#অমানিশা❤️
#লেখিকা_মালিহা_খান❤️
#পর্ব-১৬
ময়ুখের তপ্ত ছটায় ভোর কেটেছে অনেকক্ষণ।
সেদিন সকালে আরশাদকে আর খালি গায়ে ঘুরে বেড়াতে দেখা গেলো না। ফুলহাতা ধবধবে শার্টে আগাগোড়া আঁটসাঁট পোশাকে নাস্তার টেবিলে বসল সে।
মিনিটদশেকের মধ্য নাস্তা সেড়ে উঠেও গেলো। মুনতাহা বিছানা ঝাড়ছিলো তখন। আরশাদ ঘরে ঢুকল। একপলক দেখে ড্রয়ার খুলে ঘড়ি বের করল। হাতে পরতে পরতে বলল,”আপনি একা একা ছাদে যাবেন না। যেতে হলে, আম্মাকে সাথে নিয়ে যাবেন। ঠি কাছে?”
মুনতাহা মাথা নাড়ালো। মুখে বলল,”আচ্ছা।”
আরশাদ যাবার আগে একবার আনতারা কেও ডেকে বলে গেলো,”আম্মা, ওকে তোমার কাছে কাছেই রাখবে। একা বাইরে যেতে দিবে না। ওই ফ্ল্যাটেও না।”
আনতারা কি যেনো দেখলেন ছেলের চোখে। সন্ধানী কন্ঠে বললেন,”কিছু হয়েছে বাবা?”
আরশাদ কি যেনো ভাবে। সাবিনা বেগমের পাশে বসে লাজুকভাবে হাসতে থাকা মুনতাহার দিকে চেয়ে কি যেনো দেখে। নিশ্চিত দাদি উল্টোপাল্টা কিছু বলছে। আরশাদ চোখ সরায়।
অত:পর মৃদু গতিতে মাথা নাড়িয়ে বলে,”না, কিছু হয়নি। সাবধানে থেকো।”
–
সপ্তাহ-র বেশি কেটে গেলো যেনো চোখের পলকে।
মাহতাব সাহেব ফিরবেন আজ। মেয়েকে ফোন করেছিলেন বিকেলেই। কাজ শেষ তার। রাতের মধ্য পৌছে যাবেন। সেই বিকেল থেকেই একগাল হাসি নিয়ে বসেছে মুনতাহা। সরছেইনা।
আরশাদ ফিরলো সন্ধ্যার দিকে। মুনতাহা দরজা খুলতেই তার হাসি দেখে নিজেও হেসে ফেলল। ঢুকতে ঢুকতে বলল,”যাক, হেসেছেন তবে। কেঁদেকেঁদেই তো সপ্তাহ কাটিয়েছেন।”
মুনতাহার হাসি চওড়া হলো। হাত বাড়িয়ে আরশাদের ব্যাগটা নিলো সে। আরশাদ আশেপাশে তাকালো। ড্রইংরুমে কেউ নেই। দাদির ঘরের দরজা বন্ধ। আম্মার ঘরেরও।
চট করে মুনতাহার কপাল টেনে ছোট্ট একটা চুমু খেয়ে নিয়ে বলল,”আমার থেকে দূরে যেতে আপনার এতো হাসি চাঁদ?”
