অবেলায় বসন্ত (শেষ পর্ব)

অবেলায় বসন্ত (শেষ পর্ব)
লেখাঃ শামীমা জামান

চিত্রার সন্তান জন্ম নেবার সময় যত ঘনিয়ে আসছে চিত্রার তত ঘুমের ঘোরে দুঃস্বপ্ন দেখা বাড়তে লাগল। আজকাল তার অজানা আশংকায় বুক ভার হয়ে থাকে। সে পারবে তো একা সব দিক সামলে নিতে? ফাইজ থাকলে হয়ত সব কিছু সহজ হয়ে যেত। বাড়তি কোন চাপ তাকে নিতেই হত না। মা, বাবা, ভাইয়া এত কিছু করছে তারপরও সব কিছু ছাপিয়ে সে কেবল ফাইজকেই ভাবে! এতদিন পর এসেও তার ফাইজের জন্য দম বন্ধ লাগে।

জাহানারা বেগম এখন রাতে চিত্রার সাথেই ঘুমায়। তিনি টের পান চিত্রা সারা রাত ঘুমের ঘোরেও কেমন অস্থির থাকে। প্রায় রাতেই চিত্রা ঘুম থেকে জেগে ফুপিয়ে কাঁদে। তারপর আস্তে করে তাকে ছুঁয়ে থাকে। তার তখন বুক ভেঙে আসে… তার এই মেয়েটার কপালে আল্লাহ এত পরীক্ষা লিখে রেখেছেন! আজ রাতেও চিত্রার ঘুম ভালো হলো না। ছাড়া ছাড়া ঘুমে সে রাত পার করল। ভোরের দিকে ঘুমিয়ে যেতেই সে স্বপ্ন দেখতে শুরু করল। দেখল- “তার খুব সুন্দর একটা মেয়ে হয়েছে। কী আশ্চর্য মেয়েটা দেখতে হুবহু তার বাবার মত হয়েছে! ঠিক বাবার মতই সে হাসছিল। মেয়েকে কোলে নিতে যাবে এমন সময় ফাইজ এলো। এত এত ব্যাগ তার হাতে। জিজ্ঞেস কর‍তেই বলল- কন্যার জন্য ভালোবাসা নিয়ে এসেছে। তার মেয়ে তখন বাবার দিকে তাকিয়ে খিলখিল করে হাসছিল। চিত্রা অভিমান করে বলল- সব ভালোবাসা শুধু মেয়ের জন্য? ফাইজ তখন চিত্রার কাছে এসে বলল- তোমার জন্য তো আমিই আছি আর কি চাই? চিত্রা তখন ফাইজকে ধরতে গেল…” আর তখনই স্বপ্ন ভেঙে গেল! তার ভীষণ কষ্ট হতে লাগল। উঠে দেখল ফজরের আযান হচ্ছে। সে উঠে নামাজটা পড়ে নিল। দীর্ঘ মোনাজাতে এখনো সে ফাইজকেই চেয়ে চোখের পানি ফেলে। আজও তাই হলো। আজকে দেখা স্বপ্নটা এত বাস্তব ছিল যে চিত্রার কষ্ট হতে লাগল।

প্রেগন্যান্সির কারণে চিত্রার অফিস থেকে এখন তার জন্য অনেক কিছুই শিথিল করা হয়েছে। আজ তার শরীর তেমন ভালো লাগছিল না। স্বপ্নটা দেখার পর থেকে কেমন অস্থির লাগছিল। তাই আজ আর অফিসে গেল না। সে নাশতা করে বারান্দায় এসে বসেছে। তার মনের ভেতর কেমন যেন এক চঞ্চলতা তৈরি হয়েছে। কিছুক্ষণ পর জাহানারা বেগম এসে পাশে বসলেন।

চিত্রা মায়ের দিকে তাকিয়ে দেখল তার দুচোখ লাল হয়ে ফুলে আছে। মাত্রই কেঁদে এসেছে। চিত্রার সাথে সাথে তার মায়েরও কান্না রোগ হয়েছে। মাঝেই মাঝেই তার চোখ লাল হয়ে ফুলে থাকে। আর সেটা চিত্রার জন্যই। তিনি যতই লুকিয়ে কাঁদুক চিত্রা ঠিক বুঝতে পারে চোখ মুখ দেখে। তিনি চিত্রাকে বললেন-

-তোর কী শরীর খারাপ লাগছে?

