অব্যক্ত ভালোবাসা পর্ব-১৮

0
912

#অব্যক্ত ভালোবাসা
পর্ব :১৮

🍁
মধ্যাহ্নের শেষ প্রহর। বাইরে মৃদুমন্দ বাতাস বইছে।সকাল থেকে গুড়ি গুড়ি বৃষ্টি হচ্ছে। শিশির কণা গুলো গাছের পাতায় চিকচিক করছে।মেহবিন এখন প্রায়শই উদাস হয়ে থাকে।অথচ ওর নাকি বৃষ্টি পছন্দ।এবার ওর কি হয়েছে কে জানে,সারাদিন মন খারাপ করে থাকে।প্রতিবছর পহেলা বৈশাখের মেলায় মেহবিন আর মাইজা ঘুরে আসে। কিন্তু এবার সেটাও হলো না।মেহবিনের এখন কান্না পাচ্ছে ভীষণ।সে এতক্ষণ যাবত পড়ায় মনোনিবেশ করার চেষ্টা করছিল।কিন্তু কোনো ভাবেই পারছিল না।অবশেষে হার মেনে নেয়।সে উঠে ঘর থেকে বের হয়।ড্রয়িং রুম পুরো ফাকা।এই সময়ে ওর আব্বু অফিসে থাকে আর ওর আম্মু ঘুমোয়।মেহবিনের এখন একটু ক্ষিধে ক্ষিধে পাচ্ছে।সে দ্রুত পায়ে হেটে গিয়ে ফ্রিজ খুলে।আশ্চর্য! ফ্রিজে শুধু গাজর আর গাজর।মেহবিনের মাথায় আকাশ ভেঙ্গে পড়ল।এত গাজর কেন।মেহবিন ফ্রিজের প্রত্যেক টা কোণা দেখে নেয়,নাহ গাজর ছাড়া আর কিছুই নেই।মেহবিন উপায় না পেয়ে একটা গাজর নিয়েই চিবোতে থাকে।সে গাজর টা নিয়ে সোফায় বসবে এমন সময়ে কলিং বেল বাজাল।মেহবিন একবার ঘড়ির দিকে তাকাল।বিকেল চারটে বাজে।এই অসময়ে কে আসতে পারে এটা ওর খুব ভালো করেই জানা।মেহবিন উঠে গিয়ে দরজা খুলে দেয়।মেহবিনের ধারণা ঠিক ছিল।মাইজাই এসেছে।মাইজা তড়িঘড়ি করে মেহবিন কে ঠেলে ঠুলে ভিতরে নিয়ে যায়।মেহবিন কিছু বলবে তার আগেই মাইজা তাড়া দিয়ে বলে-

-”’মেহু তারাতারি রেডি হয়ে নে,আমরা ঘুরতে যাব।

মেহবিন কপাল কুঁচকে বলে-

-”’এই সময়ে কোথায় যাব?

-”’আরে এটাই বেস্ট সময় ঘুরতে যাওয়ার।আয় আয়।

-”’আচ্ছা কিন্তু কোথায়?

-”’ঐ যে লেকের পাড়ে একটা মেলা বসেছে।ওখানেই যাব।যা না তারাতারি রেডি হ।

মেহবিন প্রথমে যেতে রাজি না হলেও পরে মাইজার জোরাজুরিতে রাজি হয়ে গেল।মেহবিন আজকে একটা লাল রঙের গাউন পড়েছে।সাজ বলতে শুধু হালকা লিপস্টিক, মুখে পাউডার এইটুকুই।অনেকের মতো এই সামান্য সাজেই পরিদের মতো লাগছে না।কিন্তু এই হালকা প্রসাধনী ওর শ্যাম বর্ণ চেহারায় মায়া আরো বাড়িয়ে দিয়েছে।মেহবিন একটা ছোট্ট সাইট ব্যাগ নিয়ে ঘর থেকে বের হয়।মাইজা মেহবিন কে আসতে দেখে ওর হাত ধরে বলে-

-”’সুন্দর লাগছে মেহু তোকে, আচ্ছা চল নিচে যাই।

-”’আরে দাড়া,আম্মু কে বলে যাই।আম্মু তো মনে হয় ঘুমুচ্ছে।

মাইজা মেহবিনকে টেনে বাইরে নিয়ে যেতে যেতে বলে-

-”আরে বলতে হবে না।আম্মু পরে এসে বলে যাব।

মেহবিন মাথা নাড়ে।ওরা দুজন লিফটে উঠে নিচে চলে যায়।ওরা নিচে যেতেই রাফিজ কে দেখতে পায়।রাফিজ ওদের দেখে এগিয়ে এসে বলে-

-”’যাক অবশেষে তোদের দেখা মিলল।কোথাও যাওয়ার কথা শুনলে তোদের সাজের সুনামি শুরু হয়।

