আঁধারে ঢাকা ভোর পর্ব-১৯

0
1748

#আঁধারে_ঢাকা_ভোর
#ঊনিশ
প্রজ্ঞা জামান দৃঢ়তা
এদিকে আভা তুষারকে কল দিয়ে পাচ্ছে না, দেখে তার বাসায় আসে সে। দরজা খুলতেই চমকে যায় ফারহা! বাসার পরিস্থিতি এমনিতেই ভালো না। তার মধ্যে আভা এসেছে মানে, মা দু’য়েক কথা শুনিয়ে দিবেন।

ফারহা তাই ইতস্ততভাবে বলল, “আভা তুই পরে আসিস৷ আজ বাসায় একটু সমস্যা হচ্ছে।”

আভা তার কথার উত্তর না দিয়ে প্রাণহীন হাসিতে ফারহার কাঁধে হাত রেখে আস্বস্ত করল কিছুই হবে না। ভেতরে যেতেই দেখতে পেল পারভীন বেগম সামনে দাঁড়িয়ে আছেন। সালাম দিয়ে বলল, “কেমন আছেন আন্টি?”

পারভীন বেগম গম্ভীর গলায় বললেন, “এসো কথা আছে তোমার সাথে।”

আভার বুকের ভেতর ধড়ফড় করছে। তারপরও নিজেকে যথাসম্ভব সামলে নিয়ে সোফায় গিয়ে বসল। চারদিকে একবার চোখ বুলিয়ে তুষারকে খুঁজল, কিন্তু দেখতে পেল না। পাবেই বা কী করে মাকে বুঝাতে না পেরে সে বাসা থেকে পাগলের মতো বেরিয়ে গেছে।

ভদ্রমহিলা যেন আরও গম্ভীর হয়ে বললেন, “দেখো আমি সব তুষারের কাছে শুনেছি। জানি তুমি বা তোমরা আমাকে স্বার্থপর ভাববে। তারপরও এটুকু আমাকে করতেই হবে। প্রতিটি মা চায় তার সন্তান ভালো থাকুক, সন্তানের ভবিষ্যৎ নিরাপদ থাকুক, সেখানে আমি কী করে আমার সন্তানকে অনিশ্চিতের দিকে ঠেলে দেই বলো?”

আভা নিচের দিকে তাকিয়ে চুপ করে শুনলো। কিছু বলল না।

তিনি বললেন, “আমার সুদর্শন ছেলের জন্য আমি চাইলেই একটা সুন্দরী বউ নিয়ে আসতে পারতাম, কিন্তু সে তোমাকে ভালোবাসে বলে আমি তোমার গায়ের রঙ নিয়ে কিছুই বলিনি। কারণ আমারও মনে হয়েছে গায়ের রঙ বাদ দিলে তুমি অত্যন্ত চমৎকার একটা মেয়ে। তাই তোমাকে ঘরের বউ করাই যায়।”

পারভীন বেগম একটু থেমে আবার বললেন, “তোমার এমন ভয়ংকর অতীত আছে, আমি জানতামই না। বলতে গেলে এক কথায় তোমরা আমায় ঠকিয়েছ। আগে জানলে হয়তো এই বিয়েতে আমি প্রথম থেকেই অমত করতাম। এতে করে তোমাদের সিদ্ধান্ত নেয়াও সহজ হতো, এখন আমি নিরুপায়।”

আভার দৃষ্টি এখনো ফ্লোরে।
ভদ্রমহিলা কিছুক্ষণ থেমে আবার বললেন,

“দেখো জেনে শুনে আমার সন্তানের ভবিষ্যৎ নষ্ট করতে পারি না। হ্যাঁ! আজ হয়তো সে বুঝছে না, এখন সে আবেগের রঙিন চশমা পরে আছে। কিন্তু একদিন সে নিশ্চয়ই বুঝতে পারবে। তখন যদি আমাকে বলে মা তুমি কেন আমায় বাধা দাওনি, তখন আমি কী উত্তর দেব? তাছাড়া ভবিষ্যতে তার সন্তান আসবে সে সন্তানদের সমাজের সামনে কী পরিচয় হবে? প্রতি পদে পদে মায়ের জন্মপরিচয় নিয়ে তাদের খোঁটা শুনতে হবে। উঁচু সমাজে বাস করতে পারবে না তারা।

তখন আমার ছেলের মনে হবে সে ভুল করেছে। কারণ, একজন প্রেমিক যখন একজন বাবা হয় তখন অনেক কিছুই পাল্টে যায়, পাল্টাতে হয়, যা সে এই মুহূর্তে বুঝতেই পারছে না। জীবনের অভিজ্ঞতা থেকে বলছি তোমরা সুখী হবে না। তাই আমি চাই একটা অসুখী জীবন কাটানোর চেয়ে দুজন দু’দিকে ভালো থাকাই উত্তম হবে। অন্তত অসুস্থ জীবন থেকে দুজনেই রেহাই পাবে।”

