অবেলায় বসন্ত (পর্ব – ৪)

অবেলায় বসন্ত (পর্ব – ৪)
লেখাঃ শামীমা জামান

প্রফেসর সাহেবের বাড়িতে ইন্টেরিয়রের কাজ অনেকটাই এগিয়ে গেছে। এর মধ্যে চিত্রা একবারও আসেনি। মিসেস চৌধুরীর সাথে অবশ্য ফোনে কথা হয়েছে। কিন্তু অদ্ভুতভাবে চিত্রার অনুপস্থিতি মিসেস চৌধুরী এবং ফাইজ দুজনকেই যেন পীড়া দিচ্ছিল। সেদিন দরজা থেকে চিত্রার ভাবির কথা দুর্ভাগ্যবশত ফাইজ শুনে ফেলেছিল। লজ্জায় ফাইজের নিজেরই কান ঝাঁ ঝাঁ করে উঠেছিল। এ কারণেই কী চিত্রা বলেছিল “জীবন সহজ নয়”? চিত্রাদের বাড়িতে ফাইজের সেদিন একটা ব্যাপার খটকা লেগেছিল… চিত্রা বাড়ির কারো সাথে তার আলাপ করিয়ে দেয়নি! যদিও সে শুধুই চিত্রার একজন ক্লায়েন্ট কিন্তু তারপরও ব্যাপারটা ফাইজের চোখে লেগেছে। আর চোখে লাগার একটাই কারণ, চিত্রাকে দেখে সে যতটুকু বুঝেছে তাতে এটুকু বোঝা যায় যে চিত্রা ফ্যামিলি টাইপ মানুষ। সবাইকে নিয়ে ভালো থাকতে চায়। সেদিনের পর চিত্রার সাথে কথা বলতেও তার সংকোচ হয়। তবে চিত্রার কথা তাকে এত ভাবাচ্ছে কেন সেটাও সে বুঝতে পারছে না।

ফাইজ যেদিন চিত্রাদের বাড়ি এসেছিল তার পরদিনই চিত্রা অফিস করার সিদ্ধান্ত নেয়। যদিও তার আরও দু’দিন রেস্ট করা দরকার ছিল তবু সে অফিস করতেই চাইল। কারণ বাসায় থাকলে সবার বাঁকা বাঁকা কথা শুনে ও আরও অসুস্থ হয়ে যাবে। চিত্রা অফিসের জন্য তৈরি হচ্ছিল এমন সময় ওর মা এসে বলল-

-অফিস যাচ্ছিস? এখনো তো শরীর ঠিক হয়নি। আজ যেতে হবে না।

চিত্রা মায়ের দিকে তাকিয়ে বোঝার চেষ্টা করল তিনি কী চাইছেন আসলে? বলল- আমার শরীর নিয়ে তুমি চিন্তিত! হঠাৎ?

চিত্রার মা রেগে গিয়ে বললেন- সব কিছু বাঁকা চোখে দেখিস কেন? বলেছি যাবি না, ব্যস।

-বাঁকা করে দেখতে তোমরাই সাহায্য করেছ। তাছাড়া কোন কারণ না থাকলে অযথা অফিস কামাই করব কেন?

-আমি বলেছি তাই।

-চিত্রা হাসল। অধিকার শব্দটা আজকাল আর মায়ের মুখে মানায় না। অথচ তার সব কিছুতে সবচেয়ে বেশি অধিকার তার মায়েরই থাকার কথা! চিত্রা আস্তে করে দৃঢ়তার সাথে বলল- কারণটা বলো নয়ত আমি বের হচ্ছি…

চিত্রার মা হাল ছেড়ে দেওয়া গলায় বলল- আরমান ফোন করেছিল। ওর সাথে আমার কথা হয়েছে। ও তোকে বিয়ে করতে রাজি হয়েছে। আমি বলেছি ২/১ দিনের মধ্যেই ওরা সবাই এসে যেন বিয়ের কথা পাকাপাকি করে যায়। তাই এই কয়দিন তুই অফিস যাবি না। অসুখে তো চেহারার ১২টা বাজিয়েছিস সেটা একটু ঠিক কর।

