#অপ্রিয়_প্রেয়সী
#লিখা_তানজিলা
#পর্ব- ৩১
পার্স খুলে সেটার ভেতরে থাকা সবকিছুই বিছানার ওপর ফেললো আইজা। মেমোরিকার্ডটা ফোন থেকে আলাদা করেই রাখতো ও। সে রাত “ডিপ ডার্ক সিক্রেট” নামক ক্লাবে কথায় কথায় আরমানের কাছ জানতে পেরেছিলো রায়হানের ওখানে যাওয়ার কথা। যদিও আরমান সেটা স্বচক্ষে দেখেনি।
আর প্রমান ছাড়া তো এ তথ্যের কোন গুরুত্ব থাকতো না আইজার কাছে। তাই আরমানের আড়ালেই সেই ক্লাবে কর্মরত একজন এমপ্লয়িকে টাকা দিয়ে রায়হানের ড্রাগস নেয়ার ফুটেজ নিয়ে এসেছিলো আইজা।
-“পাঁচ মিনিট! এরপর আমি ওদের নিয়ে চলে যাবো!”
জামিল মাহমুদের কথায় মৃদু হাসলো আইজা। কিন্তু কোন প্রতিউত্তর নেই ওর মুখে। হনহন করেই সিঁড়ি অব্দি চলে গেলো ও।
-“তুই ভয় পাস না। আমি এদিকেই থাকবো। ঐ সীমান্ত কিছু করলে..!”
আরফানের কানে টান পড়ায় আর বলতে পারলো না সে।
-“তোকে কতবার বলেছি, আমি সীমান্তকে ভয় পাই না! আমি যা করতে বলেছি সেটা কর গিয়ে, যা!”
-“আচ্ছা..আচ্ছা..কান ছাড় আমার!”
আইজা আরফানের কান ছেড়ে সিঁড়ি চড়ে নামতে লাগলো। পেছন থেকে আবারও ভেসে এলো আরফানের কন্ঠ,
-“একদম ভয় পাবি না!”
এবার মেজাজ তীক্ষ্ণ হলেও ফিরে তাকালো না আইজা। নিজ গতিতে অটল রইলো। আকাশ টা ভিষণ আঁধার হয়ে আছে। তার প্রভাব ক্লিনিকেও পড়েছে। আশেপাশে তেমন মানুষ নেই। তাই সুঠাম দেহের অধিকারী ব্যাক্তির অস্তিত্ব খুঁজে পেতে তেমন সময় লাগলো না আইজার।
-“এতো তাড়াতাড়ি আপনাকে দেখবো ভাবিনি।”
সীমান্তর ঠান্ডা কন্ঠে দাঁতে দাঁত চেপে তাকালো আইজা। এই মানুষটার সামনে নিজ ক্রোধের মাত্রা নিয়ন্ত্রণের চেষ্টায় অনিচ্ছাকৃত ভাবেই ব্যর্থ হলো ও। সীমান্তর অর্ধসিক্ত কলারটায় চোখ পড়তেই সেটা জোড়ালো ভাবে টেনে ধরে বলে উঠলো,
-“আপনি আমার পরিবারটা ধ্বংস করতে যেভাবে উঠে পড়ে লেগেছেন সেখানে ঘরের এক কোণে পড়ে থাকতে ইচ্ছে করলো না আমার। একা একা লড়াইয়ে কিসের মজা। আপনি আমার পাপাকে বরবাদ করুন। আমি বরবাদ করবো আপনার ভাইকে!”