আভার দিকে তাকিয়ে দেখলেন। তিনি জানেন কথাগুলো শুনতে আভার কষ্ট হচ্ছে। ভাবলেন না বলে উপায় নেই। আভার কাঁধে হাত রেখে বললেন,

“জানি তোমাদের কষ্ট হবে, বিশ্বাস করো সময় সব ঠিক করে দেয়। তেমন গভীর ভালোবাসাও স্রোতের টানে তলিয়ে যায়। ভুলে যায় একদিন কাউকে সে উন্মাদের মতো ভালোবেসেছিল, ভুলে যায় কেউ তার জীবনে এসেছিল। তুমি আমাকে ভুল বুঝো না আভা। আমি চাই তুমি ভালো থাকো। আমাকে বিশ্বাস করে দেখো এতে তোমাদের দুজনেরই ভালো হবে। হাত জোড় করে বলছি তোমাকে আমার ছেলের জীবন থেকে চলে যাও।”

আভা উনার হাত দুটো নিজের হাতের মুঠোয় আগলে ধরা গলায় বলল, “আপনি হাত জোড় করে আমাকে অপরাধী করবেন না মা। ক্ষমা চেয়ে নিচ্ছি আপনাকে মা ডাকার জন্য, জানি এই অধিকার আমার না থাকলেও আজ ডেকে নিলাম। আর হয়তো কোনোদিন সে সুযোগ পাবোই না মা। স্বপ্ন যা ছিল সব আজ আমি ভেঙে দিলাম। আপনার প্রতিটি ভাবনাকে আমি সম্মান করি, একজন মায়ের সম্পূর্ণ অধিকার আছে সন্তানের ভালো মন্দ ভাবার। কিন্তু আপনার একটা কথা আমি মানতে পারলাম না। সময়ের স্রোতে সব সম্পর্ক বিলীন হয়ে যায় না। কিছু ভালোবাসা রয়ে যায় মনের বাক্সের গোপনে সীলমোহর লাগানো, হ্যাঁ! হয়তো সেটা আজীবন নিষিদ্ধ ও তালাবদ্ধ থাকে। হয়তো তার হদিশ সেই একজন ছাড়া কেউ পায় না। কিন্তু রয়ে যায় অনাদিকালের হৃদয়ে সোনার অক্ষরে লেখা। যা কোনো সমাজ, কোনো সম্পর্ক, কিংবা কোনো নিয়ম আটকাতে পারে না।”

কথাগুলো বলতে তার কষ্ট হচ্ছিল, চোখের কোল বেয়ে নোনা জল গড়িয়ে পড়ছিল অবিরত। গলা কাঁপছিল বারবার, স্বর বেরুতে যেন প্রাণ বেরিয়ে আসছিল। বহু কষ্টে টলটলে পায়ে উঠে দাঁড়াল সে। সামনের টেবিল থেকে ব্যাগটা কাঁধে ঝুলিয়ে জোরে শ্বাস নিয়ে নিজেকে নিয়ন্ত্রণে নিয়ে আসার চেষ্টা করল।

ফারহা পাশে দাঁড়িয়ে নীরবে কেঁদে চলেছে, কান্নার ধমকে শরীর কাঁপছে। তারই চোখের সামনে একটু একটু করে গড়ে উঠেছিল আভা তুষারের ভালোবাসার স্বপ্নের মহল। সে মহলের প্রতিটি পিলারে ছিল যত্নে গড়া ছোট একটা সংসার। একটা দমকা হাওয়ায় সব কেমন এলোমেলো করে দিল। তার নিজের এত কষ্ট হচ্ছে, না জানি সে দুজন মানুষের কী হচ্ছে! এই ক্ষণে সে এটাই অনুভব করছে যে এঁরা কেউই দুজন দুজনের থেকে আলাদা হয়ে বাঁচতে পারবে না। বরং যদি আলাদা হয়, বেঁচে থাকবে জীবন্ত লাশ হয়ে।

কেন জানে না এতদিন যে মাকে নিয়ে গর্ব হতো তার, সে মাকে ঘৃণা করতে ইচ্ছে করছে। মনে হচ্ছে এই মুহূর্তে সবচেয়ে কুৎসিত দেখতে মানুষটা তার গর্ভধারিণী মাতাই। ফারহা কিছু বলার বা সান্ত্বনা দেয়ার সাহস করে উঠতে পারল না। সত্যি বলতে কাউকে খুন করে সান্ত্বনা দেয়াটা নিছক বিলাসিতা বৈ কিছু নয়। তাই সে চেষ্টা না করাই উত্তম।

অধিক মদ্যপানে মানুষ যেমন নিজের উপর থেকে নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলে ঠিক তেমনই আভার অবস্থা। টলটলে পায়ে হাঁটছে সে। পৃথিবীর কোনোদিকে হুঁশ নেই তার। রাস্তায় বেরিয়ে উন্মাদের মতো হেঁটে কোনোরকম একটা রিকশায় ওঠল। বাসায় কীভাবে এসেছে সে বোধহয় নিজেই জানে না। রুমে এসে সটান শুয়ে পড়ল বিছানায়। মাথার উপর ঘুরতে থাকা ফ্যানটার দিকে তাকিয়ে রইল শূন্য চাহনিতে। পাশের রুমে থাকা অন্তরা তাকে দেখে অস্বাভাবিক লাগায় এসে বলল, “তোমার কী শরীর খারাপ লাগছে?”