-শরীর ঠিক আছে কিন্তু হঠাৎ কেমন একটু অস্থির অস্থির লাগছে। কিছু বলবে?

-তোর তো প্রায় সময় হয়ে এলো এমন সময় কেউ এমন টেনশন করে? তুই এখন থাকবি আনন্দে ঝলমল করে।

চিত্রা কিছু বলল না। সে তো চায় তেমন করে থাকতে কিন্তু তার সবটুকু আনন্দ ফাইজ এমনভাবে তুলে নিয়ে চলে গেছে যে, পৃথিবীর সবচেয়ে সুন্দর অনুভূতির ভেতর বাস করেও চিত্রা বিষণ্নতায় ঘিরে থাকে! একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল সে।

-তোর কী এখনো ফাইজের আশা হয়? আল্লাহ যদি তোর দোয়া হুট করে কবুল করে ফেলে?

-চিত্রা হু হু করে কেঁদে ফেলল। আশা হয় মা। সে এভাবে আমাকে ফেলে চলে যেতে পারে কীভাবে? আমার এখনো বিশ্বাস করতে কষ্ট হয়। সে যদি সত্যিই মিথ্যা হয় তাহলে এই পৃথিবীতে কাউকে বিশ্বাস করার মত শক্তি আমার আর থাকবে না। এই যে তার সন্তান প্রতিদিন আমার ভেতর বেড়ে উঠছে এর প্রতি ফাইজের দায় আছে তো। তাকে ফিরে আসতে হবে মা। আমার কেবলই মনেহয় এই বুঝি সে এসে আমার সামনে দাঁড়াল…

জাহানারা বেগম মেয়েকে জড়িয়ে ধরে ডুকরে কেঁদে ফেলল। বলল- তোর বিশ্বাস আল্লাহ নিশ্চই কবুল করবেন। তুই আর এভাবে মনমরা হয়ে থাকবি না, কাঁদবি না। দেখতে ভালো লাগে না। ওঠ যা গোসল করে ভালো একটা শাড়ি পর। কতদিন হয় শাড়ি পরিস না। তোর তো পছন্দ শাড়ি পরা, পরিস না কেন? ভালো কাপড় পরলেও মন ভালো হয়ে যায়।

-ইচ্ছে করে না মা।

-আজ পর যা। তোর চেহারার দিকে তাকানো যায় না। চুলে শ্যাম্পুও দিস না মনেহয় কতকাল চুলে তেল, চিরুনি, শ্যাম্পু পড়ে না। এত সুন্দর চুলগুলো কেমন দেখাচ্ছে।

জাহানারা বেগম মাঝে মাঝেই চিত্রাকে এমন করে বলে মন ভালো রাখবার জন্য। কিন্তু চিত্রা কী করে বোঝায় তার এখন এসব কোন কিছুতেই আর আগ্রহ লাগে না! তবু আজ মায়ের পিড়াপীড়িতে উঠে গেল। গোসল করে ফাইজের দেয়া শাড়িই পরল একটা। অনেকদিন পর শাড়ি পরল। আয়নার সামনে বসে চুল আচড়াতে গিয়ে ফাইজের ভাবনা চলে এলো… চিত্রার চুলের গন্ধে নাকি সে কেমন মাদকতা অনুভব করত। তার নেশা ধরে যেত… কাছে এসেই জাপটে ধরে চুলের ভাজে নাক ডুবিয়ে দিত। তারপর ফাইজের সাথে কাটানো সুন্দর মুহূর্তগুলো মনে পড়তে লাগল… এমন সময় সে আয়নায় দেখল ফাইজ তার পেছনে এসে দাঁড়িয়েছে! চিত্রা অবাক হলো না। কারণ এমন হ্যালুসিনেশন ওর মাঝে মাঝেই হয়। আজকাল শরীরটা কেমন যাচ্ছে সে বুঝতে পারে না। সে ফাইজের দিকে চুপচাপ তাকিয়ে রইল। ফাইজ কেমন রোগা হয়ে গেছে। তারপর খেয়াল করল ওর কপালে গভীর একটা কাটা দাগ, এটা তো ছিল না! তখন ফাইজ আস্তে করে বলল-

-কেমন আছো চিত্রা?