চিত্রা মায়ের কথা শুনে অবাক হয়ে গেল। এসব কী বলছে! সব জেনেও আরমানের সাথে বিয়েতে রাজি হয়ে যাচ্ছে! চিত্রা ঝাঁজের সাথে বলল- অসম্ভব, আমি এই লোককে কিছুতেই বিয়ে করব না। এই রকম একটা নীচু মন-মানসিকতার ছেলে কখনোই আমি মানতে পারব না।

চিত্রার মা রেগে গেলেন। বললেন- এখানে তোমার কোন মতামত চাওয়া হচ্ছে না। আমি আরমানের সাথে কথা বলে ফেলেছি তাই যা বলছি সেটাই করো। আর মানুষ চিরকাল একরকম থাকে না। বিয়ে হলে আরমানও একদিন বদলাবে। সেই মুহূর্তে চিত্রার ভাবি এসে বলল-

-মা, আপনার মেয়ের কিছু থাকুক বা না থাকুক দেমাগে সে ভরপুর। একে যে কেউ বিয়ে করতে চাচ্ছে সেটাই তো তার ভাগ্য বলে মেনে নেয়া উচিত। এই রূপ নিয়ে আবার সে পাত্রের দোষ খোঁজে, অদ্ভুত! আপনি শুধু শুধু ওর বিয়ের জন্য এত কিছু করছেন। টাকা খরচ করে এত ঘটক ডেকে পাত্র দেখছেন, তাদের খাওয়াচ্ছেন। চিত্রার মনে কী আছে সেটাও তো আপনাকে ভাবতে হবে।

চিত্রার পক্ষে আর সম্ভব হল না এখানে দাঁড়িয়ে থাকা। সে হনহন করে ঘর থেকে বের হয়ে অফিসে চলে গেল। এই নিয়ে সে মানসিকভাবে এবং বাসায় বেশ ঝামেলা পড়ল। সে তার মাকে কিছুতেই কিছু বোঝাতে পারছে না। দিন শেষে সে সবার বিরক্তির কারণ হচ্ছে আরও বেশি করে। শেষ পর্যন্ত কী সে এই প্রস্তাব মেনেই নেবে? নিজের সাথে, পরিবারের সাথে আর কত যুদ্ধ করবে সে? ক্লান্তি আর ভয়ানক মানসিক চাপে সে পুরোপুরিভাবে বিপর্যস্ত। বাসার মানুষগুলো থেকে পালাতে অফিসে যাচ্ছে কিন্তু অফিসে গিয়েও কাজে মন বসাতে পারছে না। এর মধ্যে আরমান ফোন করেছে অনেকবার। ১০ বার ফোন দিলে সে একবার রিসিভ করেছে। ভেবেছে আর একটু কথা বলে দেখি এর সম্পর্কে ভাবনা বদলায় কিনা? কিন্তু সেটা তো হয়ইনি বরং বেড়েছে। বিয়ের কথা এখনো পাকা হয়নি অথচ এই লোক তাকে রীতিমত বউ ভেবে বসে আছে। কথার ফাঁকে এমন সব কথা বলে যেগুলো শুনলে চিত্রার একই সাথে রাগ এবং ঘেন্না হয়। লোকটা শুধু লোভীই নয় অশ্লীল টাইপও! মেয়েদের সাথে কী করে কথা বলতে হয় তার সামান্য বোধটাও নেই। যে লোকের সাথে সামান্য ১০টা মিনিট কথা বলা যায় না সেই লোককে চিত্রা কী করে সমস্ত জীবনের জন্য গ্রহণ করবে? চিত্রা কিছু ভাবতে পারে না। এই কথাগুলো সে পরিবারের কাউকে বোঝাতেও পারে না। কী করে বোঝাবে কেউ তার কথা শুনলে তবে না? চিত্রার দমবন্ধ লাগে… তার ইচ্ছে করে দূরে কোথাও হারিয়ে যেতে। সেই মুহূর্তে তার ফাইজের কথা মনে পড়ে। ফাইজের সাথে কী সব কিছু শেয়ার করা যায়? তিনি প্রফেসর মানুষ নিশ্চই সঠিক পথ বাতলে দিতে পারবেন? সেই মুহূর্তে তার ফোন বেজে উঠল, হাতে নিতেই দেখে ফাইজ! চিত্রা ভীষণ অবাক হয়, এমন কাকতালীয় ঘটনাও ঘটে? সে ফোন রিসিভ করেই বলল-

-আপনি ফ্রি আছেন?

