অবেলায় বসন্ত (পর্ব – ৭)

অবেলায় বসন্ত (পর্ব – ৭)
লেখাঃ শামীমা জামান

চিত্রা ফাইজের দেয়া শাড়িগুলো থেকে ল্যাভেন্ডার রঙের শাড়িটা পরেছে। আজ সারাদিন অফিসের কাজ ঠিক মত করতে পারেনি উত্তেজনায়। মাথায় কেবলই ফাইজের ভাবনা। অফিস ছুটির আগে সে নিজেকে একটু গুছিয়ে নিল। চোখে গাঢ় কাজল দিল। কাজল পরলেই তাকে দেখতে ভীষণ মিষ্টি লাগে। সে আয়নার দিকে অনেকক্ষণ তাকিয়ে রইল কিন্তু নিজেকে দেখল না। ভাবনারা আজ তাকে পেয়ে বসেছে যেন। সে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে ফাইজকে টেক্সট করে বের হয়ে গেল।

রেস্টুরেন্টে পৌছে দেখল ফাইজ এসে বসে আছে। চিত্রা তার সামনে এসে বসল। এটা একটা রুফটপ রেস্টুরেন্ট। ফাইজ একদম সাইডের একটা টেবিলে বসেছে। এখান থেকে পুরো জায়গাটা খুবই সুন্দর লাগছে। আজ দুপুরের পর থেকে আকাশ মেঘলা তাই পরিবেশটা চমৎকার লাগছে। খোলা আকাশ, হালকা বাতাস…বেশ সুন্দর আর ভালোলাগার মত জায়গা। চিত্রা ফাইজের মুখোমুখি বসে বলল-

-লেট করে ফেলেছি কী?

-না। তবে লেট করলেই মনেহয় ভালো হত।

-কেন?

-তোমার জন্য অপেক্ষা করতে ভালো লাগছিল। সময়টা অন্যরকম অনুভূতি নিয়ে কাটছিল তাই।

ফাইজ শুভ্র সাদা শার্ট পরেছে দেখতে একেবারেই… তাকানো যাচ্ছে না এর দিকে। খুব বেশি ভালো লেগে গেলে সেটাকে যেমন খেয়ে ফেলতে ইচ্ছে হয় ফাইজকে দেখে সেরকমই ইচ্ছে হচ্ছে! চিত্রা এমনিতেই এলোমেলো হয়ে আছে এখন আরও বেশি এলোমেলো হয়ে যাচ্ছে। সে ভুলেই গেল সে অপলক ফাইজের দিকে তাকিয়ে আছে।

ফাইজ তখন গলা খাকারি দিয়ে বলল- আশপাশের লোকজন কিন্তু দেখছে তুমি যে এভাবে আমার দিকে তাকিয়ে আছ।

-চিত্রা লজ্জায় লাল হয়ে গেল। কিছু বলতেও পারল না। ইসস এমন বোকামি করে কেউ?

ফাইজ চিত্রার দিকে কিছু ফুল বাড়িয়ে দিয়ে বলল- আমাকে খুব বেশিদিন অপেক্ষা না করানোর জন্য এটা।

-মানে?

-মানে তুমি আজ “হ্যাঁ” বলতে এসেছ সেইজন্য এই সুন্দর ফুলগুলো তোমার জন্য।

-আমি “হ্যাঁ” বলতে এসেছি সেটা কে বলল?

-তোমার আজকের সাজ পোশাক শুধুমাত্র আমার জন্য করেছ। “হ্যাঁ” না হলে নিশ্চই এর উল্টোটা হত, সহজ হিসাব।

-আপনার জন্য করেছি?

-তোমার কী মনেহয় আমি টিনএজ ক্যারেক্টার থেকে বের হয়ে গেছি? উহু, আমি আজও তোমাকে লুকিয়ে ফলো করেছি তোমাকে এক পলক দেখার আশায় রাস্তায় বসে থেকেছি। তুমি সকালে যখন অফিসে এসেছ তখন চোখে কাজল ছিল না। আর আমার দেয়া এই শাড়িটা আজ পরার উদ্দেশ্য কী অন্য কেউ হতে পারে?

