#আঁধারে_ঢাকা_ভোর
#আঠারো
প্রজ্ঞা জামান দৃঢ়তা
দেখতে দেখতে আভার এলএলবি ফাইনাল পরীক্ষার ফলাফল চলে এসেছে। সে খুব ভালো করেছে। তার এই সফলতায় সবচেয়ে বেশি খুশি হয়েছেন শফিক সাহেব ও তুষার।
তুষার মাকে তাদের সম্পর্কের কথা জানালে, তিনি খুশীই হলেন। আভার গায়ের রঙ কালো হলেও তার মাঝে মায়া আছে, যা ভদ্রমহিলাকে বরাবরই আকৃষ্ট করেছে। তাছাড়া পড়াশোনায় ভালো, সদ্য ‘ল’ পাশ করেছে। শিক্ষায়-দীক্ষায় কোনো অংশে কম নয়। তাই তিনি চাইলেন খুব দ্রুত তাদের বিয়েটা দিয়ে দিতে।
ছেলেকে বললেন আভার বাবাকে যেন তাড়াতাড়ি তার সাথে দেখা করতে বলে। এদিকে ফারহা খুব খুশী প্রিয় বান্ধবী এবার সর্বক্ষণ সামনে থাকবে। এর চেয়ে সুখের বিষয় আর কী হতে পারে! এই তিন বছরে তাদের ভালোবাসার গভীরতা কতটা সে দেখেছে। এ দুটো মানুষ যে একে অপরকে ছাড়া থাকতে পারবে না, সে ভালো করেই জানে।
তুষার আভাকে সবটা বলার পর অনেকটা নিশ্চিন্ত হয়েছে সে।
শফিক সাহেব আগেই তুষারকে দেখেছেন, পছন্দও হয়েছে তাকে। তিনি অনেক খুশী যে, তার মেয়ে অনেক কষ্ট পাওয়ার পর কাউকে এমন ভালো একজন মানুষকে পেয়েছে। এর চেয়ে বেশি তিনি কিছুই চান না। বরং এতদিন ভেতরে ভেতরে মেয়েকে নিয়ে বেশ চিন্তায় ছিলেন। শত হলেও বাবার একটা চিন্তা তো রয়েই যায়। আজ সব চিন্তা শেষ হয়ে গেল। আভা যখন কল দিয়ে বাবাকে পারভীন বেগমের সম্মতির কথা জানাল, তখন তিনি খুব খুশি হলেন। তিনি জানান আগামীকালই চট্টগ্রাম আসবেন পারভীন বেগমের সাথে দেখা করতে।
বাবার সাথে কথা শেষ করে তুষারকে কল দিল আভা।
রিং হতেই ওপাশ থেকে ভেসে এলো, “কী ব্যাপার ম্যাডাম বিয়ের কথা শুনে কী ভয় পেয়ে গেলেন? কোনো কল নেই, টেক্সট নেই?”
“বাবার সাথে কথা বলছিলাম তাই কল দিইনি। বাবা কাল আসছেন আন্টির সাথে কথা বলতে। আমি ভাবতে পারিনি আন্টি আমার অতীত সম্পর্কে সব জেনেও আমাকে মেনে নিবেন। আসলে তিনি সত্যিই আলাদা। নয়ত এটা মেনে না নিলেও আমি খুব একটা অবাক হতাম না।”
তুষারের ভেতর যে আনন্দ ছিল তা যেন আভার কথা শুনে মুহূর্তেই হাওয়ায় মিলিয়ে গেল। তার মাকে এসব নিয়ে কিছুই বলেনি সে। কারণ সে জানে তিনি যতই ছেলেমেয়ের সাথে বন্ধুত্ব সম্পর্ক বজায় রাখুন, কিছু বিষয়ে খুবই সংবেদনশীল।
তুষার গম্ভীর গলায় বলল, “অরনী আসলে মাকে এসব নিয়ে কিছুই বলা হয়নি। সমাজ নিয়ে তিনি
খুব বেশি ভাবেন। এই বিষয়ে কিছু জানাতে চাই না তাকে, কারণ তিনি হয়তো মেনে নিবেন না।”
