#অভিমান
#পর্বঃ১৯ (শেষ পর্ব)
#তানিশা সুলতানা
রক্ত শূন্যতা তোহার। পর্যাপ্ত পরিমান রক্ত নেই শরীরে। থাকার কথাও না। রক্ত দেওয়া ছাড়া সিজার করা সম্ভব না। হাসপাতালে তোহার গ্রুপের কোনো রক্ত নেই। অন্য কোথাও থেকে আনতে হবে। আকাশ চলে গেছে রক্ত আনতে।
অন্যান্য দিনের থেকে আজ তোহা একটু বেশিই সুস্থ বোধ করছে৷ বসে আছে সিটের ওপর। কেনো জানি খুব করে সব কিছু মন ভরে দেখতে ইচ্ছে করছে। পেটে হাত দেয় তোহা।
“আমায় মিস করবি তো সোনা? না কি ভুলে যাবি আমায়? তোর পাপা নতুন মা এনে দেবে তাকেই মা বলবি? আমায় ভুলিস না রে। আমার ছবিটা দেখিস তুই। তোর মাকে চিনে নিস।
টপটপ করে চোখ থেকে পানি গড়িয়ে পড়ে তোহার।
আস্তে আস্তে করে জানালার কাছে যায়। দুই তালার ওপরে তোহা। জানালার গ্রিল ধরে নিচে তাকায়। শত শত মানুষ ছোটাছুটি করছে। নিজেদের পেট চালানোর ধান্দায়। ব্যস্ত নগরির ব্যস্ত মানুষ। হাসপাতালের গেট দিয়ে কেউ কেউ হাসি মুখে বেরিয়ে যাচ্ছে আবার কেউ কেউ কান্না করতে করতে।
তোহা সব কিছু প্রাণ ভরে দেখছে। খুব ইচ্ছে করছে মেঘের সাথে একটু সময় কাটানোর। শেষবারের মতো মেঘকে দুচোখ ভরে দেখতে ইচ্ছে করছে। আর যদি দেখা না হয়।
” একি আপনি ওখানে কেনো?
নার্স কেবিনে ঢুকে বলে।
তোহা আস্তে করে ঘাড় ঘুড়িয়ে নার্সের দিকে তাকায়। ঠোঁট প্রসারিত করে মলিন হাসে।
“শেষ বারের মতো দুনিয়াটা দেখে নিলাম।
নার্স চোখ নামিয়ে নেয়। কথা ঘোরাতে বলে
” এভাবে হাঁটাহাঁটি করা ঠিক না। এখানে বসুন
নার্স তোহার হাত ধরে বেডে বসিয়ে দেয়,তোহাকে।
“আমার হাজব্যান্ডকে একটু ডেকে দেবেন? ওর সাথে একটু কথা বলতে চাই।
আকুতি ভরা কন্ঠে বলে তোহা।
নার্স তোহার মাথায় হাত বুলিয়ে চোখ মুছতে মুছতে বেরিয়ে যায়।
মেঘ কেবিনের বাইরেই বসে ছিলো। এখানেই বসে থাকে সব সময়। তোহাকে দেখতে যায় না।
” আপনার বউ আপনাকে ডাকছে।
নার্সের কথায় মেঘ মাথা তুলে তাকায় নার্সের দিকে।
মেঘের মনে হয় মেঘ তোহার সাথে কথা বললেই তোহা কে হারিয়ে ফেলবে। তাই তো কখনোই তোহার সামনে যায় না।
“আআআমি যাবো না। কথা বলবো না। ও সুস্থ হবে তারপর কথা বলবো।
মেঘ তারাহুরো করে বলে। চোখ দিয়ে পানি ঝড়ছে।
আনোয়ার চৌধুরী মেঘের পাশেই বসা ছিলো। তিনি মেঘের কাঁধে হাত রাখে।
” আপনি প্লিজ বলবেন না আমাকে ওর সাথে কথা বলতে। আমি পারবো না।
দাদাকে জড়িয়ে হাউমাউ করে কেঁদে ফেলে মেঘ।
তোহা নার্সের পেছন পেছন চলে আসছিলো দরজার কাছে। মেঘের কথা শুনতে পায়।
“অনেক অভিমান জমে আছে আপনাকে নিয়ে। ভেবেছিলাম এখনই সব অভিমান মিটিয়ে ভালোবেসে বিদায় নেবো কিন্তু আপনি আসলেন না। আবারও এক সমুদ্র অভিমানে ভাসিয়ে দিলেন আমাকে।
ধপ করে পড়ে যায় তোহা। কিছু পড়ার শব্দে সবাই দৌড়ে আসে। তোমাকে পড়ে থাকতে দেখে ডাক্তারকে ডাকে। মেঘ কোলে করে তোহাকে বেডে শুয়িয়ে দেয়।
ততখনে আকাশ রক্ত নিয়ে চলে এসেছে।
তোহা কে অপারেশন থিয়েটারের নিয়ে যাওয়ার পরই নিপা আসে শুভর সাথে।
সবাই অপেক্ষা করছে তোহার জন্য।
