আঁধারের_গায়ে_গায়ে
তমসা_চক্রবর্তী
পর্ব-৫
।।১৪।।
-“নতুন অধ্যায়ই বটে।বিয়ে হয়ে সেন বাড়িতে আসার কিছুদিন পর থেকেই সৌমিলি এইবাড়িতে শ্বশুরের দাপট আর শাশুড়ির অবস্থান দুটোই খুব ভালো করে উপলব্ধি করতে শুরু করে। এমনকি সৃঞ্জয়ের ওপর শুভেন্দুদার প্রভাব সৌমিলিকে দিনদিন বড়ই উদ্বিগ্ন করে তুলছিল। কিন্তু সেও বড় বুদ্ধিমতি আর বিচক্ষন মেয়ে ছিল।কি করে করেছিল,কি করেছিল জানা নেই জানেন, কিন্তু বিয়ের কয়েকমাস পর থেকেই সৃঞ্জয়কে মাঝেমাঝেই নিজের মায়ের ঘরে দেখা যেত। প্রায়ই অফিস থেকে তাড়াতাড়ি ফিরে সে বৌ আর মায়ের সাথে বিকেলের চায়ের আসরে যোগ দিতে শুরু করে।ছেলের চারিত্রিক পরিবর্তন ধীরে ধীরে শুভেন্দুদার নজরে আসলেও আসল ব্যাপারটা কিন্তু উনি সমঝে উঠতে পারেননি।তাই সৃঞ্জয়ও সবদিক দিব্যি সামল দিয়ে চলছিল। কিন্তু শেষ রক্ষা আর হল না, বুঝলেন। একদিন বিকেলে হঠাৎই তাড়াতাড়ি বাড়ি ফিরে আসায় ছেলের হাটে হাঁড়ি ভেঙে গেল। সেদিন বাড়ি ঢোকার পরই দিদির ঘর থেকে খুব পরিচিত স্বরে হাসি ঠাট্টার আওয়াজ পেয়ে অতি সন্তর্পনে সে ঘরে প্রবেশ করেন শুভেন্দুদা।আর ঘরে ঢুকেই চক্ষু চড়কগাছ!
সৃঞ্জয় মায়ের পায়ের কাছে বসে দিব্যি বাবাকে নকল করে চলেছে আর তাই দেখে দিদি আর সৌমিলি হেসে লুটোপুটি খাচ্ছে। কিন্তু আড্ডার ছন্দপতন ঘটল অকস্মাৎ শুভেন্দুদাকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে।ওনাকে অসময়ে বাড়িতে দেখে সৃঞ্জয় আর দিদির মুখের হাসি শুকিয়ে গেলেও সৌমিলি খুব স্বাভাবিক ছিল।সে এগিয়ে এসে সেদিন বলেছিল,’ভালোই হল, আপনারা তাড়াতাড়ি ফিরে এসেছেন।আজ সবাই মিলে গল্প করা যাবে। আপনারা বসুন আমি চা নিয়ে আসছি’।সৌমিলির কথায় শুভেন্দুদার বুঝতে অসুবিধা হয় না যে এটা তাদের রোজকার রুটিন।মনে মনে বিরক্ত হলেও সেদিন মুখে কিন্তু কিচ্ছুটি প্রকাশ করেননি উনি”।
প্রিয়নাথ সাহা এবার একটু থেমে মিলির দিকে তাকালেন।
-“কিছু জিজ্ঞাস্য আছে নাকি”!!
-“হ্যাঁ, মানে..”!!
-“আরে এত ইতস্তত করার দরকার নেই!! তোমার মুখ দেখেই বোঝা যাচ্ছে কিছু একটা বলবে”!!
এবার সামান্য হাসলো মিলি।
-“জিজ্ঞাস্য মানে, সৌমিলি ম্যাডামের ওই ‘আপনারা’ টার্মটা”!!
-“আই মাস্ট অ্যাপ্রিসিয়েট।তোমার পর্যবেক্ষন সত্যি বেশ ভাল। আসলে শুভেন্দুদার সেক্রেটারিই বল,রাইট হ্যান্ডই বল সে সময় এই অধমই ছিল”!!
নিজেকে দেখিয়ে কথাগুলো বললেন প্রিয়নাথ সাহা।
-“তাই ভাবছিলাম, আপনি প্রত্যেকটা ঘটনার এত পুঙ্খানুপুঙ্খ বিবরণ কিভাবে দিয়ে চলেছেন।সরি টু ইন্টারাপ্ট ইউ স্যার।প্লিজ কন্টিনিউ করুন”!!
।।১৫।।
-“স্যার, বাইক মালিকের খবর পাওয়া গেছে। কিন্তু কেস তো পুরো ঘেঁটে ঘ”!!
