#অমানিশা❤️
#লেখিকা_মালিহা_খান❤️
#পর্ব-১৭
আজানের সুর ভেসে এলো। ফজর ওয়াক্ত। নতুন ভোর। নতুন প্রত্যুষ।
মুনতাহা তার আদরের শক্ত বুকের বা’পাশটায় এলোমেলো হাত বুলিয়ে আস্তে করে ডাকল,”আব্বু নামাজ পরবা না?”
আনতারা মুখে আচঁল চাপা দিলেন। মুনতাহা তাকাল একবার। চোখদুটো শুকনো। অনুভূতির খড়া লেগেছে। নিরব আর্তনাদরা হাহাকারে ফাঁটছে।
আনতারা দেখতে পারলেন না। মুখ অন্যদিকে ফিরিয়ে নিলেন।
মুনতাহা কাঁদলোনা। খুব স্বাভাবিক ভঙ্গিতে চোখ ফিরিয়ে মাথাটা পুনরায় এলিয়ে দিলো বাবার বুকে। বুকটা ঠান্ডা। বরফের মতো। এতো ঠান্ডা কেনো? শীত পড়েছে নাকি?
মুনতাহা ধীরপায়ে উঠে ফ্যান বন্ধ করে এলো। আবারো পূর্বের মতন বুকে মাথা পেতে ছোট্ট করে চুমু খেলো মাঝখানটায়। আনতারা ফের ডুঁকরে উঠলেন। মেয়েটা কম করে হলেও হাজারখানেক চুমু খেয়েছে।
মুনতাহা আদর করে বলল,”এ্যাই আব্বু? তোমার ঘুম তো এতো গাঢ় না। উঠো।”
মাহতাব সাহেব উঠলেন না। লাশ কি আর আবদার রাখতে পারে?
মুনতাহা আবার বলল,”তুমি না বলো নামাজ না পরলে আল্লাহ রাগ করে? উঠো না আব্বু। ওয়াক্ত পেরিয়ে যাচ্ছে। পরে কাজা হয়ে যাবে।”
আনতারা নির্বাক চেয়ে রইলেন। সাবিনা বেগম এককোঁণায় বসে চোখের জল মুছলেন গোপনে। মেয়েটার এবার কাঁদা দরকার। অনেকক্ষণ হলো চুপ করে আছে।
আজান শেষে মৃত্যু ঘোষনা হলো। একটি শোক সংবাদ, একটি শোক সংবাদ ধ্বনিতে চারপাশ নিঝুম ভোর আলোড়িত হতেই ঘরে প্রবেশ করলো আরশাদ। মসজিদে গিয়েছিলো। জানাজার কথা বলে এসেছে।
মুনতাহা মাথা তুলে মনোযোগ দিয়ে মাইকিং শুনছে। রক্তলাল নিষ্প্রাণ চোখদুটিতে আকাশছোঁয়া অবিশ্বাস। মাইকিং শেষ হলো। মুনতাহা আবার কান পাতলো বুকে। এই ঘোষনায় তার কিচ্ছু যায় আসে না। সে তো বাবার বুকেই আছে। এইতো বাবা। একটুপরেই উঠে যাবে। মাথায় হাত বুলিয়ে বলবে,”আহা! আম্মা? এত কাঁদে নাকি? আব্বু একটু ঘুমিয়েইছিলাম শুধু।”
আরশাদ ধীরপায়ে এগুলো। পদচারণে শব্দ নেই। আনতারার সাথে চোখাচোখি হলো একবার।
মুনতাহাকে সরানো যাচ্ছেনা কিছুতেই। বাবার বুক থেকে কিছুতেই সরবে না সে। আরশাদের সাথে একচোট চিল্লাচিল্লি করেছে। শেষমেষ তাকে না সরিয়েই তখন বেরিয়ে গিয়েছিলো আরশাদ।
আরশাদ কাছে গেলেও মুনতাহা মুখ তুলে তাকায়না।
আরশাদ মৃত চোখে দেখে সে পাশে দাড়ানো মাত্র মুনতাহা বুকের শার্ট মুচরে ধরেছে। কি করবে এই মেয়েকে নিয়ে? দিশেহারা লাগলো।
এ্যাম্বুলেন্স এসেছিলো। আরশাদ মানা করে দিলো যখন, মুনতাহা কান্না থামিয়ে ফ্যালফ্যাল করে চেয়ে ছিলো। মিনমিন করে বলছিল,”মানা করলেন কেনো?”
