#অবেলার_প্রেম
#পর্বঃ২
#অলিন্দ্রিয়া_রুহি
-‘যাবেন না..শুনুন!’
আকুতি মাখা কণ্ঠস্বর। দিগন্ত নামতে গিয়েও থেমে দাঁড়াল। ডাকটা তাকেই উদ্দেশ্য করা। মেয়েটা কী তবে আবার ফিরে এসেছে? দিগন্ত দ্রুত পায়ে ছাদে উঠে এলো। হ্যাঁ,ঠিক তাই,ওপাশের ছাদে চঞ্চল মুখখানা উন্মুখ হয়ে দাঁড়িয়ে। চেহারায় পানির ছিঁটে নেই, কিন্তু ভেজা। মায়াবিনী লাগছে। ‘মায়াবিনী’ ঠোঁট নাড়িয়ে বিড়বিড় করে উচ্চারণ করল দিগন্ত। ফাগুন শুনতে না পেয়ে কান পাতলো, প্রশ্ন ছুঁড়লো,
-‘কী বললেন?’
-‘উমম..কিছু না।’ বলে হালকা হাসলো দিগন্ত। হাসি ফুঁটে উঠল ফাগুনের ঠোঁটজোড়ায়। একটা বই এগিয়ে ধরে বলল,
-‘একটু সাহায্য করুন। বইটা আপনার কাছে রেখে দিন প্লিজ! আমার আম্মু একদম গল্প উপন্যাসের বই পছন্দ করে না। উনার তাড়া খেয়েই ছাদে এসেছিলাম। এই বইটা হাতের কাছে পেলে নির্ঘাত ছিড়বে। এটা আমার এক ফ্রেন্ডের বই। ছিড়ে গেলে ওকে ফেরত দিতে পারব না। ঝামেলায় পড়ে যাব। তাই আজকের জন্য এই বইটা আপনার কাছে রেখে দিয়ে আমাকে একটু সাহায্য করুন!’
ফাগুন থেমে দম নিলো। এক নাগাড়ে কতগুলো কথা বলে গেছে! শ্বাস নিয়ে ফের মিষ্টি করে হাসলো। এই হাসি উপেক্ষা করার সাধ্য দিগন্তের নেই। সে হাত বাড়িয়ে বইটা নিলো। দুটো বিল্ডিং গায়ে গায়ে লাগানো। হুট করে কেউ দেখলে ভাববে,একটা বিল্ডিংই বুঝি। তাই বই আদান প্রদান করতে কোনো সমস্যাই হলো না দু’জনার। বই দিয়ে ফাগুন পুনরায় ঠোঁট ভাঙে,
-‘থ্যাংকিউ। আপনি আমার অনেক উপকার করলেন।’
দিগন্ত গালে হাসে। বলল,
-‘এরপর থেকে আর বই ধার আনতে হবে না। আমার কাছে প্রায় পাঁচশো বইয়ের কালেকশন আছে। আমার বাসায় এসে পড়তে পারবেন যখন খুশি।’
-‘পাঁচশো বই!’
ফাগুন উল্লাসে ফেটে পড়ল। রীতিমতো চাপা চিৎকার দিয়েই কথাখানা বলল সে।
-‘বাপরে! এত বই আপনি কী করেন? খান নাকি মাথায় দেন?’
দিগন্ত স্মিতহাস্যে বলল,
-‘খাইও না,মাথায়ও দেই না। পড়ি। পড়তে পড়তে জমিয়েছি চার বছর ধরে। বই পড়া আর জমানোটা আমার কাছে নেশার মতো।’
-‘আপনার আম্মু কিছু বলেন না?’
ঝিলিমিলি চোখের তারায় হুট করে একটা কালো জাল ছড়িয়ে পড়ল। ভীষণ অন্যমনস্ক দেখালো দিগন্তকে। ফাগুনের নজর এড়ালো না। অবাক সে,কী এমন বলল যাতে মন খারাপ করতে হবে উনাকে? উত্তরের আশায় অপলক চেয়ে রইলো। দিগন্ত দৃষ্টি সরিয়ে নিয়ে হাসার চেষ্টা করল। মলিন হাসি, অস্ফুটে বলল,
-‘আমার মা নেই।’
একটা ঝটকা খেলো ফাগুন। অপ্রস্তুত হয়ে দ্রুত বলল,
-‘সরি,সরি..আ..আমি জানতাম না আসলে..’
