আঁধারে ঢাকা ভোর পর্ব-৫

0
1599

#আঁধারে_ঢাকা_ভোর
#পাঁচ
প্রজ্ঞা জামান দৃঢ়তা

আভাকে গ্রামের বাড়ি না নিয়ে, সোজা চট্টগ্রাম নিয়ে এসেছে শাহিদ। তাকে বাসায় অনেকটা সময় হলো এনেছে।

আভাকে যে রুমটায় বসানো হয়েছে সেটায় বেশ সৌখিনতার ছাপ আছে। একটা রাজকীয় খাট, তার সামনে একই ধাচের ড্রেসিং টেবিল। ডানপাশে ওয়াল আলমারিটা ঠাঁই নিয়েছে অনেকটা জায়গা জুড়ে। বাঁ পাশে একই নকশার ওয়ারড্রব। তার উপর ফুল দানিতে কাঁচা গন্ধরাজ ফুল। যার সুগন্ধে পুরো ঘর ম ম করছে। প্রতিটি ফার্নিচারে কায়দা করে সুন্দর নকশা করা, যা ঘরের সৌন্দর্য বাড়িয়ে দিয়েছে শত গুণে।

এই এত বড় ঘরে বসে থেকেও তার মন শান্তি হচ্ছে না। কারো পায়ের শব্দে সে সতর্ক হয়ে গেল। একজন মাঝ বয়সি মহিলা ধীর পায়ে এগিয়ে আসছেন তার দিকে। সে চোখ মেলে দেখল পরনে ছাই রঙের জামদানী শাড়ি, চুল গুলো পরিপাটি, ফর্সা মতো দেখতে মহিলাটির চেহেরায় একটা আভিজাত্যের ভাব আছে।

এই মুহুর্তে তার ঠিক কী করা উচিত সে বুঝতে পারছে না। মন ভীষণ ভার হয়ে আছে।

ভদ্রমহিলা তার পাশে এসে বললেন, “আমি শাহেনা হায়দার, তোমার শাশুড়ি।”

আভা খাট থেকে নেমে এসে সালাম করল শাশুড়িকে। শাহেনা হায়দার হাতে থাকা ছোট বাক্স থেকে এক জোড়া সোনার চুড়ি বের করে বউয়ের হাতে পরিয়ে দিতে দিতে বললেন, ” হায়দার বাড়ির বউদের এই ঐতিহ্য। সবসময় পরে থাকবে এগুলো।”

ছোট বেলা থেকেই আভার সোনা গহনা নিয়ে কোনো আগ্রহ ছিল না। তার কাছে সুন্দর মানে মনের পবিত্রতা, শুদ্ধতা।

ভদ্রমহিলা গম্ভীর গলায় বললেন, ” শোন বউ! মেয়ে মানুষের জীবন হচ্ছে পুরুষের জন্য। আমার ছেলে এমনিতেই খুব ভালো, কিন্তু তার কয়েকটি বিষয়ে খামখেয়ালি আছে, যেমন ধর রাতে দেরি করে বাসায় ফিরে, বন্ধুবান্ধবদের সঙ্গে আড্ডা বেশি দেয়। তুমি ভয় পেও না। সব পুরুষই বিয়ের আগে একটু আধটু এমন করে, কিন্তু বউ এলে সবাই ঠিক হয়ে যায়। তুমি তোমার সবকিছু দিয়ে তাকে আগলে রাখবে। আমার ছেলেটা অবুঝ।”

আভা কথাগুলো শুনল কিন্তু কোনো প্রতিক্রিয়া দেখাল না। ভদ্রমহিলাকে এই মুহুর্তে সে ভালো করে বুঝতে না পারলেও, এটা বুঝেছে তার ছেলের প্রতি ভালবাসাটা একটু বেশি। নয়তো এত বড় ছেলেকে ‘অবুঝ’ বলতেন না।

তিনি বললেন, “এই শাড়ি পাল্টে সুতি শাড়ি পরে নাও। আমার সাথে রান্নাঘরে যাবে। একটুপর তোমার শ্বশুর চলে আসবেন। আসলে তিনি একটা কাজে বাইরে ছিলেন তাই তোমাদের বিয়েতে যেতে পারেনি।।

আভা বলল, ” জি আচ্ছা।”

★★★

আসাদ হায়দার কিছুক্ষণের মধ্যে বাসায় প্রবেশ করলেন। রান্নাঘরের দিকে তাকাতেই আভাকে দেখতে পেলেন। ধারণা করলেন এই অপরিচিতা মেয়েটা হলো তার একমাত্র ছেলের সদ্য বিয়ে করা বউ।