আরশাদ উওর দেয়নি।
সেই যে কান্না থামিয়েছে মুনতাহা এখন অবধি আর কাঁদেনি। একফোঁটা জল গড়ায়নি গাল বেয়ে।
লাশ বেশিক্ষণ রাখতে হয়না। দাফন করতে হবে। আরশাদ গোপনে দীর্ঘশ্বাস ফেলল।
–
ঘরভর্তি মানুষ কিলবিল করছে। মৃত পিতার লাশ আঁকড়ে কন্যার নিশ্চুপ নিরিবিলি শুয়ে থাকায় জল উপচেছে প্রতিটা চোখে। মুনতাহার চোখ বন্ধ। আনতারা ধীরগলায় ডাকল,”মা, উঠতে হবেতো।”
পাশ থেকে কে যেনো বলছে,”লাশ শক্ত হয়া যাইতাছে। গোসল আর কহন করাইবেন।”
মুনতাহা বুক থেকে মাথা তুললো। ক্ষিপ্ত চোখে তাকাল। সেকেন্ডের ব্যবধানে বাড়ি কাঁপিয়ে চিৎকার করে উঠল,”যান এখান থেকে। যান বলছি। মা, যেতে বলেন এদের। কেন এসেছে? বের হন।”
আনতারা পরিস্থিতি সামলানোর চেষ্টা করলেন। তাড়াহুড়ো করে ফোন করলেন আরশাদকে। আরশাদ রিসিভ করেই ব্যস্ত কন্ঠে বলল,
—“এইতো আসছি আম্মা, আসছি। মুনতাহা চিৎকার করলো মাত্র?”
ভোরের বাতাসে হেমলকের বিষ। মুনতাহার ফোঁলা চোখে ধোঁয়াটে অভিলাষ। বাবা চোখ মেলবে। অবশ্যই মেলবে। মেলতেই হবে যে।
আরশাদ ঢুকল। কবর খোড়া শেষ। কবরস্থান কাছাকাছিও নয়। বেশ দূরে। গোসল করিয়ে নিয়ে যেতে হবে। সকাল হয়েই গেছে। এতক্ষণ লাশ রাখা উচিত না।
মুনতাহা কেমন করে যেনো তাকায়। আরশাদের বুকটা মোচর দিয়ে উঠে। পারে না সে মৃত শরীরটায় জান দিয়ে দেয়। কিন্ত হায়! সে অপারগ! চরম অধম!
মুনতাহা চেয়েই আছে। কিছু কি বলতে চাচ্ছে মেয়েটা? আরশাদ বুঝতে পারেনা চোখের ভাষা। খুব এলোমেলো লাগে শব্দ গুলো, কথাগুলো। খুব অনর্থক আবদার।
কাছে যায়। হাঁটু ভেঙে ঝুঁকে মুনতাহারমাথার পাশে হাত রেখে বলে,”আপনি যত দেরি করবেন, আংকেলের কষ্ট ততোই বাড়বে।”
—“আমার কাছে থাকতে আব্বুর কিসের কষ্ট?”
আরশাদ উওর দেয়না। চেয়ে থাকে। মুনতাহা থরথর করে কেঁদে ফেলে। ঠোঁট কাঁপে। চোখে উপচে উঠে দলা পাকানো কান্না। বাবার ধরে রাখা হাতটা ছুটে যায়। মুনতাহা দু’হাতে জড়িয়ে ধরে আরশাদকে। ঘরভর্তি মানুষ আরশাদ বাঁধা দেয়না। বারণ করেনা। সরায়না। মুনতাহা হেঁচকি তুলে কাঁদে। শ্বাস আটকে চোখের পানি ফেলে। বুকের শার্ট খামছে ঝাঁকি দিয়ে বলে,”আপনি কেনো কিছু করলেন না? কেনো করলেন না? বলুন। কেনো করলেন না?”
