অলৌকিক
শেষ অংশ।
শুক্রবার বিকেলে রাকিব ভাই সহ মিলিদের বাড়িতে পৌঁছে গেলাম। দোতলা ছিমছাম একটা বাড়ি। দোতলা পুরোপুরি কমপ্লিট হয়নি। বাড়ির সামনে বেশ খানিকটা ফাঁকা জায়গা আছে। সেখানে একপাশে ছোট একটা ফুলের বাগান। আর ছড়িয়ে ছিটিয়ে দেয়ালের চারপাশ ধরে নানান রকম ফলের গাছ। দোতলা এখনো কমপ্লিট হয়নি। দুটো ঘরের কাঠামো তুলে রাখা হয়েছে।
আসার পথেই মিষ্টি কিনে এনেছি। সেগুলো একটা কমবয়সী মেয়ে এসে বাড়ির ভেতরে নিয়ে গেছে। বসার ঘরে মিলির বাবা আর বড় ভাই আছেন। আমাকে টুকটাক প্রশ্ন করলেন।
তা বাবাজি বাড়ি কোথায় আপনার?
জ্বী বরিশালে।
চাকরি যেন কোথায় করেন।
আমি কোম্পানির নাম বললাম।
এটার অফিস কোথায়?
গাজীপুরে।
বাবাজি যেন কি পাস দিছেন?
বি,এ পাস করেছি।
মাশাআল্লাহ।
বাড়িতে কে কে আছেন?
কাছের বলতে তেমন কেউ নাই। এক দূর সম্পর্কের মামা আছেন। দাদী আর চাচারা আছেন। খুব একটা যোগাযোগ নেই।
আচ্ছা।
কথাবার্তার এই পর্যায়ে মিলি ঢুকল শরবতের গ্লাস হাতে নিয়ে।
আসসালামুআলাইকুম।
রাকিব ভাই জোরে সালামের উত্তর দিলেন।
ওয়ালাইকুমুস সালাম।
মিলির কন্ঠস্বর ভীষণ মিষ্টি। যেন রিনিঝিনি করে কাঁচের চুড়ির আওয়াজ তুলছে।
আমি মুখ তুলে মিলির দিকে তাকালাম।
বড় করে ঘোমটা টানা। চেহারা দেখা যাচ্ছে না।
মিলির এক ভাবি ঢুকল পেছনে পেছনে। উনি মিলি বসার পর পেছন থেকে ঘোমটা একটু টেনে মুখটা বের করে দিলেন।
রাকিব ভাই বললেন,
মাশাআল্লাহ।
আমি হা হয়ে গেলাম।
এতো সুন্দর দেখতে কোনো মানুষ হয় নাকি!এই মেয়েকে আমার সাথে বিয়ে দেবে এনারা?
ভাবি বললেন,
আপনাদের কোনো প্রশ্ন থাকলে করতে পারেন।
রাকিব ভাই বললেন,
আপনার পুরো নামটা যেন কি?
মোছাঃ শাহরিন মিলি।
সুন্দর নাম।
রাকিব ভাই আমাকে বললেন,
ভাই কিছু জানতে চাইলে বলেন।
আমি রাকিব ভাইকে বললাম,
আমার তেমন কোনো প্রশ্ন নাই।
মিলি ওর ভাবির কানে কানে কি যেন বলল।
উনি বললেন,
আপনারা বরং নিজেরা একা কথা বলুন।
আমাকে ছাদে নিয়ে যাওয়া হলো। কিছুক্ষণ পরেই মিলি এলো।
আপনি ভালো আছেন?
জ্বি আলহামদুলিল্লাহ। আপনি?
আলহামদুলিল্লাহ।
আমার সম্পর্কে সবকিছু জানেনতো?
জ্বি শুনেছি।
আপনার বিয়েতে আপত্তি নেই?
নাহ। অতীত নিয়ে আমার কোনো আপত্তি নেই। তবে আপনি হয়তো আমার সম্পর্কে সবটা জানেন না। আমি খুব সাধারণ পরিবারের ছেলে। ছোটখাটো একটা চাকরি করি। গাজীপুরে একটা একরুমের বাসায় ভাড়া থাকি। আমার সম্পত্তি বলতে কিছু নাই,মানে জমিজমার কথা বলছি। আপনি বিয়েতে রাজীতো?
আমার আপত্তি নেই।
তাহলে দিনতারিখ ঠিক করে ফেলি?