মুনতাহা লাজুক ভঙ্গিতে মুখ ঝুঁকিয়ে নিলো। চাঁদ ডাকায় সে লজ্জা পেয়েছে। আরশাদ জুতো খুলতে ব্যস্ত হলো। মুনতাহা চুপটি করে দাড়িয়ে রইলো পাশে। রোজই থাকে। আরশাদ জুতো খুলে পাশে তুলে রেখে ধীরকন্ঠে বলল,”পানি দিয়েন তো মুনতাহা।”
–
একনিশ্বাসে ঠান্ডা পানিটা ঢকঢক করে গিলে নিয়ে ক্লান্ত ভঙ্গিতে গ্লাসটা বিছানার উপর রাখলো আরশাদ। মুনতাহা তার ঘেমে নেতিয়ে যাওয়া শার্টটা বারান্দায় মেলতে গিয়েছে। আরশাদ মাথার নিচে হাত দিয়ে সটান হয়ে শুয়ে পড়লো বিছানার মাঝখানে। ফ্যান ঘুরছে ভনভন করে। বা হাতটা মেলে বিছানার বা পাশে রাখলো।
মেয়েটা আজ ঘুমাবেনা এখানে। খালি খালি লাগবে। তার অভ্যাস হয়ে গেছে।
মুনতাহা ফিরে এলো। একপলক আরশাদকে দেখে পানির গ্লাসটা বিছানা থেকে সরিয়ে সাইড টেবিলে রাখলো। ঝুঁকে ড্রয়ের খুললো। ঘড়িটা ঢুকিয়ে রাখলো ভেতরে।
আরশাদ উঠে বসেছে। মুনতাহা ড্রয়ের আটকে সোজা হতেই ভরাট কন্ঠে ডাকলো সে,”এদিক আসেন।”
মুনতাহা ঘাড় ঘুরালো। দৃষ্টি বিনিময় হলো। আরশাদের চোখে স্পষ্ট আহব্বান।
মুনতাহা বুঝে। চোখ নামিয়ে নেয়। ধীরপায়ে কাছাকাছি যেয়ে দাড়াতেই বাহু টেনে কোলের উপর বসিয়ে নেয় আরশাদ। মুনতাহা মুখ তুলেনা। আরশাদ বামগালে হাত রেখে বিষাদ নিয়ে বলে,
—“এই ঘরটা অমাবস্যায় ডুবে যাবে।”
মুনতাহা আরো একটু নতজানু হয়। আরশাদ সময় নিয়ে গাঢ় স্পর্শ আঁকে। মুনতাহা মিনমিন করে বলে,
—“দু’একদিন আব্বুর কাছে থাকি?”
আরশাদ থামে। গালের হাতটা সরিয়ে কপালের চুল গুছিয়ে দেয়। বলে,”আমি আপনাকে কিছু বলেছি? আপনার যতদিন ইচ্ছে থাকেন। ইচ্ছে হলে আসবেন, না আসলেও আমি কিছু বলবোনা।”
মুনতাহা তাকায় এতক্ষণে। আরশাদের চোখে মুগ্ধতা। সে আজকাল দেখতে পায়। বুঝতে পারে।
মুনতাহা মনে মনে স্বগতোক্তি করলো,”আচ্ছা, আপনিও কি বুঝেন? আপনি ওই চোখে যতটুকু মুগ্ধতা নিয়ে তাকান, তার থেকে হাজার গুন বেশি মুগ্ধতা নিয়ে আমি আপনার দিকে তাকাই?”
–
মাহতাব সাহেব ফিরেছেন গুনে গুনে এগারো দিন পর। সাতদিনের জা’গায় এগারো দিন। মেয়ে নিশ্চিত অভিমানে রুষ্টপুষ্ট হয়ে আছে। রাস্তা শুনশান। রাত অনেক। সি এন জি থেকে নামতেই আরশাদ এগিয়ে এলো। মাহতাব সাহেব বিস্তর হেসে জড়িয়ে ধরলেন স্বস্নেহে। পিঠ চাপড়ে বললেন,”কষ্টে করে আবার নামতে গেলে কেনো বাবা?”
আরশাদ হেসে ফেলল,”আপনার মেয়ে আমাকে নিশ্চিত শুলে চড়াতো এখন নিচে নিয়ে না আসলে।”
—“মুন এসেছে? কোথায়?”
