অব্যক্ত ভালোবাসা পর্ব-৪

0
1350

অব্যক্ত ভালোবাসা
পর্ব:৪

অতীতে
।।।।।
মেহবিন দাঁড়িয়ে আছে স্কুলের গেটের সামনে। আজ মেহবিনের আর মাইজার প্রথম সেমিস্টার এক্সাম ছিল। মেহবিন এক হলরুমে সিট পরেছে আর মাইজা আরেক হলে। তাই মেহবিনের সাথে মাইজার এখনও দেখা হয়নি। মেহবিন মাইজার জন্য দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করছে। এদিকে মেহবিনের পেটের মধ্যে বারবার মোচর দিয়ে উঠছে। আজ মেহবিনের প্রথম পরীক্ষা ছিল অংক। বরাবরই সে অংকে কাচা। তাই গতরাত থেকে নাওয়া খাওয়া সব ভুলে শুধু অংক কষেছে। যার ফলাফল এখন খুব ভালো করেই পাচ্ছে। নাহ, আর সহ্য করতে পারল না মেহবিন।দোকান থেকে কিছু কিনে খাওয়ার সিদ্ধান্ত নিল। তাই আর উত্তর-দক্ষিন না তাকিয়ে দৌড়ে রোড পার হতে গেল আর ওমনি একটা গাড়ি এসে লাগিয়ে দিল একদম মেহবিনের পা বরাবর। মেহবিন ছিটকে পড়ে গেল রাস্তায়। কিন্তু সেটা গাড়ির ধাক্কায় নয়, ভয়ে। গাড়িটা সঠিক সময়ে ব্রেক করে ছিল তাই শুধু মেহবিনের পায়ের সাথে অল্প একটু লেগেছিল। এতেই মেহবিন জড়োসড়ো হয়ে রাস্তায় পড়ে গেল। চারপাশে মানুষ এসে ভিড় করে দিচ্ছে। মেহবিন শুধু কনুই এ একটু ব্যাথা পেয়েছে। কিন্তু আকস্মিক ঘটে যাওয়া ঘটনায় স্তম্ভিত মেহবিন উঠে দাঁড়াতে পারছে না।
গাড়ির মালিক ততক্ষণে গাড়ি থেকে নেমে গিয়েছে। ভিড় ঠেলে সামনে গিয়ে দেখে একটা স্কুল ড্রেস পরা মেয়ে রাস্তায় জড়োসড়ো হয়ে বসে আছে। লোকটা সামনে এগিয়ে এসে মেয়েটির সামনে হাটুভেঙে বসে বলল-

-”’বেশি ব্যথা পেয়েছ?

মেহবিন অসহায় মুখ করে বলল-

-”’হুম, হাতে।

-”আচ্ছা উঠো, আমি দেখেছি।

লোকটি মেহবিনকে টেনে তুলে গাড়ির সামনে নিয়ে গেল। গাড়ি থেকে ফাস্ট এইড বক্স নিয়ে খুবই যত্ন নিয়ে মেহবিনের হাতে সেভলন দিয়ে পরিষ্কার কর মলম লাগিয়ে দিল। তারপর অপরাধী কন্ঠে বলে উঠল –

-”’সরি, আমার জন্য ব্যাথা পেলে পিচ্চি। আসলে আমি একটা জরুরী কলে ছিলাম আর তুমিও হুট করে সামনে এসে পরলে তাই।

হঠাৎ হয়ে যাওয়া ঘটনায় মেহবিন এতক্ষণ ঠাহর করতে পারে নি যে তার সাথে কি হচ্ছে। লোকটার কথা শুনে সে হুশে ফিরল। তৎক্ষণাৎ মাথা তুলে তাকাল লোকটার মুখপানে। সেকেন্ড দুই এর মধ্যেই মেহবিনের মাথায় আগুন ধরে গেল। এই লোক ওকে গাড়ি দিয়ে ধাক্কা মেরেছে? মেহবিন দুইকদম পিছিয়ে গিয়ে আঙুল তুলে বলল-

-”’ সমস্যা কোথায় আপনার? চোখে দেখেন না? সামনে দিয়ে কে গেল না গেল তা দেখার প্রয়োজনবোধ করেন না নাকি। সোজা গাড়ি উঠিয়ে দিবেন শরীরের উপর। গাড়ি আছে বলে কি আকাশে তাকিয়ে চালাতে হবে নাকি। অসহ্য।

মেহবিন রাগে ফোঁসফোঁস করতে লাগল। লোকটা মেহবিনের রাগে ভড়কে গেল। একটু আগেই না মেয়েটা অসহায় ফেস করে তাকিয়ে ছিল। হঠাৎ এমন রনচন্ডী রূপ ধারন করল যে। মেয়েটির অবস্থা বেগতিক দেখে লোকটা সামান্য হাসার চেষ্টা করে বলল-