-sorry?

-মনে হচ্ছে ফ্রি আছেন না থাকলেও হয়ে যান, একসাথে লাঞ্চ করছি। আপনার পছন্দের কোন রেস্টুরেন্ট আছে?

-something urgent?

-হুম।

-ok, I’ll pick you up then. কথাটা বলেই ফাইজের মনে হলো, সে কী তাহলে চিত্রার জন্য অপেক্ষা করছিল যে এত সহজেই দেখা করতে রাজি হয়ে গেল?

প্রায় আধঘন্টা পর ফাইজ গাড়ি নিয়ে চিত্রার অফিসের সামনে এসে দাঁড়ায়। চিত্রা গাড়িতে উঠলে ফাইজ ওর দিকে তাকিয়ে চমকে ওঠে, চেহারার একি অবস্থা হয়েছে! সে প্রশ্নটা না করে থাকতে পারল না। বলে ফেলল- আপনার চেহারার এই অবস্থা হয়েছে কেন? আমি তো ভেবেছি আপনি সুস্থ হয়ে গেছেন!

চিত্রা হেসে বলল- আমার চেহারা তো সব সময়ই খারাপ, ভয়ংকর।

ফাইজ গাড়ি স্টার্ট দিয়ে বলল- আপনি কী জানেন আপনি সব সময় একটা ভুল ধারণার ভেতর বাস করেন?

-কী ভুল ধারণা?

-আপনি কখনো আয়নায় নিজেকে ভালো করে দেখেননি, দেখলে বুঝতেন সৃষ্টিকর্তা আপনাকে কতটা স্পেশাল করে বানিয়েছে। যার সৌন্দর্য অন্য কারো সাথে মেলে না, একদম আলাদা। যে সৌন্দর্য ধরার জন্য অসাধারণ মন আর এক জোড়া গভীর দৃষ্টিক্ষমতা সম্পন্ন চোখ থাকা প্রয়োজন।

ফাইজের কথায় চিত্রা কী রিয়েকশন দেবে বুঝতে পারছে না। সে কী আসলেই এমন? তাকে নিয়ে আসলেই এভাবে ভাবা যায়? নাকি ভদ্রলোক প্রফেসর মানুষ তাই সহজেই ছাত্রদের মন বুঝে যাওয়ার মত অন্যদেরও মন বুঝে কথা বলেন? সে কিছু না বলে চুপ করে রইল।

ফাইজ বুঝে ফেলল চিত্রা কী ভাবছে কিন্তু কিছু বলল না। সব পরিস্থিতিতে সবাইকে সব বোঝানো যায় না। চিত্রা হয়ত তেমন পরিস্থিতিতে নেই যেখানে দাঁড়িয়ে সব কিছু সহজ আর সুন্দরভাবে ভাবা যায়।

১০মিনিটের মাথায় তারা একটা রেস্টুরেন্টে এসে বসল। লাঞ্চ করে চিত্রাকে আবার অফিস ধরতে হবে তাই কাছেই কোথাও বসেছে। লাঞ্চ অর্ডার করে ফাইজ বলল-

-এবার বলুন জরুরী বিষয়টা কী?

চিত্রা ভনিতা না করে সরাসরি বলল- আপনি সেদিন বলেছিলেন দূরের কাউকেও মনের কথা বলা যায়… আমি কী আপনাকে বলতে পারি?

-আপনার যদি মনেহয় “বলা যায়” তাহলেই বলতে পারেন।

-চিত্রা একটা লম্বা শ্বাস নিয়ে তার জমানো কথা বলতে শুরু করল… সংকোচ হলেও বাড়িতে তার অবস্থান কেমন সেটা থেকে শুরু করে আরমান পর্যন্ত বলে সে থামল। তারপর বলল- কী করা উচিত আমার?