জ্বি, বাবার সাথে কথা বলুন।
সাতদিনের মধ্যে মিলির সাথে আমার বিয়ে হয়ে গেলো। মিলিকে নিয়ে উঠলাম আমার একরুমের ছোট্ট বাসায়।
বাসর রাতে মিলি আমাকে বলল,
আপনি আমাকে বিয়ে করলেন, আপনার ভয় নাই?
কিসের ভয়।
এই যে আমার সাথে জ্বীন থাকে এটা জেনেও বিয়ে করলেন।
এসব জ্বীন ভুত কখনো মানুষের সাথে থাকে না। এসব আমি বিশ্বাস করি না।
হিহি।
হাসছেন কেনো, হাসির কিছু বলিনি।
আমার সাথে কিন্তু আসলেই জ্বীন আছে।
আচ্ছা ডাকুন আপনার জ্বীনকে। উনিও তো আমাদের সাথেই এ বাসাতে থাকবেন আজ থেকে। আমার সাথে আলাপ পরিচয় করিয়ে দেন।
আপনি বিশ্বাস করলেন না। কিন্তু সবাই বিশ্বাস করে।
এই পৃথিবীতে কোটি কোটি মানুষ। এক একজন একেকরকমের মতে বিশ্বাস রাখে। তাদের বিশ্বাস তো আর আমি বদলাতে পারবো না।
আমার আগের স্বামী কিন্তু বিয়ের পরদিন মারা গেছে।
শুনেছি।
কিভাবে মারা গেছে শুনবেন?
এসব কথা থাক। আপনি এখন ঘুমান। ক্লান্ত দেখাচ্ছে আপনাকে। ঘরটা ভীষণ এলোমেলো। একটাই ঘরতো। রান্না খাওয়া সব এখানে। আপনার কষ্ট হবে এভাবে থাকতে।
আমার কষ্ট হবে না। আমি গুছিয়ে ফেলব।
একটা কথা বলব?
জ্বি বলেন।
আপনি এতো সুন্দর, এতো সুন্দর কোনো মেয়ে আমাকে বিয়ে করতে রাজি হবে কখনো ভাবিনি।
মিলি আমার কাছে সরে এসে বলল,
আপনিও সুন্দর। এখন গলার হারটা খুলে দিনতো। এসব খুব ভারি লাগছে।
মিলি তার মাথায় দেয়া লাল ওড়না সরিয়ে আমার দিকে পেছন ফিরে বসল। আমি কাঁপা হাতে ওর গলারটা খুলতে চাইছি। কিছুতেই খুলছে না। মিলি খিলখিল শব্দে হাসছে। আমি সাহস করে ওর ঘাড়ে আমার ঠোঁট ছুঁয়ে দিলাম। ও আমার দিকে ফিরে আমাকে জড়িয়ে ধরে চোখ বন্ধ করে ফেলল।
মিলি আমার ছোট্ট এক রুমে খুব সুন্দর করে সংসার পাতলো। ঘরের একপাশে সুন্দর একটা কাপড় রাখার আলনা রাখল। আরেকপাশে ছোট একটা মিটসেফে রান্নার জিনিসপত্র গুছিয়ে রাখল। সাইড টেবিলে সুন্দর একটা ঘড়ি রেখেছে। ঘড়িটার নীচের দিকে একটা ছেলে একটা মেয়েকে পেছন থেকে জড়িয়ে আছে। খাটের পাশের টেবিলেটায় বেশ কিছু গল্পের বই রাখল। ওগুলো ও বাড়ি থেকেই নিয়ে এসেছে সাথে করে।
মেয়েটা দারুণ গোছানো। নিজেও পরিপাটি থাকে। ওকে দেখলে মনে হয় না ওর মধ্যে অশুভ কিছুর বাস আছে।
মিলির অস্বাভাবিকতা প্রথম ধরা পড়ল একদিন রাতে। আমি আর মিলি বসে আছি। হঠাৎ বিদ্যুৎ চলে গেলো। মিলি বলল,
মোমবাতি আছে?
হুম, আমি আনছি,তুমি বসে থাকো।
আমি উঠে গেলাম ম্যাচ আর মোম আনতে। হাতরে হাতরে এগোচ্ছি। হঠাৎ মিলি বলল,
বায়ে সরে যান। দরজা বা দিকে।
আমি একটু বা দিকে সরে এগোলাম। তারপর থমকে দাঁড়িয়ে পড়লাম। মিলি কিভাবে দেখছে সারা ঘরতো ঘুটঘুটে অন্ধকার।
তুমি আমাকে অন্ধকারে দেখতে পাচ্ছো ?