-চিত্রা ব্যাপারটাকে আর স্থায়ী হতে দিতে চাইল না। সে চোখ বন্ধ করে ফেলল তারপর উঠে দাঁড়িয়ে পেছন ফিরল। আশ্চর্য এখনো সে ফাইজকে দেখতে পাচ্ছে, ফাইজের গায়ের পারফিউমের স্মেল পাচ্ছে! তার শরীর কী খুব বেশি খারাপ করেছে? নয়ত এমন হচ্ছে কেন? আচ্ছা ফাইজের মুখটা এমন দেখাচ্ছে কেন? অনেক রকম অনুভূতি সেখানে। চিত্রা কী হাত দিয়ে ছুঁয়ে দেখবে? ছুঁয়ে দেখলে যদি মুখখানা হাওয়ায় মিলিয়ে যায়? থাকুক, আরও কিছুক্ষণ নাহয় কল্পনাটাই ভেসে থাকুক। তবু তো সে কিছুক্ষণ ফাইজের মুখটা দেখতে পারবে। তখন ফাইজ চিত্রার চুলের ভেতর হাত গলিয়ে দিয়ে আলতো করে গালে রাখল। চিত্রার তখন বুক কেঁপে উঠল… সে বিস্ফোরিত চোখে ফাইজের দিকে তাকাল। ফাইজ বলল-

-চিত্রা তোমার চুলের গন্ধে এখনো সেই মাদকতা রয়ে গেছে!

চিত্রা তখন কাঁপা হাতে ফাইজের হাত ধরল… সত্যিই ফাইজ! তার চোখ থেকে এক ফোটা পানি দ্রুত গাল বেয়ে নেমে এলো। আস্তে করে বলল- তুমি কি সত্যি?

ফাইজ মাথা নাড়িয়ে বলল- “হ্যাঁ, সত্যি”

চিত্রা ফাইজের গালে হাত রাখল। কোন কথা বলতে পারল না। তার সমস্ত শরীর দুলতে লাগল, সে হাওয়ায় ভেসে যাওয়া তুলোর মত ভেসে যেতে লাগল। ভাসতে ভাসতে সে নিকষকালো অন্ধকারে ডুবে গেল!

১০মিনিট পর চিত্রা শুনতে পেল অনেক দূর থেকে কেউ তাকে ডেকে যাচ্ছে “চিত্রা… চিত্রা…”বলে। তার কপাল বেয়ে শীতল স্রোত নেমে যাচ্ছে শব্দ করে। সেই স্রোতের শীতলতার সাথে কেউ তার নাম ধরে পরম মমতা, উদ্বেগ আর ভালোবাসায় ডেকে যাচ্ছে। আস্তে আস্তে চিত্রা চোখ খুলল। সে তাকিয়ে প্রথমেই ফাইজকে দেখল তারপর দেখল তার মা পাশে বসে আছে। দুজনের মুখেই উদ্বেগের ছাপ। চিত্রাকে চোখ খুলতে দেখেই ওর মা বললেন-

-কেমন লাগছেরে মা?

চিত্রা কিছু বলল না, সে শুধু তার সামনে বসে থাকা মানুষটার দিকে অপলক তাকিয়ে রইল। এই মানুষটাকে দেখার জন্য সে কতকাল ধরে বুকের ভেতর গভীর তৃষ্ণা চেপে নিয়ে বেঁচে আছে! সেই তৃষ্ণা কী তার একজনমে শেষ হবে?

জাহানারা বেগম তখন বললেন- আল্লাহ তোর দোয়া কবুল করেছে। ফাইজ ফিরে এসেছে।

চিত্রার দুচোখ বেয়ে অশ্রুধারা নেমে এলো। হাত বাড়িয়ে ফাইজকে ছুতে চাইল, তখন দেখল ফাইজ ওর হাত ধরেই রেখেছে।

জাহানারা বেগম চিত্রাকে উঠিয়ে বসিয়ে দিয়ে চলে গেলেন। ফাইজ আর চিত্রা এখন ঘরে একা… ফাইজ কোন কথা বলছে না। মুখ নিচু করে অপরাধীর মত বসে আছে। চিত্রা ফাইজকে বলল- আমি কী তোমাকে সত্যি ধরে নেব? নাকি ভরসা করতেই আবার হাওয়ায় মিলিয়ে যাবে?