-চিত্রা আর কিছু প্রতি উত্তর করতে পারল না। আজ যেন ফাইজের দিন, সকল কথা তার পক্ষে সেজে বসে আছে।সে কথা খুঁজে না পেয়ে বলল- আপনার ধারণা ভুলও হতে পারে।

-উহু, আমি ভুল নই। যদি ভুল হয়েই থাকি তাহলে সঠিকটা কী বলো?

-শুধু কথাই বলবেন? খেতে খেতে বলি? অফিস করে এসেছি খিদে পেয়েছে।

-খিদে নিয়ে তো আমিও বসে আছি, “হ্যাঁ” শুনবার খিদে। তাই আগে সব কথা হবে তারপর খাওয়া।

চিত্রা অসহায়বোধ করল… তার গুছিয়ে আনা সকল কথাগুলো বেঈমানের মত সব হাওয়ায় মিলিয়ে গেছে!

ফাইজ চিত্রার দিকে তাকিয়ে আছে জবাবের জন্য। চিত্রার খোলা চুল বাতাসে বেসামাল হয়ে যাচ্ছিল। আর চিত্রা তাদের আটকাবার ব্যর্থ চেষ্টায় ব্যস্ত। উড়তে থাকা চুল থেকে, থেকে থেকেই সুন্দর একটা স্মেল আসছে। স্মেলটায় এক ধরনের মাদকতা আছে। যেটা ফাইজকে কেমন টানছে একবার চিত্রার চুলে নাক ডুবিয়ে দিতে! ফাইজ ভাবনা থেকে ফিরে নিজেই বলল- চিত্রা, তোমার ভেতরের ভয় আমি বুঝতে পারি না তা নয়। তুমি শুধু এটা বলো যে তুমি কী বিশ্বাস করো আমি সত্যিই তোমাকে চাই?

চিত্রা ফাইজের দিকে তাকিয়ে গভীর গলায় বলল “বিশ্বাস করি” কিন্তু…

-“এই কিন্তুটাকে আমার আর সহ্য হচ্ছে না একে এক্ষুণি বিদায় দিচ্ছি” বলে সে উঠে দাঁড়িয়ে গেল তারপর চিৎকার করে সবার উদ্দেশ্যে বলল- এটেনশন প্লিজ… আমি ফাইজ চৌধুরী, পেশায় একজন প্রফেসর। দীর্ঘদিন প্রবাসে থেকেছি, অল্পদিনেই হয়ত ওখানে আবার ফিরে যাব। দেশে এসেছিলাম প্রয়োজনে। আমার দীর্ঘ জীবনে যা ঘটেনি, ঘটবার আশাও যেখানে ছেড়ে দিয়েছিলাম সেটা এবার ঘটে গেছে! কোন এক বঙ্গনারী আমার হৃদয় হরণ করে ফেলেছে। এই পর্যায়ে এসে চিত্রা চাপা করুণ গলায় ফাইজকে বলল- “কী করছেন এসব আপনি? please stop this…” ফাইজ তখন চিত্রার হাত ধরে নিজের পাশে দাঁড় করে দিয়ে বলল- এই সেই রমণী। যার সৌন্দর্য আর মায়ায় আটকে গেছে আমার জীবন। যার জন্য এখন আমার রাত-দিন দীর্ঘ হয়ে গেছে। এর জন্য শত পাগলামোও স্বাভাবিক লাগে। কিন্তু যার জন্য এত কিছু সে কিনা সামান্য একটা “কিন্তু” তে আটকে আছে! এই অবিচার কী মেনে নেয়া যায়?

সবাই একসাথে চিৎকার করে উঠল- মেনে নেয়া যায় না। please say “yes” তারপর সবাই স্লোগানের মত সেটা বলতেই থাকল। চিত্রা লজ্জায় লাল নীল বেগুনি হয়ে যাচ্ছে। ফাইজ তখন চিত্রার সামনে তার হাত বাড়িয়ে দেয়। চিত্রা নিজেকে আর ধরে রাখতে পারে না। মনের যত ভয়, সংকোচ, দ্বিধা সব ঝেড়ে ফেলে দেয় এক মুহূর্তে। তার জন্য যে এক পৃথিবী ভালোবাসা নিয়ে ফাইজ হাত বাড়িয়ে অপেক্ষা করছে তার থেকে দূরে থাকাটা তার পক্ষে আর সম্ভব নয়। অনেক হয়েছে নিজের সাথে যুদ্ধ আর প্রতারণা। সে ফাইজের বাড়ানো হাতটা ধরে… তারপর দৃঢ়তার সাথে বলে- “YES” সাথে সাথেই সবাই আনন্দে হাত তালি দিয়ে উঠল। ফাইজ সবাইকে ধন্যবাদ দিল, তারপর এখানে উপস্থিত সবার জন্য পেস্ট্রি ওর্ডার করল। তারপর চিত্রাকে নিয়ে বসে বলল- এবার বলো তুমি কী খাবে? আজ জাহাপনা খুব খুশি, তার হবু বেগম যা খুশি চাইতে পারে।