হুম,আমি অন্ধকারে দেখতে পাই।
ও মিথ্যা বলেনি। মিলি অন্ধকারে দেখতে পায়,অনায়াসে হাঁটা চলা করতে পারে। এমনকি তরকারি কাটা ,খাবার বাড়া এসব টুকটাক কাজ আলো ছাড়াই করে ফেলে। ও মাঝে মাঝেই অকারণে হিহি করে হাসে। একা একাই কথা বলে। আবার হঠাৎ হঠাৎ মন খারাপ করে থাকে।
যখন ওর মন খারাপ থাকে তখন আমার সাথে তেমন কথা বলে না। ওর চোখ ফোলা থাকে। আমি বুঝি ও লুকিয়ে কান্না করেছে।
যেই আমি এসব জ্বীন, ভুত, জাদুটোনা বিশ্বাস করতাম না সেই এখন মাঝে মাঝে ভাবি সত্যি কি মিলির সাথে খারাপ কিছু আছে?
একদিন কাজ শেষে বাসায় ফিরে দেখি ও অসময়ে শুয়ে আছে। আমি বুঝলাম ওর মন খারাপ। কারণ আমার সাথে কোনো কথা বলেনি। উঠে চুপচাপ খাবার বেড়ে দিয়েছে।
আমি বললাম,
তোমার মনখারাপ?
হুম।
আমাকে কারণটা বলা যায়?
আপনি তো বিশ্বাস করবেন না।
আচ্ছা বলো, বিশ্বাস করব।
মিলি আগ্রহ নিয়ে পা গুছিয়ে আরাম করে বসল। যেন কোনো মজার রুপকথার গল্প বলবে।
আমার না একটা অদ্ভুত ক্ষমতা আছে। আমি মাঝে মাঝে মানুষের অতীতের বিশেষ কোনো ঘটনা বলতে পারি।
কিভাবে পারো। তোমার সাথে থাকা জ্বীন বলে দেয়?
হি হি হি।
হাসো কেন?
আচ্ছা হাসবো না। শোনেন,জাফর লোকটা কিভাবে মারা গেলো বলি।
আমি আজ আর না করলাম না।
আচ্ছা বলো।
মিলি এমনভাবে বলছে যেন খুব স্বাভাবিক কোনো ঘটনা।
লোকটা বাসর রাতে ঘরে ঢুকেই দরজা বন্ধ করে সোজা এসে আমাকে জড়িয়ে ধরল। লোকটার মুখ থেকে একটা বাজে গন্ধ আসছে। হয়তো নেশা করেছে। আমার দমবন্ধ লাগতে শুরু করল। বলা নেই, কওয়া নেই এভাবে অচেনা কেউ জড়িয়ে ধরলে কেমন লাগে বলুন?
হুম, খারাপ লাগারই তো কথা।
হঠাৎ আমার মাথাটা ঝিমঝিম করে উঠল। আমি গরগর করে বললাম,মানে কেউ একজন বলিয়ে নিলো, জলজ্যান্ত মেয়েটাকে মেরে ফললেন,আর কেউ কিছু জানলো না।
লোকটা ছিটকে সরে গেল। চোখেমুখে ভয়ের ছাপ স্পষ্ট।
আমি বলেই গেলাম,
আপনি ওর পরিচিত। ওর সাথে বাজে কাজ করেছেন। ছেড়ে দিলে সবাইকে বলে দিতো তাইনা!
জাফর কাঁপা কাঁপা গলায় বলল,
কিসব উলটা পালটা বকতেছো।
সারারাত অত্যাচার করে তারপর গলা টিপে মেরে বস্তায় করে ভোররাতে সোজা নদীতে। লাশ কোথায় ভেসে চলে গেলো । কেউ কিছু টের পেলো না।
জাফর দাঁড়িয়ে টেবিলে রাখা জগ থেকে পানি ঢেলে খেলো। তারপর বিস্তারিত চোখে আমার দিকে তাকিয়ে থাকল। এতো বছর আগের ঘটনা আমি কিভাবে হরহর করে বলে দিচ্ছি তাই ভেবে ঘামতে শুরু করল। ভয়ার্ত কন্ঠে বলল,
আজকে আমাদের বাসররাত। আর তুমি ভয় দেখাইতেছো কেন?