শাহেনা হায়দার আভাকে ইশারায় শ্বশুরকে সালাম করার জন্য বললেন। চুপচাপ সে সালাম করল। হায়দার সাহেব গভীর দু’চোখ মেলে দেখলেন কৃষ্ণ বর্ণের মেয়েটাকে। ঘোমটার আড়ালে তার বুদ্ধিদীপ্ত দুটো চোখ স্পষ্ট, সে চোখ জুড়ে রাজ্যের মায়া। তার ষাটোর্ধ্ব বয়সের জীবনে এমন মেয়ে তিনি খুব কম দেখেছেন। যার গায়ের রঙ কালো অথচ মুখখানায় শ্বেতাঙ্গদের চেয়ে অনেক বেশি মায়া, যার সৌন্দর্য, নয়নাভিরাম! তার অভিজ্ঞতা বলছে এই মেয়ে পারবে তার সংসারকে বাঁচাতে।

এই মুহুর্তে নতুন বউয়ের মুখ দেখে কী দিবেন সেটা ভাবতেই পকেট থেকে হাজার টাকার দুটো নোট বের করে দিলেন। আভা নিতে চাইল না। শ্বাশুড়ির কথায় অগত্যা তাকে নিতেই হলো।

★★★

শ্বশুর বাড়িতে আভার কোনোরকম দিন কাটতে লাগল। হায়দার সাহেব তাকে কোচিং করার অনুমতি দিয়েছেন, শ্বাশুড়ির তাতে ঘোর আপত্তি। তিনি কিছুতেই চান না, সে পড়াশোনা চালিয়ে যাক। শহরে থাকলেও তার ধ্যান ধারণা বড্ড সেকেলে। তিনি মনে করেন ঘরের বউ বেশি বাইরে গেলে খারাপ হয়ে যায়। কিন্তু হায়দার সাহেবের সেই এক কথা তিনি চান তার বউমা পড়াশোনা করুক। তাছাড়া আভার পূর্ববর্তী পরীক্ষা গুলোর ফলাফল দেখে তিনি অবাক এবং একইসাথে খুশি হয়েছেন। তিনি মনে করেন এমন মেয়েকে শুধু সংসারে আটকে রাখার কোনো মানে হয় না।

শাহেনা বেগম অনেক চেষ্টা করেও স্বামীকে বুঝাতে পারেননি। এই সংসারে তার কথায় সব হলেও, স্বামীর কথার উপর সিদ্ধান্ত নেয়ার সাহস তার নেই। তাই অনিচ্ছাসত্ত্বেও মেনে নিলেন। তবে মনে মনে পণ করলেন যে করেই হোক আভার পড়াশোনা বন্ধ করবেনই।

আভা এতদিনে বুঝে গেছে শাহিদের এই নিয়ে কোনো মাথা ব্যাথা নেই। সে থাকে সারাদিন তার জগৎ নিয়ে। খুব একটা বাসায় থাকে না। স্ত্রী, সংসার কোনোকিছুর প্রতি তার কোনো টান দেখা যায় না। হায়দার সাহেব জানয়েছিলেন শাহিদ নাকি ব্যবসার কাজে সাহায্য করে না।

তাহলে গভীর রাত অবধি সে কোথায় থাকে! তার সাথে যে খুব একটা সময় কাটায় সেটাও নয়। ওই যে রাতে কিছুটা সময় আসে, এটাই তাদের সম্পর্ক। খুব একটা কথা হয় না, দেখাও হয় না। সে খুব বুদ্ধিমতী মেয়ে এটুকু নিশ্চয়ই বুঝতে পারে যে, তার স্বামীর তার প্রতি কোনো আলাদা অনুভূতি নেই। তাদের সম্পর্ক একটা গন্ডিতে সীমাবদ্ধ। যার অর্থ আলাদা করে বের করতে হলে কতগুলো বিশ্রী শব্দ বেরিয়ে আসবে।

অবশ্য সে যে শাহিদকে ভালবাসতে পেরেছে তাও নয়। কাউকে ভালবাসার জন্য যে সময় ও পরিবেশ লাগে তার কোনোটাই সে পায়নি। শুধু মাত্র কারো শয্যাসঙ্গী হয়েই কাউকে ভালবাসা যায়, এটা মানতে সে নারাজ।

তার কাছে ভালবাসার ব্যাখ্যা একটু ভিন্ন!