মেঘ দাদার বুকে মুখ লুকিয়ে কেঁদেই যাচ্ছে।
ডাক্তার বলে গেছে তোহার ব্রেইনের দাগটা আর চওড়া হয়ে গেছে। তারপর শরীরে রক্ত নেই।
সবাই কাঁদছে। হাউমাউ করে কাঁদছে। সবাই বুঝে গেছে তাদের আদরের লম্বা চুল ওয়ালা তোহা আর ফিরবে না তাদের কাছে।
খুব তারাতাড়ি অপারেশন শেষ হয়ে যায়।
নার্স সাদা তোয়ালে তে মুরিয়ে ফুটফুটে শিশুটিকে নিয়ে বের হয়। পেছন পেছন ডাক্তার। ডাক্তার আর নার্সের মুখটাও শুকিয়ে গেছে
কেউ জিজ্ঞেস করে না তোহার কথা। সাহস নেই কারোর। বাচ্চাটার দিকে তাকায়ও না কেউ।
আকাশ কাঁপা কাঁপা হাতে বাচ্চাটাকে কোলে নেয়।
” রক্তের প্রয়োজন হয় নি। সিজার করার সাথে সাথেই প্রাণ হারায়।
ডাক্তারও কেঁদে ফেলে। এরকম একটা মৃত্যু কেউই মেনে নিতে পারছে না। কিন্তু তোহার যে মৃত্যুই হবে এটা কম বেশি সবারই জানা ছিলো।
পাগল পাগল হয়ে গেছে সবাই। মেঘ স্থির দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে।
সবটা মেঘের পাপের শাস্তি। কতো মেয়ের জীবন নষ্ট করেছে। টাকা দিয়ে সম্মান কেনা যায় না। যখন তোহা বলেছিলো ওর মাথা ব্যাথা করছে তখনই ডাক্তার দেখালে আজ তোহা চলে যেতো না।
তোহার প্রতি একটু কেয়ার ফুলি হলে একটু যত্ন করলে আজ তোহা মেঘকে একটা করে চলে যেতো না।
যেদিন তোহা বলেছিলো “আমার বেবি চাই” সেদিন যদি মেঘ কারণটা জানতে চাইতো তাহলে আজকে তোহা প্রাণ হারাতো না।
কই এতো টাকা দিয়েও তো মেঘ পারলো না তোহার জীবন বাঁচাতে। তাহলে করবে কি টাকা দিয়ে? একদিন এই টাকার জন্যই মেঘ পরিবার ছেড়ে ছিলো আজকে সেই টাকাই মেঘকে একা করে দিলো।
দুর দুরান্তের সবাই এসেছে তোহাকে দেখতে। খাটিয়াতে শুয়িয়ে রাখা হয়েছে তোহাকে। ঘন লম্বা চুল গুলো আর নেই। হাতে গোনা কয়েকটা চুল আছে মাথায়। ফর্সা মুখটা কালো কুটকুটে হয়ে গেছে। মুখটা দেখে মনে হচ্ছে হাসছে।
চৌধুরী বাড়ির সামনে শুয়িয়ে রাখা হয়েছে তোহাকে।
মেঘ স্তব্ধ হয়ে বসে আছে তোহার মুখ টার দিকে তাকিয়ে।
পুরো শহর কাঁদছে তোহার জন্য। কিন্তু সে কাঁদছে না যার জন্য আজকে তোহা লাশ হয়ে আছে।
আকাশ বাচ্চাটাকে কোল থেকে নামায় নি। কোলে করেই তোহাকে দেখছে। শেষ বারের মতো।
আর কখনোই দেখা হবে না। আকাশ ভাইয়া ডাকটা শোনা হবে না। লম্বা চুল নারিয়ে হাঁটতে দেখবে না। খিল খিল করে হাসবে না। কোথায়,হারিয়ে গেলো তোহা?
দুনিয়াটা বড্ড স্বার্থপর।
গোছল করাতে নিয়ে যাওয়া হয় তোহাকে। আজ শুক্রবার। জুমার নামাজের আগেই দাফন করা হবে। কবর দিয়ে জুমার নামাজ আদায় করবে সবাই।
কাফন সরিয়ে শেষ বারের মতো তোহার মুখটা দেখানো হয় সবাইকে। আকাশ বাচ্চাটাকে তোহার সামনে আনে।
“এটা তোমার মা সোনা।
বাবা শশুড় আকাশ আর মেঘ। চারজনের কাঁধে চেপে তোহা নিজের শেষ ঠিকানায় যায়। বাড়ির সামনেই তোমাকে কবর দেওয়া হচ্ছে।। মেঘ এক মুঠো মাটি দেয় তোহার কবরে। আকাশও দেয়।
” এতোটা স্বার্থপর তুমি। তুমি তো জানতে বলো তোমাকে ছাড়া আমি চলতে পারবো না। কি হবে আমার? আমি বাঁচবো কি করে?