ফাইজ সব শুনে বলল- মানুষ হিসেবে আমি খুব লজ্জিত বোধ করছি যে এই সময়ে এসেও একটা মানুষকে তার গায়ের রঙ এর জন্য এত কিছু সহ্য করতে হয়! আমি সত্যিই খুব দুঃখিত। আর আরমান সাহেবের ব্যাপারে সিদ্ধান্ত আপনাকেই নিতে হবে। যেটা আপনি তীব্রভাবে অপছন্দ করছেন সেটার ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নেয়াটা কেন আপনার কাছে জটিল মনে হচ্ছে সেটাই ভেবে পাচ্ছি না।

ফাইজের কথা শুনে চিত্রা এক মিনিট ভাবল তারপর আচমকাই ফোন বের করে আরমানকে ফোন দিল। আরমান ফোন ধরেই বলল-

-কী ব্যাপার ডার্লিং আজ সূর্য কোন দিক থেকে উঠল যে তুমি নিজে ফোন দিলা? যাক উন্নতি হইছে। আমি জানতাম আমার সাথে কথা বললে তোমার ভালোবাসা জেগে উঠতে বাধ্য। বলো বলো কী বলবা?

চিত্রা রাগে চিবিয়ে চিবিয়ে বলল- “তোর কথা শেষ হয়েছে ব্যাটা বদ? তোর মত অসভ্য লোককে কোন সুস্থ মানুষের পক্ষে সহ্য করা অসম্ভব সেটুকুও তোর বোঝার ক্ষমতা নেই। তোর মত ইতর শ্রেণীর লোককে বিয়ে করব আমি? অসম্ভব। কান খুলে শুনে রাখ তোর সাথে আমার কোন কিছু হওয়া কোনভাবেই সম্ভব না। এরপরও যদি বিয়ের কথা ভাবিস, আমাকে একবারও ফোন করিস তাহলে ৯৯৯ এ কল করে তোর নাম, নাম্বার, ঠিকানা দিয়ে দিব। ফোন রাখ।” বলেই ফোন কেটে দিল। এদিকে চিত্রার এমন আচরণে এপাশে ফাইজ এবং অপর পাশে আরমান দুজনই তব্দা খেয়ে গেল। কারও মুখে কোন কথা নেই। ফোন রেখে চিত্রা ফাইজের দিকে তাকিয়ে হাসল। তারপর বলল- ভালো বলেছি তো?

ফাইজ তব্দা খাওয়া ভাব কাটিয়ে বলল- sure, nice to see your confidence.

চিত্রা ম্লান হেসে বলল- এটা নিয়ে বাসায় খুব ঝামেলা হবে।

-বুঝতে পারছি। ভালো কিছু পেতে হলে ঝড় ঝাপ্টা মেনে নেয়া যায়। সেই মুহূর্তে খাবার চলে এলো। চলুন খেয়ে নেই বলে ফাইজ চিত্রার প্লেটে খাবার তুলে দিল। ব্যাপারটা চিত্রার ভালো লাগল। খাওয়া হতে হতে তারা অল্প কিছু গল্প করল। বিদায় নেবার সময় ফাইজ বলল- চিত্রা, আপনি যে পরিস্থিতির ভেতর দিয়ে যাচ্ছেন তা কখনোই আপনার প্রাপ্য নয়। তাই এটা নিয়ে দুশ্চিন্তা বা কষ্ট চেপে রাখবেন না। ভালো থাকাটা আপনার অধিকার। সেই অধিকার থেকে নিজেকে কখনো বঞ্চিত করবেন না।

-কেউ কখনো নিজে থেকে খারাপ থাকতে চায় না। কিন্তু সবার জন্য পরিবেশ এক রকম হয় না। পরিবেশ অনেক কিছু করতে পারা থেকে বেঁধে রাখে। তবে আপনার কথাগুলো মনে রাখব। ধন্যবাদ আমাকে সুন্দর কিছু সময় আর ভালো থাকার অনুপ্রেরণা দেবার জন্য।

একদিন পর চিত্রা প্রফেসর সাহেবের বাসায় এসেছে কাজ দেখতে। কাজ প্রায় শেষের দিকে তাই তার আসা। প্রফেসরের ডিরেকশন অনুযায়ী সব কাজ হলেও চিত্রা মিসেস চৌধুরীর ঘরে বাড়তি কিছু কাজ করে দিয়েছে। যেটা মিসেস চৌধুরী ভীষণ পছন্দ করেছে। প্রফেসরের বারান্দাটা করে দিয়েছে এক টুকরো স্বর্গ! ফাইজের খুব পছন্দ হয়েছে।

