#আঁধারে_ঢাকা_ভোর
#বারো
প্রজ্ঞা জামান দৃঢ়তা
আজ পড়তে বসতেই ঝুনঝুনি টেনে টেনে বলল,
“ম্যাম আজ না আমার পেটে ব্যাথা পড়তে ইচ্ছে করছে না। আমি যদি না পড়ি তুমি কী আমাকে মারবে?”
কথা বলার সময় ঝুনঝুনির ফোকলা দাঁতগুলো স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে। তাছাড়া সামনের দুটো দাঁত পড়ে গেছে বলে কথাগুলো অস্পষ্ট শোনাল। আভা ঝুনঝুনির কথার মাঝেও মায়া খুঁজে পায়। সবচেয়ে যেটা বেশি ভালো লাগে তা হচ্ছে ও যখন ‘স’ কে ‘ছ’ উচ্চারণ করে।
সে ইচ্ছে করে তার ছাত্রীকে স ও ছ এর মধ্যে পার্থক্যটা বুঝায় না। কারণ সে মনে করে বড় হতে হতে ঠিক এসব সমস্যাগুলো থাকে না। তারচেয়ে বরং এই যে এখন ঝুনঝুনি সুন্দর করে কথাগুলো বলে তখন তার কাছে খুব ভালো লাগে। দিনের সবচেয়ে সুন্দর সময় সে তার এই কিউট ছাত্রীটার সাথে কাটায়।
আভা ঝুনঝুনির ছোট্ট ফোলা ফোলা দু’গালে হাত রেখে মমতা ভরা গলায় বলল, “তুমি চাইলে আমি তোমাকে আজকে ছুটি দিয়ে দেব। তার জন্য তুমি মিথ্যে কেন বলছো? শোনো যেদিন তোমার পড়তে ইচ্ছে করবে না, সেদিন তুমি আমাকে বলবে তার জন্য যদি কোনো মিথ্যে বলো আমি কিন্তু আর আসব না তোমাকে পড়াতে বুঝলে ঝুনঝুনি?”
ঝুনঝুনি ভেজা গলায় বলল, “সরি ম্যাম আমি আর এমন করব না। আমাকে তুমি ক্ষমা করে দাও। প্লিজ আমাকে ছেড়ে যেও না। তুমি খুব ভালো ম্যাম তুমি আমাকে একদমই মারো না। তুমি যাবে না প্লিজ আমি খু…”
কথাগুলো শেষ করার আগেই ঝুনঝুনি কেঁদে ফেলল। আভা বুঝতে পারল না কী করবে। হঠাৎ সে ঝুনঝুনিকে বুকের সাথে জড়িয়ে ধরল। একে তো মেয়েটা কাঁদছে এবার জড়িয়ে ধরাতে কান্নার বেগ চক্রবৃদ্ধিহারে বাড়তে লাগল। মেয়েটাকে বুকে নিয়ে সে কেমন অচেনা একটা সুখ অনুভব করল। সে জানে না এ সুখের নাম কী! জানে না হঠাৎ এমন সুখের আগমনের কারণ! শুধু জানে এই সুখটা ভীষণ জরুরী।
ঝুনঝুনির কান্না শব্দে তার মা সুমিতা দৌঁড়ে আসতে গিয়েও দরজার সামনে থমকে গেলেন, দেখলেন তার মেয়ে তার ম্যামকে জড়িয়ে ধরে কাঁদছে। তাই ভেতরে না গিয়ে বাইরে থেকে কী হয়েছে বুঝার চেষ্টা করলেন।
প্রায় মিনিট পাঁচেক পরে আভা ঝুনঝুনিকে নিজের থেকে আলগা করে দু’হাতে তার মুখ আঁজলা ভরে নিয়ে বলল, “এভাবে কাঁদছো কেন বোকা মেয়ে? সাহসী মেয়েরা কী কখনো কাঁদে? তোমাকে বলেছি কখনো সামান্য বিষয়ে কান্না করবে না। যারা কথায় কথায় চোখের জল ফেলে তাদের মানুষ দূর্বল ভাবে। ঠিক আছে আমার ঝুনঝুনি-টুনটুনি? ”
ঝুনঝুনির কান্নার বেগ কমেছে আভার দিকে ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে জড়ানো গলায় বলল, “তুমি চলে যাবে নাতো?”