আরশাদ পূর্বের মতোই নিশ্চুপ। উওর নেই। বড়ই অভাব মুখ ফোঁটা জবাবের। কি করবে সে? মুনতাহার কান্নাগুলো আগুনের লাভার মতো বুকে ক্ষত সৃষ্টি করে।
মুনতাহা হাহাকার করতে করতেই শরীর ছেড়ে দেয়। নি:স্ব-র ন্যায় ফ্লোরে বসে পড়ে। আরশাদও বসে যায় হাঁটু গেড়ে। মুনতাহা মাথা ঠেকায় তার বুকেই। সাদা শাড়ি পরিহিত বিক্ষিপ্ত দেহ। তার ঝলমলে চাঁদের আজ পুরোটাই অমানিশা।
আরশাদ চোখের ইশারা করে। ড্রইংরুমের কিছু লোক এগিয়ে আসে দ্রুত। মাহতাব সাহেবকে নিয়ে যাওয়া হয়। আরশাদ দেখে মাহতাব সাহেবের ডান হাতটা মুঠো হয়েই শক্ত হয়ে গেছে। মুনতাহা যেভাবে ধরেছিলো এতক্ষণ, ঠি ক সেভাবেই। আঙুলগুলো নিচের দিকে বাঁকানো। তালুর থেকে হাল্কা ফাঁক। শুধু আরেকটা হাতের অভাব সেই বন্ধনীতে। শেষ সময়েও বাবা তার মেয়ের হাতই ধরে রেখেছিলো।
গোসল শেষ হলো। একতলায় গোসল করানো হয়েছে। আরশাদ ওখানেই। মুনতাহা উপরে। বুঝিয়ে রেখে এসেছে। লাশ মোড়ানো হলো কাফনে। আরশাদ শেষবারের মতো দেখে নিল মুখটা। মানুষটা তাকে প্রচন্ড ভরসা করেছিলো। এত আদরের মেয়েকে সারাজীবনের জন্য তাকে দিয়ে দেয়ার আগে একবারও আপত্তি করেনি। আরশাদ হাতের পিঠে চোখ মুছে। মুখ ঢেকে দিল। ধুপধাপ পায়ের শব্দ। আরশাদ চকিতে পিছে ফিরে। মুনতাহা নেমে এসেছে। সফেদরঙা আচঁল ছুটে গেছে কাঁধ থেকে। নিচের দিকটা আছরাচ্ছে পায়ের কাছে।
চরম অবহেলায় ধুলো মাখা হচ্ছে মুক্ল কাপড়।
অথচ গতরাতে এ জা’গায়েই পরিপাটি হয়ে দাড়িয়ে ছিল মেয়েটা। বাবাকে দেখবে এগারো দিন পর। কি বাঁধভাঙা খুশি ছিলো চোখদুটিতে।
আর সকাল না পেরোতেই তার এহেন এলোমেলো আবেশ। চোখে সেই বাবাকেই শেষ বিদায় জানানোর আঁকুতি। পৃথিবী বড়ই অদ্ভুত! নিয়ম গুলো বড়ই দূর্বোধ্য
আরশাদ এগিয়ে গেলো। একপলক আশেপাশে দেখে আঁচলে ভাঁজ দিয়ে তুলে দিলো কাঁধে। গালে হাত রেখে বলল,”কি হয়েছে?”
—“আব্বুকে দেখবো।” মুনতাহার ছোট্ট উওর।
আরশাদ ফোঁস করে শ্বাস ফেলল। ঘাড় ঘুরিয়ে পেছনে তাকাল একবার। ছেলেমানুষে ভর্তি লাশের আশপাশ।
মুনতাহার মুখটা চুপসে গেলো নিমিষেই । উনি উওর দিচ্ছেননা কেনো? বাবাকে কি আর দেখাও যাবেনা? উনি কি মানা করে দিবে? মুনতাহা অনুনয় করে উঠল,”একটু দেখি? আর দেখবেনাতো।”
আরশাদ বুঝলো তার আশঙ্কা। সবাইকে বাইরে যেতে বলে জায়গা খালি করলো। আনতারা উপরের সিঁড়িতে দাড়িয়ে ছিলেন। মনে প্রশ্ন, মেয়েটার কে তারা আদৌ সামলাতে পারবে তো?
