#অসুখের_নাম_তুমি (পর্ব-০৮)
#সোনালী_আহমেদ
রাতের খাবার বেশ জমজমাট হয়েছে। তাজা তাজা সবজি আর মাংস পরম তৃপ্তিতে খেয়েছে সবাই। ঘরে বড় টেবিল না থাকায়, মাটিতে পাটি বিছিয়ে খাবার দেওয়া হয়েছে সবাইকে। সৌহার্দকে নিচে বসতে বলার সময় প্রত্যেকে ভীষণ লজ্জা পেয়েছে। নতুন জামাইকে কীভাবে নিচে খেতে বলা যায়?
সৌহার্দ অবশ্য বিষয়টাকে সাধারণ ভাবেই নিয়েছে। সবার খাওয়া হলেও রেশমির খাওয়া হলো না। সৌহার্দের রুহানীর সাথে অতিরিক্ত মেলামেশা তার পছন্দ হয় নি। ভাত না খেতে পারলেও দুজনের মাঝখানে যেয়ে ঠিকই বসেছে সে। রুহানী তাকে বেশ কয়েকবার বলেছে না খেলে যেয়ে শুয়ে থাকতে। কিন্তু রেশমি নড়লো না,সে ঠাই বসে রইলো।
খাবার টেবিলেই রেশমির মা তাকে বলে ওঠে,
—‘হ্যা,রে রেশমি। তোর শশুড়বাড়ীতে কে কে থাকেন? ‘
—‘ উনাকে জিজ্ঞাস করুন।’
সৌহার্দ রেশমির ফুলে থাকার কারণ ধরতে পারলো না। সে বিনয়ের সাথে জবাব দেয়,
—‘জ্বি। আমি আমার বোন, আমার দাদী, আমার চাচা-চাচী। আর তিন চাচাতো ভাই বোন। বড় চাচাতো ভাইয়ের সাথে আমার বোনের বিয়ে হয়েছে। মেঝো চাচাতো বোন এবার স্কুল পাশ করবে।আর একটা ছোট চাচতো ভাই আছে। আমার মা-বাবা নেই। চাচা-চাচী ই আমাদের মা-বাবা।’
রাতে ঘুমানোর সময় হয়েছে আরেক সমস্যা। ঘরে মাত্র দুটো রুম। সবাই যার যার নিয়ম মাফিক জায়গাতেই ঘুমায়। কিন্তু এখন সৌহার্দকে তো আর নিচে দেওয়া যায় না। তাই রুজি তাদের রুম সৌহার্দ আর রেশমির জন্য ছেড়ে দেয়। সে আর তার স্বামী, রুহানীর রুমে নিচে মাটিতে পাটি বিছিয়ে ঘুমাবে।
সৌহার্দ অবশ্য প্রস্তাব টা শুনে তৎক্ষণাৎ না করে দেয়। সে বলে যে সে নিচে শুবে। কিন্তু রুজি তা মানতে নারাজ। জোর করে সে সৌহার্দকে তাদের রুমে দিয়ে আসে।
রেশমি ভারী অবাক হয়ে মামীর কান্ডে। তার মামী তো এ ধরনের মানুষ নয়। মেহমানকে দরকার পড়লে বাহিরে রাখবে তবুও সে বিছানা ছাড়বে না। রেশমি অনেক খুঁজে কারন বের করতে পারলো না। মামী হঠাৎ সৌহার্দের সাথে এত ভালো আচরণ কেনো করছে? কোথায় নিশ্চই স্বার্থ আছে। কারণ মানুষ স্বার্থ ছাড়া কিছুই করে না। কথা টা কেউ মানুক আর না মানুক এটাই বাস্তবতা।
গা ফুলিয়ে রুমে যায় রেশমি। সে কিছুতেই আসতে চায় নি। মায়ের পাশে ঘুমাবে সে। কাল মায়ের সাথে ঘুমাতে পারে নি। তার কত কষ্ট হয়েছিলো। সে মায়ের সাথে ঘুমাবে,রাতভর জেগে সারাদিনের সব গল্প বলবে।
ও বাড়ীতে কি কি হয়েছে কি কি দেখেছে সব বলবে। কিন্তু মা তো তাকে কঠিন আদেশের সুরে সৌহার্দের কাছে পাঠিয়ে দিয়েছে। সাথে এটাও বলে দিয়েছে যে সে যেনো কোনোদিন কোথাও স্বামী ছাড়া না ঘুমায়। রেশমি হু হা না করেই রাগে ফুলতে ফুলতে চলে আসে।
সৌহার্দের উপর সে রেগে আছে। ভীষণ রেগে আছে। সে কেনো রুহানীর সাথে এমন আলাপ করবে? এ তো অন্যায়! ঘোর অন্যায়। এর জন্য যদি সৌহার্দকে পুলিশ সারাবছর জেলে রাখে তাহলেও শাস্তি সম্পূর্ণ হবে না।