সে গভীর চোখে তাকিয়ে কিছুটা সময় চুপ থেকে শান্ত গলায় বলল, “আমি কাউকে ছেড়ে যাইনা ঝুনঝুনি, কিন্তু সবাই আমাকে ছেড়ে চলে যায়। তাই আমি তোমাকে রেখে কোথাও যাবো না। যদি না তুমি যাও।”
ঝুনঝুনি হয়তো তার কথাটার অর্থ কতটা গভীর বুঝতে পারল না। কিন্তু এতটুকু বুঝেছে তার ম্যাম তাকে ছেড়ে যাবে না। তাই খুশিতে আবার জড়িয়ে ধরল তাকে। ওকে বুকের সাথে জড়িয়ে ধরে চোখ বুঝে তার মাথায় চুমু খেয়ে বের হয়ে এলো।
সুমিতা সবটা ঘটনা আড়ালে থেকে দেখেল। অজান্তেই তার মুখে স্পষ্ট শান্তির একটা হাসি ফুটল। তার সাথে সাথে ঠিক করে নিল আভাকে কোনোমতেই ছাড়বে না। সে যতদিন চায় তার মেয়েকে পড়াতে পারে। কারণ আজ এ দুজনের মাঝে সে অন্যরকম এক টান দেখেছে। কোথাও তা হয়তো মাতৃত্বের মতো!
আভা উঠতেই সুমিতা ঘরে ঢুকে বলল, “এখন আর তোমার যাওয়া হচ্ছে না ভাই। আজ তুমি আমাদের সাথে খেয়েই যাবে।”
“এ না না আজ হবে না আপু। পরে একদিন খেয়ে যাব। আজ দেরি হয়ে যাবে।”
সুমিতা তাকে অনেক চেষ্টা করেও রাখতে পারল না। তাই একটা টিফিনবক্সে রাতের খাবার দিয়ে দিল। আভা সেটা নিতেও রাজি ছিল না। সুমিতা কষ্ট পাবে ভেবে নিল। রাস্তায় নেমে আভার কেন যেন খুব কান্না পেল। এতটা সময় সে অনেক কষ্টে নিজেকে সামলে রেখেছে। ঝুনঝুনির জড়িয়ে ধরার সময় থেকে একটা চাপা কান্না বেরিয়ে আসছিল, অন্যকারো বাসায় এভাবে কান্না করা ঠিক বলে মনে হলো না। তাই নিজেকে অনেক কষ্টে নিয়ন্ত্রণে রেখেছিল। এখন আর পারছে না।
জীবনে খুব কম মানুষের ভালবাসা সে পেয়েছে। এমন সুন্দর ফুটফুটে একটা মেয়ে তাকে অল্পদিনে এতটা ভালবেসে ফেলবে এটা যেন সে ভাবতেই পারেনি! জীবনে অবজ্ঞা অবহেলা পাওয়া মানুষদের কাছে ভালবাসা কতটা দামী তা শুধু তারাই জানে।
জীবন সুন্দর! এই ছোট ছোট বিষয়গুলোর জন্য আরও সুন্দর!
★★★
আকাশের গায়ে মেঘ জমেছে। মেঘের গুড়ুম গুড়ুম শব্দে জানান দিচ্ছে আগমনী বর্ষণের কথা। আভা ও ফারহা ক্লাস শেষ করে ক্যাম্পাসে মাঠে সবুজ ঘাসের উপর বসে আছে। ফারহা হাঁটুতে নোট রেখে কিছু একটা লিখছে, আভা তাকিয়ে আছে সাদা-কালো উড়ো মেঘগুলোর দিকে, তার দুচোখ জুড়ে শূন্যতা, কেউ জানে না সে শূন্যতা কীসের! দূর থেকে তার এই শূন্য চাহনিতে যে অন্য কেউ প্রগাঢ় মায়া খুঁজে পাচ্ছে তা সে টেরই পেল না।
ফারহা বলল, “মনে আছে আজ আমাদের বাসায় যাওয়ার কথা তোর? আম্মু কল দিয়েছেন তোর জন্য রান্না করে বসে আছে একসাথে খাবেন বলে। আজ তো আর ক্লাস নেই চল বেরিয়ে পড়ি।”
“আজ না গেলে হয় না দোস্ত? মনে হচ্ছে বৃষ্টি হবে। আসব কীভাবে?”
