আঁধারের_গায়ে_গায়ে
তমসা_চক্রবর্তী
পর্ব-১১
।।২৮।।
সূর্য সেভাবে এখনো চোখ মেলতে পারেনি।গতকাল গভীর রাত পর্যন্ত মায়ের সাথে মিসেস সেনের ডায়েরি আর তদন্তের বর্তমান এবং আগামী গতিপ্রকৃতি নিয়ে আলোচনা করছিল মিলি। অদ্ভুত এক জটিল কেস।যখনই মনে হচ্ছে সুত্রগুলো একে একে মিলিয়ে মিলিয়ে কেসের প্রায় শেষ পর্যায়ে এসে পড়েছি,ঠিক তখনই কিছু না কিছু নতুন তথ্য এসে পুরো হিসেব গুলিয়ে দিচ্ছে।যদিও কাল রাত দুটো নাগাদ অরণ্য ফোনে জানিয়েছে, কার্তিককে বাইক চুরির চেষ্টায় হাতে না হাতে ধরা হয়েছে।ইন্টারোগেট করা হচ্ছে।এইসব নানানরকম ভাবনা চিন্তার মাঝে কাল সারারাত আর সেভাবে ঘুম হয়নি মিলির। শেষরাতে চোখটা একটু লেগে এসেছিল। কিন্তু মোবাইলের সুরেলা রিংটোনে কাঁচা ঘুমটা ভেঙে গেল মিলির।অতি কষ্টে চোখ দুটো খুলে বিছানা হাতড়ে মোবাইলটার ওপর ঝুঁকে পড়ল মিলি।ল্যান্ডলাইন নম্বর, লালবাজার থেকে। উজান ফোন করছে। ঘুমজড়ানো গলায় উত্তর দেয় মিলি।
-” বলো”!
-“জেরায় কার্তিক স্বীকার করেছে, শহরের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে নতুন নতুন গাড়ি আর বাইক উঠিয়ে পরে সেইসব গাড়ির ভোল পাল্টে বিক্রি করাটাই ওর আসল পেশা।গ্যারেজটা শুধুই একটা দেখনদারি”! ক্লান্ত গলায় মিলিকে খবরটা দেয় উজান।
আবার একটা হাই তুলে মিলি প্রশ্ন করল,
-“ওকে। কিন্তু ও সেদিন অত রাতে হিমাংশু রায়ের সাথে দেখা করতে কেন গিয়েছিল! সে ব্যাপারে কিছু বলেছে”!
-” বলেছে। চুরির গাড়ি পাচারের সাথে যুক্ত বেশ কিছু লোক নাকি হিমাংশু রায়ের পরিচিত ছিল। হিমাংশু রায় নাকি কমিশনের পরিবর্তে কার্তিকের সাথে সেইসব লোকের যোগাযোগ করিয়ে দিত।এর বেশি ও নাকি হিমাংশু রায় সম্পর্কে কিছুই জানে না। অরণ্য আর ইন্সপেক্টর মজুমদার অনেকভাবে চেষ্টা করেছে পেট থেকে কথা বের করার। বাট টিল নাউ নো রেজাল্ট”!
উজানের কথাগুলো শুনে ঘুমটা উড়ে গেল মিলির।হালকা করে জানলার পর্দাটা সরিয়ে দেখল, বাইরে ঝিরিঝির করে বৃষ্টি হচ্ছে।
-“কার্তিক মিথ্যে বলছে উজান।শুধু হিমাংশু রায় নয় শুভেন্দু সেনের সম্পর্কেও ও অনেক কিছু জানে।আজকের মধ্যেই ওর পেট থেকে কথাগুলো বেরোনোটা খুব জরুরি উজান।নচেৎ সোমবার, মানে কাল কোর্টে তুললে কিন্তু তোমরা ওর কাস্টডি পাবে না।তোমাদের কেস ধোপে টিকবে না”!
-“তাহলে এখন উপায়”!
উজানের ক্লান্ত গলায় করা প্রশ্নে মিলি বলে,
-“আমি আধাঘন্টার মধ্যে সার্ভে পার্ক পৌঁছে যাচ্ছি। তুমিও চলে এসো।তারপর দেখছি”!