আরশাদ সি এন জি থেকে ব্যাগ তুলতে তুলতে বলল,”ভেতরেই দাড়িয়ে আছে। রাত হয়েছেতো। বাইরে আসতে মানা করেছি।”
–
মুনতাহা গুটিগুটি হয়ে দাড়িয়ে ছিলো। পরণে শুভ্ররঙা শাড়ি। ভেতরে ঢুকতেই নিকষমেঘে পূর্ণিমা খেলে গেলো যেনো। মাহতাব সাহেব নিজ থেকেই দু’হাত মেলে দিলেন। মুনতাহা ঝাঁপিয়ে পড়লো বুকে। ফুঁপিয়ে উঠলো সশব্দে। মাহতাব সাহেব চুলে হাত বুলালেন সবসময়ের মতো, “কাঁদেনা আম্মা। আব্বু এসে পড়েছিতো।”
—“আপনার মেয়ের কাঁদা ছাড়া কোনো কথা নেই।”আরশাদ ফোড়ন কাটলো।
মাহতাব সাহেব হাসলেন। মুনতাহা তখনো কাঁদছে।
–
তখন গভীর রাত। শুক্ল মেঘের আড়ালে সেদিন ঘুটঘুটে অমাবস্যা। হলুদ ল্যাম্পপোস্টের আলোতে ঝিঁ ঝিঁ পোকা ঝাঁক বেঁধেছে।
মুনতাহা প্লেটবাটি ধুচ্ছে রান্নাঘরে। বাবা ভাত খেয়েছে কিছুক্ষণ আগে। গোসল সেড়ে, ব্যাগের জিনিসপত্র বের করে গোছাতে গোছাতে দেরি হয়ে গেছে।
মাহতাব সাহেব ঘর থেকে ডাক দিলেন,”মুন? এদিকে আয়।”
মুনতাহা প্লেটবাটি সেভাবে রেখেই ঘরে ছুটে গেলো। ওইযে, বাবার ডাকই যে তার প্রথম প্রাধান্য। মাহতাব সাহেবের হাতে প্যাকেট। চারকোনা প্যাকেট। মুনতাহার দিকে বাড়িয়ে দিলেন তিনি। মুনতাহা শাড়ির আঁচলে ভেজা হাত মুছল। ধরার আগেই মাহতাব সাহেব হাত নামালেন হঠাৎই। চুপ করে রইলেন কিছুক্ষণ। চোখের শান্ত দৃষ্টি মেঝের দিকে। অত:পর আবার হাত বাড়িয়ে দিয়ে বললেন,”ধর মা, তোর উপহার।”
মুনতাহা কপাল কুঁচকালো। বলল,
—“উপহার কিজন্য আব্বু?”
মাহতাব সাহেব জোরপূর্বক হাসলেন বোধহয়। স্বাভাবিক থেকে বললেন,
—“এইযে আমার মেয়েটা এগারোটা দিন আমাকে ছাড়া থেকে ফেলল সেজ…” মাহতাব সাহেব চুপ করলেন। মুনতাহা প্যাকেট খুলছিলো। বাবার চুপ হয়ে যাওয়ায় হাত থামলো তার। মাহতাব সাহেব আবার হাসলেন। হাসার চেষ্টা করলেন। বললেন,”খোল খোল। খুলে দেখ।”
মুনতাহা প্যাকেট খোলায় মনোযোগ দিলো। ভেতরে শাড়ি। জামদানী শাড়ি। সাদা জামদানী। অদ্ভুত সুন্দর।
মাহতাব সাহেব থেমে থেমে বললেন,
—“তোকে… তোকে শাড়িতে খুব সুন্দর দেখায় আম্মা। সবসময়..সবসময় শাড়ি..পড়বি।”
মুনতাহা কি যেনো দেখল। বাবা কেমন করছেনা? একটু অন্যরকম করে কথা বলছেনা? শাড়িটা পাশে রেখে তাড়াহুড়ো করে বলল,”আব্বু কি হয়েছে?”
মাহতাব সাহেব উওর দিলেননা। চুপ করে রইলেন। চোখ তুলে একবার তাকালেন মেয়ের দিকে। আবার চোখ নামালেন। বোঝা যাচ্ছে, নীরবে কিছু একটা সহ্য করার চেষ্টা করছেন। মুনতাহা ভীত কন্ঠে বলল,”আব্বু? আব্বু কি হলো? খারাপ লাগছে? পানি খাবে?”
