#অপ্রিয়_প্রেয়সী
#লিখা_তানজিলা
#পর্ব – ২৮
-“তোমার প্রেগনেন্সির প্রায় তিন মাস হয়ে গেছে। আর তুমি জানো না! নিজের মধ্যে কোন পরিবর্তন নজর পড়েনি তোমার?”
ভদ্রমহিলার কথায় কিঞ্চিত অস্বস্তিতে চোখ ঘুরিয়ে নিলো আইজা। মৃদু গলায় বললো,
-“আমি মনে করেছি সব টেনশনের জন্য হচ্ছে!! এতোকিছু মাথায় আনার সময় পাইনি।”
তিনি যে আইজার জবাবে সন্তুষ্ট নন সেটা তার মুখভঙ্গিতে ভালো করেই ফুটে উঠলো। সে গমগমে গলায় আইজার দিকে তাকিয়ে বলে উঠলো,
-“তোমার একবার হলেও চেক-আপ করানো উচিত ছিলো!”
আইজা এবার নিরব হয়ে রইলো। ভদ্রমহিলাও চুপচাপ প্রস্থান করলো। খাটের একপাশে কারো উপস্থিতি টের পেয়ে সেদিকে নজর ঘুরালো আইজা। আরফান বেশ সতর্ক ভঙ্গিতে বসে পড়েছে।
-“এখন কী করবি?”
-“জানি না।”
-“জানি না বললেই তো হবে না আপু! সীমান্ত হয়তো পাগলের মতো খুঁজছে তোকে!”
-“জানি না আমি! কিচ্ছু জানি না! কানের সামনে এতো ভনভন করিস না তো!”
এবার কিছুটা উচ্চস্বরেই বলে বসলো আইজা। আরফান থমথমে মুখে তাকিয়ে আছে।
-“আবার শুরু!!!”
সিমির কন্ঠে কড়া বিরক্তির ছাপ। আইজার গলার আওয়াজ যে বাহিরে পর্যন্ত চলে গেছে তা বুঝতে সময় লাগলো না ওর। একটু আগে বেরিয়ে যাওয়া আইজার মামী ইনসিয়া পুনরায় ফিরে এলো। তার মুখে লেগে থাকা রক্তিম আভা দৃষ্টিগোচর হলো না আইজার।
-“এটা কোন চিৎকার চেচামেচির জায়গা না! তোমাদের মামা একটু পরেই চলে আসবে। ততক্ষণ ধৈর্য ধরে চুপচাপ বসে থাকো!”
-“ধৈর্য! এই মহিলা হয়তো এর বানানও জানে না! কথায় কথায় শুধু তেজ!!”
আরফানের তীক্ষ্ণ কন্ঠের বিপরীতে আইজাও তীক্ষ্ণতার সহিত মুখ ঘুরিয়ে জানালার বাইরে চোখ রাখলো। সিমি আইজার মামীর রেখে যাওয়া ফোনে গেমস খেলতে শুরু করেছে। যেন সামনে চলা ঘটনায় তার কোন আগ্রহ নেই।
ইনসিয়া শান্ত গলায় বলে উঠলো,
-“আরফান, এটা ঝগড়া করার সময় না! আর প্রেগনেন্সিতে মুড সুইংয়ের কারণে এরকম আচরণ করে অনেকেই। ওকে একটু একা থাকতে দাও!
-“মুড সুইং! এর দিনে চব্বিশ ঘন্টাই মুড সুইং থাকে!”
কর্কশ গলায় কথাগুলো বলেই রুম থেকে চলে গেলো আরফান। ইনসিয়া হয়তো কিছু বলতে চেয়েছিলো কিন্তু বাইরে থেকে কেউ একজন ডাকতেই সে-ও হনহন করে বেরিয়ে গেলো।
পেটে চিনচিন ব্যথা অনুভব করছে আইজা। এক হাত নিজের পেটে রেখে সেদিকে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো ও। এই মুহুর্তে কী অনুভূতি ওর মাঝে বাসা বেঁধেছে বুঝতে পারছে না সে। ওর শরীরে আরও একজনের অস্তিত্ব আছে! ভাবতেই কেমন যেন লাগছে। মস্তিষ্কে হানা দিচ্ছে অসংখ্য চিন্তা। আচ্ছা, পরিস্থিতি যদি অন্যরকম হতো তাহলে কী ও খুশি হতো! এ প্রশ্নের জবাব জানা নেই আইজার।
মনে হচ্ছে ও কোন একশো টনের পাথরের নিচে চাপা পড়ে আছে। তাও একটা না অনেক গুলো! আর এখন এটাই বুঝতে পারছে না যে কোন পাথরটা নিজের ওপর থেকে আগে সরাবে! জানালার বাইরে চোখ গেলো আইজার। কালো মেঘের দলে আকাশ টা কেমন ভারী হয়ে আছে। এই হয়তো আকাশ ভাঙা ঝর্ণা নেমে আসবে! কিন্তু না! কাল রাত থেকে শুধু মেঘেদের ভ্রমনই চোখে পড়ছে ওর। এর বেশি কিছু না!
