে। বেশ!
একমাত্র স্ত্রীর এই আবদার রাখবে ও! হনহন করে বাড়ির বাইরে বেড়িয়ে এলো সীমান্ত। বাইক স্টার্ট করেই ছুটে চললো সে। এই দক্ষিণ মেরু তার উত্তর মেরুকে একা ছাড়বে না। অন্তত আজ আইজা যা করেছে তার পাল্টা জবাব না দিয়ে তো একদমই না!
চলবে…
আগের পর্ব
https://m.facebook.com/groups/371586494563129/permalink/527731255615318/