অতুৎসাহী অরণ্য, সেন বাড়ির বৈঠকখানায় ঢুকেই উজানকে রিপোর্ট করতে শুরু করলে প্রিয়নাথ সাহা গোল গোল চোখে অবাক হয়ে প্রশ্ন করলেন,
-“বাইক!!কোন বাইক!এই কেসে আবার বাইক এল কোথা থেকে”!!
-“ওই লতায় পাতায় জড়িয়ে আছে আর কি। চিন্তা করবেন না, আমরা দেখছি”!!
এরপরেই মিলি অরণ্যকে ঘুরিয়ে প্রশ্ন করে,
-“বাইকটা চুরি হয়েছিল তো”!!
-“হ্যাঁ, মানে তুই কি করে..”!!
আমতা আমতা করতে থাকে অরণ্য।
-“কয়েকদিন আগে আসলে পেপারে এই নিয়ে বেশ কয়েকটা খবর বেরিয়েছিল।উল্টোডাঙা আর আশেপাশের চত্বর থেকে বেশ কিছু নতুন বাইক চুরি হওয়া শুরু হয়েছিল। কিন্তু পুলিশি তৎপরতায় তারমধ্যে বেশিরভাগ বাইকই উদ্ধার করা গেছে। তবে এই কেসের একটা অন্য টুইস্টও আছে বুঝলি। সেটা এখনও আনসলভড”!!
-“কিরকম টুইস্ট ম্যাডাম”!! প্রশ্ন করলেন ভুবন তালুকদার।
-“যে বাইকগুলো উদ্ধার করা গেছে, সেগুলো প্রায় বেশিরভাগই কোনো না কোনো ধাবা বা বারের আশেপাশে পরিত্যক্ত অবস্থায় পাওয়া গেছে। কিন্তু অদ্ভুতভাবে সেই সবকটা বাইক উদ্ধার করতে গিয়ে পুলিশের কাছে একটা করে নতুন গাড়ি চুরির কেস নথিভুক্ত হয়েছে। এবং এই নতুন কেসেগুলোর প্রায় প্রতিটা গাড়িই উদ্ধার হওয়া বাইকগুলোর থেকে অনেক বেশি দামি।যেমন, ইয়ামাহার ওই বাইকটার থেকে আজকের চুরি যাওয়া আই টয়েন্টি খানা অনেক দামি।অ্যান্ড নো ওয়ান্ডার, প্রথম চুরি যাওয়া বাইকগুলো উদ্ধার হলেও পরের একটি গাড়িরও কিন্তু খোঁজ পাওয়া যায়নি”!!
-“মানেটা কি! একটা চোর প্রথমে খুঁজে খুঁজে একটা বাইক চুরি করে চম্পট দেয়। কিন্তু তারপরেই রাস্তায় আরেকটা দামী গাড়ি দেখে তার মনে হল,’এই কম দামি বাইক কোনো কম্মের নয়, তারথেকে বরং ওই দামি গাড়িটা দিয়েই নিজের কাজ সম্পন্ন করি।ইজ ইট অ্যা জোক অর সামথিং এলস”!!
উজানের বিরক্ত মুখটা একঝলক দেখে নিয়ে মুচকি হাসল মিলি।
-“তুমি যতই বিরক্ত হও না কেন, কেসটা কিন্তু অনেকটাই এরকম”!!
-“কি সাংঘাতিক চোররে বাবা!!এলাকায় এরকম মাল দু তিন পিস থাকলে তো পুলিশের নাভিশ্বাস উঠবে”!!
ভুবন তালুকদারের চিন্তার আগুনে আরেকটু ঘৃতাহুতি করল মিলি।
-“দু তিনটের দরকার পড়বে না ভুবন বাবু।এই একটাকে সামলাতেই কিন্তু বিধাননগর কমিশনারেট হিমশিম খাচ্ছে”!!
-“আচ্ছা আপনারা আমাকে একটু খুলে বলবেন, হিমাংশুর মৃত্যুর সাথে এই বাইক চুরির কি সম্পর্ক”!!
প্রিয়নাথ সাহার প্রশ্নের জবাবে ভুবন তালুকদার কিছু বলতে উদ্যত হলে, মিলি চোখের ইশারায় উজানকে ব্যাপারটা এখানেই থামিয়ে দিতে বলে।
-“এখনও সম্পর্কটা আমরা ঠিকমতো এস্টাব্লিস করে উঠতে পারিনি মিস্টার সাহা।ব্যাপারটা এখনও তদন্তাধীন। তবে কিছু জানতে পারলেই আপনাকে জানাব”!!