।।২৯।।
-“আমি আচ্ছা আচ্ছা অপরাধীকে দেখেছি ম্যাডাম,যারা ইন্টারোগেশন রুমে ভয়ে কুঁকড়ে থাকে, টেনশনের চোটে অসংলগ্ন কথাবার্তা বলে ফেলে। কিন্তু কার্তিক মাঝির কেসে তো পুরো উল্টো।লোকটা অতিরিক্ত ধুরন্ধর। একের পর এক বাইক আর গাড়ি চুরির করেও যেভাবে পুলিশের নাকের তলায় বহাল তবিয়তে ঘুরে বেড়াচ্ছিল, আমি বলছি ম্যাডাম,এ মালকে বাগে আনা কিন্তু খুব একটা সহজ হবে না”!
কার্তিক মাঝির ইন্টারোগেশনে সেরকম ফলপ্রসূ সুবিধা করতে না পেরে সাব ইন্সপেক্টর অভিজিৎ মজুমদারের গলা থেকে আক্ষেপ চুঁইয়ে পড়ল।
-“তুই বিশ্বাস করবি না মিলি,কি প্রচন্ড ঠান্ডা মাথায় সব প্রশ্নের জবাব দিচ্ছে। সবথেকে বড় কথা, বাইক চুরির কথাটা কি অবলীলায় স্বীকার করে নিল। আমাদের বিন্দুমাত্র এফর্ট দিতে হয়নি। কিন্তু তারপর থেকেই আর কোনো উত্তর নেই”!
অরণ্যের কপালেও চিন্তার ভাঁজ।
-“বাইক বা গাড়ি চুরি এবং চোরাই গাড়ি স্মাগলিংয়ের শাস্তি মাত্র কয়েক বছরের জেল মিস্টার মজুমদার। কিন্তু খুনের শাস্তি যে ফাঁসি বা যাবজ্জীবন হতে পারে এটা কার্তিক মাথায় বসিয়ে নিয়েছে।তাই হিমাংশু রায়ের সম্পর্কে ভুলভাল কথা বলে আপনাদের বিভ্রান্ত করছে”!
চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়াল মিলি।
-“যদি আপনাদের কোনো সমস্যা না থাকে তাহলে আমি একবার কার্তিকের সাথে কথা বলতে চাই।একলা”।
মিলির এমন অদ্ভুত দাবিতে উজান, অরণ্য আর ইন্সপেক্টর মজুমদার নিজেদের মধ্যে মুহুর্ত খানেক মুখ চাওয়া চাওয়ি করে বলে,
-“অ্যাজ পার ল’ আমর কাছে কিন্তু তোমাকে অনুমতি দেওয়ার অথোরিটি নেই মিলি।লেট মি স্পিক টু প্রধান স্যার”!
।।৩০।।
-“আমাকে চিনতে পারছেন তো কার্তিক বাবু”!
খোলা চুলের গোছা কপাল থেকে কানের পাশে সরিয়ে নিতে নিতে প্রশ্নটা করল মিলি।অপলকে কয়েক মূহুর্ত মিলির দিকে তাকিয়ে থাকার পর কার্তিকের সরু গোঁফের নিচে সুক্ষ হাসির রেখা সুস্পষ্ট হল।
-“সেন পাবলিকেশনের অফিসে দেখেছি আপনাকে”। সতর্কভাবে জবাব দেয় কার্তিক।
-“আচ্ছা কার্তিক বাবু, গত পরশু আপনি ঠিক কি কারণে হিমাংশু বাবুর সাথে দেখা করতে গিয়েছিলেন”!
টেবিলের উপর থাকা রাইটিং প্যাডে হিজিবিজি কাটতে কাটতে প্রশ্নটা করল মিলি। স্বচ্ছ কাচের দরজার ওপারে তিনজোড়া চোখ ইন্টারোগেশন রুমে মিলির দিকেই নিবদ্ধ।
-“আর কতবার বলবো বলুন তো ম্যাডাম! চুরির গাড়ি বিক্রি করি।কম দামে সেই সব গাড়ি কেনার জন্য হিমাংশু রায় আমাকে বেশ কিছু কাস্টমার জোগাড় করে দিতেন।এবারেও একটা পার্টির কথা বলেছিল।তাই সেদিন রাতে ওনার সাথে দেখা করে সব ফাইনাল করে আসতে গিয়েছিলাম”!
-“বেশ।তা এখনো পর্যন্ত এরকম কত’জন কাস্টমারের খোঁজ আপনি হিমাংশু রায়ের থেকে পেয়েছেন”!