ফাইজ তখন চিত্রাকে জড়িয়ে ধরে কেঁদে ফেলল। চিত্রাকে মিশিয়ে নিতে চাইল তার অস্তিত্বের সাথে। তার নিজের বুকেও যে তৈরি হয়েছে অসীম শূন্যতা। একজন ভাঙাচোরা মানুষ সে এখন। চিত্রাকে বুকে চেপে ধরে সেই শূন্যতা সে মিটিয়ে নিতে চাইল। চিত্রার চিরো ভরসা হতে চাইল, চাইল চিত্রা তার ভরসা হোক। তাদের দুজনেরই এখন দুজনকে ভীষণভাবে প্রয়োজন। নিয়তি তাকে আর চিত্রাকে যে অসীম যন্ত্রণাময় অন্ধকারে ফেলে দিয়েছিল সেটা যদি এক লহমায় কাটিয়ে নেয়া যেত?

***
মানুষ কিছু দিন কোথাও বাস করলে সেই জায়গায় তার এক রকম শেকড় গজিয়ে যায়। চাইলেই সেই জায়গাটার মায়া কাটিয়ে নিজেকে উচ্ছেদ করতে পারে না। তাই দীর্ঘদিন পর ফাইজ অস্ট্রেলিয়ায় পা রেখে বুঝতে পারল এই দেশটাকে সে মিস করেছে। মেলবোর্নে তার বাড়ি, তার অফিস, তার ছাত্র-ছাত্রী, তার সহকর্মী সকলকেই সে মিস করেছে। যদিও সে চিত্রাকে, নিজের দেশকে মিস করছিল তবু অনেকদিন পর এখানে এসে তার ভালো লাগছিল। এয়ারপোর্ট থেকে নিজের বাসার উদ্দেশ্যে টেক্সি নিয়ে রওয়ানা হয়ে গাড়িতে বসে এসব ভাবছিল ফাইজ। আগামীকাল ভার্সিটি যেতে হবে। চিত্রাকে এখানে আনার ব্যাপারেও কাজ করতে হবে। বাসায় পৌঁছে চিত্রাকে ফোন করতে হবে। ১০ ঘন্টা পার হয়ে গেছে চিত্রার সাথে কথা হয় না। ঠিক সেই সময় পেছন থেকে ছুটে আসা নিয়ন্ত্রণহীন একটা লরি এসে ধাক্কা দেয় তাদের গাড়িকে। এত জোরে ধাক্কায় ফাইজের গাড়ি উড়ে গিয়ে আছরে পড়ে। তাৎক্ষণিক তাদের হাসপাতালে নেয়া হলে ডাক্তার মিসেস চৌধুরীকে মৃত ঘোষণা করে। আর ফাইজের অবস্থা মুমূর্ষু। সে মাথায় ভয়ানকভাবে আঘাত পেয়েছে। প্রচুর রক্তক্ষরণ হয়েছে তাতে। ডাক্তারের আপ্রাণ চেষ্টায় ফাইজকে মৃত্যুর হাত থেকে ফেরানো তো যায় কিন্তু সে কোমায় চলে যায়। প্রায় ২ মাস সে কোমায় থাকে। এদিকে সে এখানে এসেই এক্সিডেন্টের স্বীকার হওয়ায় তখনই তার খোঁজ পাওয়া সম্ভব হয়নি। দুর্ঘটনায় তার পাসপোর্ট, ফোন সবই নষ্ট হয়ে গিয়েছিল। তাই তাৎক্ষণিক তাকে ট্রেস করা সম্ভব হয়নি। চিত্রার ভাই ফাইজের অফিসে খোঁজ নিলে তারাও এইজন্য কোন খোঁজ দিতে পারেনি তখন। কিন্তু চঞ্চল আশা ছাড়েনি সে প্রতিদিন যতভাবে সম্ভব খোঁজ চালিয়ে গেছে নিয়ম করে। বেশ কয়েকদিন পর চিত্রার ভাই অবশেষে জানতে পারে ফাইজের দুর্ঘটনা সম্পর্কে। তখন ফাইজ কোমায় ছিল। তার বেঁচে ফেরার আশা প্রায় শূন্য ছিল তখনও। চিত্রা প্রেগন্যান্ট এবং তার অবস্থা একটু ক্রিটিকাল হয়ে যাওয়ায় এই খবরটা চঞ্চল চিত্রা বা অন্য কাউকে আর জানাবার সাহস করেনি। কারণ ডাক্তার চিত্রাকে সম্পূর্ণভাবে স্ট্রেস নিতে বারণ করেছিল। বাসায় অন্য