আইজার গলায় কোন অনুভূতির রেশ নেই। আর না আছে সীমান্তর চোখে। এতোক্ষণ শীতল হয়ে থাকা আঁখি জোড়া মুহূর্তেই ঘন আঁধার রূপে ছেয়ে গেলো। তার হাত দুটো গিয়ে ঠেকলো আইজার বাহুদ্বয়ে।
একটু আগে আরফানকে মিথ্যে বলেনি আইজা। সীমান্তর জন্য ওর মধ্যে আর যাই হোক ভয় নেই। কিন্তু এই মুহুর্তে তার তাকানোর ভঙ্গি দেখে এ কথা বলতে পারবে কি-না সন্দেহ হচ্ছে ওর। সীমান্তর এ চাহনি সাহিলকে মারধর করার সময়ই শেষবার দেখেছিলো আইজা। হঠাৎ বাহুতে কিঞ্চিত ব্যথা অনুভব করলো ও।
-“আমার আগেই সন্দেহ হয়েছিলো। রায়হানের সাথে কী কথা হতো আপনার?”
এবারও আগের মতোই ঠান্ডা গলায় জিজ্ঞেস করলো সীমান্ত। তবে সেই ঠান্ডা আবেশে নির্লিপ্ততার ছাপ নেই। না চাইতেও চোখ মুখ কুঁচকে এলো আইজার। তাতে কোন হেলদোল নেই সামনে দাঁড়িয়ে থাকা ব্যাক্তির। মনে হচ্ছে নিজের প্রশ্নের জবাব না পেয়ে আইজাকে ছাড়বে না সে।
-“সেটা আপনার ভাইকেই জিজ্ঞেস করবেন। আপনার ফোনে হয়তো অলরেডি একটা ভিডিও পাঠানো হয়েছে। সেটা দেখে নিলে অন্তত অর্ধেক আপনার কাছে পরিষ্কার হয়ে যাবে।”
সাথে সাথেই আইজার বাহু ছেড়ে দিলো সীমান্ত। ভ্রু কুঁচকে পকেট থেকে নিজের ফোন বের করলো। পুরোটা সময়ই তার চাহনি আইজার ওপরই নিবদ্ধ।
-“দূর্বলতা ব্যবহার করে নিজের কাজ হাসিল করার দক্ষতা কী শুধু আপনারই আছে না-কি! আর এখানে আপনার নিজের ভাইও কিন্তু নিরপরাধ না!”
ব্যঙ্গার্ত্বক ভঙ্গিতে ভরপুর হয়ে আছে আইজার কন্ঠ।
-“সম্পূর্ণ নিরপরাধ হয়তো আপনার পাপা-ও না!”
সীমান্তর কথায় ভ্রু কুঁচকে এলো আইজার। সীমান্ত ফোন বের করলেও ওন করলো না। হয়তো আইজার সামনে দেখতে চায় না।
-“এসব টেকনিক আমার বিরুদ্ধে ব্যবহার করে কোন লাভ নেই আইজা। নিজের পরিবারকে সেফ রাখার দক্ষতা তা যে শুধু আপনারই আছে এমনটা মনে করবেন না।”
-“আমার পাপা কী ক্ষতি করেছে আপনাদের? কেন করছেন এসব? আপনি আমাকে পাপার বিরুদ্ধে ব্যবহার করতে বিয়ে করেছেন, তাই না!”
আইজার অধৈর্য কন্ঠ যেন সীমান্তর বিনোদনের খোরাক হয়ে দাঁড়িয়েছে। উচ্চস্বরে হেঁসে উঠলো সে।
-“বাহ্! এতোদিনে বুঝলেন আপনি!”
সীমান্তর কথার বিপরীতে কিছু বলতে পারলো না আইজা। তার ঠোঁটে লেগে থাকা ক্রুর হাসির সামনে থমথমে ভাব এসে ভর করলো আইজার মুখে। তা দেখে সীমান্ত ভ্রু কুঁচকে আরো বলে উঠলো,
-“এতোটা দুঃখী হয়ে আছেন কেন? এমন তো না যে, আপনি আমাকে ভালোবাসে বিয়ে করেছেন অথবা ভরসা করেছিলেন! এই মুখে আপনাকে একদম মানাচ্ছে না!”