হিমাংশু রায় প্রসঙ্গে এহেন অপ্রত্যাশিত প্রশ্নের সম্মুখীন হতে স্বাভাবিকভাবেই হতচকিত হয়ে গেল কার্তিক।যদিও পরমুহূর্তেই নিজেকে সামলে বলে উঠলো,
-“ওই তিন চারজন কাস্টমার দিয়েছিলেন”!
-“কাস্টমারদের নাম ঠিকানা রাখেন? নাকি চুরির মাল বেচতে গেলে ওসবের দরকার পড়ে না”!
-“ওসবের মধ্যে আমরা বিশেষ যাই না ম্যাডাম।সে চুরির গাড়ি কিনতে এসেছে আমি বেচতে এসেছি।ওসব ঠিকানায় আমাদের কি কাজ”!!
মুখে মেকি ব্যাঙ্গের হাসি ঝুলিয়ে প্রশ্ন করলেও মিলিকে বেশ সাবধানী হয়ে উত্তর দেয় কার্তিক।
-“তা আপনি যে চুরির গাড়ি বিক্রি করেন সেটা কি মাইক নিয়ে প্রচার করে বেড়ান নাকি মশাই”!
-“মা.…মানে”!
-“মানে আপনি যে চোরাই গাড়ি স্মাগলিং করেন, সেটা হিমাংশু রায় কিভাবে জানলেন! আপনি বলেছিলেন!নাকি উনি অন্য কোথা থেকে জানতে পেরেছিলেন”!!
উত্তর দিতে কালঘাম ছুটে গেল কার্তিকের। কোনমতে তোতলাতে তোতলাতে বলে,
-“ঠিক মনে নেই।অনেক লোকজনের সাথেই তো লেনদেন হয়,তাই মনে পড়ছে না”!
-“আচ্ছা বেশ,তা এবারে কি গাড়ি বিক্রি করতেন!হন্ডা সিটি নাকি আই টয়েন্টি”!!
কার্তিককে চমকে উঠতে দেখে মিলি মৃদু হেসে আঁকিবুঁকি কাটতে কাটতেই বলে,
-“কি হলো বলুন,এবার হিমাংশু রায়ের দেওয়া কাস্টমারকে কি গাড়ি বেচতেন!হন্ডা সিটি নাকি আই টয়েন্টি!ওই দুটো গাড়িই তো এখন আপনার গ্যারেজে পড়ে আছে,তাই জিজ্ঞেস করছি”!
মিলির একেরপর এক প্রশ্নে স্বভাবজাত সতর্কতা বজায় রেখেই উত্তর দিতে থাকা কার্তিক ধীরে ধীরে রীতিমতো বেসামাল হয়ে পড়তে থাকে।কোনমতে নিজেকে একটু গুছিয়ে নিয়ে উত্তর দেয়,
-“দুটোই।আসলে উনি বলেছিলেন, দুটো কাস্টমার আছে।তাই তড়িঘড়ি দেখা করতে গিয়েছিলাম ওনার সাথে”!
ক্রমাগত কাগজে আঁচড় কাটতে থাকা মিলির হাতের পেনটা থেমে গেল। অপরাধীর যুক্তিতর্কের জলসায় যে কাঙ্খিত ছিদ্রের দেখা পাওয়া মাত্রই বিন্দুমাত্র কালবিলম্ব না করে কালসর্পের মতো ঢুকে পড়তে হয়,সেই ছিদ্র মিলি পেয়ে গেছে। মাথা তুলে এতক্ষন পর কার্তিক মাঝির চোখে চোখ রাখল মিলি। ঠোঁটে খুব সুক্ষ হাসি টেনে জিজ্ঞেস করল,
-“যে গাড়িটা চুরিই হলো না সেটা নিয়ে ডিল করতে অত রাতে একজন ভদ্রলোকের বাড়ি চলে গেলেন কার্তিক বাবু!একটু বাড়াবাড়ি হয়ে গেল না”!