-”” দেখ পিচ্চি, আমি সরি। খেয়াল করিনি আমি। আর আমি মলম ত লাগিয়ে দিলাম ঠিক হয়ে যাবে।

মেহবিন এমনেই রেগে ছিল। পিচ্চি ডাক শুনে যেন তেলে বেগুনে জ্বলে ওঠল,,,

-”’পিচ্চি মানে? আমি পিচ্চি না আপনি বূইড়া। এইজন্যই চোখের সামনে সব পিচ্চি দেখেন। আর মলম লাগিয়ে দিয়েছেন… ব্যাথা দিয়ে এখন আপনি শান্তনার মলম লাগাতে এসেছেন? আপনার মলম তো আমি–

বলেই হাতে থাকা মলম গুলো লোকটার ব্লেজারে লাগিয়ে দিল। লোকটা কিছুক্ষন নিজের ব্লেজারের দিকে তাকিয়ে রইল। কিন্তু নিমিষেই তার নাক মুখ কুচকে গেল। বিদেশে থেকে এসেই যে এমন নোংরা একটা ব্যাপার ঘটবে কে জানত। আগের থেকেই তার বিশ্বাস ছিল যে বাংলাদেশের সব কিছু নোংরা আর এখানকার মানুষজন ও। আর আজ সেই বিশ্বাস প্রবল বিশ্বাস এ রূপ নিয়েছে। লোকটা কঠিন মুখে সামনে তাকিয়ে কিছু বলবে কিন্তু কই মেয়েটি কোথায়? পালিয়েছে, বাঁদরামি করে এখন পালানো হয়েছে ।লোকটা চিবিয়ে চিবিয়ে বলল –

-”’ বাদর মেয়ে।

বর্তমান
।।।।
আজও সেইসব মনে পড়লে মেহবিনের ভীষণ হাসি পায়। কি কাজটাই না করেছিল সেইদিন। সেদিন ব্লেজারে মলম লাগিয়ে নিজেই বোকা বনে গিয়েছিল। বুঝতে পারেনি রাগের বশে এমন কিছু করে ফলবে সে।ভয়ে ভয়ে লোকটার মুখের দিকে তাকাতেই দেখল সে চোখ মুখ কুচকে দাড়িয়ে আছে। মেহবিন ভরকে গেল। আশেপাশে না তাকিয়েই ভো দৌড় দিয়েছিল সেদিন। মেহবিন ভেবেছিল এটাই বুঝি তাদের শেষ দেখা। কিন্ত নিয়তি তা হতে দেয়নি। তাদের আবার দেখা হওয়াটা যেন কাল ছিল। মেহবিন বিরবিরিয়ে বলল-

-”আপনি আমার জীবনে না আসলেই ভালো হত মায়ান ভাই।

টানা দুইঘন্টা শাওয়ার নিয়ে বেরিয়ে এল মেহবিন। ভেজা চুল গুলো মেলে দিয়ে ধুপ করে বসে গেল খাটে।
তবে কি তাদের আবার মুখোমুখি হতে হবে? কীভাবে যাবে সে ঐ মানুষটার সামনে? আচ্ছা, ঐ মানুষটাকে দেখে কি সে কান্নায় ভেঙ্গে পড়বে নাকি, শক্ত হয়ে মুখ ঘুরিয়ে নিবে? না কাদবে কেন? সে তো কিছুই করেনি। ছেড়ে তো গিয়েছে ঐ লোকটা। কিন্তু এই রাগ ও বা কেন হবে তার ঐ লোকটা উপর? লোকটা তো তাকে একবারও বলেনি যে সে তাকে ভালোবাসে। কিন্তু তার আচার আচরণে তো এটাই প্রকাশ পেত যে মায়ান মেহবিন কে ভালোবাসে। সব কথা কি মুখে বলতে হবে। থাকে না কিছু অব্যক্ত কথা। যা বুঝে নিতে হয়। তবে কেন এই বিচ্ছেদ।মেহবিন তাচ্ছিল্য করে হেসে বলল-

-”’কার জন্য কাঁদছি আমি, যে কিনা আমার হাত টা আগলে ধরে পথ চলতে পারলনা। যে মানুষটা ভালোবাসা নামক পবিত্র শব্দটা বিষিয়ে তুলেছে?না আমি আর কাদব না। আমি তো কাদার জন্য পৃথিবীতে আসিনি। হে কাদব না আমি।

কিন্তু সত্যিই কি ভুলে থাকা যায়। যাকে নিয়ে বেচে থাকার স্বপ্ন দেখেছিল তাকে ভুলে বেচে থাকাটা যে বড্ড দায়।