জায়গা খালি হলে সামনে থেকে সরে দাড়ালো আরশাদ। অঘোষিত অনুমতি পেয়েই ছুট লাগালো মুনতাহা।
তারপর? তারপর সেখান জুড়ে শুধুই হাহাকার, হাহাকার আর হাহাকার এবং হাহাকার। আরশাদ পাশেই দাড়িয়ে থাকে। মুনতাহা গলা ফাটিয়ে কাঁদলেও সে বিন্দুমাত্র বাঁধা দেয়না। মেয়েটার কাঁদা দরকার। সে ঠাঁই দাড়িয়ে রয়। কানে ভেসে আসে,”এটাই যেনো ওর শেষ কান্না হয়।”
মুনতাহা শান্ত হয়না। কাঁদতে কাঁদতে কেমন ঘোরে চলে যায়। চোখ বন্ধ অথচ মেয়েটা কাঁদছেই। নি:শ্বাস আটকে আসছে যেনো। আনতারা ভয়ার্ত কন্ঠে বলে,”বাবা, অসুস্থ হয়ে যাবে। এমনেই গায়ে জ্বর উঠেছে।”
আরশাদ দীর্ঘশ্বাস ফেলে। পাশে বসে মাথাটা সরায় লাশের বুক থেকে। হাত দুটো ধরে করে ছুটিয়ে নেয় কাফনের কাপড় থেকে। মুনতাহা বিরবির করছে,”আব্বু খুব নিষ্ঠুর হয়ে গেছে জানেন? আমি এত কাঁদলাম। এত ডাকলাম। তবু উঠলোনা।”কন্ঠে স্পষ্ট তীব্র অভিমান।
আরশাদ দু’হাতে উঠিয়ে দাড় করালো তাকে। মুনতাহা তখনও বিলাপ বকেই যাচ্ছে,”আব্বু নিষ্ঠুর হয়ে গেছে। খুব নিষ্ঠুর। আমার আব্বু এতো নিষ্ঠুর ছিলোনা।”
ঘরে তখন রাঙা সূর্যের আলো। একহাতে গাল চেপে হা করিয়ে আরেকহাতে হাই ডোজের ঘুমের ওষুধটা মুখে তুলে দিলো আরশাদ। মুনতাহা দূর্বল হাতে বাঁধা দেয়ার চেষ্টা করে। আরশাদ একহাতে তার হাতদুটো আটকে আরেকহাতে পানি খাইয়ে দিলো। মেয়েটা শান্ত হবেনা নয়তো। তার যেতে হবে। অনেক দেরি হয়ে গেছে।
কিছুক্ষণের ব্যবধানেই ঘুমিয়ে পড়লো মুনতাহা। আরশাদ বুক থেকে সরিয়ে বালিশে শুইয়ে দিলো। গায়ে চাদর টেনে দিয়ে আনতারাকে বলল,”আপাতত ঘুমিয়ে থাক আম্মা। এ ঘরে কাউকে আসতে দিওনা।”
আনতারা মাথা নাড়ালেন। আরশাদ বেরিয়ে গেলো শক্তপায়ে।
–
—“আংকেল স্ট্রোক করেছিলেন। খুব সম্ভবত নিজের ব্যাবসাবিষয়ক কারণে বেশ দুশ্চিন্তায় ছিলেন তিনি। ড্রয়ারে রাখা কাগজপত্রগুলো দেখে আপাতত এতটুকুই বুঝেছি। ব্যাংকের অনেকগুলো রিসিট আছে সেখানে। এ কয়দিনে মোটা অংকের টাকা তুলেছেন বেশ কবার। লস হয়েছিল ব্যাবসায়। সেগুলো ঘিরেই বোধহয় খুব বেশি দুশ্চিন্তা করেছেন। তাছাড়া উনার প্রেশারও আন্ডার কন্ট্রোল ছিলোনা। অতিরিক্ত প্রেশার উঠেই মাঝরাতে স্ট্রোক করেছেন। আর মস্তিষ্কের রক্তক্ষরণেই..”
এটুকু বলো থামলো আরশাদ। কন্ঠস্বরে মনে হলো কিছু একটা থামিয়ে দিয়েছে তাকে।
তার ঘরের দরজা খোলা। মুনতাহা ঘুমাচ্ছে তখনো। দুপুর গড়িয়ে বিকাল নেমেছে। মেয়েটার ঘুম ভাঙেনি। বেহুশের মতো ঘুমাচ্ছে। আরশাদ সোফা ছেড়ে উঠে দাড়ালো। মেয়েটার জন্য হলেও বাকি কথাটা সে কখনোই সামনে আসতে দিবে না।
~চলবে~