সৌহার্দ আগেই বিছানার এক পাশে শুয়ে ছিলো। রেশমিকে দেখে সে একটু নড়েচড়ে ঘুমালো। রেশমি রাগ দেখিয়ে বালিশ টা নিয়ে নিচে শুয়ে পড়লো। এ লোকের সাথে সে কিছুতেই ঘুমাবে না। নাহলে তার মনের রাগের রাজা কষ্ট পাবে। সে চায় রেশমি যাতে সৌহার্দ থেকে দূরে থাকুক। তাই রেশমিও দূরে থাকতে চাইলো।
রেশমির কান্ডে কোনো পরিবর্তন দেখা দিলো না সৌহার্দের মাঝে। সে বরং আরো একটু হাত পা ছড়িয়ে বিছানায় জায়গা জুড়ে নিলো।
সৌহার্দের কান্ড দেখে রেশমি আরো রেগে যায়। দুপদাপ বালিশ নিয়ে বিছানায় এনে শুয়ে পড়ে। সৌহার্দ কি ভেবেছে সে কি বোকা ? সে বিছানা না ঘুমালে যে সৌহার্দ খুশি হবে এটা কি সে বুঝে নাই? মনের ভেতর ভারী অভিমান নিয়ে কাত হয়ে চোখ বুঝে রেশমি।
কিছুক্ষণ বাদেই ফিসফিসানি কানে আসে।
কেউ গভীর নিঃশ্বাস ফেলে তার কানের কাছে বলছে,
–‘ আমি জানতাম না ওর নাম রুহানী। ওই বলেছে রুহা। আর ‘তুমি’ টাও ও নিজে জোর করেই ডেকেছে। আমি দুবার বারণ করেছে,ও শুনে নি।”
রেশমির ইচ্ছা করলো চোখ মেলে দেখবে। কিন্তু পারলো না। কারণ ততক্ষণে তার চোখে গভীর ঘুম নেমে এসেছিলো। সৌহার্দ চাঁদের স্নিগ্ধ আলোয় রেশমির ঘুমন্ত মুখ দেখলো। হালকা হেসে মাথায় হাত বুলিয়ে দিলো। সে জানে রেশমির মনের অভিমাণ তার প্রতি টানকে বুঝিয়ে দিচ্ছে। সে চাইলে তখনই বলতে পারতো,কিন্তু বলে নি। দেখতে চাইলো রেশমি কি করে। তার ধারনা ছিলো রেশমি নিশ্চই অন্য মেয়েদের মতো আড়ালে গিয়ে কাঁদবে কিন্তু মুখে কোনো টু শব্দ করবে না। কিন্তু কিছুক্ষণ বাদেই রেশমি তার ধারনা ভুল প্রমাণ করে দেয়।
সৌহার্দ হাসে। রেশমির হঠাৎ বড় বড় কথা,হঠাৎ বাচ্চামো তার খুব ভালো লাগছে। বহু দিন বাদে এ বাচ্চা মেয়েটা তার আবেগ গুলোকে এলোমেলো করে দিচ্ছে। সে কি এই টুকুনি মেয়ের উপর দূর্বল হয়ে পড়ছে?
ভোরের নতুন আলোর সাথে শুরু হয়ে রেশমির নব জীবনের আরেক নতুন সূচনা। পলকে পলকে সময়গুলো চলে যাচ্ছে। একটা সময় এমন আসবে যখন এই ফেলা সময়গুলোর কথা খুব মনে পড়বে। খুব ইচ্ছা করবে এই দিনগুলোতে ফিরে আসতে। খুব করে চাইবে এদিনে আবার উপস্থিত হয়ে নতুন করে শুরু করতে।
দুপুরের বেশ খানেক আগেই রওনা দেয় সৌহার্দ আর রেশমি। অবশ্য তাদের সাথে রুহানীও আসতে চেয়েছিলো। কিন্তু রেশমি সাথে সাথে না করে দেয়। সৌহার্দ পড়েছিলো মাইনকা চিপায়। না সে না করতে পারছিলো আর না হ্যা বলতে পারছিলো! রেশমি বেশ খানেক কাহিনী বানিয়ে রুহানীকে রেখে আসতে সক্ষম হয়েছে। আসার সময় সৌহার্দ তাদের হাতে কিছু টাকা দিয়ে এসেছিলো খরচ করার জন্য। রেশমির মামী –‘কি দরকার কি দরকার’ বলে টাকাগুলো ছোঁ মেরে নিয়ে নেয়। রেশমির মামীর কান্ডে মনে মনে বিরক্ত হয়। নিবেই যখন তাহলপ এত কাহিনীর কি দরকার?