মাইজা মুখ লটকিয়ে বলে-

-”আমার সাজ নিয়ে কিছু বলবি না ভাইয়া।দেখ কতো সুন্দর করে সেজেছি।

রাফিজ ও মুখ লটকে বলে-

-”পেত্নি লাগতাছে।

তারপর মেহবিনের দিকে তাকিয়ে হালকা হেসে বলে-

-”এই যে মেহুকে দেখ মুখে সাজ নেই বললেই চলে তবুও কি সুন্দর লাগছে।আর তোর মুখে তো পুরো এক পাউন্ড ওজনের মেকআপ মারছিস তাও পেত্নি লাগে।

মাইজা মুখ ফুলিয়ে অন্যদিকে তাকায়।মেহবিন মাইজার দিকে তাকিয়ে মৃদু হাসে।মেহবিন জানে যে রাফিজ ওকে রাগানোর জন্য এসব বলেছে।মাইজাকে বরাবরই অনেক সুন্দর লাগে।আর সাজলে তো কথাই নেই।মেহবিনের মাঝে মাঝে খুব খারাপ লাগে।এই ভেবে যে ওর গায়ের রঙ কেন সাদা হলো না কেন কালো হতে হলো।সবাই ওকে বলে যে ও নাকি শ্যাম বর্ণের।কিন্তু ও সেটা মানতে নারাজ।ওর ধারণা শ্যাম বর্ণ বলতে কিছু নেই।যারা কালো তাদেরই শান্তনা স্বরূপ শ্যামলা বলা হয়।ওর ভাবনায় ছেদ পড়ে রিক্সার হর্ণের আওয়াজে।মেহবিন সামনে তাকিয়ে দেখে দুইটা রিক্সা আসছে।আর ওদের পেছনে মায়ান আসছে।মায়ানকে দেখেই মেহবিনের চোখ ধাধিয়ে গেল।কি মারাত্মক সুন্দর লাগছে।ডেনিম প্যান্ট,হোয়াইট শার্ট ওপরে ডেনিম জ্যাকেট।মেহবিন ভেবে পায় না এই ছেলে শীত,বর্ষা,গ্রীষ্ম সবসময়ই জ্যাকেট পরে কেন।কিন্তু এতেই যেন এই ছেলেটির সৌন্দর্য আরো বেরে যায়।মেহবিন তাকিয়েই আছে মায়ানের দিকে।মায়ানের সাথে চোখাচোখি হতেই মেহবিন চোখ সরিয়ে নিল।সাথে গ্রাস করল এক রাশ লজ্জা।কালকে কি মনে করে যে মায়ান কে প্রেমের কথা বলেছিল সে নিজেও জানে না।এখন তাকাবে কিভাবে মায়ানের দিকে।মায়ান না জানি কি ভেবেছে।মেহবিন এসব ভেবেই আরো লজ্জা পেয়ে গেল।মেহবিনকে এতক্ষন নিজের দিকে তাকিয়ে থাকতে চোখে হাসল মায়ান।মায়ান রিক্সা নিয়ে আসতেই রাফিজ বলল-

-”নে দুজন দুজন করে উঠে পড়।আজকে রিক্সা দিয়ে ঘুরব।

মেহবিন চোখে মুখে খুশির ঝলক এনে বলল-

-”সত্যিই রাফিজ ভাইয়া আমরা রিক্সা দিয়ে ঘুরতে যাব?

রাফিজ হ্যা বলতেই লাফিয়ে উঠে মেহবিন।ওর রিক্সা করে ঘুরতে যেতে অনেক ভালো লাগে।মাইজা কিছু একটা ভেবে মেহবিনকে বলল-

-”মেহু তুই রাফিজ ভাইয়ার সাথে রিক্সা করে যা।আমি মায়ান ভাইয়ের সাথে যাব।

মূহূর্তেই মেহবিনের মন খারাপ হয়ে গেল।কেন সে নিজেও জানে না।সে কি মায়ানের সাথে এক রিক্সা করে ঘুরতে চেয়ে ছিল।হবে হয়ত।নাহলে কথাটা শুনে ওর মন খারাপ হলো কেনো।মায়ান মেহবিনের বিষন্ন মুখের দিখে একবার তাকিয়ে রাফিজকে কি যেন ইশারা করতেই রাফিজ মাইজা কে বলে-

-”নাহ মাইজা তুই আমার সাথে আয়।আম্মু বলেছে তোকে দেখে রাখতে।তুই আবার ঘুরতে যাওয়ার আনন্দে লাফাতে গিয়ে রিক্সা থেকে পড়ে যেতে পারিস।তুই আমার সাথে যাবি।