সিমির দিকে চোখ পড়তেই এক ছো মেরে ওর হাত থেকে ফোন কেড়ে নিলো আইজা। সিমির ফোলা ফোলা চোখেও এবার কালো মেঘের দেখা মিললো।
-“এভাবে তো চোখগুলো নষ্ট হয়ে যাবে! আর ফোন দেখা চলবে না। চুপচাপ ঘুমা!”
সিমি ভ্রু কুঁচকে তাকালো। রুক্ষ কন্ঠে বলে উঠলো,
-“রাতে আমাকে ঘুমোতে দেয়নি কে! আজ ছোট্ট বেবির জন্য কিছু বললাম না! নাহলে তোমার মাথার সবগুলো চুল ছিড়তাম!!”
সিমির বলতে দেরি আইজার ওর মাথায় করে রাখা এক ঝুঁটি টেনে ধরতে সময় লাগলো না। সিমি মৃদু আর্তনাদ করে নিজের ঝুঁটি ছাড়ানোর চেষ্টা করছে। তা না পেরে কাঁদো কাঁদো গলায় বলতে লাগলো,
-“ছাড়ো! ছাড়ো আমাকে! আমি কিন্তু আম্মুকে…!”
মাঝ পথেই কথা থামিয়ে দিলো সিমি। আইজাও ওর ঝুঁটি ছেড়ে দিয়ে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। পরক্ষনেই এক টানে সিমিকে নিজের কাছে এনে বসালো ও। মেয়েটার মাথা নিজের বুকে রেখে বললো,
-“অনেক ঝগড়াঝাটি হয়েছে। এখন ঘুমা!”
আলতো হাতে সিমির মাথায় বিলি কেটে দিচ্ছে আইজা। কয়েক সেকেন্ড পর সিমিও আইজার পেটে হাত বুলানো শুরু করলো। আইজা কপাল কুঁচকে জিজ্ঞেস করে বসলো,
-“কি করছিস?”
সিমি ওর হাত টা আইজার পেটের ওপর স্থির রেখেই বলে উঠলো,
-“বেবিকে ঘুম পাড়াচ্ছি! তুমি তো একটা গাঁধি! একটুও কমন সেন্স নেই!”
সিমির পিঠে হালকা চাপর মারলো আইজা। তীক্ষ্ণ কন্ঠে বলে উঠলো,
-“বড়দের সাথে কেউ এভাবে কথা বলে!”
-“তোমার থেকেই শিখেছি!”
সিমির সোজাসাপটা জবাব। এরপর আর মুখ খুললো না আইজা।
ওর পেটে বুলোতে থাকা ছোট হাতটা একসময় থেমে এলো। সিমির কপালে আলতোভাবে ঠোঁট ছোয়ালো আইজা। মেয়েটার ঘুমন্ত মুখটা কেমন যেন বিষন্নতার আভায় লেপ্টে আছে। সেদিকে তাকাতে ইচ্ছে করে না আইজার। চোখ পড়লেই মন ভারী হয়ে আসে।
সিমির মাথা বালিশে রেখেই উঠে দাঁড়ালো আইজা। সকাল সকাল জোর করে ভাত খাওয়ানো হয়েছিলো ওকে! যদিও পেটে তেমন কিছু টেকেনি। পরে সুপ খেয়েই এতোক্ষণ পড়ে ছিলো। এই মুহুর্তে প্রচন্ড কফি ক্রেভিং হচ্ছে আইজার। কফি তো তার চাই ই চাই!