মিসেস চৌধুরী চিত্রাকে দেখে ভীষণ খুশি হয়েছেন। আজ কিছুতেই চিত্রাকে না খেয়ে যেতে দেবেন না বলেছে। চিত্রা “হ্যাঁ” বলতেই সে রান্নার আয়োজন করতে চলে গেছে। চিত্রা তার পেছন পেছন রান্নাঘরে যায়। দুজনে গল্প করে। মিসেস চৌধুরী একসময় বললেন- তুমি এলে আমার খুব ভালো লাগে, সময়গুলো ফুরুত করে চলে যায়। কী মিষ্টি মেয়ে তুমি! তোমার মত আমার যদি একটা মেয়ে থাকত…? কথাটা চিত্রাকে আবেগী করে ফেলল… এই ভদ্রমহিলার যেখানে তাকে মেয়ে হিসেবে না পাওয়ার জন্য আফসোস হচ্ছে সেখানে তার নিজের মা!!! পুরো পৃথিবী যেখানে চিত্রাকে কেবল তার গায়ের রঙ দিয়ে বিচার করেছে সেখানে এই দুটো মানুষ কেমন খাপ ছাড়া! তাদের কারণে চিত্রার মনে আজকাল নতুন কিছু শব্দ যোগ হতে চায়… “চিত্রা কী তবে আসলেই সৃষ্টিকর্তার যত্নে বানানো?” চিত্রার ইচ্ছে হল মিসেস চৌধুরীকে অনেক কিছুই বলতে কিন্তু বলার জন্য সুন্দর কোন ভাষা সে খুঁজে পেল না! এই ভদ্রমহিলা মনের দিক থেকে এত সুন্দর যে তার সামনে সকল সৌন্দর্যই ম্লান হয়ে যায়। তাই সে শুধু “আপনি আসলে খুব ভালো” বলে আন্টিকে জড়িয়ে ধরে। তারপর কাজ দেখার কথা বলে রান্নাঘর থেকে বের হয়ে আসে। কাজ দেখতে দেখতে চিত্রা প্রফেসরের ঘরে চলে আসে। ফাইজ ঘরেই ছিল। চিত্রা বলল- আসব?

-oh sure…

-কাজ তো প্রায় শেষ কোন সমস্যা থাকলে এখনো সময় আছে বলে ফেলুন?

-কোন সমস্যা এখন পর্যন্ত পাইনি। আপনাদের কাজ বেশ গোছানো।

-শুধু গোছানো?

-না, অনেক ভালোও। ক্লায়েন্টের ডিমান্ডের বাইরেও যে আপনারা কাজ করেন জানা ছিল না। সবার জন্যই কী এমন করেন?

-যাদের ভালো লাগে তাদের জন্য আমি একটু বেশি করি। এটা আমার তরফ থেকে তাদের জন্য সামান্য গিফট হিসেবে থাকে।

-তাহলে আপনার জন্যও তো কিছু করতে হয়। কারণ আমার চোখে, আমার মায়ের চোখে আপনিও বেশ ভালো মনের মেয়ে।

-করেছেন তো।

-কী করেছি?

-আপনাদের কাছ থেকে ভালোবাসা পেয়েছি, সম্মান পেয়েছি, বেঁচে থাকার অনুপ্রেরণা পেয়েছি। এত কিছুর কাছে আমি যা করেছি তা খুবই সামান্য।

-চা খাবেন? আমার বারান্দাটা তো বেহেশত বানিয়ে দিয়েছেন। এখানে আপনাকে নিয়ে এক কাপ চা না খেলে অপূর্ণতা থেকে যাবে।