কেউ জানলে কোন না কোনভাবে সেটা চিত্রা অব্দি পৌছে যেতই। তাই সে মুখ বন্ধ রাখল। সে ভাবল ফাইজের অনুপস্থিতি নিয়ে চিত্রার মনে এই কয়দিনে এক ধরেণের মানসিক পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েই গেছে। এখন নতুন করে কিছু জানলে নতুন করে আবার একটা বড় ধাক্কা খাবে। খোঁজ না পাওয়া অব্দি একটা কিছু বুঝ দিয়ে চিত্রার মনে ফাইজের আশা বেঁচে থাকবে কিন্তু তার এমন করুণ অবস্থার কথা জানলে সেটা চিত্রার পক্ষে মেনে নেয়া সম্ভব হবে না। তার ভেতরে তো ছোট্ট একটা প্রাণ বেড়ে উঠছে তার জীবনটা তো ঝুঁকির ভেতর ফেলে দিতে পারে না সে। একদিকে ফাইজের দুঃশ্চিন্তা অন্যদিকে চিত্রাকে সামলে নেয়া, দুটো ব্যাপার ব্যালেন্স করতে চঞ্চল হিমশিম খেয়ে যাচ্ছিল। সারাক্ষণ মনে প্রাণে সৃষ্টিকর্তার কাছে একটাই প্রার্থনা করত ফাইজ যেন সুস্থ হয়ে দ্রুত ফিরে আসে। ততদিন পর্যন্ত সে ধৈর্য ধরে রইল আর চিত্রাকে যতটা সম্ভব ফাইজ সম্পর্কে পজিটিভ কথা বলে ভালো রাখার চেষ্টা করল। এদিকে কোমা থেকে ফিরলেও ফাইজ সম্পূর্ণ ঝুঁকি মুক্ত হয় না। মস্তিষ্কে আঘাতের কারণে সে মেন্টালি বেশ কিছু দিন ইমব্যালেন্সড থাকে৷ মানসিক এবং শারীরিকভাবে পুরোপুরি সুস্থ হতে তার কয়েক মাস লেগে যায়। ডাক্তার তাকে কোন রকম স্ট্রেস নিতে বারণ করেছে। মায়ের মৃত্যু আর চিত্রার ভাবনায় পুরোপুরি সুস্থ হতে তার বেশ কিছু সময় লেগে যায়। এভাবে কয়েক মাস কেটে গেলে সে যখন মানসিক বিপর্যস্ততা থেকে বের হতে পেরেছিল তখন এত সময় চলে যাবার পর চিত্রার সাথে যোগাযোগ করার সাহস করে উঠতে পারে না। কিন্তু কোমা থেকে উঠে আসার কিছুদিন পর একটু সচল অবস্থায় যখন আসে তখন চঞ্চলের সাথে তার যোগাযোগ হয়েছিল। ফাইজের সুস্থতার কথা ভেবে চঞ্চল তাকে চিত্রার ব্যাপারে সব জানাতে পারে না। তাকে শুধু আশ্বস্ত করে চিত্রাকে সে আর সবাই মিলে সামলে নিয়েছে। সে সুস্থ হওয়া পর্যন্ত সব সামলে রাখবে চঞ্চল। ফাইজ মোটামুটি শঙ্কামুক্ত হতেই চঞ্চল ফাইজকে চিত্রার প্রেগন্যান্সির খবরটা দেয়। ফাইজ তখন সরাসরি দেশে আসার সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলে। কারণ এই মুহুর্তে চিত্রার তাকে ভীষণভাবে প্রয়োজন। চিত্রা এতদিনে নিজেকে অনেকটাই পরিস্থিতির সাথে মানিয়ে নিয়েছে তাই তাকে খবর দিয়ে জানানোর চেয়ে সে নিজে সরাসরি সবটা বলতে চাইল। ফাইজ সামনে থাকলে চিত্রার উপর দিয়ে নতুন করে কোন বড় ঝড় আসতে পারবে না। তাই চঞ্চলও ফাইজের কথা মেনে নিয়ে আর কিছু বলেনি কাউকে। তবে সে চেষ্টা করেছে রুনার মুখটা বন্ধ করতে। কিন্তু রুনা তো রুনাই! “চোরে না শোনে ধর্মের কাহিনী” তেমন।