আমি হি হি করে হেসে ফেললাম।
ঘটনাতো সত্য। সত্যি কিনা বলেন।
তোমার মাথায় গন্ডগোল আছে।
তারপর বাইরে চলে গেল। কিছুক্ষণ পর বাইরে হৈচৈ কান্নাকাটি। জাফর স্ট্রোক করেছে।
আমি দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললাম।
এসব বলে তুমি কি মজা পাও মিলি। জাফর লোকটার হয়তো প্রেশার হাই ছিল। বিয়ে বাড়ির টেনশন,রিচ ফুড খাওয়া,তার ওপর নেশা করা এসব কারণে স্ট্রোক করেছিল।
মিলি আহত চোখে তাকাল।
আপনি বিশ্বাস করেন নাই তাইতো।
হুম। আমাকে বলছ বলছ,আর কাউকে এসব বলবা না ঠিক আছে?
হুম।
মিলি আর ওসব বলেনি। কিন্তু আমি কিভাবে কিভাবে যেন এই বিষয়টা মাথা থেকে সরাতে পারলাম না। মিলিকে আমার একটু একটু ভয় লাগতে শুরু করল। ও যখন আমার চোখের দিকে তাকিয়ে কিছু খোঁজে আমার ভয় করে। আমি মনেপ্রাণে বলতে থাকি মিলি যেন আমার অতীত বলতে না পারে। ওকে আমি আর ভয় পেতে চাই না।
বিয়ের ছয়মাসের মাথায় সুখবর পেলাম। মিলি মা হতে চলেছে। খুশিতে আমার চোখে পানি চলে আসল। কেউ না থাকা আমার একজন রক্তের কেউ আসবে। আমার সন্তান। মিলির প্রতি আমার ভীষণ খেয়াল রাখতে হয়। ও খুব অনিয়ম করে। একা একা থাকতে খারাপ লাগে ওর।
একদিন আমার শশুর এসে মিলিকে নিয়ে গেলেন। এ সময় নাকি মেয়েদের মায়ের কাছে থাকতে হয়। নিয়মিত চেক আপ করাও হলো। ডাক্তার বললেন সবকিছু স্বাভাবিক আছে। কিন্তু মিলির ব্যথা উঠলো ডেটের দেড়মাস আগেই। প্রচন্ড ব্যথা হলো সারারাত। কিন্তু নরমাল ডেলিভারি হলো না। কিসব জটিলতা দেখা দিলো। শেষে ডাক্তার সিদ্ধান্ত নিলেন সিজার করার। অপারেশন থিয়েটারে ঢোকার আগে মিলি আমাকে ডেকে বলল,
আপনার কোনো দোষ নাই। বাচ্চাটা দৌড়ে আপনার বাইকের সামনে চলে আসছিল। আপনি নিজেকে অপরাধী ভাববেন না।
আমি কেঁপে উঠলাম। সেই কলেজ জীবনের ঘটনা। মামার বাইক নিয়ে বাজারে গেছি। মামির একটা ঔষধ গ্রামের ঔষধের দোকানে পাচ্ছিনা। তাই মামা তার বাইক দিয়ে উপজেলায় পাঠালেন। মামা দোকানে ব্যস্ত। ঔষধ নিয়ে ফেরার পথে বকখালির মোড়ে গাড়ি ঘুরিয়েছি মাত্র একটা পাঁচ বছরের বাচ্চা হুট করে দৌড় দিয়ে এসে পড়ল বাইকের সামনে। তারপর ছিটকে একপাশে পড়ে গেল। আমি ব্রেক কষে দাঁড়ালাম । বাচ্চাটাকে হাসপাতালে নিতে হবে। কিন্তু পেছনে ফিরতেই দেখলাম কিছু মানুষ হৈ করতে করতে ছুটে আসছে।
ধর ধর ধর,শালাকে পুঁতে ফেলব আজ।
খুব ভয় পেয়েছিলাম। জোরে বাইক টেনে চলে এসেছিলাম। পরে খবর পেয়েছি বাচ্চাটা মারা গেছে। আমি চুপ করে থাকলাম। কাউকে কিছু জানাইনি। কিন্তু সেই দহন আজো আমাকে তাড়া করে। কিন্তু এই কথা মিলি কিভাবে জানল!