মাটি আকড়ে ধরে কাঁদে মেঘ।
পুরো চৌধুরী বাড়িটাই স্তব্ধ হয়ে গেছে। প্রত্যেকটা মানুষ বেঁচে আছে মরার মতো।
“এই মেয়েটা মরে যাওয়াতে পুরো শহর কাঁদছে। দুটো ছেলে পাগল হয়ে যাচ্ছে। কারো কোনো অভিযোগ নেই মেয়েটা প্রতি। শুধু আছে অফুরন্ত ভালোবাসা। সত্যিই অসাধারণ তুমি তোহা। তোহার জবাব হয় না।
মায়া তোহার ছবিটায় হাত বুলিয়ে বলে।
” আপনাকে আমি খুব ভালোবাসি মেঘ। কখনো বলা হয় নি আপনাকে। আপনার মুখ থেকে কখনো শোনাও হয় নি৷ চার দেয়ালের বাড়িটায় একা একা বড্ড বোরিং লাগতো আমার৷ ইচ্ছে করতো আপনার সাথে বলে গল্প করি। পাখিদের মতো আপনার সাথে উড়ে বেড়ায়। সব সময় আপনার সামনে থাকি। আপনাকে প্রাণ ভরে দেখি। এক সাথে খাবার খাই। কিন্তু আপনার তো সময় নেই। সেই সকালে চলে যেতেন আর অনেক রাত করে ফিরতেন।
আমার সাথে কথা বলার মতো কেউ ছিলো না। তাই ভেবেছিলাম একটা বেবি হলে আমার নিসংঙ্গতা ঘুচবে। সারাদিন ওকে নিয়েই মেতে থাকবো।
তাই আবদারটা করে বসলাম। বেবি পেটে আসার পরই মাথা ব্যাথাটা তিব্র বেরে গেলো। যতটুকু সয্য করার যায় করতাম। কিন্তু যখন আর পারতাম না তখনই আপনাকে বলেছিলাম। আপনি বললেন জাস্ট এমনি। খুব গায়ে গেলে ছিলো আমার। আপনি আমার মুখটা দেখেও বুঝতে পারেন নি আমি ঠিক কতোটা অসুস্থ। অবশ্য আপনার আমার মুখের দিকে তাকানোর সময়ও ছিলো না।
ভেবে নিলাম আর বলবোই না আপনাকে। ঠিক তাই করলাম। বললাম না। আগে যে মেডিসিন খেতাম সেটা খাওয়া বন্ধ করে দিলাম বেবির হ্মতি হবে বলে।
জীবনে আমি সব পেয়েছি শুধু আপনার থেকে একটু সময় ছাড়া।
অনেক অভিমান আপনার ওপর আমার। খুব পচা আপনি। তবুও আপনাকে আমি খুব ভালোবাসি।
তোহাকে যেদিন হাসপাতালে নেওয়া হয় সেদিনই মেঘ তোহার ডাইরি থেকে পড়ে নেয়। নিজেকে খুব অপরাধী আর অসহায় মনে হয় মেঘের।
আজ পাঁচ দিন হয়ে গেছে তোহা চলে যাওয়ার। মেঘ মেয়েকে কোলে করে তোহার কবরের পাশে বসে আছে।
এটাই মেঘের কাজ। সব সময় এখানেই বসে থাকে। মেয়ে কাঁদলে কাউকে ডেকে দিয়ে দেয়।
পাঁচ দিনের মেয়েটাকে প্রচন্ড কান্না করলেও মেঘের কোলে আসলেই শান্ত হয়ে যায়। তোহার মতো পিচ্চিটাও মেঘের কাছে থাকতে চায়।
“এতোটাও অভিমান করা ঠিক না। রাগ অভিমান জেদ আমাদের জীবনটা তছনছ করে দেয়। তুমি তো অভিমান করে শান্তিতে ঘুমিয়ে পড়লে কিন্তু আমাকে দিয়ে গেলে এক সমুদ্র দুঃখ কষ্ট।
লম্বা চুল ওয়ালা মায়া ভরা মুখের অধিকারী মেয়েটাকে আমি খুব ভালোবাসি৷ কে বলেছে সে নেই? সে আমার সাথে আছে। আমার বুকে আছে। আমার মনে প্রাণে আছে। আমার মেয়ের মধ্যে সে লুকিয়ে আছে।
এখন শুরু আমি অপেক্ষায় আছি মেয়েটাকে নিরাপদ কোথাও রেখে আমার অভিমানির ডান পাশে শোয়ার।
” আর হবে না দেখা”
আকাশ তোহার কবরের পাশে একটা গোলাপের চারা লাগিয়ে দেয়। গাছ টায়,একটা গোলাপ আছে।
“এই গোলাপ টাই আমার তোহা। এখনো খুব ভালোবাসি তোমায়। তোমার মেয়েকে খুব যত্ন করে বড় করবো আমি। তার মায়ের জায়গায় কাউকে বসতে দেবো না কথা দিলাম।
সমাপ্ত
গল্পটার নামই অভিমান। আর আমি এভাবেই ভেবে রেখেছিলাম। তোহা বেঁচে গেলে বেপারটা মানাতো না।
এতোগুলো সরি sad ending দেওয়ার জন্য। গল্প লিখতে গিয়েই আমার কান্না চলে আসছে।