চট করে পরিস্থিতি অনুকূলে এনে ফেলে দিগন্ত। পুনরায় জ্বলজ্বলে হাসিটা সেলোটেপ দিয়ে ঠোঁটে আঁটকে নিলো। এক হাতে চুলগুলো ব্রাশ করতে করতে বলল,
-‘বাদ দাও। তুমি যখন খুশি আমার বাসা থেকে বই নিতে পারবে। বাসায় বসেও পড়তে পারবে। আমি আর আব্বা- আমরা দু’জনই বাসার সদস্য। আর আছে জমিলা বিবি। মা চলে যাওয়ার পর থেকেই বাসার লিখিত, অলিখিত সমস্ত দায়িত্ব তার হাতে। তাই ভেবো না, একা ফ্ল্যাটে ডেকে…’
দিগন্ত কথার মাঝখানেই উচ্চশব্দে হেসে উঠে। ফাগুন ভ্রু কুঁচকালো। তেজী গলায় বলল,
-‘ছিঃ! আপনি কত নেগেটিভ! আমি মোটেও উল্টাপাল্টা কিছু ভাবিনি। আমি যাবো না আপনার বাসায়, আর না আপনার থেকে বই আনবো। যান..’
-‘আচ্ছা আচ্ছা, সরি আমি..’ বলে কানে আঙুল চেপে নাটকীয় ভঙ্গিতে দুঃখী দুঃখী চেহারা করে তাকাল দিগন্ত। ফাগুনের কুঁচকানো কপাল মসৃণ হয়ে উঠে। হাসি পেয়ে গেল তার। কত বড় মানুষ, অথচ স্বভাব দেখো! একদম বাচ্চা!
ফাগুন বলল,
-‘আমি আগামীকাল সকালে কলেজ যাওয়ার সময় আপনার থেকে বইটা নিবো।আপনি একটু কষ্ট করে আটটার সময় বাসার গেটে দাঁড়াতে পারবেন?’
-‘হুম পারবো। একদম আটটার সময়ই থাকবো। চিন্তা করো না।’
-‘ওকে।’
কথার প্রায় শেষের দিকে দিগন্তের হুট করে মাথায় এলো, সে ‘আপনি থেকে তুমি’ তে নেমে গিয়েছে। ফাগুন কী উল্টোপাল্টা কিছু ভাবছে? বা মাইন্ড করেছে? উঁহু, করেনি। করলে দিগন্তের সাথে সুন্দর ভাবে কথা নিশ্চয়ই বলতো না। ফাগুন কত ছোট! আচ্ছা ফাগুনের বয়স কত হবে? ১৬-১৭? উনার ২৭। যদি ১৭ হয় তাহলে পাক্কা ১০ বছরের ছোট বড়! বাপরে…লম্বা ডিস্টেন্স!
দিগন্তকে হাবাতের মতো তাকিয়ে থাকতে দেখে ফাগুন তুড়ি মেরে উঠল। ডেকে বলল,
-‘এই যে মিস্টার, কী ভাবছেন?’
সম্বিত ফিরে দিগন্ত তড়িঘড়ি করে জবাব দেয়,
-‘ভাবছি, তোমার নাম..কী নাম তোমার? সেটাই তো জানা হলো না।’
-‘ও.. আমার নাম ফাগুন। আর আপনার?’
-‘ফাগুন?’
অস্ফুটে উচ্চারণ করে দিগন্ত। ফাগুন মাথা দু’দিকে নাড়িয়ে বলল,
-‘হুম ফাগুন, কেন?’
-‘নাহ, এমনি। আমার নাম দিগন্ত। আজ থেকে আমরা ফ্রেন্ডস?’
বলে একটা হাত বাড়িয়ে ধরলো দিগন্ত। উদ্দেশ্য হ্যান্ডশেক করা। ফাগুন মিটিমিটি চোখে চেয়ে রইলো অবাক বিস্ময় নিয়ে। এতবড় বুড়ো ছেলে, সে কীনা পুচকে মেয়েটাকে বন্ধুত্বের অফার দিচ্ছে! কেন রে? তোর কী বন্ধুর এতই অভাব যে ফাগুনকেও বন্ধু বানাতে হবে? ফাগুনকে অন্যকিছু বানানো যায় না বুঝি?