মাইজা কিছু বলবে তার আগেই রাফিজ মেহবিনকে বলল-

-”মেহু তুই মায়ানের সাথে সামনের রিক্সায় গিয়ে বস।

রাফিজের বলতে দেরি কিন্তু মেহবিনের রিকশায় উঠতে দেরি হলো না।মেহবিনের কান্ড দেখে মায়ান ঠোট টিপে হেসে রিক্সায় উঠে বসে।মাইজাও মন খারাপ করে রাফিজের সাথে রিক্সা করে যায়।রিক্সা চলা শুরু হয়েছে।মেহবিনের এতক্ষন ভালো লাগলেও এখন অস্বস্তি লাগছে।রিক্সার ঝাকুনিতে বারবার মায়ানের সাথে ওর গা লাগছে।মেহবিন একবার আড়চোখে তাকায় মায়ানের দিকে। মায়ান ফোনে কি যেন করছে।মেহবিন আরেকবার তাকাতেই একটা জোরে ঝাকুনি দিয়ে উঠে রিক্সায়।মেহবিন মায়ানের উপর পরতে নিয়ে ও নিজেকে সামলে নেয়।সে শুকনো ডোক গিলে মায়ানের দিকে তাকিয়ে একটু দূরে সরে বসে।হঠাৎই মায়ান ও মেহবিনের দিকে আরেকটু চেপে বসে।মেহবিন গিয়ে আরেকটু দূরে সরে বসতেই মায়ান ভ্রু কুঁচকে মেহবিনের দিকে তাকিয়ে বলে-

-”এত ওদিকে চেপে বসছ কেন?পড়ে যাবে তো।

মেহবিন যেন শুনেও শুনল না কথাটা।সে চাপতে চাপতে একেবারে রিক্সার কোণ ঘেসে বসে। পারে না তো এক পা রিকশার বাইরে নামিয়ে দেয়।মেহবিন আরেকটু চেপে বসবে তার আগেই মায়ান মেহবিনের কনুই ধরে টেনে নিজের সাথে মিশিয়ে বসিয়ে দেয়।মেহবিন যেন কয়টা হার্ট বিট মিস করে ফেলল।সে শক্ত হয়ে বসে রইল।মায়ান মেহবিনের দিকে না তাকিয়েই বলল-

-”’বলেছি না পড়ে যাবে।এখানে বসে থাকো,একদম নড়বে না।নাহলে আমিই ফেলে দিব রিক্সা থেকে।

মেহবিন ভ্রু কুঁচকে তাকায় মায়ানের দিকে।এই লোকের কি কোনো কাজ নেই।সারাদিন ওকে ফেলে দেওয়ার চিন্তা ঘুরে নাকি।ওরা লেকের সামনে গিয়ে রিক্সা থেকে নেমে পড়ে।মেহবিন গিয়ে মাইজার পাশে দাড়ায়।মাইজা মুখ ভার করে রয়েছে।মেহবিন কি হয়েছে জিজ্ঞেস করতেই সে কিছু না বলে অন্য দিকে চলে যায়।মেহবিন অবাক হয়ে যায়।পুরোটা লেকে ওরা ঘোরাঘুরি করে।কিন্তু আশ্চর্যের বিষয়,মেহবিন যতবারই মাইজার সাথে কথা বলতে গিয়েছে সে অন্য দিকে চলে গিয়েছে।মেহবিনের একারণে মন খারাপ।ও কি করেছে যার জন্য মাইজা ওর সাথে কথা বলবে না।মেহবিন নিজেও মন খারাপ করে থাকে।রাফিজ কতবার ওদের কতকিছু কিনে দিতে চেয়েছে।কিন্তু ওরা দুজনেই সাফ সাফ জানিয়ে দিয়েছে যে ওরা কেউ কিছু নিবেনা আর যথাসম্ভব দ্রুত বাসায় যেতে চায়।আর কি করার রাফিজ গিয়ে দুটো রিক্সা নিয়ে আসে।যথারীতি মেহবিন গিয়ে মায়ানের সাথে বসে আর মাইজা রাফিজের সাথে। রিক্সা আবারো চলতে শুরু করেছে।মেহবিন এবার ইর নড়চড় করছে না।সে উদাস ভঙ্গিতে তাকিয়ে আছে আকাশের দিকে।চোখ ঘুরিয়ে মায়ানের দিকে তাকিয়ে দেখতে পেল মায়ানের হাতে একটা ব্যাগ।সে কৌতুহল দমাতে না পেরে জিজ্ঞেস করল-

-”ব্যাগে কি আছে মায়ান ভাই?মনে তো হচ্ছে মেলা থেকে নিয়েছেন।

মায়ান মেহবিনের দিকে তাকিয়ে বলল-

-”’হুম মেলা থেকেই নিয়েছি।

মেহবিন একটু খুচিয়ে জিজ্ঞেস করল-

-”কার জন্য?নিশ্চয়ই গার্লফ্রেন্ডের জন্য তাই না?

মায়ান মেহবিনের দিকে একটু ঝুঁকে জিজ্ঞেস করে-

-”যদি বলি হ্যা?

মেহবিন একটু সরে বসে মিনমিনিয়ে বলে-

-”এ-একটু স-সরে বসুন।

মায়ান ঠোট কামড়ে হেসে সোজা হয়ে বসে।রিক্সা এপার্টম্যান্টের সামনে থামতেই মাইজা সবার আগে নেমে উপরে চলে যায়।মাইজাকে এভাবে চলে যেতে দেখে মেহবিনের খুব খারাপ লাগে।সে নিজেও উপরে যেতে নিলে কেউ ওর হাতে একটা ব্যাগ ধরিয়ে দেয়।সে পিছে ফিরে কিছু বলবে তার আগেই শুনতে পায় সেই মোহনীয় কন্ঠস্বর –

-”This is for my picchi❤

চলবে…

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here