অপ্রিয়_প্রেয়সী #লিখা_তানজিলা #পর্ব – ৫

#অপ্রিয়_প্রেয়সী
#লিখা_তানজিলা
#পর্ব – ৫

রিয়ার-ভিউ মিররে নিজেরই প্রতিচ্ছবি দেখতে পাচ্ছে আইজা। কিছুক্ষণ পর পর ড্রাইভিং সীটে বসে থাকা ব্যাক্তির দৃষ্টি পড়ছে সেদিকে। রাত যত বাড়ছে ততই যেন নিস্তব্ধতার আভাস পাচ্ছে ও।বাইরে ঝড়ো হাওয়ায় বেহাল দশা। ঝিরিঝিরি বৃষ্টির মধ্যে সবটা ঘোলাটে মনে হচ্ছে। সীমান্ত কতক্ষণে বাড়ি এসে পৌঁছবে জানা নেই ওর। তার ওপর সামনে বসে থাকা ব্যাক্তির অস্বস্তিকর দৃষ্টি!

-“এনি প্রবলেম!”

কর্কশ গলায় বলে উঠলো আইজা। লোকটা কোন কথা বললো না। তৎক্ষনাৎ রিয়ার ভিউ মিরর থেকে চোখ সরিয়ে নিলো। আইজা বেশ সতর্ক হয়েই গাড়ির গতিবিধি লক্ষ্য করছিলো। এই মুহুর্তে ট্যাক্সিতে সামনে বসে থাকা লোকটাকে সুবিধার মনে না হওয়ায় ওখানেই নেমে পড়লো আইজা। ভাড়া মিটিয়ে সামনে এগোতে গিয়ে খেয়াল হলো ট্যাক্সিটা একই জায়গায় দাঁড়িয়ে আছে। কয়েক কদম আগে যেয়ে পুনরায় পেছনে ফিরে দেখলো ও। ট্যাক্সিটার কোন নড়চড় হয়নি।

ফোনটা বের করে মেসেজ বক্স ওপেন করে এড্রেসটায় চোখ বুলালো ও। অন্ধকার জগতের জনপ্রিয় ক্লাব। সচরাচর কোন বাবাই চাইবে না তার মেয়ে এসব ক্লাবের ধারে কাছেও আসুক। অথচ এতো রাতে ওর পাপা এখানে ওকে কেন আসতে বলবে বোধগম্য হচ্ছে না!

ছোটবেলায় একবার ওদের ওপর একদল গুন্ডা হামলা করায় আইজা আর ওর বাবা এ ক্লাবে পালিয়ে এসেছিলো কিছু সময়ের জন্য। আইজার বাবার কোন স্কুল বন্ধু এই ক্লাব চালাতো সে সময়। তারপর আর কখনও এ রাস্তায় যাওয়া পড়েনি ওর। এই মুহুর্তে নিজের ওপরই রাগ হচ্ছে। আর কেউ না হোক, আইজার এই ক্লাবের নাম মনে থাকার কথা। ওর বাবা এখানে এসেছে তার সম্ভাবনাও ছিলো প্রচুর। কেন ওর মাথায় আসলো না ব্যপারটা!

বেশিদূর হাঁটতে হলো না আইজাকে। বাইরে থেকে এটিকে জনমানবহীন স্থান মনে হচ্ছে। আশেপাশে দুই একটা বিল্ডিংয়ের অস্তিত্ব থাকলেও অন্ধকারে সেরকম বুঝা যাচ্ছে না। কেউ হয়তো প্রথম দেখায় বলতেই পারবে না এটা একটা ক্লাব। এমন গোপনীয় ক্লাব যে কতটা সেফ হবে তা আর কল্পনাই না করলো ও। মেসেজে এড্রেস সহ গোপন পাসওয়ার্ড আর সাথে এক রুম নাম্বারও ছিলো। সামনেই এক গাদা ময়লার স্তুপ পড়ে আছে। দুর্গন্ধে গা গুলিয়ে আসছে পর। মোবাইলের ফ্লাশলাইট জ্বালিয়ে টিপ টিপ পায়ে হেটে যাচ্ছে আইজা। কাঁদা মাটিতে পা রাখার কোন ইচ্ছে নেই। জুতো জোড়া কয়েক দিন আগেই কেনা হয়েছে! দামও ছিলো বেশ চড়া। ধুর! পুরোনো জুতো কেন পড়লো না ও! একবার নিজের বাবাকে নির্দোষ প্রমান করে নিক; যারা ওদের পরিবারের এই দশা করেছে সবকটাকে রাস্তায় নামিয়ে ছাড়বে ও!