সীমান্তর এ কথায় না হেঁসে পারলো না আইজা। সেই হাসির মাঝেই বলে উঠলো,
-“আপনার মনে হচ্ছে আমি আপনার বিরহে দুঃখী!”
হুট করে সীমান্তর দিকে এক ধাপ এগিয়ে গেলো আইজা।
-“আপনার সাথে এতোগুলা সময় নষ্ট করেছি আমি! এই কারণই যথেষ্ট! এখন তো আবার..!”
কিছু একটা বলতে গিয়েও মাঝ পথে থেমে গেলো আইজা। নিজের ওঠানো সকল পদক্ষেপের ভার যে ওকেই বহন করতে হবে! কোন মানুষই এ ভার থেকে মুক্তি পায় না! সীমান্ত আর ও কেউই এ সীমার বাইরে নেই।
মনের অজান্তেই নিজের পেটের দিকে হাত চলে গেলো আইজার। মিহি গলায় বলে উঠলো,
-“আমি আমার প্রশ্নের জবাব এখনো পাইনি। পাপার সাথে কিসের শত্রুতা আপনার?”
-“চোখের পানি দেখিয়ে দূর্বল করতে চাচ্ছেন আমাকে?”
সীমান্তর কথায় একটু নড়েচড়ে উঠলো আইজা। চোখের নিচে বেয়ে পড়া একবিন্দু অশ্রু দ্রুত হস্তে মুছে নিলো। তখনই ওর দৃষ্টি সীমান্তর হাতে গিয়ে ঠেকলো। নিজের হাতের মুঠি শক্ত করে রেখেছে সে।
-“আপনাকে দেখে কেন যেন মনে হচ্ছে আপনি আসলেই আমার চোখের পানিতে দূর্বল হয়ে পড়বেন। সাবধান হয়ে যান। শত্রুর সামনে নিজের দূর্বলতা প্রকাশ করলে বিপদে পড়বেন!”
নিস্প্রভ গলায় বলে উঠলো আইজা। সীমান্ত তার কথার উত্তরে কিছু বললো না। নিজের হাত ঠিক করলো শুধু। সেকেন্ড কয়েক পর গম্ভীর কন্ঠে বললো,
-“আমি আবার আসবো।”
আইজাকে আর কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে তার সামনে থেকে সরে এলো সীমান্ত। পিলারের দিকে ঠেশ দিয়ে রাখা ছাতাটা তুলে নিলো ও! পেছন থেকে আইজার কন্ঠ কানে এলেও পায়ের গতি থামলো না।
-“দাঁড়ান বলছি! আমার প্রশ্নের জবাব দিয়ে যান!!”
***
শীতল থেকে শীতলতর…ক্ষণে ক্ষণে এ হাওয়ার স্পর্শে শিউরে উঠছে সীমান্তর পুরো শরীর। ঠিক যেন শীতকালের ন্যায়। গতকাল রাতেও এরূপ শীতলতার উপস্থিতি ছিলো না। গায়ের রক্ত হীম হয়ে আসছে। হাতটা থরথর করে কাঁপতে শুরু করেছে। রাস্তার ওপাড়ে এক মহিলা পাঁচ কী ছয় বছরের এক ছেলের মাথায় ছাতা ধরে রেখেছে। রাস্তা পাড় হওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছে হয়তো। দৃশ্যটা ওর বেশ পরিচিত। হুট করেই চোখ সরিয়ে নেয় সীমান্ত। তবে পাড় পেলো না। স্মৃতির পাতার সবচেয়ে ভয়ংকর মুহূর্তগুলো ওর মস্তিষ্কে আবারও নাড়া দিয়ে গেলো যেন!