চিত্রার মুখের লাল নীল রঙ যেন ফাইজ যেতেই দিবে না একের পর এক এমন সব কান্ড করে যাচ্ছে… চিত্রা বলল- এত কিছুর পর আর খিদে থাকে? পেট ভরে গেছে।

-ওসব বললে হবে না। আচ্ছা আমি অর্ডার করছি। সে কিছু লাইট খাবার অর্ডার করে বলল- আমি কী আজ রাতেই মাকে নিয়ে তোমাদের বাসায় আসব?

চিত্রা তখন পানি পান করছিল ফাইজের কথা শুনে বিষম খেয়ে গেল তারপর নিজেকে ধাতস্থ করে বলল- আজই?

-হুম, শুভ কাজে দেরি করতে নেই। আর তাছাড়া ৩ জন মানুষের যন্ত্রণায় আমি অস্থির তাই এক মুহুর্ত সময় নষ্ট করতে চাই না।

-কোন ৩ জনের যন্ত্রণা? কিসের যন্ত্রণা?

-আমি, আমার মা আর তোমার মা। ৩ জনই তোমার বিয়ের জন্য অস্থির হয়ে আছি। তাড়াতাড়ি বাসায় যাও গিয়ে আমার আর আমার মায়ের রাতের খাবারের আয়োজন করো। রাত ৮টার মধ্যে এলেই তো চলবে?

-আপনি হরবর করে এতসব কী বলছেন? এত দ্রুত কীভাবে সব সম্ভব? তাছাড়া বাসায় আপনার কথা জানাতে তো হবে আগে?

-জানাতেই তো যাচ্ছি। আর তাড়াহুড়ো করার আরও একটা কারণ আছে। আমি চাই এই ব্যাপারটা বাড়ির লোক আগে অন্য কারো মাধ্যমে না জানুক। সেটা ভালো দেখাবে না।

চিত্রা অবাক হয়ে বলল- অন্য কোন মাধ্যমে জানবে?

-এখানে আমার এক স্টুডেন্ট আছে। সে প্রথম থেকেই আমাদের ফলো করছিল তারপর বাকি কান্ড সে তার মোবাইলে ধারণ করেছে। সবই আমি দেখেছি। এখনকার ছেলেমেয়েরা যা করে সেও তাই করেছে এবং তার পরের স্টেপটা হবে আমাদের নিয়ে করা ভিডিওটা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে দেয়া। আর এ ধরণের ভিডিও খুব সহজেই ভাইরাল হয়ে যায়। বোঝাতে পেরেছি?

-কী অবস্থা…! আপনাকে এসব হিরোগিরি কে করতে বলেছিল?

-তোমার “কিন্তু” করতে বলেছিল। আর এই হিরোগিরিটার খুব প্রয়োজন ছিল। কারণ তুমি তো এই ভয়টাই পাচ্ছিলে তাই পুরো সমাজকে এখনই দেখিয়ে দিলাম আমার ভালোবাসায় তোমার ভয় পাবার কিছু নেই। আমার সাথে থাকা প্রতিটি মুহূর্ত হবে তোমার জন্য স্পেশাল। কথাটা শেষ হবার কয়েক মুহুর্ত পর ফাইজের ফোনে একটা ম্যাসেজ এলো, আর সেটা চিত্রাই পাঠিয়েছে।

“সামনে বসে থেকে ম্যাসেজ পাঠাচ্ছে, কী অদ্ভুত!” বলে ফাইজ ম্যাসেজ ওপেন করে দেখল তাতে লিখা “I love you Professor Shaheb” ফাইজ মুচকি হেসে চিত্রার দিকে তাকিয়ে বলল- যেখানে আমি সারা দুনিয়াকে জানিয়ে বলার সাহস রাখি সেখানে তুমি মুখেও বলতে পারছ না!

