আঁধারে ঢাকা ভোর পর্ব-১১

0
1515

#আঁধারে_ঢাকা_ভোর
#এগারো
প্রজ্ঞা জামান দৃঢ়তা

খুব চমৎকার ভাবে আভার ভার্সিটি জীবনের দিনগুলো কাটতে লাগল। ক্লাস শুরু হওয়ার পর সে পড়াশোনায় ব্যস্ত হয়ে পড়ে। এর মাঝেই একটা মেয়েকে রুমমেট হিসেবে পেয়ে গেল। মেয়েটার নাম অন্তরা। আভার সাথে বেশ ভালো সম্পর্ক গড়ে উঠেছে তার। অন্তরা বাসায় উঠতেই শফিক সাহেব বাড়িতে ফিরে গেলেন। যাওয়ার সময় তাকে হাত খরচ ও যাতায়াতের খরচ হিসেবে কিছু টাকা দিয়ে যান।

আভা তখন তাকে বলেছিল, “বাবা আমি চাই দুই একটা টিউশনি করতে। এখানে থাকা খরচ, বই কেনা, প্রাইভেট সবমিলিয়ে অনেক টাকা আসবে প্রতি মাসে। আমি চাই হাত খরচ বা অন্য টুকটাক খরচ গুলোর জন্য টিউশনি করে আয় করি। বাবা আমি জানি তুমি সব দিবে, তবুও আমি কিছু করা আগে থেকেই শিখতে চাই। আমাকে কী তুমি এই অনুমতিটা দিবে বাবা?”

প্রথমে তিনি না করলেন, পরে দেখলেন মেয়ের সাথে পেরে উঠছেন না। তাছাড়া আত্মনির্ভরশীল হওয়ার পক্ষে তিনি বরাবরই মেয়েকে সাপোর্ট করে গেছেন। তাই এবারও অমত করলেন না। তবে মেয়েকে দিয়ে প্রতিজ্ঞা করিয়ে নিলেন যখনই টাকার প্রয়োজন পড়বে, তখনই যেন তাকে জানায়। আভাও বাবার কথায় সায় দিল।

দুই মাসের ভেতর একটা টিউশনিও পেয়ে গেল। তাই সব মিলিয়ে ব্যস্ত সময় যাচ্ছে তার। কিন্তু সমস্যা হলো ক্লাসে কিছু সংখ্যক মেয়ে তাকে নিয়ে হাসাহাসি করে। মানুষের এমন ব্যবহারের সাথে সে অনেক আগে থেকেই পরিচিত। তাই এসবকে সে পাত্তা দেয় না। এতদিনে সে এটা বুঝে গেছে মানুষের জীবন সহজ নয়, আর তার মতো মেয়েদের তো আরও নয়। সব প্রতিকূলতাকে পেছনে রেখে একটু একটু করে সময় কেটে যাচ্ছে।

একদিন ক্যাম্পাসে বসে ফারহা সহ ক্লাস টেস্টের নোট করছিল, এমন সময় সেই প্রথম দিনের মেয়েদের দলটা তাদের পাশাপাশি এসে বসে। আভা যেন শুনতে পায় এমনভাবে টিপ্পনী কেটে নানা কথা কটুক্তি করে যায় অনবরত। সে প্রথমে সেদিকে পাত্তা না দিয়ে নিজের নোটে মনোযোগ দেয়।

কিন্তু পরে যখন শুনতে পেল একটা মেয়ে বলছে, ” এই চেহেরা নিয়ে ‘ল’ পড়তে এসেছে! মুখটা দেখো কেমন বিচ্ছিরি দেখতে!” এবার আর আভার কেন যেন সহ্য হলো না।

সে উঠে তাদের কাছে গিয়ে কঠিন গলায় বলল, “শুধু মাত্র গায়ের চামড়া ফর্সা হলেই যে মানুষ, আর কালো হলে সে মানুষ না, সে জীবনে ভালো কিছু করতে পারবে না! এমনটা কেন ভাবো তোমরা? খুব দুঃখের সাথে বলতে হচ্ছে যে তোমরা পুথিঁগত শিক্ষার জোরে এখান পর্যন্ত আসলেও, তোমাদের ভেতরটা আমার গায়ের রঙটার চেয়েও অন্ধকার। প্রকৃত শিক্ষা বলতে যা বুঝায় তোমাদের মাঝে তার ছিটেফোঁটাও নেই।”