“আমি ঠিক আছি। একটু একা থাকতে চাই।” ক্ষীণস্বরে বলল সে।

“আসলে কাল আমাকে বাবা কল দিয়েছেন এখনই বাড়ির উদ্দেশ্যে রওনা দিতে। আমি এখনই বেরিয়ে যাব। তোমাকে বলব বলে অপেক্ষা করছিলাম।”

আভা দূর্বল গলায় বলল, “যাও।”

অন্তরা আলো নিভিয়ে দরজাটা ভেজিয়ে দিয়ে চলে গেল। কিছুটা সময় বুদ্ধিভ্রষ্টের মতো থেকে ডুকরে কেঁদে উঠল সে। উপুড় হয়ে বালিশে মুখ গুঁজে বিছানার চাদরটা খামচে ধরে অঝোরে অশ্রুপাত করতে লাগল। সন্ধ্যা নেমেছে অনেকক্ষণ আগে। অন্ধকার ঘরে সে হাহাকার করছে। সবচেয়ে প্রিয় মানুষকে হারানোর ব্যাথা যে এত তীব্র হয়, এতটা প্রখর হয় জানা ছিল না। মনে হচ্ছিল কেউ অযুত-লক্ষ তীর বুকের ভেতর গেঁথে দিয়েছে। যার যন্ত্রণায় ডাঙায় উঠা মাছের মতো ছটফট করছে সে। ক্রমশ বক্ষঃস্থল শূন্য হতে লাগল। নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে আসছে।

তুষার অনেকটা সময় অকারণে রাস্তায় পথহীন পথিকের মতো ঘুরেছে। অনেক চেষ্টা করেও নিজের গন্তব্য খুঁজে পাচ্ছে না। তবে কী সেও নাম লেখাবে সেই হাজার বছরের দিশেহারা পথিকের পথে। যারা অনন্তকাল ধরে হেঁটে গেছে গন্তব্য আর মেলেনি।

দিশাহীন হয়ে ঘুরতে ঘুরতে কখন রাত নয়টা ভেজে গেছে সে বুঝতেই পারেনি। হঠাৎ তার মনে হলো পথের দিশা পেয়েছে। তড়িঘড়ি করে ঘড়ি দেখে দ্রুত হাঁটতে লাগল। আচমকা মনে হলো কোনো অশরীরী শক্তি তার উপর চেপে বসেছে। পৌঁছে গেল সেই গন্তব্যে।

আভার বাসার সামনে নেমে দারোয়ানকে দেখল। তাকে কোথাও দেখতে না পেয়ে তাড়াতাড়ি করে সিঁড়ি বেয়ে উপরে উঠতে লাগল। হয়তো দারোয়ান বাথরুমে গিয়েছেন। মনে মনে আল্লাহর কাছে শুকরিয়া জানাল। তিনি থাকলে নিশ্চয়ই ডুকতে দিতেন না। তাড়াতাড়ি করে উপরে উঠে আভার বাসার কলিং বেল বাঁজাল। কিন্তু কোনো সাড়া শব্দ পেল না।

অন্তরা যাওয়ার সময় বাইরে থেকে দরজা দিয়ে গেলেও আভা ভেতর থেকে বন্ধ না করায় তুষার একবার লক ঘোরাতেই দরজা খুলে গেল। তুষারের ধীর পায়ে ভেতরে ঢুকল। সামনের রুমটায় কাউকে দেখতে না পেয়ে বুক ধুকপুক করছে তার।

ভেতরের রুমে গিয়ে দেখে আভা এলোমেলো হয়ে ঘুমিয়ে আছে। চুলগুলো সামনের দিকে চোখের উপর ছড়ানো। একটা বালিশকে জড়িয়ে রেখেছে। পা অর্ধেক খাটের বাইরে।

ফারহা তুষারকে কল দিয়ে তাকে জানিয়েছিল আভা তাদের বাড়ি গিয়েছিল মায়ের সাথে হওয়া সব কথা বলেছে। তাই সে চিন্তিত। পাশে বসে আভার কপালে হাত দিয়ে মৃদুস্বরে ডাকল। তুষারের বুকের রক্ত হিম হয়ে আসে। আভা কোনো কথা বলছে না কেন?”

ইনশাআল্লাহ শেষ পর্ব আসছে

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here