-অনুভূতির প্রকাশ সবার এক রকম নয়। আমি পারি না আপনার মত। আমি আমার মত করে পারি।

-আর আমার সেটাই পছন্দ। সেই মুহূর্তে ওয়েটার এলো খাবার সার্ভ করতে। দেখল তাদের অর্ডার করা খাবারের সাথে ছোট্ট কিউট একটা হার্ট শেপের রেড ভেলভেট কেক। ফাইজ অবাক হয়ে বলল- আমরা তো কেক অর্ডার করিনি!

ওয়েটার বলল- স্যার আপনাদের শুভ কামনায় আমাদের রেস্টুরেন্টের পক্ষ হতে সামান্য উপহার পাঠিয়েছেন ম্যানেজার স্যার।

ফাইজ ওয়েটারকে বলল- বাহ, ভালো লাগল। আপনাদের স্যার এবং আপনাদের সকলকে ধন্যবাদ।

ওয়েটার চলে যেতেই ফাইজ বলল- দেখলে আমার ভালোবাসার সৌন্দর্য কতটা?

চিত্রা মাথা নাড়িয়ে সায় জানাল। কোন কথা বলল না, সে শুধু সময়গুলো উপভোগ করতে চায়। এই মুহূর্তে সে পৃথিবীর সবচেয়ে সুখী মানুষ। দুহাত ভরে সেই সুখ সে অনুভব করতে চায়।

ওরা আরও কিছুক্ষণ বসল তারপর ফাইজ বলল- চলো উঠি। রাতে প্রথমবারের মত আমার দাওয়াত আছে হবু শ্বশুরবাড়িতে। প্রথম দিনে লেট হতে চাই না।

চিত্রা বাজার করেই বাসায় ফিরেছে। ফিরে মায়ের হাতে সব দিয়ে বলল- রাতে দুজন গেস্ট আসবে ভালো করে যেন রান্না করে। তারা রাত ৮ টার মধ্যেই আসবে তাই সব যেন তাড়াতাড়ি গুছিয়ে ফেলে। জাহানারা বেগম বিরক্ত হলেন। এত শর্ট নোটিশে কিছু করা যায়? আর এমন কে-ই বা আসবে যার জন্য এত আয়োজন? জিজ্ঞেস করতেই চিত্রা বলল-

-মা গেস্ট যে-ই হোক তারা খুব সম্মানি আর ভালো মানুষ। তারপর মুখ নামিয়ে বলল- তারা বিয়ের ব্যাপারে কথা বলতে আসবে।

জাহানারা বেগম অবাক হলেন ভীষণভাবে। বললেন- বিয়ের কথা! কে, কি করে, কোথায় থাকে, কীভাবে কী হচ্ছে বলবি তো সব আগে? এভাবে দুম করে বললেই হলো?

-এখন এতসব বলার সময় নেই মা। তারপর শর্টকাটে যতটুকু সম্ভব জানাল। জাহানারা বেগম শুনে বিস্মিত হয়ে গেলেন। তিনি কী বলবেন, কী করবেন কিছুই বুঝতে পারছেন না। কাঁপা গলায় বলল- এত অল্প সময়ে কী দিয়ে কী করবরে চিত্রা? আমার কেমন গলা শুকিয়ে আসছে। চিত্রা দেখল তার মায়ের চোখে পানি! চিত্রার নিজের চোখেও তখন পানি এসে গেল। অনেকদিন পর তার মনে হচ্ছে সে তার মাকে ফিরে পেয়েছে। ছোটবেলা থেকে চিত্রা তার মায়ের ভালোবাসা অন্য ভাইবোনের চেয়ে বরাবরই বেশি পেয়েছে। সবাই একটু অন্য চোখে দেখত বলেই হয়ত জাহানারা বেগম অতিরিক্ত ভালোবাসা দিয়ে সেটা পুষিয়ে দেয়ার চেষ্টা করতেন সব সময়। প্রতিটা মা-ই হয়ত এমন, তার দুর্বল বাচ্চাটার প্রতি সে একটু বেশিই ভালোবাসা লালন করে বুকে। পৃথিবীর কদর্যতা সে ঢেকে রাখতে চায় তার ভালোবাসার আঁচলে। চিত্রার মাও তেমন ছিলেন। যখন থেকে একের এক চিত্রার বিয়ের প্রস্তাবগুলো মুখ ঘুরিয়ে চলে যাচ্ছিল তিনি সেটা আর মেনে নিতে পারছিলেন না। মানুষ যখন দুঃখ, কষ্ট, রাগ, অভিমানে পড়ে তখন সে তার প্রকাশ সবচেয়ে কাছের মানুষের উপর দিয়ে করে। আর বেশিরভাগ সময় তার প্রতিক্রিয়া খারাপভাবেই হয়। জাহানারা বেগমও তাই করেছেন। চিত্রাকে নিয়ে সমাজের যত নোংরা রূপের শাস্তি সে তার চিত্রাকেই দিয়েছেন। কিন্তু প্রতিনিয়ত নিজেও যন্ত্রণা ভোগ করেছেন। চিত্রা এসবই বোঝে এই কারণেই যতই অভিমান হোক সে মায়ের প্রতি কোন অভিযোগ করতে পারে না। আজ সে ভীষণ খুশি। নিজেকে পৃথিবীর সবচেয়ে সম্পদশালী বলে মনে হচ্ছে নিজেকে। বলল-