একটু দম নিয়ে আবার সে বলল, ” শুধু বই মুখস্থ করলেই হয় না। সুন্দর মনের প্রয়োজন হয়, যেটা কিনা তোমাদের নেই। আগে নিজেদের উপরের খোলসের মতো ভেতরটাকে সাদা করো। তারপর দেখবে অন্যকে নিয়ে কটুক্তি করার রুচিই হবে না। আমি এখানে এসেছি পর্যন্ত তোমরা এসব বলে যাচ্ছো আমি কিছু বলিনি। আজও বলতাম না, কিন্তু তোমরা এমন শুধু আমার সাথে না, ভবিষ্যতে অন্যদের সাথেও করবে। আজকের পর থেকে যাতে মানুষকে মানুষ হিসেবেই দেখো। সে জন্যই বলা। মানুষকে গায়ের রঙ দিয়ে বিচার করো না। আমি দুঃখিত এই কথাগুলো না বলে পারলাম না।”

কথাগুলো শেষ করেই সে এক মিনিটও দাঁড়াল না হনহনিয়ে চলে গেল ক্যাম্পাস থেকে। পেছন থেকে মেয়েগুলো আবার খারাপ কথা বলা শুরু করে দিয়েছে। তার কানে কয়েকটি কথা গেলেও সে কিছুই বলল না।

অন্যদিকে তাদের থেকে খানিকটা দূরত্বে দাঁড়িয়ে সবটা দেখল তুষার। তুষার এখানেই মাস্টার্স করছে। ফোনে কথা বলতে বলতে বন্ধুদের থেকে একটু আলাদা হয়ে এসেছে এদিকটায়। হঠাৎ আভার কথার শব্দে সে পেছনে ফিরতে বাধ্য হলো। এর আগে আভাকে সে দেখেছে ফারহার সাথে। সেদিনও সে আভার কন্ঠস্বর শুনে থমকে দাঁড়িয়ে গিয়েছিল। কেন সে জানে না! শুধু জানে মেয়েটার কন্ঠস্বরে এমন কিছু একটা আছে যা তাকে থমকে যেতে বাধ্য করে। আজ কাছ থেকেই দেখল কথা বলার ভঙ্গিটা। এত কঠিন কঠিন কথা সে বলেছে অথচ গলায় ছিল শীতলতা! চোখে ছিল কঠোরতা, তার বলার ধরণে ছিল দৃঢ়তা। আর ঠোঁটের প্রান্তিক কোণে মৃদু হাসি। সবকিছু মিলিয়ে অসাধারণ লাগল তার কাছে!
★★

কয়েকদিন পর আভা ও ফারহা বই কিনতে লাইব্রেরীতে এসেছে। তাদের থেকে কিছুটা দূরে দাঁড়িয়ে আছে তুষার, সেও বন্ধুদের সাথে এসেছে এখানে। সে ফারহাদের খেয়াল করলেও তারা করেনি। দূর থেকে দাঁড়িয়ে দুজনকে দেখছে সে। সেদিন আভাকে দেখে তার স্ট্রং মেয়ে বলে মনে হয়েছে। সে দেখল আভা দুইটা বই হাতে নিয়ে নাড়াচাড়া করে আবার রেখে দিয়েছে। একটু আড়ালে এসে ব্যাগ দেখে গিয়ে ফারহাকে জানায় সে আজকে বই নিবে না। পরে এসে নিয়ে যাবে। তার কাছে যে টাকা নেই, সেটা ফারহাকে বুঝতে দিল না। তুষার পুরো সময়টা তাকিয়ে ছিল বলে কোনোকিছুই তার নজর এড়াল না।

সে ফারহাকে কল দিয়ে বলল, “আমি তোর পেছনের দোকানে আছি তুই একটু এদিকে আয় তো। ”

কল কেটে ফারহা এলে তুষার তাকে কিছু টাকা দিয়ে বলে, “তোর বান্ধবী বোধহয় টাকার জন্য বই নিতে পারছে না। এই টাকা তোর বলে ধার দে, সে যখন পারবে তোকে দিতে বলিস।”

ফারহা ভাইয়ের দিকে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে চেয়ে হেসে টাকাটা নিয়ে চলে আসে। আভার রেখে দেয়া বইগুলো নিজেই নিয়ে টাকা পেইড করে দেয়। আভা তাকে টেনে আলাদা করে নিয়ে এসে বলে, ” তুই কেন দুটো করে বই নিচ্ছিস?”