কথাগুলো শুনে আভার মনে হলো বজ্রপাত হয়েছে। তার পায়ের নিচ থেকে মাটি সরে গেছে। শেষ পর্যন্ত এটাই তার ভাগ্যে ছিল! আভা দাঁড়ানো থেকে খাটের উপর গিয়ে বসল।
কাঁপা গলায় বলল, “মাকে এখনই সব জানাও। তিনি যদি সব শুনে হ্যাঁ বলেন তবেই এই বিয়ে হবে। নয়তো না।”
কথাগুলো বলতে তার খুব কষ্ট হচ্ছিল। মনে হচ্ছিল জীবনে অনেক যন্ত্রণার পর যে মানুষটির কাছে সুখের দেখা পেয়েছে, সে মানুষটিকে হারাতে বসেছে।
তুষার কাতর গলায় বলল, “প্লিজ অরনী এমনটা বলো না। মাকে কিছুই জানাতে চাই না। তোমার বাড়ি কুমিল্লায়, মাকে সেখানে কখনো না নিয়ে গেলেই হবে। মা কিছু জানতে পারবেন না। তাছাড়া সংসার করব আমি তোমার সাথে, তাহলে মাকে কেন এসব জানাতে হবে? তুমি এটা নিয়ে আর কোনো কথা বলো না।”
আভা কঠিন হওয়ার চেষ্টা করে বলল, ” আমি-তুমি দিয়ে প্রেম হলেও সংসার হয় না। সংসার করতে আমাদের শব্দটার প্রয়োজন। একটা ঘরের একটা পিলার যদি নড়বড়ে হয়ে যায় তবে সম্পূর্ণ ঘরটাই ঝুঁকিতে থাকে, কখন না জানি ভেঙে পড়ে যায়। তাই তুমি যদি না বলো আমি মাকে জানাব। সব শুনে তিনি যদি চান তবেই এই সম্পর্ক এগুবে, নয়ত না।”
তুষার বিষন্ন গলায় বলল, “আমি বলব না অরনী। তোমাকে হারালে আমি নিজেই শেষ হয়ে যাব।”
আভা তুষারের এই কথাটা সহ্য করতে না পেরে কল কেটে দিল। ফোনটা বুকের সাথে জড়িয়ে ধরতেই চোখ দিয়ে কয়েক ফোঁটা অশ্রু গড়িয়ে পড়ল। মনে মনে আল্লাহর কাছে দোয়া করল পারভীন বেগম যেন তাদের সম্পর্কটাকে মেনে নেন। নয়ত শুধু তুষার নয়। সে নিজেও যে শেষ হয়ে যাবে।
তিনটা বছর তিলে তিলে গড়া স্বপ্নগুলোকে কীভাবে ভেঙে যেতে দিবে ! এটা ভাবতেই নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে আসে। নিজের অস্তিত্বকেই শূন্য মনে হয়! অনেকদিন পর আভা এভাবে কাঁদল। এই তিনটা বছর কান্না কী ভুলেই গিয়েছিল সে। তুষার তার জীবনে এসে তাকে যে সুখ দিয়েছে তা সে কোনোদিন পায়নি। জীবনে প্রতিটি উত্থান-পতনে ডাল হয়ে ছিল সে। তার তমসাবৃত জীবনে যে সোনালি রঙের আলো এসে ভিড় করবে, সে কল্পনাই করেনি।
ভাবেনি কেউ তাকে বলবে অরনী তুমি অন্য দশটা সাধারণ মেয়ের চেয়ে অনেকখানি আলাদা। তুমি সাধারণ নও, তুমি অসাধারণ। যাকে হৃদয় দিয়ে অনুভব করা যায়। যাকে নিঃশ্বাসে ধারণ করা যায়। যাকে কোনো কারণ ছাড়াই ভালোবাসা যায়।
এই যে এমন একটা মানুষকে কী তবে ছেড়ে চলে যেতে হবে? যে মানুষটা তাকে তার সৌন্দর্য খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখিয়েছে চোখে আঙুল দিয়ে। এমন মানুষটাকে কী সারাজীবনের সঙ্গী করে পাওয়া তার ভাগ্যে নেই!
