#অসুখের_নাম_তুমি’
পর্ব নং– ১৬
লেখিকাঃ #সোনালী_আহমেদ
সূর্যের প্রখর তাপমাত্রায় গরম হয়ে উঠছে বাসা-বাড়ীর টিন-ছাদ। এত এত গরমের মধ্যেও বাড়ীভর্তী মানুষ। লোকজনে গিজগিজ করছে ঘরবাড়ী । চারদিকে শোকের মহল। কান্নাকাটির আওয়াজ দূর-দূরান্ত থেকে শুনা যাচ্ছে। ইতোমধ্যে সুমির মৃত্যুর সংবাদ ছড়িয়ে গিয়েছে চারদিকে। তাকে এক পলক দেখতেই এত মানুষের ভীড়। লোকজনের মুখে চলছে আফসোসের সুর। সুমির মৃত্যুর সংবাদ শুনলেই প্রত্যেকের মুখে অবিশ্বাসের তাক লেগে যায়। এ যেনো কোনো বিষ্ময় আর অবাক কান্ড। বিশ্বাস ই করতে চায় না কেউ। সাদা কাপড়ে মুড়িয়ে ঘরের মাঝখানেই শুইয়ে রাখা হয়েছে তাকে। মানুষজন আসলেই মুখের কাপড় টা উল্টিয়ে দেখানো হয়।
কি সুন্দর! সাদা গোলগাল মুখ। মৃত্যুর কোনো ছাপ তার মুখে পরিলক্ষিত হচ্ছে না। দেখতে সুস্থ স্বাভাবিক মানুষের মতো লাগছে। মনে হচ্ছে চোখ বন্ধ করে ঘুমিয়ে আছে,এক্ষুণি বোধ হয় চোখ খুলে ফেলবে। অথচ এমন কিছুই ঘটবে না।
জমিলার চোখ ফুলে ঢোল হয়ে গিয়েছে,সাথে হাত পা দুটোও। তবুও নাতনির কাছ থেকে সরছেন না। কেঁদে কেঁদে তিনি বলছেন,
‘ ও নাতিন, আমারে রেখে তুই চলে গেলি?তোরে ছাড়া আমি কীভাবে থাকবো রে?’
সুমির কোনো নড়চড় নেই। মরা মানুষ আবার নড়ে নাকি? জমিলার অবস্থা খারাপ হতে দেখে লোকজন তাকে সরিয়ে নিতে চাইছেন কিন্তু তিনি নড়ছেন না। সুমিকে ধরে তার কান্নার শেষ নেই। নাতিন যে তার বড় আদরের,কীভাবে সহ্য করবে আর কীভাবেই বা মেনে নিবেন?
লিনা অজ্ঞান হয়ে পড়ে আছে। এটা তার নাটক কি না তা কারো বোধগম্য হচ্ছে না। তবে সুমির মৃত্যুতে সে বেশ বড়সড় ধাক্কা খেয়েছে। এই মেয়ের কারণেই ছেলেকে হাতের মুঠোয় রাখতে সক্ষম হয়েছিলেন তিনি। সজিবকে সবসময় সুমির ভয় দেখিয়ে আঁচলে বেঁধে রেখেছেন। এবার কি হবে? সৌহার্দের অঢেল টাকা হাতিয়েছেন সুমির উছিলায়। কিন্তু এখন তো ডিম পাড়া হাস টা উড়াল দিলো, কীভাবে ভোগ করবেন টাকা আর সম্পত্তি।
এদিকে সজীব লা-পাত্তা। তার কোনো খবর নেই। সুমির মৃত্যুর সংবাদ শুনার পর তার আর খবর নেই।বাচ্চা নষ্ট হওয়ার পর প্রথমবারের মতো কিছু হারিয়েছে এমন অনুভূতি হয়েছিলো তার।হৃদয়ে শূন্যতা অনুভব করতো। ভেতর থেকে একদম ভেঙ্গে গিয়েছিলো। কিন্তু সুমিকে অধিক মাত্রায় ভেঙ্গে পড়তে দেখে নিজের টা প্রকাশ করলো না। খুবই স্বাভাবিক ভঙ্গিমায় চলাচল করেছে। বাচ্চা নষ্ট হওয়াটাকে তুচ্ছ ব্যাপারের মতো সুমির সামনে তুলে ধরেছে। যাতে সুমির ভেতরের হাহাকার টা একটু হলেও কমে আসে। কিন্তু আফসোস তা আর হলো কই? বরং তাকে রেখে বুকে এক আকাশ অভিমান পুষে ছেড়ে চলে গেলো। বুকের এক অংশে তীব্র হাহাকার অনুভব করছে সজীব। মা কে খুশি করতে কারণে অকারণে সুমির উপর অত্যাচার করেছে। সে কখনো ভাবে নি অত্যাচারের পাল্লা এত বেশি হবে যে তার বউ পৃথিবী ছেড়েই চলে যাবে। হাত পা ছুড়ে কাঁদছে সে। তার একেক টা গগন ভুলানো চিৎকারে আকাশ কেঁপে উঠছে। কিন্তু আফসোস এখন কেঁদে কোনো লাভ নেই। যে চলে যাবার সে তো চলে গিয়েছে। প্রায় মানুষজন সজীবের মতো। যখন থাকে তখন মূল্য দেয় না,যখন হারিয়ে ফেলে তখন সেটার জন্য আফসোস করে কেঁদে মরে।