****
কফি হাতে নিয়ে করিডোর ঘুরে ফিরে দেখছে আইজা। ক্লিনিকের দোতলার একপাশে ছোটখাটো একটা থাকার ফ্ল্যাট। ইনসিয়ার প্রয়োজন হলে সেদিকে থাকে হয়তো। এতোক্ষণ সেই ফ্ল্যাটেই ছিলো ও। এখন সিঁড়ি বেয়ে ছাঁদে ওঠাই ওর উদ্দেশ্য।
এক রঙের বেশ কিছু পর্দায় ছেয়ে আছে সম্পূর্ণ ছাদ। কোনমতে ছাদের এককোনা খালি পেলো আইজা। সেদিকে দাঁড়িয়েই এখানকার পরিবেশে চোখ বুলিয়ে যাচ্ছে ও। জায়গাটায় কেমন যেন গ্রাম্য এক ভাব আছে। শহুরে চঞ্চলতার রেশ নেই এখানে। তার ওপর বেশ উঁচু নিচু রাস্তা চারিদিকে।
হঠাৎ উল্টোদিকে কিছু চিৎকার চেচামেচির আওয়াজে কিঞ্চিত লাফিয়ে উঠলো আইজা। মনে হচ্ছে কোথাও গন্ডগোল চলছে। শব্দের উৎস ক্লিনিকের ঠিক উল্টো দিক থেকে। দ্রুত পায়ে ছাদের অপর পাশে গেলো ও। ছাদে আরও একজন মহিলা কাপড় শুকোতে দিচ্ছিলো। সে-ও আইজার পাশে এসে দাঁড়ালো।
বেশ কয়েকজন শক্তপোক্ত বিশালদেহী ব্যাক্তি বড় সাইজের লাঠি নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। আর তাদের সামনে দাঁড়িয়ে আছে ইনসিয়া অর্থাৎ ওর মামী। ভদ্রমহিলা বেশ সাহস নিয়ে তাদের সাথে কথা বলছে। আশেপাশে আরও মানুষ জড়ো হলেও ধারে কাছেও কেউ যাচ্ছে না। সবাই দূর থেকে দেখে যাচ্ছে।
-“ওরা আবারও!! আজকেও তো জামিল সাহেব নাই!”
পাশে থাকা মহিলার কন্ঠ কানে যেতেই সেদিকে নজর ঘুরালো আইজা। কৌতুহলী কন্ঠে জিজ্ঞেস করলো,
-“এরা কারা?”
মহিলার চোখ এখনও নিচেই। ওখানে তাকিয়েই বলতে লাগলো,
-“ওরা এখানে রিসোর্ট খুলতে চায়। কিন্তু ইনসিয়া ম্যাম এই জমি বিক্রি করতে চান না। তাই কয়েকদিন পর পর এসে হুমকি দিয়ে যায় এরা। যদিও জামিল সাহেব থাকলে এরা তেমন আসে না।”
আর কিছু জিজ্ঞেস করলো না আইজা। লম্বা একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়লো ও। আপাতদৃষ্টিতে সবকিছু শান্ত মনে হলেও পুরোপুরি স্বস্তিতে কেউই নেই।
-“তুমি জামিল সাহেবের ভাগ্নি না!”
সেই মহিলার দৃষ্টি এই মুহুর্তে আইজার দিকে। যদিও জবাব দেয়ার সময় আইজা পেল না। নিচে আরফানকে দেখেই একটু সতর্ক হয়ে উঠলো ও। এতোক্ষণ চিৎকার চেচামেচি করা লোকগুলো যেন এখন হামলা করার উপক্রম। আরফার আর ইনসিয়ার কথা তেমন বুঝা না গেলেও লোকগুলোর কথা স্পষ্ট ছাঁদ থেকেও শোনা যাচ্ছে।
-“আমাগো ভাইরে চিনোস তোরা! এটা কিসের ক্লিনিক, এরকম হাজারটা ক্লিনিক কেনার ক্ষমতা আছে তার! আর তুই!” লোকটার দৃষ্টি এই মুহুর্তে আরফানের দিকে। সে কর্কশ গলায় আরও বললো, -“তোর এতো দরদ কিসের! একদম এই চোখ তুইলা ফেলুম!!”
সবটা ঠান্ডা চোখে দেখে গেলো আইজা। ছাদের রেলিঙের ওপর রাখা ওর হাত মুহূর্তেই শক্ত মুঠ হয়ে এলো। শীতল কণ্ঠে পাশে দাঁড়িয়ে থাকা মহিলাকে বললো,
-“এরা কী আমার ভাইয়ের চোখ তুলে ফেলার কথা বললো মাত্র!”