-খাওয়া যায়।

চা খেতে খেতে অনেক আলাপই হল। চিত্রা ভেতরে ভেতরে সময়গুলো লুফে নিচ্ছিল। এত সুন্দর সময় তার জীবনে হয়ত আর কখনো আসবে না। এই যে তার সামনে ভালো লাগার মত মানুষটা বসে আছে যার কাছে সে অকপটে মনের যত ব্যথা শেয়ার করেছে, ইচ্ছে মত যার সময় কেড়ে নিয়েছে সেই মানুষটাকে চাইলেই হয়ত আর দেখা যাবে না। দুদিনের জন্য কেন এমন মানুষগুলো জীবনে আসে? এরা কিছু সময়ের জন্য জীবনে এসে শক্ত মায়াজালে জড়িয়ে ফেলে তারপর ভালো থাকাটুকু আলগোছে তুলে নিয়ে চলে যায়! রেখে যায় ছায়া… যে ছায়া সমস্তটা জুড়ে থাকে না থাকা হয়ে। জীবন এমন কেন? কেন এইসব মানুষ আজীবন থেকে যেতে পারে না?

ফাইজ কথার ফাঁকে ফাঁকে চিত্রাকে লক্ষ্য করছিল। চিত্রা তার কথা তো শুনছে কিন্তু তার মন পড়ে আছে অন্য কোন ভাবনায়। সে আচমকা প্রশ্ন করে বসল- চিত্রা, বিয়ে ভাঙা নিয়ে আপনার বাসায় কোন সমস্যা ফেস করতে হয়নি তো?

চিত্রা স্মিত হেসে বলল- না হওয়ার তো কিছু নেই। বাসায় আমার নামে রীতিমত কার্ফিউ জারি হয়েছে। মা, ভাইয়া কথা বলা বন্ধ করে দিয়েছে। বাবাও বিরক্ত কিন্তু সরাসরি আমাকে কিছু বলছে না তবে মাকে কথা শোনাচ্ছে। একমাত্র ভাবি কথা বলাটা চালিয়ে যাচ্ছে। আর তার কথার যা ধরণ তা ভাষায় প্রকাশের যোগ্য নয়।

-সেদিন দুর্ভাগ্যক্রমে আমি আপনার ভাবির কথা শুনে ফেলেছিলাম… তার কথা কেমন হতে পারে আন্দাজ করতে পারছি। আপনার দৈনন্দিন জীবন তো তাহলে বিভীষিকাময় কাটছে!

-আমার অভ্যেস হয়ে গেছে। তাই এসব নিয়ে খুব একটা কষ্ট পাই না। কষ্ট পেতে পেতে আমার মনটাই হয়ত শক্ত পাথর হয়ে গেছে।

-আল্লাহ্‌ বলেছেন “নিশ্চই কষ্টের পর সুখ আছে” তাই আপনি নিশ্চিন্তে থাকুন। এই সময়টা খুব দ্রুতই বদলে যাবে।

-হয়ত… তবে স্বপ্ন দেখি না। জীবনে এত যন্ত্রণা পেতে হয়েছে যে স্বপ্ন ভাঙার যন্ত্রণা সহ্য করার সাধ্য আমার নেই।

ফাইজ চিত্রার দিকে তাকিয়ে রইল… তার মস্তিষ্কে তখন এলোমেলো অনেক প্রশ্ন উঁকি দিতে লাগল… মেয়েটার জন্য কী তার ভেতরে কোন অনুভূতি কাজ করে? সেই অনুভূতির নাম কী? কেন এই অনুভূতি? মেয়েটা অসহায় বলে? নাকি অন্যরকম বলে?

দুপুরে খেতে বসে চিত্রা দেখল অনেক আয়োজন! চিত্রার মনে পড়ে না তার জন্য কবে আয়োজন করে কিছু করা হয়েছিল। মিসেস চৌধুরী বললেন-

-চিত্রা তুমি তো তোমার কী পছন্দ কিছুই বললে না তাই আমি আমার পছন্দে সব করেছি। এখন এই সব তোমাকে খেতে হবে।

চিত্রা আতকে উঠে বলল- সব!!! আপনিও কী আমাকে রাক্ষস ভাবেন?

-আমি তো ভাবছি না কিন্তু অন্য কে তোমাকে রাক্ষস ভাবে?