ফারহা নোট ব্যাগে ঢুকাতে ঢুকাতে বলল, “কিচ্ছু মানছি না আমি। আজ তোকে যেতেই হবে। মা নয়তো খুব কষ্ট পাবেন। এখন তুই ঠিক কর। তুই মাকে কষ্ট দিবি কিনা। ভার্সিটিতে আমাদের বন্ধুত্বের এক বছর হতে চলল। তুই বলেছিস পরীক্ষা শেষ হলে যাবি। পরীক্ষা শেষ। মাকে প্রতিদিন তোর কথা বলি। মা শুধু বলেন তোকে নিয়ে যেতে, কিন্তু তুই তো আমার কথাই শুনিস না। আজ যদি না যাস আমি খুব রাগ করব বলে দিলাম।”
ফারহা খুব অভিমানে কথাগুলো বলল।
আভা আকাশের দিকে তাকিয়ে লম্বা শ্বাস নিয়ে বলল, ” ম্যাডাম রাগ করেছেন মানে তো যেতেই হবে। তো চলুন যাওয়া যাক ম্যাডাম।”
★★★
আভা বসে আছে ফারহাদের বাসায় ড্রয়িং রুমে। ফারহা তাকে বসিয়ে রেখে ভেতরে গেছে মাকে ডাকতে। রুমটা সাধারণের মধ্যে খুব সুন্দর করে সাজানো। সবকিছুতে রুচিবোধের ছাপ স্পষ্ট। সে উঠে দেয়ালে টানানো ফারহাদের পরিবারের ছবিগুলো দেখতে লাগল। দুপাশে দুজন মাঝ বয়সি পুরুষ ও মহিলা। তাদের দুপাশে দুটো ছেলেমেয়ে। সে বুঝল এনারা ফারহার বাবা-মা। ভাইকে তো আগেই দেখেছে।
অবচেতন মনে আভা কেন যেন তুষারের ছবিটা খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখতে লাগল। ফর্সা মুখে কালো ছোট-ছোট খোঁচাখোঁচা দাড়ি। তীক্ষ্ণ নাক, দীর্ঘ পল্লবযুক্ত চোখগুলোতে বুদ্ধিমত্তা স্পষ্ট। দুই নয়নে কিছু একটা আছে যা বেশিক্ষণ তাকিয়ে থাকার সাহস দেয় না। কিন্তু সেটা কী? হঠাৎ পেছন থেকে ফারহার ডাকে তার ধ্যান ভাঙে।
ফারহার পাশে দাঁড়িয়ে আছেন এক প্রৌঢ়া, পরনে ছাই রঙের চিকন পাড়ের সুতি শাড়ি। পরার স্টাইলে বোঝা যায় মহিলাটি কতটা স্মার্ট। ধবধবে ফর্সা চামড়ায় কুচকে কিছুটা বুড়িয়ে গেছে। তবে তার মাঝে বেশ আভিজাত্য একটা ব্যাপার আছে, যে কেউ উনাকে দেখলে ভাববে যৌবনে উনি কতটা সুন্দরী ছিলেন। সবচেয়ে সুন্দর উনার মায়াবী আঁখি দুটো। আভার মনে হলো এমন চোখ জোড়া আগে কোথাও সে দেখেছে। তৎক্ষনাৎ মনে করতে পারল না। বিনয়ী সুরে সালাম দিল ফারহার মা পারভীন বেগমকে।
তিনি এগিয়ে এসে আভার চিবুকে হাত দিয়ে হেসে বললেন, “ফারহা তুই যেমন বলেছিস মেয়েটা তো তার চেয়েও মায়াবী।”
আভা মৃদু হাসল। তার হাসি দেখে তিনি বললেন, “বাহ! হাসিটা তো আরও সুন্দর।”
সে কেমন অপ্রস্তুত হয় পড়ল, এভাবে সামনাসামনি কেউ তার কখনো প্রশংসা করেনি। তাই সে বুঝতে পারছে না, তার কী বলা উচিত।
তাই কিছু ভেবে না পেয়ে বলল, “আপনার শরীর কেমন আন্টি?”
“বসো মা, শরীর এখন বেশ ভালো। কিন্তু হঠাৎ হঠাৎ অসুস্থ হয়ে যাই। বয়স হয়েছে তো।”
সে কিছুটা সময় তার সাথে পড়াশোনার কথা বলল। তারপর ফারহা বলল, “মা সব কথা এক বসায় শেষ করে ফেলবে? খেতে দিবে না? তাছাড়া আভাকে আমার ঘর ও বাড়ি দেখাতে হবে না?”