উত্তরে সেই মহিলা কিছু বললো না। কেমন যেন অদ্ভুত চোখে তাকিয়ে আছে আইজার দিকে। তবে সেটা নিয়ে ভাবার সময় আইজার নেই।
ও এবার কিছুটা ধীর কন্ঠে বলে উঠলো,
-“আমার এক্ষুনি একটা স্প্রে বোতল চাই!”
****
চোখে রঙিন সানগ্লাস আর মুখে মাস্ক পড়ে এক হাত পেছনে রেখে নিচে নেমে এলো আইজা। লোকগুলোর মধ্যে একজন আরফানের কলার ধরে ছিলো। আইজাকে চোখে পড়তেই সবার নজর এখন ওর দিকে। এই মুহুর্তে নিজেকে সেলিব্রিটি মনে হচ্ছে আইজার।
-“তুমি এখানে কী করছো? ভেতরে যাও!”
-“যা এখান থেকে! দয়া করে কোন ঝামেলা করিস না!”
ইনসিয়া আর আরফানের নির্দেশনা পুরোপুরি উপেক্ষা করে গেলো আইজা। সেই লোকটা আরফানের কলার ছেড়ে আইজার মাথা থেকে পা অব্দি চোখ বুলালো। দাঁত বের করে কুৎসিত ভঙ্গিতে হেঁসে বললো,
-“সকালেই শুনলাম মেহমান আসছে আপনার বাড়িতে। তা ম্যাম, একবার আমাদের সাথে চলেন। মেহমানদের খাতিরদারি কিন্তু আমরাও জানি!”
সাথে সাথেই ঐ লোকের মুখে ঘুষি বসিয়ে দিলো আরফান। ক্রোধে পুরো মুখ লাল হয়ে গেছে ওর। বাকি লোকগুলো আরফানের দিকে তেড়ে আসতে গেলেই সেই লোকটা হাতের ইশারায় থামিয়ে দিয়ে
রক্তচক্ষু নিয়ে তাকালো আরফানের দিকে। তখনই আরফানের সামনে দাঁড়িয়ে পড়লো আইজা। আরফান আইজাকে সরাতে গেলেই ও তীর্যক কন্ঠে ফিসফিস করে বলে উঠলো,
-“চুপচাপ পিছিয়ে যা। আর নিজেদের চোখ ঢেকে রাখ!”
আইজার কথায় প্রথমে ভ্রু কুঁচকে তাকালেও পরক্ষণেই বিনাবাক্যে পিছিয়ে গেলো আরফান। আইজা সামনে তাকিয়ে দেখলো লোকটা এখনও ওর দিকে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে।
-“আপনার চোখ দেখতে খুব ইচ্ছে করছে ম্যাম!”
লোকটার কথায় কোন প্রতিক্রিয়া দেখালো না আইজা। উল্টো শান্ত কন্ঠে বলে উঠলো,
-“আগে নিজের চোখ বাঁচিয়ে নিন!”
কথাটা বলতেই পেছনে মুড়িয়ে রাখা হাতটা বের করে সাথে সাথেই ঐ লোকগুলোর চোখে স্প্রে করতে শুরু করলো আইজা। কানে বেশ কিছু মানুষের আর্তনাদ আর বিশ্রি গালি ভেসে এলো। স্প্রে বোতলে কী কী মিশিয়েছে পুরোপুরি মনে নেই আইজার। তবে একটা উপাদান স্পষ্ট মনে আছে। মরিচের গুঁড়ো! ওর সবচেয়ে প্রিয়!!
লোকগুলোর কাহিল অবস্থা দেখে আইজা আনমনে কটমট করে বলে উঠলো,
-“আসছে আমার ভাইয়ের চোখ তুলতে!!”
-“এসব কী হচ্ছে!!”
আর্তনাদ করা লোকগুলোর মধ্যে পরিচিত কন্ঠ কানে যেতেই থমকে গেলো আইজা। গুন্ডা বাহিনীর ঠিক পেছনে সীমান্ত নিজের চোখে হাত রেখে ছটফট করে যাচ্ছে!!
চলবে…
আগের পর্ব
https://m.facebook.com/groups/371586494563129/permalink/535608888160888/