কাঠের দরজায় একবার কড়া নাড়তেই মাঝ বয়সী এক লোক আইজাকে বেশ সময় নিয়ে পর্যবেক্ষণ করতে শুরু করলো। আইজা ভ্রু কুঁচকে তাকালো লোকটার দিকে। পাসওয়ার্ড বলতেই আইজার মুখের ওপর ঠাস করে দরজা বন্ধ করে ভেতরে চলে গেলো লোকটা।এক সেকেন্ডের জন্য স্তম্ভিত হয়ে পড়লো ও। ভুল জায়গায় চলে এলো না তো! কিন্তু পরক্ষণেই সেই কাঠের দরজার পাশে দেয়ালের মতো আবরণটা হুট করে খুলে যেতেই আইজা লাফিয়ে পিছিয়ে গেলো! হোয়াট দা হেল! বিড়বিড় করে বলে উঠলো আইজা। ওর হৃদপিণ্ড কেঁপে উঠলো যেন! ছোটবেলায় যখন এসেছিলো তখন তো এরকম কিছু দেখেনি ও!

এতোক্ষণ বাইরের পরিবেশটাকে ভয়ংকর মনে হলেও এই মুহুর্তে তার ঠিক উল্টো মনে হচ্ছে। মনে হচ্ছে স্নিগ্ধতার পরশ থেকে অন্ধকার জগতে প্রবেশ করলো। বিয়ের আগে দুই একবার বিভিন্ন ক্লাবে যাওয়া আসা ছিলো আইজার। কিন্তু এরকম ক্লাব ওর ধরা ছোঁয়ার বাইরে। ভেতরে প্রবেশ করতেই বিষাক্ত ধোয়ার কবলে পড়ে চোখ মুখ কুঁচকে এলো। ব্যাগটা শক্ত করে নিজের কাছে চেপে ধরলো ও। নিজের ওপর কয়েকজনের দৃষ্টি অনুভব করতে পারছে আইজা। তবে বেশিরভাগই নেশায় মেতে আছে।

ক্লাবে কোন মিউজিক চলছে না। দূর থেকে দেখে বুঝার উপায় নেই যে এটা কোন ড্রাগসের আড্ডাখানা হবে! পাপা এরকম জায়গায় কী করছে! যতই বন্ধু হোক, এ জায়গায় থাকা একদমই সুরক্ষিত মনে হচ্ছে না। পারলে তো আরও ফেঁসে যেতে পারে!

সামনেই বড় একটা সাইনবোর্ডে ইংরেজি অক্ষরে লেখা, “ডিপ ডার্ক সিক্রেটস”। এ স্থানের সাথে নামটা বেশ মানানসই মনে হচ্ছে। একবার চারপাশে চোখ বুলালো আইজা। এরা কেউই হয়তো বাইরের জগতে নিজেদের এ রূপ প্রকাশ করতে চাইবে না!

আইজার মনে হচ্ছে সে কোন ভিন্ন জগতে প্রবেশ করেছে। কোন কিছুই আগের মতো নেই। গায়ের রক্ত হিম করা পরিবেশ। ইচ্ছে করছে এক দৌড়ে বেরিয়ে যেতে। কিন্তু ওর পাপা! সে তো এখানে আছে! পা গুলো নড়তে চাইছে না। ফোন বের করতেই এক দীর্ঘশ্বাস বেড়িয়ে এলো আইজার মুখ থেকে। এতোক্ষণ নট রিচেবেল ছিলো আর এখন নেটওয়ার্কই নেই। সন্দেহ হচ্ছে আইজার। ওর বাবা কখনোই ওকে এরকম পরিস্থিতিতে ফেলবে না। কিন্তু আইজা ওর পাপার কন্ঠ চিনতে ভুল করেনি। এক পা সামনে বাড়িয়েই ভ্রু কুঁচকে এলো ওর। সিড়িতে ঠেশ দিয়ে দাঁড়িয়ে থাকা দুই মানব মানবীর কর্মকান্ড দেখে সাথে সাথেই স্থান ত্যাগ করলো ও!