চিত্রা হেসে ফেলল। ফাইজের দিকে আড়চোখে তাকিয়ে বলল- হবে কোন হোমড়াচোমরা লোক।

ফাইজ বলল- যে বলেছে সে হয়ত আপনার যে মাঝে মাঝে রাক্ষুসে খিদে পায় সেটা দেখেই বলেছে।

খাবার টেবিলে তাদের সবার বেশ ভালো সময় কাটল। বাড়িতে চিত্রার যে খরা যাচ্ছিল তা এই অল্প কিছু সময়ে যেন ঝুম বৃষ্টিতে শীতল হয়ে গেল। তার কেবলই চোখে পানি এসে যাচ্ছে এটা ভেবে যে, এই মানুষগুলো তার জীবনে স্থায়ী নয়। এ বাড়িতে আসবার জন্য আজকের পর তার আর কোন প্রয়োজন নেই!

চিত্রা চলে যাবার সময় ফাইজ কয়েকটা শপিং ব্যাগ চিত্রার হাতে ধরিয়ে দিয়ে বলল- এটা আপনার জন্য। আপনার সাথে আমাদের ভালো কিছু সময় কেটেছে। আমাদের ভুলে যাবেন না। যোগাযোগ রাখবেন। দেশে কতদিন আছি জানি না। আপনার সাথে দেখা হলে আমাদের ভালো লাগবে।

চিত্রা মনে মনে বলল- যোগাযোগ করব, অবশ্যই করব। আমি এতকাল একটা বন্ধুর জন্য যে তৃষ্ণা অনুভব করেছি আপনি সেই অভাবটা পূরণ করেছেন। তাই যখনই আমার মন কেমন করবে আমি আপনাকেই খুঁজব। আর মুখে বলল- এত সব কী?

-এটা কোন ঋণ পরিশোধের জন্য নয়, আপনার জন্য আমাদের তরফ থেকে সামান্য কিছু উপহার।

চিত্রা মুখে সামান্য হাসির রেখা টেনে ব্যাগগুলো নিয়ে ধন্যবাদ জানিয়ে চলে এলো। চিত্রা চলে যাবার পর ফাইজের কেন যেন মনে হল- কিছু একটা তার জীবন থেকে হারিয়ে যাচ্ছে, যেটা হারিয়ে ফেলা উচিত নয়। কেন এমন মনে হচ্ছে সেটাও সে বুঝতে পারছে না। কী হয়েছে কী তার? আজকাল অদ্ভুত সব অনুভূতি মনের ভেতর জায়গা করে নিতে চাচ্ছে। যার সাথে সে পরিচিত নয়। কী হল তার?

মাঝরাতে চিত্রা ফাইজের দেয়া ব্যাগগুলো বের করল। দেখল ৫ রঙের ৫টা শাড়ি। এত শাড়ি! সবগুলো শাড়িই কী চমৎকার। এর মধ্য থেকে সে আকাশী রঙের শাড়িটা নিয়ে আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে দেখল তাকে কেমন দেখায়? সাথে সাথে শাড়ির ভাজ থেকে একটা খাম টুপ করে নিচে পড়ল। সে খামটা হাতে নিয়ে খামের ভেতর থেকে ছোট্ট একটা চিরকুট বের করল। তাতে লিখা-

“আমার তো আকাশের মত নীল পছন্দ কিন্তু আপনার পছন্দের রঙ কোনটা আমার জানা নেই। এই প্রথম মা ছাড়া অন্য কারো জন্য কিনেছি। এর ভেতর থেকে কোন একটা হয়ত ঠিক আপনার পছন্দ হয়ে যাবে। অনেক ভালো থাকবেন।
ফাইজ।”

চিত্রার অবাক লাগল এতগুলো শাড়ির মধ্যে তার আকাশী শাড়িটাই খুলতে হল? কী অদ্ভুত! চিত্রার এত ভালো লাগল যা আগে কখনো কোন কিছুতে লাগেনি। এই ভালো লাগার কারণ কী তাহলে ফাইজ? কারণ যেটাই হোক প্রফেসর সাহেব একটা সারপ্রাইজ ডিজার্ভ করে। স্পেশাল সারপ্রাইজ।

আগের পর্বের লিংক
https://www.facebook.com/groups/boipokaofficial/permalink/1358129898325836/

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here