এদিকে এত লম্বা ছুটির পর আবার ছুটি নেয়াটা ফাইজের জন্য প্রায় অসম্ভব পর্যায়ে ছিল। কিন্তু সেটা তাকে সম্ভব করতে হয়েছে। তার মেডিকেল কন্ডিশনের কারণে ছুটি মঞ্জুর করতে বাধ্য হয় প্রতিষ্ঠান। সে শুধু চঞ্চলকে জানিয়ে দেশে আসে। চঞ্চল তাকে এয়ারপোর্ট থেকে রিসিভ করে তার গুলশানের বাসায় ওঠে। ফাইজ এসে বুঝতে পারে চিত্রা মাঝে মাঝেই এখানে আসে। কারণ ঘর জুড়ে চিত্রার স্মেলটা সে অনুভব করতে পারছিল। চিত্রাকে দেখার জন্য তার আর এক মুহূর্ত তর সইছিল না। কিন্তু আজ আর সে দেখা করতে গেল না। তার শরীরটা তো আগের মত এতটা স্ট্রং নেই, দীর্ঘ সময় জার্নি করে এসেছে বিশ্রাম প্রয়োজন। তাই সে সকালে চিত্রার সাথে দেখা করার সিদ্ধান্ত নিল। চঞ্চল তাকে বাসায় সেট করে দিয়ে রাতটা এখানেই থেকে যায়। ফাইজ চঞ্চলকে বলে দেয় বাসায় সবাইকে তার কথা যেন আগামীকাল সকালে জানায়। আর সে নিজে উপস্থিত হয়ে চিত্রাকে সরাসরি তার কথা জানাবে। চঞ্চল তার কথা মতই কাজ করে। পরদিন সকালে জাহানারা বেগম সব শুনে আবেগে মন খুলে কাঁদেন। তারপর ফাইজ আসবে বলে চিত্রাকে পরিপাটি হয়ে নিতে বলে। এই হলো ফাইজের উধাও হবার পেছনের কাহিনী।

***
অনেকদিন পর চিত্রার দিন আবার আনন্দে কাটতে লাগল। ফাইজ তার পাশে আছে, তার অনাগত সন্তানও বাবার সান্নিধ্য পাচ্ছে। চিত্রার সমস্ত পৃথিবী এখন রঙিন। ফাইজ অনেক কষ্ট করেছে। চিত্রা যত কষ্টেই থাকুক সে তার পরিবারের সান্নিধ্যে ছিল। সবাই তার সাহস হয়েছে। পাখির ছানার মত আগলে রেখেছে। কিন্তু ফাইজ? ফাইজ তো বিদেশ বিভূঁইয়ে একা এত বড় এক্সিডেন্ট করে মাকে হারিয়ে একা মৃত্যুর সাথে লড়েছে! তাকে দেখার একটা আপন মানুষ, কাছের মানুষ বলতে কেউ ছিল না। অথচ তখন তার পাশে কাছের কাউকে ভীষণভাবে প্রয়োজন ছিল। চিত্রা চেষ্টা করে ফাইজের বুকে জমে থাকা সেই দুঃসময়ের অধ্যায়টা মুছে দিতে। এই মানুষটাকে সে আর পারত পক্ষে চোখের আড়াল হতে দেয় না।