“একটা করে আমার, আর একটা করে তোর। আমি টাকাটা তোকে ধার দিচ্ছি। যখন তুই টিউশনির বেতন পাবি দিয়ে দিবি।” ফারহা খুব কঠিন হওয়ার ভান করে কথাগুলো বলল।

আভা কী যেন বলতে যাচ্ছিল তার আগেই তাকে থামিয়ে দিয়ে ফারহা বলল, “ও ম্যাডাম আপনাকে আমি একেবারে টাকা দিচ্ছি না, ধার দিয়েছি। তাই বেশি কথা বলবেন না।”

তার কথা বলার ঢঙ দেখে আভা আর কিছু বলল না। এমন সময় তুষার তাদের দিকে আসলো। ফারহা আভাকে দেখিয়ে বলল, “ভাইয়া আমার বান্ধবী ‘অরনী আভা।’

আভা উনি হচ্ছেন আমার ভাইয়া ‘মেহেরাব তুষার’ আমাদের ভার্সিটিতে মাস্টার্সে পড়ে। আগামী বছর পাশ করে বেরিয়ে যাবে।”

আভা বিস্ফারিত চোখে তাকাল তার দিকে। তার এক মিনিটও লাগল না তাকে চিনতে। ভাবল ট্রেনে দেখা হওয়া সেই ছেলেটা ফারহার ভাই! নিজেকে সামলে সৌজন্যতার সাথে কুশলাদি বিনিময় করল। তুষার এমনভাবে কথা বলল, মনে হয় তাকে চিনেনি। পড়াশোনা নিয়ে কিছুটা সময় কথা বলে বিদায় নিয়ে একসাথে বাসায় ফিরবে বলে ঠিক হলো। ফারহা তখন আবদার করে বসল ফুচকা খাবে।

তুষার হেসে বলল, “চল খাওয়াব।”

আভা বাদ সাধল সে বাসায় চলে যাবে বলে জানাল। কিন্তু ফারহা তো ছাড়ার পাত্রী নয়। তাই তাকে অগত্যা থাকতেই হলো। সামনে রেস্টুরেন্টে তুষার তাদের নিয়ে ঢুকল। ফুচকা অর্ডার করে পড়াশোনা নিয়ে কথা চলল।

তুষার কথা বলতে বলতে খেয়াল করলো আভা মেয়েটার মাঝে একটা চার্ম আছে যা সহসা মেয়েদের মাঝে দেখা যায় না। কথা বলার স্টাইলটাও একটু ভিন্ন। সাধরণের ভেতর কেমন অসাধারণ। কথা বলে সাবলীল কিন্তু ধরণ ধারালো। সেই প্রথম দিনের মতো অদ্ভুত সুন্দর করে কথা বলে। কথা বলার সময় দৃষ্টি থাকে স্থির। দৃষ্টি বিনিময় হওয়ার সময় তুষার খেয়াল করল তার সুদীর্ঘ পল্লব যুক্ত আঁখিতে কিছু একটা আছে যা কাউকে আটকে রাখতে পারে। কিন্তু সেটা কী তা তুষার ধরতে পারল না। ভাবল মেয়েটা আগের মতোই আছে!

ফুচকা খেয়ে তারা যে যার বাসার উদ্দেশ্যে বেরিয়ে গেল। কোনো এক অজানা কারণে আভা পেছন ফিরে তাকাতেই দেখল মানুষটা তার পথের দিকে তাকিয়ে আছে। খুব দ্রুত হাঁটতে লাগল সে। সোজা সেখান থেকে টিউশনি করার জন্য ছাত্রীর বাসায় চলে গেল।

কিন্তু কী অপেক্ষা করছে আভার জন্য সে নিজেই জানে না!

ইনশাআল্লাহ চলবে

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here