একজন ইন্টার্ন ডাক্তার এসে জানালো রক্ত রেডি রাখতে। মা আর বাচ্চা দুইজনের কন্ডিশন ক্রিটিকাল।
সব চিন্তা ছেড়ে দিয়ে খোদাকে ডাকলাম।
খোদা আমার মিলির আর বাচ্চাটার যেন কিছু না হয়।
ডাক্তাররা চেষ্টা করল কিন্তু মিলিকে বাঁচাতে পারলো না। আমার কোলে ফুটফুটে এক কন্যা সন্তান আর কিছু অমিমাংসিত প্রশ্ন দিয়ে মিলি চলে গেলো ওপারে।
**
রুজাইফার বয়স এখন দশ চলে। আমাদের বাপ বেটির সংসার বেশ কেটে যাচ্ছে। রুজাইফা দেখতে ঠিক মিলির মতো হয়েছে। আমার মুখে ও ওর মায়ের গল্প শোনে। আমি যখন মিলির কথা বলি ওর চোখেমুখে একটা আলো ছড়িয়ে পড়ে। মাকে যেন ও দেখতে পাচ্ছে।
আমরা এখন নিজেদের বাড়িতে থাকি। চাকরি ছেড়ে দিয়েছি অনেক আগেই। রুজাইফাকে বড় করতে গিয়ে চাকরি করা হয়নি। ব্যবসা শুরু করেছিলাম। এখন নিজের দোকান আছে।
রুজাইফাকে ওর নানা নানী নিজেদের কাছে রাখতে চেয়েছিলেন কিন্তু ওকে ছাড়া আমি বাঁচব কিভাবে। তাই নিজেই ওকে লালনপালন করছি।
কয়দিন হয় আমাদের পাশের ফ্ল্যাটে নতুন এক পরিবার উঠেছে। সেখানে প্রায়দিন একটা বাচ্চা ছেলে চিৎকার করে কাঁদতে থাকে আর বলে,
আমাকে ছেড়ে দাও,আর মেরো না। আর ভুল করবো না।
খোঁজ নিয়ে জানলাম ছেলেটার নিজের মা নেই। চার পাঁচ বছর বয়স হবে। বাবা আবার বিয়ে করেছে। সৎমাটা ছেলেটাকে দুই চোখে দেখতে পারে না।
রোজ রোজ কান্না শুনি। ভীষণ মায়া হয়। একদিন বাইরে লোকটার দেখা পেয়ে বলেই ফেললাম,
এতটুকু একটা ছেলেকে আপনার ওয়াইফ এভাবে পেটায়,এটাতো ঠিক না।
লোকটা চটে উঠল,
আরে মশাই,এটা আমার পারিবারিক বিষয়। আপনি কথা বলার কে? মা ছেলেকে শাসন করে না! সৎ মা বলেই খারাপ লাগছে। নিজের মা হলে কেউ কিছু বলতো না।
আর কি বলব। মনখারাপ হয়ে গেল। আহারে বাচ্চা ছেলেটা।
একদিন বাজার করে ফিরছি। রুজাইফাও আছে। বাসায় ঢুকতে যাব। দেখলাম সিঁড়ির গোড়ায় ছেলেটা মলিন মুখে দাঁড়িয়ে আছে। রুজাইফাকে চকোলেট কিনে দিয়েছিলাম। ও ছেলেটাকে বলল,
চকোলেট খাবে?
উহু।
আরে নাও। কিছু হবে না। আমার ভাই থাকলে ওকেতো চকোলেটের ভাগ দিতাম।
ছেলেটা চকোলেট হাতে নিলো। ওর মুখটায় হাসি ফুটে উঠল। হঠাৎ ওর মা এসে হাত থেকে চকোলেট কেড়ে নিয়ে মারতে শুরু করল।
ফকির কোথাকার। এখন মানুষের থেকে চেয়ে খাওয়া শুরু করছিস। কি দেখাচ্ছিস, তোকে খেতে দেইনা।
আমি হতচকিত হয়ে গেলাম। তাকিয়ে দেখলাম রুজাইফা একপাশে সরে গিয়ে চোখ বড় বড় করে মহিলার দিকে তাকিয়ে আছে। ওর মাথার দুপাশের রগ ফুলে উঠেছে। তারপর অদ্ভুত একটা ঘটনা ঘটল। মহিলা হঠাৎ বুকে হাত দিয়ে বসে পড়ল। আর্তনাদ করতে থাকল,
উফ! মরে গেলাম। কেউ যেন কলিজাটা খামচে ধরেছে।
কিছু সময় পর রুজাইফার মুখ স্বাভাবিক হলো। ও হাসছে। আমি অবাক হয়ে দেখলাম ওকে এখন ঠিক মিলির মতো দেখতে লাগছে।
(সমাপ্ত)