“সে ঠিক বলেছিস আগে খেয়ে নে, তারপর সব কথা হবে। তুষারকে একটা কল দে তো তাড়াতাড়ি আসতে বল একসাথে খাওয়া যাবে।”
ফারহা ভাইকে কল দেয়, সে বাইরে খেয়ে নিয়েছে বলে জানিয়ে দিল।
তারা খেতে বসল। পুরো টেবিল জুড়ে খাবারে ভরতি। আভা অবাক হয়ে গেল সব খাবার তার পছন্দের। ভাবল ফারহাটা যা করে না। ধূর এখন যে কী লজ্জা লাগছে।
মুখে উৎকন্ঠা হয়ে বলল, “এত খাবার কেন কষ্ট করে করতে গেলেন আন্টি, এতকিছু কী একসাথে খাওয়া যায়? আর ফারহা তুই খুব খারাপ, আন্টিকে আমার পছন্দের তালিকা দিয়েছিস কেন? তোর কী আমাকে রাক্ষস মনে হয়?”
ফারহা বলল, “কুল ম্যাম কুল! এভাবে রাগ করতে আছে? আমি আম্মুকে কিছু বলিনি, আম্মু বলেছে তোর কী পছন্দ আমি শুধু বলেছি। এবার বাকীটা আম্মু জানে। আমি এসবের কিছুই জানি না। ”
পারভীন বেগম বললেন, “আমি শুধু রান্না করেছি মা। সব বাজার করে দিয়েছে তুষার, সব জোগাড় করে দিয়েছে শরিফা যে আমাকে কাজে সাহায্য করে। তাই আমার বেশি কষ্ট হয়নি তুমি এত চিন্তা করো না তো, আসো বসে পড়ো।”
আভা প্রায় বছর খানিক পরে বাড়ির রান্নার স্বাদ পেল। সবগুলো খাবার খুব ভালো হয়েছে। সেই যে ভর্তি হওয়ার জন্য চট্টগ্রাম এসেছে আর বাড়ি যাওয়া হয়নি তার। শফিক সাহেব প্রায় বলেন যেতে কিন্তু সে যায় না। ভাই বোন ও মাকে দেখতে ইচ্ছে করলেও মায়ের ব্যবহারের কথা মনে হলে যাওয়ার ইচ্ছেটা তার শেষ হয়ে যায়। তাই বাবাকে নানা অজুহাতে যাবে না বলে দেয়। তিনি সব বুঝেন বলে মেয়েকে জোর করেন না। তিনি প্রতি মাসে অন্তত দুইবার আসেন। প্রতিদিন কল দিয়ে খবর নেন।
রেহেনা বেগমের সাথে আভার কথা হয় না। তিনি তো কল দেন না, সে দিলেও কেটে দেন। বাবা থেকে সব খবরাখবর নেয় সে। অনেকদিন পর আজ তৃপ্তি করে খেল। বাসায় তো কোনোরকম একদিন রান্না করে দু’দিন খায়। প্রতিদিন ভাত রান্না করলেও তরকারি রান্না করা হয়ে উঠে না। যেদিন যেদিন ভার্সিটি থাকে না সেদিন রান্না করা হয়।
খাওয়া শেষ করে আভাকে ফারহা ঘর দেখাতে নিয়ে গেল। বেশ পরিপাটি ঘর আভা ঘুরে ঘুরে দেখল সবটা। তারপর ফারহা বলল, “চল আরেকটি ঘর দেখিয়ে নিয়ে আসি।”
কার ঘর জিজ্ঞেস করার আগেই হাত ধরে টেনে নিয়ে গেল। এ বাড়ির বাসার সবচেয়ে সুন্দর ঘর বোধহয় এটি। দেয়ালের রঙটা সাদা,নীল। বিছানার চাদর সাদা একদম নতুন বলে মনে হচ্ছে। দেয়ালে চারপাশে সুন্দর কিছু পেইন্টেড ছবি টানানো। সে ছবিগুলো এক একটি এতটা সুন্দর যে কোনটা থেকে কোনটা বেশি সুন্দর বিবেচনা করা খুব কঠিন!
আভা খেয়াল করল বড় সাইজের একটা ক্যানভাসের উপর কাপড় দিয়ে ঢাকনা দেয়া। সেই কাপড়ের একটা পাশ ফ্যানের বাতাসে উড়ছে বলে দেখা যাচ্ছে। ছবির একটা চোখ দেখা যাচ্ছে সেই চোখটা এক মুহূর্তের জন্য তার বড্ড চেনা মনে হলো। আবার দেখার চেষ্টা করল কিন্তু হঠাৎ পেছন থেকে কারো কথায় চমকে ওঠল। সে নিজেই অপ্রস্তুত হয়ে গেল। তুষার এসেছে, পেছন থেকে তাকে দেখে চিনতে পারেনি তাই বলল, “কে?”
ইনশাআল্লাহ চলবে