কথার মাঝেই আরও একবার চোখাচোখি হল মিলি আর উজানের।
-“আচ্ছা ঋক, এই বাইকটা কোথা থেকে চুরি হয়েছিল রে”!!
-“বাইপাস থেকে। কিন্তু আরও একটা অদ্ভুত ব্যাপার কি জানিস,কুশল সিনহা মানে বাইকের মালিক কিন্তু এই পাশের পাড়াতেই থাকে”!!
-“হোয়াট..ভুবন বাবু আমার মনে হয় এই কুশলকে ইমিডিয়েটলি ইন্টারোগেট করাটা খুব দরকার। আপনি আর অরণ্য বরং ছেলেটির বাড়িতে একবার ঢুঁ মেরে আসুন।ততক্ষন আমি আর মিলি প্রিয়নাথ বাবুর সাথে কথাবার্তাটা শেষ করে নিই”!!
।।১৬।।
-“আপনাকে বারবার শুধু ইন্টারাপ্ট করছি স্যার।প্লিজ কিছু মনে করবেন না।আপনি বাকিটা বলুন স্যার”!!
এতক্ষন ধরে পুলিশের মুখে বাইক চুরির বৃত্তান্ত শুনতে শুনতে খানিকটা হতবাক হয়ে পড়েছিলেন প্রিয়নাথ সাহা। তাই খানিকটা সময় নিয়ে নিজেকে একটু ধাতস্থ করে আবার শুরু করলেন।
-“যা বলছিলাম।সেদিনে ওই চায়ের আসরে শুভেন্দুদা কিছু না বলায় বাড়ির বিভিন্ন অনুষ্ঠানে এমনকি বাড়ির বাইরেও শুরু হয় দিদির অবাধ বিচরণ। এরমধ্যেই সৃঞ্জয় আর সৌমিলি নতুন অতিথির আগমন বার্তা শোনানোয় দিদির খুশির আর সীমা থাকল না। কিন্তু ওই যে বলেছিলাম, ‘কপালে না থাকলে ঘি, ঠকঠকালে হবে কি’!ন’মাস পর সৌমিলির কোল আলো করে জন্ম নিল আমাদের রাইমা। নাতনির আগমনে দিদি আনন্দে আটখানা হলেও শুভেন্দুদা যে একেবারেই খুশি হননি তা আর সেদিন আলাদা করে কাউকে বোঝানোর প্রয়োজন পড়েনি।
কালের নিয়মে সেন বাড়িতে রাইমাকে নিয়ে সবার আনন্দে সময় কাটাতে থাকলেও শুভেন্দুদার মনে শান্তি ছিল না। সৃঞ্জয়কে হাজার বোঝানো সত্ত্বেও সে দ্বিতীয় সন্তানের কথা কানেও তুলছিল না। একদিন এই বিষয়ে নরম গরম কথাবার্তার মধ্যেই হঠাৎ করে সৃঞ্জয় বলে বসে,
‘ডাক্তার বলেছেন, পুনরায় সন্তানধারণে সৌমিলির প্রাণ সংশয় হতে পারে বাবা’!!
‘তাতে কি’!!
বাবার এই নিষ্ঠুর রূপ সেদিন সৃঞ্জয়কে বিস্মিত করলেও প্রথমবার বাবার বিরুদ্ধে গর্জে ওঠার সাহসও যুগিয়েছিল বটে। বাবার মুখের ওপর প্রথমবার সে বলে,
‘সৌমিলি আমার অর্ধাঙ্গিনী বাবা, আমার জীবনসঙ্গী। আপনি যেভাবে মাকে সারাজীবন বংশবৃদ্ধি করার মেশিন বানিয়ে রেখে দিয়েছিলেন আমি তা কিছুতেই করব না।আমি আজীবন সৌমিলির সুখে দুঃখে তার পাশে থাকব”!!
সেদিনের পর থেকেই কেমন যেন গুম মেরে গিয়েছিলেন শুভেন্দুদা।হয়ত ছেলের থেকে কস্মিনকালেও এই ব্যবহারটা উনি আশা করেননি।বা ধীরে ধীরে যে সংসারে উনি ক্রমশ কোনঠাসা হয়ে পড়ছিলেন,সেটা উপলব্ধি করতে পারছিলেন।
কিন্তু ঠিক যখন সবাই ভাবতে শুরু করেছিল এবার মনে হয় সবকিছু ঠিক হতে আরম্ভ করেছে,ঠিক তখনই, ওই ঘটনার মাস ছয়েকের মাথাতেই দার্জিলিং থেকে ফেরার পথে এক ভয়ঙ্কর পথ দুর্ঘটনায় মৃত্যু হয় সৃঞ্জয় আর সৌমিলির। সাংঘাতিক আহত অবস্থায় পুলিশ উদ্ধার করে রাইমাকে। সেদিনের কথা ভাবলে আমি আজও শিউরে উঠি জানেন।সদ্য পুত্রহারা বাবার কান্নায় সেদিন গোটা কলকাতা শহর কেঁদে উঠলেও একজন কিন্তু এক ফোঁটাও চোখের জল ফেলেনি”!