এতে অবশ্য তার কোনো খারাপ লাগাও নেই, না কোনো ভালো লাগা আছে। বিয়ে, সংসার, স্বামী নিয়ে কখনো সে স্বপ্ন দেখেনি। হয়তো তার জন্যই এমন একটা জটিল বিষয়েও তাকে বিষন্নতা ছুঁতে পারেনি।

তবে শাহিদের দিনরাত বাইরে থাকাটা তাকে ভাবায়। আবার এটাও ভাবায় শাহিদের মতো সুদর্শন, ধনী পরিবারের ছেলে তাকে কেন বিয়ে করল! সে চাইলেই অনায়াসে অনেক সুন্দরী মেয়েকে স্ত্রী হিসেবে পেত।

তবে কী এর পেছনে কোনো বিশেষ কারণ আছে?

পড়ার টেবিলে বসে অনেকটা সময় ধরে এমন নানা এলোমেলো ভাবনা মাথায় ঘুর ঘুর করছে আভার।

হঠাৎ এসব ভাবার পেছনে অবশ্য একটা কারণ আছে।

সেটা হচ্ছে আজ শ্বশুর ও শ্বাশুড়ির মধ্যে খানিকটা বাক্যালাপ সে শুনেছে। আড়ি পেতে শুনেছে এমনটা নয়। তাদের রুমের পাশ হয়ে ড্রয়িং রুমে আসার সময় কিছু কথা অনিচ্ছাসত্ত্বেও তার কানে আসে।

হায়দার সাহেব বেশ ঝাঁঝালো গলায় তখন বলছিলেন, “বিয়ের পরও তোমার ছেলে এসব করে বেড়ায়, একটুও নিজেকে পরিবর্তন করেনি। ব্যবসায় বসতে বলছি, সেটাও করছে না। এভাবে দিন যেতে লাগলে, সামনে খুব খারাপ সময় আসতে চলেছে।”

“এই জন্যই তো বলেছি মেয়েটাকে পড়াশোনা না করাতে।” এই বাক্যটি ছিল শ্বাশুড়ির।

এরপর আর কিছু শুনতে পায়নি সে। দুরত্ব বাড়ায় গলার আওয়াজ শোনা যায়নি। তারপর থেকে নানা ভাবনা মাথায় চড়ে বসেছে। শ্বাশুড়ির শেষ কথাটিতে সন্দেহ বেড়েছে শত গুণে।

★★★

এই এত বড় বাড়িটা শূন্য হয়ে থাকে। হায়দার সাহেব চলে যাওয়ার পর বউ শ্বাশুড়ি দুজন থাকে। আভার কেমন দম বন্ধ হয়ে আসে এখানে। এই যে বাড়িটা এতো সুন্দর করে দামি দামি আসবাব দিয়ে সাজানো, সবকিছু পরিপাটি তাও তার মন টিকে না। মনে হয় যে শান্তি তার ছোট্ট মেস ঘর, কিংবা গাঁয়ের তার বাবার ছোট্ট বাড়িতে ছিল, তার বিন্দু পরিমাণ এখানে নেই। এখানে শুধু কংক্রিটের দেয়াল আছে। কাঠের আসবাবপত্র আছে। কিন্তু কোনো সৌহার্দ্য নেই, নেই কোনো ভালবাসার বন্ধন, না আছে শান্তি! এই বাড়ির সবাই নিজেকে নিয়ে ব্যস্ত। কেউ কারো কথা ভাবে না।

কোচিং থেকে এসে প্রায় বিকেলে ছাদে চলে যায় সে। মুক্ত আকাশে শ্বাস নিতে শান্তি লাগে তার। আজকাল শ্বাশুড়ি এই নিয়ে দু চার কথা শুনিয়ে দেন। আভার ভীষণ মন খারাপ হয়।

বাড়ির রান্না আভা নিজেই করে। বাকি কাজের জন্য এক বেলা এক মহিলা এসে করে দিয়ে যায়। আভা উনাকে আপু ডাকে এটায়ও শাহেনা বেগমের সমস্যা। কাজের মেয়েকে নাম ধরে ডাকবে, এমন আদিখ্যেতার কী আছে!

সে এমন তেরছা কথার কোনো উত্তর দেয় না। কিন্তু মর্জিনাকে নাম ধরেও ডাকে না। তার অত বড়লোক, ছোটলোকে বিশ্বাস নেই। সে মনে করে বয়সে বড় হলেই তাকে সম্মান দিতে হয়। এবার কার কাছে টাকা আছে, কার কাছে নেই, সেই চিন্তা তার নেই।
শুধু ভাবছে এ কোথায় এসে পড়ল সে!

ইনশাআল্লাহ চলবে

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here