মেসেজে শুধু ভিআইপি রুম লেখা। রুম নাম্বার পর্যন্ত নেই। ওর এখানে আসাই উচিত হয়নি। কিছু একটা ঘাপলা তো আছেই! জায়গাটাও বেশ ভিন্ন মনে হচ্ছে। আইজার মনে হচ্ছে ও হয়তো ভুল কোথাও চলে এসেছে। দেয়ালরূপী দরজার পাশে দাঁড়িয়ে থাকা লোকগুলোও বেশ অদ্ভুত। ব্যাগে রাখা বন্দুকটা রেডি করে পিছনে ফিরতেই এক রুম থেকে পরিচিত কারো কন্ঠ কানে গিয়ে ঠেকলো। সময় নষ্ট করলো না আইজা। দ্রুত সে রুমের দিকে এগিয়ে গেলো। ও সামনে যেতেই শব্দ করে খুলে গেলো সেই দরজা। বেশ বৃহদাকার সোফায় কিঞ্চিৎ রক্তাক্ত অবস্থায় বসে আছে আইজার বাবা। এই মুহুর্তে স্থান কাল কোন কিছুরই খেয়াল নেই মস্তিষ্কে। বাবার চোখে এক প্রকার অপরাধবোধের অস্তিত্ব খুঁজে পাচ্ছে আইজা। তড়িঘড়ি করে সামনে এগিয়ে যেতেই ওর বাবা মাথা নাড়িয়ে দূর্বল কন্ঠে বলে উঠলো,

-“আই এম সরি, মামণি!”

★★★

ড্রাইভিং সীটে মাথা এলিয়ে দিয়ে বসে আছে সীমান্ত। চোখ বন্ধ অবস্থায় কানে হেডফোন লাগিয়ে কী এক গভীর চিন্তায় ব্যস্ত সে। আইজাকে কয়েকবার কল করেছিলো। প্রতিবার নট রিচেবেল। সাহিলের বাড়ির সামনেই গাড়ি পার্ক করে রেখেছে। এড্রেসটা বের করতে বেশ সমস্যা হয়েছিলো। কয়েক দিন আগেই না-কি বাসা চেঞ্জ করেছে। এমপ্লয়ি ইনফরমেশনে তার কোন আপডেট ছিলো না। বিল্ডিংয়ের এক সাইডে রাখা ময়লার স্তুপ দেখে নাক কুঁচকে এলো ওর। যথাসম্ভব চেষ্টা করছে চোখ যেন সেদিকে না যায়। সাহিলের রুমের লাইটও অফ করা।

আইজাকে সামনের গলি থেকে বের হতে দেখেই কান থেকে হেডফোন টেনে খুলে ট্যাব সহ গাড়ির পেছনের সীটে ছুড়ে মারলো ও। চোখগুলো আইজার গতিবিধি লক্ষ্য করে যাচ্ছে। এইমুহুর্তে গাড়ির হেডলাইট বাদে আলোর সেরকম কোন কোন উৎসই নেই। রাস্তার পাশের লাইট গুলো প্রায় নিভু নিভু।

আইজা আশেপাশে সেরকম চোখ না দিয়ে সামনে থাকে ধেয়ে আসা এক ট্যাক্সি থামিয়ে তাতেই উঠে পড়লো। বাঁকা হাসিতে ঝলসে উঠলো সীমান্তর মুখ। কিছুক্ষণের মধ্যেই সেই ট্যাক্সি ফলো করতে শুরু করলো ও।

বাড়ির রাস্তা থেকে কিছুটা আগে নেমেই এক দৌড়ে ভেতরে চলে গেলো আইজা। সীমান্ত বেশ দূরত্ব রেখেই এক সাইডে গাড়ি পার্ক করেছে। ক্রোধ না-কি আফসোস কোন অনুভূতিকে মনে স্থান দেবে বুঝে উঠতে পারছে না। বেশ সময় নিয়েই একই জায়গায় বসে ছিলো ও। পনেরো মিনিট হবে হয়তো! পরক্ষনেই নিজেকে সামলে গাড়িসহ বাড়িতে প্রবেশ করলো সীমান্ত। দারোয়ান চাচা এতোক্ষণ ঘুমে মশগুল হয়ে পড়ে থাকলেও গাড়ির হর্ণ শুনে সাথে সাথে জেগে উঠলেন তিনি!