সেদিন হাড় কাঁপানো শীত পড়েছিলো। সাত বছরের সীমান্ত ওর মায়ের হাত ধরে রাস্তার একপাশে দাঁড়িয়ে ছিলো। হয়তো বা তাদের উদ্দেশ্য রাস্তা পাড় হওয়া ছিলো অথবা অন্য কিছু। ঠিক মনে নেই ওর। তবে উদ্দেশ্য যাই ছিলো না কেন সেটা সফল আর হয়ে ওঠেনি। হুট করেই রাস্তার একপাশ থেকে আসা মাইক্রো ভ্যান ওদের সামনে এসে থেমেছিলো! টিভিতে এরকম মাইক্রো ভ্যানে কিডন্যাপিং এর দৃশ্য অনেকবার দেখা হয়েছে সীমান্তর। কিন্তু বিষয়টা যে এতটা গুরুতর তা হয়তো সেদিনই বুঝতে পেরেছিলো ও!
হঠাৎ হর্ণের শব্দে টনক নড়লো সীমান্তর। রাস্তার একপাশে দুটো গাড়ি থেমে আছে। দু’জন ড্রাইভারের মধ্যে সংঘর্ষ শুরু হলো মাত্র। এসবে মাথা ধরায় নিজের বাইকের দিকে নজর দিলো সীমান্ত। ঘুরাঘুরির কোন ইচ্ছেই নেই আজ!
ক্লিনিকের বাইরে বেরোনোর পর আইজা আর ওর পিছু পিছু আসে নি। একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়লো সীমান্ত। আইজার প্রশ্নের কী উত্তর দিতো সে! যে তার জন্মদাতা পিতা হয়তো সীমান্তর মায়ের খুনের সাথে জড়িত! মেয়েটা বড্ড ছটফট স্বভাবের। বিষয়টাকে আরো ঘোলাটে করে ফেলতো!
এতোক্ষণ ধরে একটা টিনের চালের নিচে দাঁড়িয়ে আছে সীমান্ত। পকেট থেকে ফোন বের করলো সে। নেটওয়ার্ক তেমন ভালো না। তাই হয়তো আইজার পাঠানো ভিডিও মাত্র ফোনে এলো।
হঠাৎ নিজের ওপর কাদা পানির অস্তিত্ব টের পেতেই চোখ মুখ কুঁচকে এলো সীমান্তর। ওর ঠিক সামনে থেকে একটা এম্বুলেন্স ছুটে গেছে। নিজের দিকে একবার চোখ বুলালো সে। পুরো কাদা পানি হয়ে গেছে! ফোনটার অবস্থাও বলতে গেলে বাজে!
ঠিক তখনই এক বাচ্চা ছেলে এসে সীমান্তর সামনে ছোট্ট একটা বক্স তুলে ধরলো,
-“এটা আপনার জন্য!”
বক্সটা চোখে পড়তেই সীমান্তর বুকটা ধক করে উঠলো। এই বস্তুটা ভিষণ পরিচিত ওর।
-“এটা কে দিয়েছে তোমাকে?”
সীমান্তর প্রশ্নে ছেলেটা কোন উত্তর দিলো না। সীমান্তর হাতে বক্সটা রেখেই ছুটে ক্লিনিকের ভেতর চলে গেলো। সীমান্তও ছুটে ক্লিনিকের ভেতর চলে এলো। কিন্তু সেই বাচ্চা ছেলেটাকে কোথাও চোখে পড়লো না। চোখের পলকে কোথায় যেন চলে গেলো!
কাঁপা কাঁপা হাতে বক্সটা খুলতে শুরু করলো সীমান্ত। প্রথমেই ওর চোখ গিয়ে ঠেকলো সেটার ভেতর রাখা একটা আংটির ওপর। তাতে ছোপ ছোপ রক্তের দাগ ফুটে আছে। একটা ঘন নিশ্বাস ফেললো সীমান্ত।
আংটিটা শেষবার ও আইজার হাতে দেখেছিলো!
চলবে…
আগের পর্ব
https://m.facebook.com/groups/371586494563129/permalink/543037317418045/