-মা তুমি এমন করছ কেন সব সামলে নিতে পারবে আমি আছি তো। তুমি আগে বাবা আর ভাইয়া ভাবিকে ডেকে জানাও।

-“ঠিক আছে” বলে জাহানারা বেগম দ্রুত ফোন নিয়ে ছেলের সাথে কথা বলে তাকে তাড়াতাড়ি বাসায় আসতে বললেন। তারপর ছেলের বউকে নিয়ে রান্নাঘরে ঢুকে গেলেন। তার কেমন অস্থির অস্থির লাগছে… চিত্রা যতটা পারল রান্নাঘরে সাহায্য করে ঘর-বাড়ি গুছিয়ে ফেলল। চিত্রার ভাবি সব দেখছে তবে মনে মনে সে কিছুটা বিরক্ত। তার ধারণা চিত্রাকে কেউ ভুলভাল বুঝিয়ে বোকা বানাতে চাইছে আর চিত্রা সেটাই হচ্ছে। নয়ত পাত্রের যা বিবরণ শুনেছে এমন ছেলের কী ঠ্যাকা পরেছে চিত্রার মত মেয়েকে বিয়ে করে ঘর অন্ধকার করার? সে ইনিয়ে বিনিয়ে শ্বাশুড়িকে তার ধারণা বোঝাবার চেষ্টা করেছিল। জাহানারা বেগম মনে কষ্ট পেলেন। তিনি চিত্রাকে জিজ্ঞেস করতে গিয়েও করলেন না। কারণ চিত্রার মুখে আজ অন্যরকম দীপ্তি খেয়াল করছেন তিনি যেটা আগে কখনো দেখেনি। সেটাকে তিনি নষ্ট করতে চাইলেন না। তাছাড়া তার চিত্রা এতটাও বোকা নয় যে হাওয়ায় ভেসে যাওয়া কথায় আটকে যাবে। তিনি মন দিয়ে রান্না এগিয়ে নিলেন।

রান্না মোটামুটি গুছিয়ে এনে জাহানারা বেগম চিত্রাকে বললেন- কাজ করতে করতে তো একেবারে ঘেমে একাকার হয়ে গেছিস, যা ফ্রেস হয়ে ভালো একটা শাড়ি পরে নে। আর ওদের একটা ফোন করে জেনে নে আসতে কতক্ষণ লাগবে?

-দিচ্ছি ফোন, তুমি এত অস্থির হয়েও না। তোমাকে হুট করে অনেক ঝামেলায় ফেলে দিয়েছি তাই না মা?

-এই ঝামেলা করব বলে কত দিন রাত আমার চোখের পানি ফেলে কেটেছে… আজ সেই দিন এসেছে। এখন সব কিছু ভালোয় ভালোয় এগিয়ে গেলেই হলো। আল্লাহর কাছে শুকরিয়া জানানোর ভাষা নাই আমার বলে জাহানারা বেগম চোখ মুছলেন আঁচলে। তুই দাঁড়িয়ে থাকিস না, যা ফ্রেস হয়ে নে।

চিত্রা হাতের কাজটা শেষ করে একেবারে গোসল করে নিল। গোসল করে এসে দেখে ফাইজ ফোন করেছিল ২০মিনিট আগে। সে কল ব্যাক করল।

ফাইজ ফোন রিসিভ করে বলল- আমরা বের হচ্ছি সেটা বলতেই ফোন করেছিলাম।

-কতক্ষণ লাগবে পৌছাতে?