-“মানে!কি বলতে চাইছেন কি আপনি”! গলার কাছে জমে থাকা থুতুটা গিলে নিলেও মনের গোপন অলিন্দে চলতে থাকা উত্তেজনা লুকিয়ে ফেলতে পারল না কার্তিক।ওর গলার কম্পনে ভয়ের ছাপ স্পষ্ট।
-“বাহ্! শের ই কলকাতা থেকে FZS বাইকটা ঘটনার দিন চুরি করলেন, তারপর সেটা নিয়েই তো গিয়েছিলেন সেনবাড়িতে! সেখানে হিমাংশু বাবুর সাথে কথাবার্তা সেরে ফেরার পথেই তো নতুন আই টয়েন্টি খানা দেখে বাইক ছেড়ে সেটা নিয়ে চম্পট দিলেন।এত তাড়াতাড়ি সব ভুলে গেলে কি করে চলবে বলুন তো!”
আশ্চর্যরকম শান্ত গলায় মিলি কথাগুলো বললেও উত্তেজিত হয়ে উঠতে থাকে কার্তিক।যদিও সে নিজের সপক্ষে যুক্তি খাড়া করতে গেলে মিলি বেশ রুক্ষ কন্ঠে ধমক দিয়ে থামিয়ে দেয় তাকে।
-“সিসিটিভি ফুটেজ আছে।তাই অস্বীকার করার চেষ্টা করে কোনো লাভ নেই। এবার বলুন তো, গাড়ির ডিল করতে তো সেদিন আপনি হিমাংশু রায়ের বাড়ি যাননি!তাহলে কেন গিয়েছিলেন!ব্ল্যাকমেইল করতে”!
নিজের অনুমান প্রমানের খাতিরে মিথ্যে কথাটাও সমান আত্মবিশ্বাসের সাথে বলল মিলি। এবং প্রত্যাশিতভাবেই কোনো সদুত্তর পাওয়া গেল না কার্তিকের থেকে।বদলে কপালে ফুটে উঠল বিন্দু বিন্দু ঘাম।ফ্যাকাশে চোখ মুখে ভয়ের ছাপ এখন সুস্পষ্ট।
-“আর যে চুপ থেকে কোনো লাভ নেই কার্তিক বাবু। হিমাংশু বাবু যে যথেষ্ট বিচক্ষন মানুষ ছিলেন।তাই সেদিন বুদ্ধি করে, আপনার সাথে হওয়া পুরো কথোপকথনটাই উনি নিজের ফোনে রেকর্ড করে রেখেছিলেন কার্তিক বাবু। আপনি যে সেদিন ওনার থেকে বড় অঙ্কের টাকা দাবি করেছিলেন সেটা কিন্তু এখন আমি জানি। কিন্তু আপনি হয়ত জানেন না, আপনার করা মানসিক অত্যাচার সহ্য করতে না পারার কারণেই সেদিন ওনার হার্ট অ্যাটাকটা হয়েছে।তাই ওনার মতো একজন বিশিষ্ট ভদ্রলোকের সম্পর্কে মিথ্যে অপপ্রচার চালানো এবং হত্যা করার অপরাধে শাস্তি যে আপনাকে পেতেই হবে। “!
-“ভদ্রলোক! – গলার স্বর যথাসম্ভব খাদে নামিয়ে এনে হিসহিসিয়ে নিজের সর্বশক্তি দিয়ে টেবিলের ওপর একটা ঘুঁষি মেরে উঠে দাঁড়ালো কার্তিক।
-“আস্ত শয়তান!হিমাংশু রায় একটা আস্ত শয়তান!মাদা***, ঠান্ডা মাথায় দু দুটো খুন করে ফেলল। বেঁচে থাকলে আরও একটা করত। আর তাকে আপনারা ভদ্রলোক বলছেন”!!
কার্তিকের চোখে ফুটে উঠল সহস্র আক্রোশের বিন্দু। সেদিকে তাকিয়ে মিলির মুখেও ফুটে উঠল এক চিলতে হাসি।দৃষ্টি কাঁচের দরজার অন্যপ্রান্তে।ছোট্ট এই ঘরের আলো আঁধারিতে চলতে থাকা প্রতিটা শব্দের আনাগোনা নিপুণ দক্ষতায় দরজার ওপারে লিপিবদ্ধ করে চলেছে অরণ্য।
#ক্রমশ
/*কমেন্ট বক্সে আগের পর্বগুলির লিংক শেয়ার করা আছে*/
© আমার ভিনদেশী তারা-amar bhindeshi tara-কলমে তমসা চক্রবর্তী
#AmarBhindeshiTara
#TamosaChakraborty
# ভালো লাগলে লেখিকার নাম সহ শেয়ার করবেন 🙏।