-“অনুসূয়া দেবী”!!
একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে মিলির কথায় সম্মতি জানালেন প্রিয়নাথ সাহা।
-“হ্যাঁ। আমাদের কারুর হাহাকারে বিন্দুমাত্র কর্ণপাত না করে দিদি তখন নিজেকে সঁপে দিয়েছিল রাইমার সুস্থতায়।দিনরাত এক করে পড়ে থেকেছিল হাসপাতালে।প্রায় একমাস জমে মানুষে টানাটানির পর রাইমাকে বিপদমুক্ত ঘোষণা করে হাসপাতাল থেকে। কিন্তু খারাপ সময় কি আর এত সহজে পিছন ছাড়ে! অ্যাক্সিডেন্টে দৃষ্টিশক্তি হারানোয় রাইমার জীবনটা চিরদিনের মতো অন্ধকারেই তলিয়ে গেল “!!
বেশ খানিকটা আবেগপ্রবণ হয়ে পড়েছিলেন প্রিয়নাথ সাহা। উজান ওনাকে ধাতস্থ হওয়ার কিছুটা সময় দিয়ে প্রশ্ন করল,
-“এটা তাও কত বছর আগের ঘটনা স্যার”!!
-“তাও প্রায় বছর ষোলো হয়ে গেল। রাইমা তখন মাত্র আট বছরের”!!
-“তারপর”!!
-“তারপর আর কি!তারপর থেকে এই বাড়ির খোলনলচে পাল্টে যেতে থাকল। হাসপাতাল থেকে রাইমা যেদিন প্রথম বাড়ি ফিরল, শুভেন্দুদা ওকে সাহায্য করতে গিয়েছিল জানেন। কিন্তু সেই প্রথম দিদি শুভেন্দুদার বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াল।সেই প্রথমবার গর্জে উঠেছিল অনুসূয়া সেন।
‘খবরদার, কেউ ওকে কোনোরকম সাহায্য করবে না’!!
আমি, শুভেন্দুদা, আমার বাবা, প্রত্যেকেই প্রচন্ড বিস্মিত হয়েছিলাম। আমার বাবা খানিক ধমক দেওয়ার চেষ্টা করেছিলেন,
‘তুই কি পাগল হলি অনু!ওকে না ধরলে যে ও পড়ে যাবে’!
কিন্তু দিদি সেদিন নিজের কথায় অনড় ছিল।
‘পড়ুক।ওকে বুঝতে হবে যে দৃষ্টিহীন হলেই কেউ পরজীবী হয়ে যায়না। আমরা কেউ সারাজীবন ওর সাথে থাকব না।তাই ওকে স্বনির্ভর হতেই হবে।’!
দিদির এই কাঠিণ্য সেদিন আমাদের সবাইকে পিছু হটতে বাধ্য করেছিল।আর সেই দিন থেকেই শুরু হল অনুসূয়া সেন আর রাইমা সেনের বেঁচে থাকার এক অদম্য লড়াই। দিদি, শুভেন্দুদাকে নিজের প্রভাব খাটিয়ে স্পেশাল স্কুলের পরিবর্তে রাইমাকে তার পুরাতন স্কুলেই রাখতে বাধ্য করেছিল জানেন। গোটা স্কুল এমনকি শুভেন্দুদাও দিদির এই পাগলামোতে সেদিন বিদ্রূপ করেছিল। কিন্তু সময়ের সাথে সাথে রাইমা নিজের চেষ্টায় ওদের প্রত্যেককে চুপ করিয়ে দিয়েছিল।কোন এক মন্ত্রবলে জীবনের একের পর এক পরীক্ষায় সফল হতে থাকে রাইমা। এইভাবেই রাইমা সসম্মানে স্কুল পেরিয়ে কলেজের গন্ডি পার করলে দিদি হঠাৎই শুভেন্দুদার কাছে এক অদ্ভুত দাবি জানিয়ে বসে।দিদির সেই অদ্ভুত দাবিতে শুধু শুভেন্দুদাই নয় আমরা সবাই যারপরনাই বিস্মিত হয়েছিলাম জানেন। কিন্তু ওই যে বললাম, রাইমার বিষয়ে দিদি ছিল ভীষন রকরমের জেদি”!!
-“কিরকম দাবি”!!
#ক্রমশ