মাহতাব সাহেব এবারো উওর দিলেননা। মুনতাহা ঘাবড়ে গেলো। ভড়কে গেলো। ভয় জেঁকে বসলো। মুখের রং ফ্যাকাশে হয়ে গেলো মূহুর্তেই। টেবিল থেকে পানির গ্লাস নিলো সে। মাহতাব সাহেব মেয়ের হাতেই পানি খেলেন। কষ্ট করে বললেন,”আম্মা, আরশাদকে ডাক তো।”
ঘরের বাতি নিভানো। আরশাদ ঘুমোয়নি। কপালে হাত ঠেকিয়ে চোখ বুজে আছে শুধু। মুনতাহা পাশে নেই। ঘরে শূন্যতার আসর। তার ঘুম আসছেনা। ফোন ভাইব্রেট করল তখনই। আরশাদ চোখ মেলল চকিতে। স্ক্রীনে মুনতাহার নাম্বার। কি হয়েছে? কি হয়েছে? ভাবতে ভাবতেই ফোন রিসিভ করলো সে। কিছু বলার আগেই ওপাশ থেকে কান্নামাখা কন্ঠস্বর ভেসে এলো,
—“আপনি একটু আসেন। আব্বু কেমন যেনো করছে।”
–
মাহতাব সাহেব চোখ বুজতেই মুনতাহা কাঁপা কাঁপা গলায় ডাকলো,”না আব্বু, আব্বু না। আব্বু? তাকাও না।”
মাহতাব সাহেব তাকালেন। মেয়ের আবদার! রাখতে হবে যে!
চোখজোড়া ভীষণ লাল তবে পানি নেই। আরশাদ ক্ষীণ ভরসায় তার হাত ধরে বলল,”কিছু হবেনা আংকেল। আর একটু.. এম্বুলেন্স চলেই এসেছে।’
মাহতাব সাহেব ঢোঁক গিললেন বোধহয়। শরীরটা একটু কেঁপে উঠলো। আরশাদ বুঝতে চেয়েও বুঝতে চাইছেনা।
মাহতাব সাহেব হঠাৎই পূর্ণদৃষ্টিতে তাকালেন। পরিষ্কার কন্ঠে ডাকলেন,”আরশাদ, শোনো।”
আরশাদ ঝুঁকলো। মুনতাহা বুকে জাপটে ধরে কাঁদছে। মাহতাব সাহেব শেষবারের মতো কাঁপা হাতে মেয়ের মাথায় হাত বুলাতে বুলাতে আরশাদের দিকে তাকালেন। ফিসফিসেয়ে বললেন,”এটাই যেনো ওর শেষ কান্না হয়।”
—“আংকেল?”আরশাদের চোখে পানি। কন্ঠ কাঁপা কাঁপা।
—“মনে রেখো।”
মাহতাব সাহেবের চোখের কোঁণা বেয়ে জল গড়ালো নিরবে। মেয়েকে আর দেখা হবেনা। আফসোস যে এই একটাই!
কিছুক্ষণের মধ্যই শরীরটা নিস্তেজ হয়ে গেলো। মাথায় বুলাতে থাকা হাতটা থেমে গেলো হুট করে। মাহতাব সাহেব চোখ বুজলেন। আরশাদ নিজেকে শক্ত করতে চাইলো। পারলোনা। মুনতাহা বুক থেকে মুখ তুলল। টিপ টিপ আওয়াজ টা থেমে গেলো কেনো? শিশুর মতন একবার আরশাদের দিকে চাইলো সে। পরক্ষণেই বাবার গালে হাত রেখে অবুঝ স্বরে ডাকলো,”আব্বু? আব্বু কথা বলো। আব্বু?”
মাহতাব সাহেব কথা বললেন না। মুনতাহা চিৎকার করলো। গলা দিয়ে রক্ত বেরিয়ে যাবার উপক্রম। কন্ঠে আহাজারির আবদার,
—“আব্বু? আব্বু তাকাও। আব্বু? ও আব্বু তাকাও।”
~চলবে~