-আধঘন্টা…

-ঠিক আছে আসুন।

-ওকে বাই তাহলে।

চিত্রা ফোন রেখে তার মায়ের আলমারি থেকে মায়ের একটা শাড়ি বের করে নিল। হালকা মিষ্টি একটা রঙ শাড়িটার… তার মায়ের খুব পছন্দের। তাই এই শাড়িটাই সে পরে নিল। মেয়েরা প্রথম মায়ের শাড়ি পরেই শাড়ি পরা শুরু করে। চিত্রার আজ একটা বিশেষ দিন তাই সে নিজের অনেক শাড়ি থাকার পরও মায়ের শাড়ি পরল। চোখে কাজল দিল। তারপর মায়ের কাছে গিয়ে দেখল রান্না শেষ। বলল- মা তুমি নিজে এবার ফ্রেস হয়ে শাড়িটা পাল্টে নাও।

-হ্যাঁ যাচ্ছি। কিন্তু তুই আজ এই শাড়িটা পরলি কেন?

-ইচ্ছে হলো তাই।

জাহানারা বেগম ঠিক বুঝে গেলেন চিত্রা এই শাড়ি কেন পরেছে। তার চোখে পানি এসে গেল। আজ যে কী হয়েছে তার শুধু চোখে পানি এসে যাচ্ছে… এমন শুভ সময়ে চোখে পানি আসতে আছে? তিনি চোখ আড়াল করে চলে গেলেন।

চিত্রার ভাইয়া এসে তখন চিত্রাকে ফাইজ সম্পর্কে সব জিজ্ঞেস করলেন। সব শুনে সেও খুব খুশি হলো।

চিত্রার ভাই আর বাবা মিলে এসব নিয়ে যখন আলোচনা করছিল তখনই ফাইজ আর তার মা চলে এলো। চিত্রার হার্টবিট বেড়ে গেল। কারণ ফাইজ আর তার ব্যাপারটা ফাইজের মা কীভাবে নিয়েছে সে এখনো তা জানে না!

চিত্রার ভাইয়া আর বাবা তাদের রিসিভ করলেন। তখন চিত্রার মাও সেখানে গেলেন। ফাইজ আর ওর মাকে দেখে সবাই অবাক এবং একই সাথে আনন্দিত। ফাইজ তো পুরো রাজপুত্র! এদের দেখে, এদের সাথে কথা বলে জাহানারা বেগমের বার বার চোখে পানি এসে যাচ্ছিল… তার চিত্রার ভাগ্যটা আল্লাহ এত সুন্দর করে লিখে রেখেছেন! কথাবার্তার এক পর্যায়ে চিত্রাকে ডাকা হলো। মিসেস চৌধুরী চিত্রাকে তার পাশে বসালেন। বললেন- আমি তোমার মত লক্ষ্মী একটা মেয়ে চেয়েছিলাম, আল্লাহ আমার দোয়া কবুল করেছেন। তারপর ওর দিকে তাকিয়ে বলল- কাজল পরলে তোমাকে এত সুন্দর লাগে! নিয়মিত পর না কেন? চিত্রা মুখ নিচু করে বসে রইল। তারপর অনেক কথাই হলো। মিসেস চৌধুরী তার হ্যান্ড ব্যাগ থেকে একটা বক্স বের করে চিত্রার হাতটা নিয়ে একটা আংটি পরিয়ে দিলেন। চিত্রার বাসার সবাই এতটা আশা করেনি। তারা ভেবেছিল প্রাথমিক কথা হবে। এখন চিত্রাকে যেহেতু আংটি পরাল তাহলে তো ফাইজকেও পরাতে হয়। কিন্তু তারা তো সে প্রস্তুতি নেয়নি! সেটা জানাতেই মিসেস চৌধুরী বললেন- আমরা তো কিছু বলে আসিনি তাই আপনারা এটা নিয়ে ভাববেন না, এটা পরেও করা যাবে। তারপর সবাই খেতে গেল। জাহানারা বেগম ছেলেকে ডেকে কিছু টাকা হাতে ধরিয়ে দিয়ে বললেন- এক্ষুণি একটা আংটি নিয়ে আয় ফাইজের জন্য। চঞ্চল টাকাটা না নিয়ে বলল-