ফাইজ দেশে আসার ১৫ দিন পরই চিত্রার কন্যা সন্তান জন্ম নেয়। চিত্রা অবাক হয়ে দেখে তার পুতুলের মত মেয়েটা বাবার চেহারা নিয়ে পৃথিবীতে এসেছে! আর ফাইজ দেখে তার মা ফিরে এসেছে তার কন্যার রূপে! সে মাঝে মাঝেই কন্যার দিকে অপলক চেয়ে থাকে, আর তার চোখ ভিজে ওঠে। চিত্রা বুঝতে পারে ফাইজ মেয়ের মাঝে মাকে খুঁজে বেড়ায়। মেয়েকে পেয়ে তাদের পৃথিবী আনন্দে ঝলমল করতে থাকল। চিত্রা মেয়ের নাম রেখেছে “ফাতিহা বিন্তে ফাইজ চৌধুরী”।

ফাতিহার জন্মের কিছুদিন পর ফাইজ চিত্রাকে বলে- আমাদের এখন প্রস্তুতি নেয়া উচিৎ। আমি ফাতিহার প্রায় যাবতীয় ব্যবস্থা করে ফেলেছি। আমরা খুব শীঘ্রই দেশ ছাড়ছি।

চিত্রা অবাক হয়ে বলল- দেশ ছাড়ছি মানে?

-আমরা অস্ট্রেলিয়া ফিরে যাচ্ছি। এবার তোমাকে আর ফাতিহাকে নিয়েই যাব। সব ব্যবস্থা করে ফেলেছি।

-অস্ট্রেলিয়া না গেলে হয় না? ফাতিহা অনেক ছোট। তাছাড়া ওখানে আমাদের কেউ নেই, এখানে সবাই আছে। তুমি চাইলেই যে কোন ভার্সিটিতে শিক্ষকতা করতে পারো।

-আমি এখানে থাকতে পারব না চিত্রা। আমাকে অস্ট্রেলিয়া ফিরতেই হবে। আর তোমাদের ছেড়ে থাকাটাও আমার পক্ষে সম্ভব নয়। তাই আমরা সবাই যাচ্ছি।

-এখানে কেন থাকা যাবে না?

-কারণ আমি আমার মাকে অস্ট্রেলিয়া রেখে এসেছি। তাকে এখানে আনা সম্ভব নয় বলেই আমারও এখানে থেকে যাওয়া সম্ভব নয়। আমি আমার মাকে ছেড়ে এত দূরে থাকতে পারব না। আমার মায়ের কবরের পাশে আমি মন চাইলেই গিয়ে দাঁড়াতে পারব না সেটা হয় না। ফাতিহা রাতে যতবার জেগে যায়, কাঁদে ততবার তোমার সাথে আমারও ঘুম ভাঙে। আমার তখন মায়ের কথা মনে পড়ে শুধু। আমার ছোটবেলাতেও মা আমাকে নিয়ে এভাবে রাত জেগে কষ্ট করেছে। আর সেই আমি মাকে রেখে এত দূর পরে আছি! এক্সিডেন্টের পর আমার যখন হুশ হয় তখন কেবল মায়ের মুখটা দেখতে পেতাম… আমার কেবলই মনে হত মায়ের কোলে একটু শুয়ে থাকলেই আমার সব ব্যথা সেরে যাবে। সুস্থ হবার পর দেশে আসার আগ পর্যন্ত আমি প্রতিদিনই মায়ের কবরের পাশে গিয়ে বসে থাকতাম। আমি যেতাম এক বুক যন্ত্রণা নিয়ে কিন্তু সেখানে কিছুক্ষণ থাকার পর হালকা হয়ে ফিরতাম। আমি এমনই অভাগা সন্তান যে মায়ের মুখটা শেষবারের মত দেখতেও পেলাম না! শেষ মুহূর্তে তার জন্য কিছুই করতে পারলাম না। আমার মা আর বেঁচে নেই আমি চাইলেই তাকে দেখতে পারব না, ছুতে পারব না এটা আমার মেনে নিতে বুকের পাজর ভেঙে আসে। আমি এখানে থাকতে পারব না চিত্রা… কথাগুলো বলে ফাইজ হু হু করে কেঁদে ফেলে….