মনে মনে বলে চলা কথাগুলো ফাগুনের অন্তর কাঁপিয়ে তোলে। ছিঃ! ছিঃ! কতটা গভীর পর্যন্ত ভেবে ফেলেছে সে! এর আগে কখনো কাউকে দেখে এতকিছু ভাবনা মাথায় আসেনি তো। তাহলে আজ কেন? একে দেখেই কেন? তার ঘন গলার স্বর? নাকি মাদক ভরা চাউনি? নাকি টোল পড়া হাসি, কোনটা ফাগুনকে আকর্ষণ করছে? ফাগুন নিচের দিকে তাকিয়ে একটা হাত বাড়িয়ে ধরলো। দিগন্তের হাত ধরলো না। লজ্জা লাগছে। ফাগুনের মনের অবস্থা বুঝতে পেরে দিগন্তই হাত বাড়ালো আরও, ফাগুনের তুলতুলে নরম হাতটা হাতের মুঠোয় নিতেই একটা শিরশিরে অনুভূতি হলো। কী নরম! পেলব…মখমলের মতো! দিগন্তের হাতের তুলনায় ফাগুনের হাত খুব ছোট, বাচ্চা বাচ্চা… দিগন্তের চট করে হাসি পেয়ে গেল। এরকম একটা বাচ্চা বন্ধু থাকলে মন্দ হয় না। তার বয়স হয়েছে তো কী হয়েছে,মনটা তো এখনো যৌবনেই আঁটকে…
ফাগুনের হাত ধরে উপরনিচ কয়েকটা ঝাকি দিয়ে ছেড়ে দিলো দিগন্ত। ফাগুন চোখ তুলে তাকাতেই পারল না।
-‘এখন আসি।’ বলে দ্রুত পায়ে সিড়িঘরে ঢুকে গেল। দেয়ালে ঠেস দিয়ে দাঁড়িয়ে যে হাতটা দিগন্তের হাতের মুঠোয় ছিল সেটা চোখের সামনে তুলে ধরলো। হাতটা তিরতির করে কাঁপছে। হঠাৎ করে নতুনসব অনুভূতিদের মেলা…ফাগুন ভাবছে,এদের সাথে সাক্ষাৎ করবে নাকি এড়িয়ে চলবে?
★
ফাগুনের বড় বোন মিলি। অনার্সে অধ্যয়নরত। মিলি দেখতে শুনতে সুন্দর, তবে গায়ের রংটা শ্যামলা। ফাগুন আর মিলিকে পাশাপাশি দেখলে সবার ঝোক ফাগুনের দিকেই থাকে বেশি। মিলি একটু ঘরকুনো স্বভাবের। কারো সাথে সহজে মিশতে চায় না। আর ফাগুন? সবসময় চড়ুই পাখির মতো ফুড়ুৎ ফুড়ুৎ উড়ে বেড়ায়। খুব চঞ্চল, প্রাণোচ্ছল। কারো কঠিন মন খারাপও এক লহমায় দূর করে দিতে পারে সে। এই নিয়ে মিলির চাপা রাগ হয়ে মাঝে মাঝে। পারিবারিক অনুষ্ঠানে যখন সবাই একত্র হয়, তখন মিলির চেয়ে ফাগুনের আধিপত্য বেশি। সবাই ফাগুনকে চোখে হারায় যেন। সবসময় ‘ফাগুন ফাগুন’ করে মুখে ধোঁয়া উড়ায়। মিলির বিরক্ত লাগে। সে বড়, তাকে কেন কেউ এত সমাদর করে না? কেন সব ভালোবাসা, আদরের ভাগিদার একা ফাগুনই? অবশ্য কাউকে কিছু বলে না মিলি। নিজের মনে চলা হিংসাত্মক তৎপরতাগুলো প্রকাশ পায় না। যেভাবে ঝড়ো বাতাসে মোম বাতি নিভে যায়, যেভাবেই তার মনের রাগগুলো উবে যায় একসময়। শুধু রয়ে যায় এর রেশ।
মিলি ফাগুনকে যতটা অপছন্দ করে,ফাগুন তার বোনকে ঠিক ততটাই পছন্দ করে,ভালোবাসে। বোনের জন্য জান হাজির সবসময়। নিলুফার প্রথম থেকেই রাগী রাগী। তাই দুই মেয়ের কেউই তার ধারেকাছে ঘেষে না। মিলি যাও বা মেশে, ফাগুন তো কাছেই যায় না। মায়ের সবসময়কার বকবকানি, আর গজগজ রাগ ফাগুনের ভালো লাগে না। তাই বাসার বন্ধু যেন মিলিই। মিলির সাথেই যত আড্ডা গল্প, দুষ্টুমি ফাগুনের। এক্ষেত্রে মিলি নির্বিকার। কখনো ফাগুনকে বুঝতে দেয় না, ফাগুনের সৌন্দর্য তাকে ঈর্ষান্বিত করেছে কতবার!