-মা, টাকা লাগবে না, আমি যাচ্ছি বলে চঞ্চল তখনই বের হয়ে গেল আংটি আনতে।

সবাই খুব তৃপ্তি নিয়ে খেলেও জাহানারা বেগমের মন ভরল না। আরও কিছু সময় পেলে আর আগে থেকে জানলে তিনি আরও ভালো কিছু করতেন বার বার সেটাই বলছিলেন।

খাওয়া শেষ হলে জাহানারা বেগম সবাইকে গল্পে ব্যস্ত রাখলেন। কারণ চঞ্চল এখনো আসেনি। আর এই পুরো সময়টাতে চিত্রার ভাবি রুনা তেমন কোন কথাই বলেনি। এখনো সে একপাশে বসে ফেসবুকিং করে যাচ্ছে আর সবার কথা শুনছে। চিত্রার মত মেয়ে এমন একজন রাজপুত্র বাগিয়ে বসতে পারে সেটা রুনার কল্পনাতেও আসেনি। তাই ব্যাপারটা হজম করতে তার কষ্ট হচ্ছে। তবে ফাইজকে দেখে রুনা চিনতে পেরেছে। এই লোকটাই তো সেদিন চিত্রাকে দেখতে এসেছিল অসুস্থ হবার পর। সেটা নিয়ে চিত্রাকে দুটো কথা বলতেই কেমন তেলে বেগুনে জ্বলে উঠেছিল চিত্রা। রুনার মনে ক্ষীণ সন্দেহ চিত্রা হয়ত ফাইজকে… এমন সময় সে চিত্রা আর ফাইজকে দেখতে পেল ফেসবুকে এক ভিডিওতে। সে অবাক হয়ে পুরো ভিডিওটা দেখল। ভিডিওটা আজ বিকেলেই আপলোড হয়েছে আর এরই মধ্যে রীতিমত হৈচৈ ফেলে দিয়েছে! অবশ্য হৈচৈ ফেলে দেবার মতই ঘটনা। সে ক্যাপশনটা ভালো করে পড়ল। কমেন্টও ঘাটল। সবাই শুভেচ্ছা আর শুভকামনায় ভরে ফেলেছে। প্রচুর শেয়ারও হচ্ছে। চিত্রা এতটা লাকি!!! রুনার মনে হিংসে আরও কয়েকগুণ বেড়ে গেল।

চঞ্চল ফাইজের জন্য ডায়মন্ডের রিং এনেছে। চিত্রাকে যেমনটা দিয়েছে তার সাথে মিলিয়ে আনবার চেষ্টা করেছে। ফাইজকে আংটি পরানো হলে সবাই বিয়ের তারিখটাও পাকা করে ফেলতে চাইল। জাহানারা বেগম তখন তার ছোট মেয়ে চন্দ্রার সাথে কথা বলতে চাইলেন। চন্দ্রা যদি আসতে পারে তাহলে সেভাবেই তারিখ নির্ধারণ করা হবে। মিসেস চৌধুরী বললেন- আপনি তাহলে এখনই ফোন করে জেনে নিন। জাহানারা বেগম মেয়েকে ফোন করলেন। তারপর সবটা জানালেন। সব শুনে চন্দ্রা ভীষণ খুশি হলো। কিন্তু তার পক্ষে ৪ মাসের মধ্যে আসা সম্ভব নয়। তাই তাকে ছাড়াই সব আয়োজন করতে বলে দিল চন্দ্রা। আপুর সুখ সময় যেহেতু শুরু হয়েছে সেটাতে ভাটা দেয়ার কোন প্রশ্নই ওঠে না। জাহানারা ফোন রেখে সবাইকে চন্দ্রার কথা জানালেন তারপর বিয়ের তারিখ ঠিক করে ফেললেন। ফাইজদের তেমন কোন আত্মীয় দেশে নেই তাই খুব কাছাকাছি একটা ভালো দিন দেখে বিয়ের তারিখ ঠিক করে ফেলল সবাই মিলে।

আগের পর্বের লিংক
https://www.facebook.com/groups/boipokaofficial/permalink/1360364964768996/

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here