——-

অশ্রুধারা বাধ যেন মানছে না মাইজার। চোখ মুছতে মুছতে চোখের চামড়া তুলে ফেলেছে কিন্তু তাও বেহায়া অশ্রু আবার বেয়ে পড়ছে।খাটের কিনারা ঘেষে ফ্লোরে বসে আছে মাইজা। পুরো রুমে অন্ধকার বিরাজমান। কী হলো তার জীবনে? কেন হলো?মায়ান নামক মানুষটাকে নিয়ে তো সে শুধু ভালো থাকার স্বপ্ন বুনে ছিল। এটাই কি তার ভুল ছিল? ভুলই ছিল হয়ত। নাহয় যে মেয়ে কিনা কোনোদিন কাদত না তার আজ এমন অবস্থা কেন হবে? মাইজার মনে পড়ে গেল সেই অতি সুখময় দিনটির কথা।

অতীত
।।।।
সকাল ১০.৩০। এখনও মাইজা হাত পা ছড়িয়ে ছিটিয়ে ঘুমুচ্ছে। বাইরে বিভিন্ন কিছুর ঠাস ঠাস শব্দ হচ্ছে। যেগুলো মাইজার কর্ণকুহুরে পৌছিয়েছে ঠিকি কিন্তু তবুও সে চোখ খুলতে নারাজ। চৈত্র মাসের মাঝামাঝি সময়ে মাথার উপর চলা সিলিং ফেনটা বেশ আরাম দিচ্ছে মাইজাকে। হঠাৎই মাইজার গালে তুলতুলে কিছু অনুভূতি হতেই লাফিয়ে উঠে গেল সে। আশপাশ তাকাতে লাগল সে। নিজের বালিশের নিচে সাদা সাদা কিছু দেখতেই হকচকিয়ে লাফিয়ে নেমে গেল সে। আর তখনই বালিশের নিচে থেকে বের হয়ে এল একটা খরগোশ। খরগোশ দেখে মাইজা ভরকে গেল । খরগোশ এল কোত্থেকে? হাত বাড়িয়ে খরগোস টা কোলে তুলে নিবে তার আগেই লাফিয়ে খরগোশেটি নিচে নেমে দৌড়ে রুম থেকে বেরিয়ে গেল। মাইজা ও ছুটল পিছনে। দুইজনই সর্বশক্তি নিয়ে দৌড়াচ্ছ। ওদের দেখে মনে হচ্ছে যেন পুলিশ খুন করা আসামীর পিছনে ধাওয়া করছে।দৌড়াতে দৌড়াতে একপর্যায়ে খরগোশেটি একজনের পায়ের সামনে গিয়ে থেমে গেল। পায়ের মালিক পরমযত্নে কোলে তুলে নিল খরগোশ ছানাকে। আর তখনই মাইজা এই দাড়াও, বলতে বলতে চলে এল। লোকটা ভ্রু কুঁচকে মাইজার দিকে তাকিয়ে বলল –

-”কি ব্যাপার আমার পিকুর পিছনে ধাওয়া করছ কেন?

কোনো পুরুষালি কন্ঠস্বর কানে আসতেই মাইজা চোখ তুলে তাকাল। তাকিয়েই মাইজা থমকে গেল। এ কাকে দেখছে সে,সত্যিই কি এটা মানুষ নাকি ফেইরিটেল এর কোনো রাজপুত্র।ফরমাল গেটআপ, ফরসা মুখে খোঁচা খোঁচা দাড়ি।আর চোখ গুলো, চোখ গুলো তে কিছু যেন একটা আছে। মাইজার ছোট্ট কিশোরী মনে যেন নতুন এক অনুভূতির সাথে পরিচিত হলো। love at first sight., কথাটা যেন হুট করেই বিশ্বাস করে ফেলল সে। আর মনে মনে ঠিক করে ফেলল, ফেইরিটেলের এই রাজপুত্র কে তার চাই ই চাই।মাইজা সব ভুলে লোকটার দিকে তাকিয়েই রইল। লোকটি হেসে দিয়ে বলল-

-”পছন্দ হয়েছে?

মাইজা আনমনেই বলল-”

-”হুম অনেক পছন্দ হয়েছে।

তখনই রাফিজ এসে ওদের দেখে বলল-

-”’মায়ান এখানে কি করছিস? ওর সাথে পরে আলাপ করিস। এখন গিয়ে ফ্রেশ হ।

মায়ান বলল

-”’হুম।

তারপর মাইজার দিকে তাকিয়ে বলল-

-”’পছন্দ হলে এখন নেও। আমি ফ্রেশ হয়ে আসা অবদি পিকু তোমার দায়িত্বে।বলেই পিকুকে মাইজার হাতে দিয়ে চলে গেল ।মাইজা মুগ্ধ নয়নে মায়ানের যাওয়ার দিকে তাকিয়ে বলল-

-”’ প্রহর শেষে আলোয় রাঙা সেদিন চৈত্র মাস,
তোমার চোখে দেখেছিলাম আমার সর্বনাশ”’।

(যারা গল্পেটি পড়ছেন প্লিজ রেসপন্স করুন❤)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here