এর অন্যতম একটি কারন হলো, লোকজন যখন ভালো কোনো জিনিস খুব সহজে পেয়ে যায়, তখন সেটা তাদের কাছে হয়ে যায় মূল্যহীন।তারা ভাবে এটা তো এমনিতেই পেয়ে গিয়েছি,এটাকে কেনো দাম দিবো! অথচ মূল্য না দিতে দিতে একসময় যখন জিনিস টা হারিয়ে ফেলে তখন সে জিনিসের মূল্য অনুভব করে। বুঝতে পারে জিনিস টা তাদের জীবনে কতটা প্রয়োজনীয় ছিলো। তখন বুঝে আর কোনো লাভ হয় না। তারা শূন্যতায় ভুগতে থাকে, এক বুক হতাশা নিয়ে কাটাতে হয় জীবন।
স্ত্রীর লাশ কাঁধে নিয়ে এলোমেলো পায়ে চলছে সজীব। তার হাত-পা নিশ্চল। এক কদম যেতেই ঢুলেঢালে যাচ্ছে সে। অনর্গল স্রোতের ধারা বইছে চোখ দিয়ে। পৃথিবীর সবচেয়ে বড় হতভাগা ব্যক্তি বোধ হয় সজীব। যে স্ত্রীর লাশ কাঁধে বয়ে নেওয়ার ভাগীদার হয়েছে। উন্মাদের মতো কত সময় যে সে কেঁদেছে তার হিসাব নেই। এক ঘরে এক রুমে দুজন মানুষ এত বছর থাকছে। তাদের প্রেম হওয়া তো অনিবার্য ছিলো। কিন্তু সজীব নিজেকে প্রেমিক পুরুষ বলে আক্ষায়িত করে না। সে জানে,পৃথিবীতে যদি নিকৃষ্ট স্বামী খোঁজা হয় তাহলে সর্বপ্রথম তার নাম আসবে। লিনা কে সম্পত্তির প্রলোভন টা সে ই দেখিয়েছিলো। যাতে সুমিকে বিয়ে করতে পারে। তার আকাঙ্ক্ষা ছিলো দিনশেষে যেনো সুমি তার কাছেই থাকে, তার দৃঢ় বিশ্বাস ও ছিলো থাকবে। কারন সুমির যে আর যাওয়ার কোনো জায়গা নেই। সে যত মারুক কাটুক, শেষে তার কাছে, তার ঘরেই থাকবে। কখনো ভাবে নি যে এ মেয়েটা কোনো একদিন টুপুস করে পৃথিবী ছেড়ে চলেও যেতে পারে।
যত কদম পা দিচ্ছে সে তত কদমে চোখের জল পড়ছে তার। বুক জ্বালা করছে, শরীর টলছে। নিঃশ্বাস আটকে আসছে। তার মনে হচ্ছে সে আর বাঁচবে না। কবরের উপর শেষ মুঠ মাটি সে দিলো। কাঁদতে কাঁদতে কবরের উপর শরীর ছেড়ে দিলো। শেষ হয়ে গেলো সুমির জীবনযাত্রা। রইলো না তার জীবনে আর কোনো অধ্যায়।
কেটে গেলো আরো কয়েকটি মাস। বদলে গেলো গুটি কতক মানুষের জীবন-ধারা। ধীরে ধীরে স্বভাবগতভাবেই অভ্যস্ত হয়ে উঠলো নতুন জীবনধারায়। চলতে লাগলো দিন। কাটতে লাগলো সময়।
——————————-
ডিসেম্বর মাস। শীতের মৌসুম চলছে। ঠান্ডা পড়া সবে শুর হয়েছে। তবুও কি নিদারুণ শীত লাগছে সৌহার্দের। গায়ে গরম কাপড়ের সাথে কম্বল জড়িয়ে বসেছে সে।অনেকদিন পর চিঠি লিখতে বসেছে । বিদেশে আসার অর্ধ বছর পেরিয়ে যাচ্ছে। এতগুলো সময় পেরিয়ে যাওয়ার পরেও কোনো কিছুতে মন বসাতে পারে নি সৌহার্দ। সবকিছুতেই সে বিরক্ত হতো,অস্থির হতো। কিছুই ভাল্লাগতো না। চোখের সামনে শুধু পরিবারের প্রতিচ্ছবি। রেশমির হাসিমাখা চেহারা। সারাক্ষণ তার মন ভীষণ অস্থির থাকে বাড়ী এবং দেশের জন্য। প্রত্যেককটা সময় কবে দেশে ফিরবে তার দিন গুণতে থাকে সে। আজ চিঠি লেখার কারণ টা বিশেষ।