তাকে পেয়েছে বলে সে রোজ আল্লাহর কাছে শুকরিয়া আদায় করেছে। পুরো শরীর অজানা ভয়ে অবশ হয়ে আসছে। কেন মনে হচ্ছে প্রাণটা রেখে যেতে হবে অনেকটা দূরে! পারভীন বেগম কী পারবেন না তাকে মেনে নিতে? তাদের এই নিখুঁত সুন্দর সম্পর্কটাকে আরও সুন্দর হতে দিতে? না আর কিছু ভাবতে পারছে না সে, মন ও মস্তিষ্ক দুটোই ফাঁকা হয়ে আসছে। নিজের ভেতরটা জ্বলে-পুড়ে যাচ্ছে।
★
তুষার মাকে ডেকে সবটা জানালে পারভীন বেগম সব শুনে হতবাক হয়ে গেলেন। এমন একটা মেয়ের অতীত জীবন, এতটা ভয়ংকর! তিনি বললেন, “এতদিন আমাকে কেন জানাওনি? ”
“যদি তুমি মেনে না নাও, তাই মা।” তুষার একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল।
“তুমি জানো আমি পৃথিবীর সবকিছুতে ত্যাগ করতে রাজি হলেও, সমাজের কাছ থেকে কোনো কটাক্ষ শুনতে রাজি নই। মেয়েটা কালো সেটা আমি মেনে নিয়েছি। তার আগে বিয়ে হয়েছে সেটাও মেনে নিতাম। কিন্তু তার জন্মপরিচয় নেই এটা আমি মানতে পারব না তুষার।”
তিনি একটু থেমে আবার বললেন, “একসাথে এতগুলো বিষয় ছাড় দেয়া সম্ভব নয়। তুমি আমার ছেলে আমি চাই না তোমার বাকি জীবন কোনো ভুলের জন্য নষ্ট হয়ে যাক। তুমি মেয়েটাকে ভুলে যাও।”
“মা প্লিজ তুমি এসব বলো না। আমি তোমার কাছ থেকে এটা আশা করি না।”
“এর জন্য যদি আমাকে তুমি খারাপ ভাবো তবে ভাবতেই পারো, কারণ আমি জানি কয়েকবছর পর ঠিক তুমি বুঝতে পারবে আমার না বলার পেছনে কতটা যুক্তি আছে। এখন আমি যদি সেগুলো বলি তুমি মানবে না। কারণ ভালোবাসা মানুষের হিতাহিত জ্ঞানশূন্য করে দেয়। তুমি এখন আবেগে ভাসছো, তাই এসব নিয়ে আর তোমার সাথে কোনো কথাই বলতে চাচ্ছি না।”
তুষার মায়ের পায়ের কাছে বসে বলল, “প্লিজ! মা আমি ওকে নিয়েই ভালো থাকব। তুমি মেনে নাও।”
“তুমি তো জানো আমার না, কখনো হ্যাঁ হয় না। এর জন্য তুমি অনেক কিছুই করবে আমি সেটাও জানি। তবুও আমার সিদ্ধান্তের এতটুকু পরিবর্তন হবে না। তোমাদের দুজনের উচিত ছিল সবটা আমাকে জানানো। সেদিক দিয়ে দেখতে গেলে তোমরা আমাকে মিথ্যা বলে ঠকিয়েছ। যাই হোক এখন আমি আর কিছুই বলতে চাই না।”
কথাগুলো শেষ করে পারভীন বেগম এক মুহূর্তও দাঁড়াননি হনহনিয়ে চলে গেলেন নিজের ঘরে।
তুষার যেন নড়তেও পারছে না। চোখের সামনে স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছে অমানিশার অন্ধকার। মনে হচ্ছে ধীরে ধীরে সে অন্ধকার তাকে গ্রাস করে নিচ্ছে। সেই অন্ধকারে নিমজ্জিত হচ্ছে অতল সমুদ্রেরর গহব্বরে। সে জানে না, সে সমুদ্রের শেষ কোথায়।
ফারহা মাকে অনেক বুঝাতে চেষ্টা করল, তিনি শুনতেই চাইলেন না। তারা দুজনেই বুঝতে পারছিল তাদের জীবনে অঘোষিত যুদ্ধ আরম্ভ হতে যাচ্ছে। সে যুদ্ধে কে জিতবে, কে হারবে তারা জানে না। শুধু জানে তারা হারুক বা জিতুক যন্ত্রণা দু’দিকেই সমান।
তুষার মায়ের রুমে ঢুকল উম্মাদের মতো। আচমকা মায়ের পা ধরে বসে অঝোরে অশ্রুবর্ষণ করতে লাগল। কিন্তু পারভীন বেগমের সিদ্ধান্তের কোনো বদল হলো না। তুষার রাগে-দুঃখে বাসা থেকে বেরিয়ে গেল। কী আছে আভা-তুষারের ভাগ্যে তা শুধু বিধাতাই জানেন।
ইনশাআল্লাহ চলবে