মিলির বাবা জাহিদ হোসেন। পারতপক্ষে তাকে শুধু মিলির বাবা-ই বলা চলে। মিলিকে তিনি যতটা ভালোবাসেন, ফাগুনকে তার কানাকড়িও বাসেন না। ছোট বেলা থেকেই ফাগুন বাবার অনাদরে বড় হয়েছে। পেটে ভাত,মাথার উপর ছাদ আর পড়াশোনার খরচ বহন করলেই বাবা হওয়া যায় না। তারই বাস্তব উদাহরণ জাহিদ হোসেন। তিনি ফাগুনের সমস্ত দায়িত্ব ঠিকঠাক ভাবেই পালন করেন, তবুও বাবা-মেয়ের মধ্য আকাশ সমান দূরত্ব! কোনোদিন তাদের এক ডায়নিং টেবিলে বসে খেতে দেখা যায়নি। ফাগুন প্রায় সময় ওর নিজের ঘরেই লাঞ্চ ডিনার সেড়ে ফেলে। আপাতদৃষ্টিতে ফাগুনকে ভীষণ হাসিখুশি একটি মেয়ে দেখালেও তার দুঃখের গল্পগুলো শুধু স্নুপি জানে। স্নুপি- ফাগুনের আদরের কুকুর। ছয়টি বছর ধরে ওকে পালে ও। ঘরে আঁটকে রেখে না, বাইরে ছেড়ে দিয়েই। স্নুপি প্রতিদিন তিন বেলা আসে, খায় তারপর আবার চলে যায়। মাঝে মাঝে অলস দুপুরে আলস্য ভরা শরীর নিয়ে খেয়ে শুয়ে পড়ে বিছানার এক কোণায়, ফাগুনের গা ঘেঁষে। সেদিন ভাতঘুম হয় না। স্নুপির সঙ্গে সুখ দুঃখের নানান গল্প করতে করতে সন্ধ্যের আগমন ঘটে!
এবাড়ির সবার সঙ্গে পরিচয় তো ঘটলো। এবার চলুন ওবাড়ির তিনজনের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেই।
দিগন্ত- পুরো নাম দিগন্ত আহসান। ওর বাবা হামিদ খান। কী অবাক হচ্ছেন এই ভেবে যে বাবার নামের শেষে খান, আর ছেলের নামের শেষে আহসান? অবাক হওয়ার মতোই বিষয়। এর পেছনেও আছে ছোট্ট একটা গল্প। দিগন্তের এই ‘খান’ ট্যাগটি কেন যেন পছন্দ নয়। তার মতে তার নামের সাথে এটা যায় না,মেশে না। আজকাল নিজের নাম নিজেই রাখে কতশত মানুষ, ঠিক তেমনি ভাবে দিগন্তের নামের শেষে ‘আহসান’ ট্যাগটিও জুড়ে দিয়েছে সে। তিন রুমের বড় ফ্ল্যাট জুড়ে এই দু’জন মানুষেরই বসবাস। বাবা একটি রুমে থাকেন, দিগন্ত অন্য রুমে- বাকি যে রুমটা পড়ে আছে সেটায় বইপত্তর দিয়ে ঠাসা। জমিলা খালা প্রায়শই চিল্লাচিল্লি করেন। শত শত বই গুছিয়ে, পরিষ্কার করে রাখা কী কম কষ্টের কথা? দিগন্তকে বারবার বলেন অপ্রয়োজনীয় বই বিক্রি করে দিতে। দিগন্ত কানে তোলে না। তার কাছে সবই প্রয়োজনীয় বই। ফাগুন আর বাবার মধ্যের সম্পর্ক যেমন খাপছাড়া,ছন্নছাড়া- দিগন্ত আর ওর বাবার মধ্যের সম্পর্ক ততটাই মধুর,বন্ধুসুলভ। বাবা-ছেলের কলতানে ঘর মুখরিত থাকে সবসময়। এ যেন, দুই বন্ধু যাদের বয়সটা শুধু উঁচুনিচু। মনের দিক দিয়ে দু’জনেই একই,সমান। জমিলা খালা তো প্রায় প্রায় বলেন,
-‘আফায় গেছে ভালো হইছে। বাইচ্চা থাকলে আফনেগো ফাগলামি দেইক্ষা এমনেই ইশটোক খাইতো।’
খালার কথা শুনে বাবা-ছেলে দু’জনেই হা হা করে হেসে উঠেন। জমিলা খালা যারপরনাই বিরক্ত হয়ে রান্নাঘরে চলে যান।
এই যখন দুই বাড়ির মধ্যকার বিভেদ, তখন কীভাবে দুটি তরুণ মন হবে এক?
(চলবে)
[রোজা রেখে শারীরিক ভাবে ক্লান্ত ভীষণ। এতটুকুই লিখে দিতে পারলাম। এই পর্বেরই বাকী অংশ আগামীকাল লিখে দিবো,ইনশাআল্লাহ। ছোট পর্ব নিয়ে কেউ অভিযোগ করবেন না তাই,প্লিজ!]
★আপনাদের মন্তব্য এবং রেসপন্সই আমার লিখার অনুপ্রেরণা। সবাইকে গঠনমূলক মন্তব্য করার জন্য অনুরোধ করছি❣️