এর আগে একবার চিঠি পাঠিয়েছে,সাথে টাকা-পয়সাও। কিন্তু ফিরতি কোনো জবাব আসে নি। ভাগ্যের কি নিষ্ঠুর পরিহাস, সুমির মৃত্যুর চারদিনের দিন এই টাকা আর চিঠি পাঠিয়েছিলো। জবাব আসবে কীভাবে?কেউই তো জবাব দেওয়ার মতো অবস্থায় ছিলো না। সেসব তো আর সৌহার্দের জানা নেই। তাই আজ আবার চিঠি লিখবে রেশমিকে উৎসর্গ করে। তার মনে বাচ্চা বউটার জন্য অনেক কথা জমেছে।
বেশ কিছু সময় পরেও সাদা কাগজের উপর কালো বল পয়েন্টের কোনো দাগ দেখা গেলো না। কি লিখবে সেটাই মাথায় আসছে না তার। কলম চলছে না,মাথা টা কেমন ফাঁকা ফাঁকা। অনেক ভাবনা চিন্তার পর কলম তুললো সৌহার্দ। লিখতে লাগলো,
প্রিয় অসুখ,
শিরোনাম টুকু উচ্ছারণ করতেই হয়তো তোমার কপাল কুঁচকে গিয়েছে। ভাবছো তোমার নাম না লিখে অসুখ কেনো লিখলাম। এই প্রশ্নের জবাব দিতেই এই চিঠি টি।
এমন অসুখ কারো হয়েছে বলতে পারো? যে অসুখ কাউকে বাঁচতে দেয় না,খেতে দেয় না,এমনকি শুতেও দেয় না। সর্বক্ষণ শুধুই পীড়া দেয়। আজ অবধি না পেরেছে ডাক্তার না পেরেছে কবিরাজ, তবুও দেখিয়েছি সকল হসপিটাল। তুমিবিহীন এ অসুখের নেই কোনো ঔষধ -নেই কোনো ট্যাবলেট। এ অসুখের একমাত্র মেডিসিন যে তুমি। তাই তো সুস্থ হই নি আমি। অসুখে যে বড্ড অসুস্থ আমি, ‘অসুখের নাম তুমি’ । হ্যা অসুখের নাম তুমি। যার এক পলক চাহনির জন্য মরিয়া হয়ে আছি আমি। যাকে স্পর্শ করার জন্য দিনরাত ছটফট করছি আমি। কবে দেখবো তোমায়- কবে মিটবে আশা? কেনো এত খারাপ অসুখের নেশায় জড়িয়েছো আমায়। যার উত্তাপে দিনদিন জ্বলে পুড়ে ছারখার হচ্ছি। বৃষ্টি হয়ে নেমে নিভিয়ে দাও না এই আগুন। যাতে দু-দন্ড সময় শান্তিতে ঘুমাতে পারি। জানো, তোমার চিন্তায় কতশত রাত নির্ঘুম কাটে। চুপিচুপি এসে কপালের মধ্যভাগে অধর যুগল স্পর্শ করিয়ে ঘুম পাড়িয়ে দাও। যাতে বাকি সময় নিশ্চিন্তে কাটাতে পারি।
এই তুমি কি জানো?
তোমার নেশা কত ভয়ংকর।
জানো কি- এ নেশার কত অসীম ক্ষমতা?
ইতি,
তুমি নামক অসুখে আক্রান্ত ব্যক্তি।
সৌহার্দ আরো একটা চিঠি লিখলো। সেটা পারিবারিক। সেখানে দাদী,চাচী,বোন সাথে ছোট এক লাইনে রেশমির কথাও জিজ্ঞেস করলো। সে কীভাবে থাকছে তার বর্ণানাও দিলো। প্রথম চিঠি টা গোপনে যাতে রেশমির হাতে পৌঁছায় তার ও ব্যবস্থা করলো। এবারের টাকার সাথে আরো কয়েক টা নোট বেশি দিলো। সে নোটগুলো সুমির জন্য বরাদ্দ করে দিলো। সেগুলা দিয়ে সে যেনো ভালো ফলমূল আর শাক-সবজি খায়। বাচ্চা যেনো সম্পূর্ণভাবে সুস্থ থাকে সেটার বিশেষ সতর্ক বার্তাও বোনের জন্য লিখেছে। টাকা পাঠাতে দেরী হওয়ার জন্য ক্ষমাও চেয়ে নিয়েছে, সাথে উল্লেখ করলো,
‘ কাগজপত্রের মেয়াদ শেষ হয়ে যাওয়ায় গত মাসের টাকাগুলো লেগে গিয়েছে। তাই টাকা দিতে দেরী হয়েছে। তুই রাগ করিস নি তো?’
চলবে!