বাড়ী আসার পথেই নানান ধরনের কথা বলছিলো রেশমি। সৌহার্দ গম্ভীর মুখে ছিলো,সে কোনো জবাব দেয় নি। রেশমি নিজের মতো বকবক করছিলো। বাড়ীর খুব কাছে আসতেই রেশমি প্রায় লাফিয়ে রাস্তার পাশের জমিতে নামছিলো। সৌহার্দ রেগে যায়। আশেপাশে কত মানুষ,তারা কীভাবে যে রেশমিকে দেখছে সেটা কি তার চোখে পড়ছে না।
রাগ সামলাতে না পেরে কঠিন ধমক দেয় রেশমিকে। গর্জনের মতো তার নাম ধরে ডেকে ওঠে,–‘রেশমি।’
হঠাৎ এত জোরে ধমক শুনে কেঁপে ওঠে রেশমি। যেখানে ছিলো সেখানেই দাড়িয়ে যায়। সৌহার্দ তার হাত চেপে রাস্তায় নিয়ে আসে। রেশমির হার্ট বিট জোরে জোরে আওয়াজ করতে লাগলো। সে ভয় পাচ্ছে, খুব ভয় পাচ্ছে। শক্ত করে সৌহার্দের হাত চেপে হাটতে লাগলো।
সৌহার্দ তার দিকে তাকাচ্ছেও না, সে খুব রেগে আছে।
রেশমি পুরো পথে আর কোনো কথা বললো না। সে সৌহার্দের উপর ভীষণ অভিমান করলো।ভীষণ! তার মন খারাপের সাথে আকাশ ও তাল মিলিয়ে ঝকঝক নীল আকাশ মুহূর্তেই ঘন কালো আধার করে ফেললো।
বাড়ীতে আসতেই আরেক নতুন চমক ঘটে গেলো। ঘরে এসে পৌঁছাতেই দেখে সুমি মাটিতে পড়ে আছে। আশেপাশে কাউকে দেখা যাচ্ছে না।
দৃশ্য টি সৌহার্দের বুকে গিয়ে লাগলো। তার শরীর চলছে না। কোনোরকম নিজেকে সামলে সুমির কাছে গিয়ে পৌঁছালো সে। সুমি কে ডাকতে ডাকতে চোখে জল চলে আসলো সৌহার্দের। এক মাত্র বোন তার। মা বাবা চলে যাওয়ার পর কোলে-পিঠে মানুষ করেছে তাকে। বোনের মুখের দিকে তাকিয়ে হাজারবার মরতে গিয়েও মরতে পারে নি সে। একমাত্র বোন। তার কিছু হলে সৌহার্দ বাঁচবে না, কিছুতেই না।
সব হারিয়ে বোন ই রয়েছে তার জীবনে। এ বোন ছাড়া আর মূল্যবান কোনো কিছুই তার জীবনে নেই। কোনোদিন বাঁচবে পারবে না সে।
‘সুমি’ বলে চিৎকার দিয়ে ডেকে ওঠে সৌহার্দ। তার চিৎকার শুনে সঙ্গে সঙ্গে নিচে নেমে আসে লিনা, জমিলা, সূচনা। বাড়ীতে কোনো পুরুষ মানুষ নেই।
কোনোরকম টলমল পায়ে সুমিকে নিয়ে হাসপাতালে পৌঁছায় সৌহার্দ। সৌহার্দের কষ্ট দেখে রেশমির চোখ ছলছল করে ওঠে। কিন্তু এমন কেনো হলো? সৌহার্দের কষ্ট কেনো রেশমি সহ্য করতে পারছে না।তার কেনো খারাপ লাগছে? এসব ভেবেই অস্থির হয়ে পড়লো রেশমি।
চলবে!
** উপন্যাস তো বড়ই হবে। যারা অধৈর্য্য হয়ে পড়ছেন তারা শেষ হওয়া অবধি অপেক্ষা করুন। শেষ হলেই পড়ে নিয়েন। অন্যরকম মন্তব্য করে দয়া করে আমাকে বিভ্রান্ত করবেন না। দায়বদ্ধতা নিয়েই পর্বটা লিখলাম, আপনাদের মতামত আশা করছি।