চিত্রা ফাইজকে পরম মমতায় জড়িয়ে ধরে বলল- তুমি সব কিছু গুছিয়ে আনো। আমরা সবাই অস্ট্রেলিয়া যাচ্ছি। আর ফাতিহাও তার দাদুমণির অস্তিত্ব জানুক।

ফাইজ চিত্রাকে শক্ত করে ধরে বলল- আমরা ছুটি পেলেই দেশে আসব। ফাতিহা এখানকার মানুষ, আলো, হাওয়া, আদর কোন কিছু থেকেই বঞ্চিত হবে না। এটা তার জন্মভূমি, তার বাবা মায়ের দেশ। এখানকার আলো, হাওয়া সব কিছুতে তার আজন্ম অধিকার রয়েছে।

চিত্রা মনে মনে বলল- তুমি আছ আমার কোন কিছুতে কোন ভাবনা নেই। আল্লাহর ইচ্ছায় ভালো থাকার দিন আমাদের শুরু হয়েছে। সামনের পথটাও আমাদের ভালো কাটবে ইনশাআল্লাহ। তুমি আমার অবেলায় পাওয়া বসন্ত। অবেলার প্রেমে বসন্ত চিরস্থায়ী হয়। তুমি আমার চিরস্থায়ী সুখ। আমার আর কী চাই?

সমাপ্ত।।

বিঃ দ্রঃ পাঠককে বলেছিলাম শেষ পর্যন্ত ভালো লাগা থাকবে কতটা পেরেছি আপনারাই জানেন। তবে পাঠকের অফুরান ভালোবাসা পেয়েছি প্রতিটা পর্বে। যারা নিয়মিত পড়েছেন এবং গঠনমূলক অসাধারণ সব মতামত দিয়েছেন তাদের জন্য ভালোবাসা অবিরাম💝💝 আপনাদের এত ভালোবাসা দেখে শেষ দুই পর্ব দিতে আমার নিজেরও খুব খারাপ আর আতংক লাগছিল। শেষবেলায় এসে এমন একটা পরিস্থিতি তৈরি করার জন্য দুঃখিত। এটার হয়ত প্রয়োজনও ছিল না। দুঃখ, দূর্দশা আমার নিজেরও খুব অপছন্দ। কিন্তু এগুলো নিয়েই তো আমাদের জীবন। কিছু মানুষ পৃথিবীতে আসেই সারাটা জীবন দুঃখ বয়ে বেড়াতে। হুটহাট স্বপ্নের মত ক্ষণিকের জন্য সুখ ধরা দিয়েও যেন দেয় না। তেমন কিছুই লিখতে চেয়েছিলাম। বাস্তবে এমন উদাহরণ অহরহ হলেও আমরা তা মানতে নারাজ। কারণ আমরা ভালোবাসায় বেঁচে থাকা বিশ্বাসী মানুষ। অনেক পাঠকের প্রশ্ন ছিল- “চিত্রা এত সফল হলেও সে কেন নিজেকে এভাবে ভাবে?” আসলে যে মানুষটা একদম ছোট্ট থেকে তীর্যক কথা, গ্লানির ভেতর দিয়ে বড় হয় সে বুঝে যায় এবং মেনে নেয় তার জীবন হীনমন্যতার জীবন। নিজের প্রতি তার আত্মবিশ্বাস তৈরিই হয় না। তাই সুখ ধরা দিলেও সেটা গ্রহণ করতে পারাটা তার জন্য কখনোই সহজ স্বাভাবিক হয় না। আমার লেখায় অনেক অপরিপক্কতা, অসামঞ্জস্যতা ছিল হয়ত, সেগুলো মেনে নিয়েই আপনারা যে নিখাঁদ ভালোবাসা দিয়েছেন তার প্রতি আমি কৃতজ্ঞ। দোয়া করবেন ভুল-ত্রুটিগুলো যেন সামনে উতরে যেতে পারি। ভালো থাকুন, ভালোবাসায় বাঁচুন সকলে। ধন্যবাদ💝💝

আগের পর্বের লিংক
https://www.facebook.com/groups/boipokaofficial/permalink/1361558511316308/

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here