সীমান্ত স্টাডি রুমের দরজা খুলে হুট করে প্রবেশ করলেও আইজার চাহনিতে কোন বিস্ময় ছিলো না। উল্টো মনে হচ্ছে মেয়েটা সেই কখন থেকে সীমান্তর অপেক্ষা করে যাচ্ছে। তবে বিচলিত মুহূর্তে ঘন ঘন নিশ্বাস নেয়ার অভ্যাস আছে আইজার। স্টাডি রুমের একপাশে থাকা ছোটখাটো টেবিল সম্পূর্ণ শূন্য অবস্থায় পড়ে আছে। যেমনটা সীমান্ত সব সময় পছন্দ করে। কয়েক ঘন্টা আগেই আইজা যে কান্ড ঘটিয়ে গেছিলো তার ছাপ নেই এই মুহুর্তে। আইজা এখনো সীমান্তর জ্যাকেট গায়ে জড়িয়ে আছে। হয়তো খুলে রাখার সময় পায়নি। সীমান্ত চোখে থেকে চশমাটা খুলে শক্ত গলায় বলে উঠলো,
-“আপনাকে বারণ করেছি আমি। কথায় কথায় এরকম অবাধ্য হওয়ার অভ্যাস টা আমার একদম পছন্দ না।”

-“আপনার এলকোহল নেয়ার অভ্যাস টাও আমার ভালো লাগছে না। আজকে তো শুধু আমি আর রিয়াদ দেখেছে। বাবা দেখলে কী হতো! এভাবে বাড়িতে মদের গোডাউন রাখা চলবে না। সবগুলো ফেলে দিয়েছি আমি। আপনার জন্য এতো রাতে বৃষ্টিতেও বাইরে যেতে হলো আমাকে!”
নির্লিপ্ত কণ্ঠে বলে উঠলো সে। আরো কিছু হয়তো বলতে চেয়েছিলো কিন্তু সীমান্ত সে সুযোগ আইজাকে দেয়নি। কোমরের দুই পাশে হাত রেখে হেঁচকা টানে টেবিলে বসিয়ে দিলো ওকে। ঘটনার আকস্মিকতায় কিঞ্চিৎ কেঁপে উঠলো আইজা। সীমান্তর হাত আইজার গায়ে জড়ানো জ্যাকেট স্পর্শ করতেই সেই হাত চেপে ধরলো আইজা। চোখ গুলো লাল হয়ে আছে মেয়েটার।

সীমান্ত ঠোঁটের একপাশে মৃদু হাসি ঝুলিয়ে এক ঝটকায় সরিয়ে দিলো ওর হাত। মাথায় অগোছালো অবস্থায় বেঁধে রাখা খোঁপা খুলে দিতেই কোমর সমান কোঁকড়া চুলগুলোর সৌন্দর্য যেন দ্বিগুণ হয়ে উঠলো সীমান্তর দৃষ্টিতে। আইজা সব সময় চুল গুলো স্ট্রেইট কেন করে রাখে বোধগম্য হয় না। মনে হচ্ছে ওর সামনে আইজা না অন্যকেউ বসে আছে। আইজার নিঃশ্বাস ক্রমশ ঘন হয়ে আসছে। মুখে অস্বস্তির ছাপটাও স্পষ্ট। কেন! সে তো সীমান্তকে কাছে পেতে চেয়েছিলো। এখন কেন এই বিব্রতবোধ কাজ করছে তার মাঝে! রাতের অন্ধকারে কতবার আইজাকে স্পর্শ করেছে হিসাব নেই। আগে কখনও তো এভাবে সীমান্তর দিকে তাকায়নি সে! আজ এতো বিতৃষ্ণা এই চোখে!

আইজা চায় সীমান্ত যেন চোখ বন্ধ করে ওর মাঝে বাস করা নেতিবাচক স্বত্বাকে মেনে নেয়। কিন্তু মেয়েটা নিজেই আবার সীমান্তকে মন থেকে মেনে নিতে পারছে না!

চলবে…

আগের পর্ব
https://m.facebook.com/groups/371586494563129/permalink/489757516079359/

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here