আঁধারে ঢাকা ভোর পর্ব-৬

0
1751

#আঁধারে_ঢাকা_ভোর
#অধ্যায়_ছয়
প্রজ্ঞা জামান দৃঢ়তা

আভা তাদের ঘরের পেছন দিকের বাঁশের মাচাং এর উপর বসে আকাশের দিকে স্থির চোখে তাকিয়ে আছে। তার চোখে এক আকাশ শূন্যতা। ছাই রঙা আকাশটায় পড়ন্ত বিকেলের সোনালী আভার দেখা মিলছে। একটা পাখি পরম শান্তিতে দ্বিকবিদিক উড়াউড়ি করছে।

সে ভাবছে, “পাখির জীবন কত সুন্দর তাই না? যেমন ইচ্ছে উড়তে পারে।”

হায়দার বাড়ি থেকে এসেছে আজ দুইদিন হতে চলল। সেদিন শাহিদের এমন ব্যবহারের পর সে চলে আসে বাবার বাড়িতে। শফিক সাহেব মেয়েকে দেখে যেন হাতে চাঁদ পেয়েছেন। বিয়ের পর খুব একটা ভালো করে দেখা বা কথা কোনোটাই হয়নি। খুব ইচ্ছে করলেও লজ্জায় মেয়েকে দেখতে যেতেন না।

আভাকে দেখে রেহেনা বেগম অবশ্য খুশি হলেন না। বিয়ে না হতেই বাবার বাড়ি আসাটা তিনি ভালো চোখে নিলেন না। তাছাড়া জামাই-ও সাথে আসেনি। একা একা বউকে ছাড়লো কেন সেটাই বুঝতে পারছেন না।

শফিক সাহেব আভাকে দেখেই জড়িয়ে ধরেছিলেন, আভা ছিল নির্লিপ্ত। মনে হচ্ছিল জাগতিক কোনোকিছুতেই তার কোনো আগ্রহ নেই। এই দু’দিন তিনি মেয়ের সাথে কথা বলার অনেক চেষ্টা করেছেন কিন্তু সে কিছুতেই কিছু বলল না। বরং কৌশলে বাবাকে এড়িয়ে গেল। শফিক সাহেব সব বুঝেছেন, তারপরও মেয়েকে কয়েকদিন সময় দিলেন। এরপর কথা বলবেন বলে ভেবে রাখলেন। আসছে অবধি কিছু একটা নিয়ে ভীষণ চিন্তায় ভুগছে সে দেখেই বুঝা যাচ্ছে।

ধীরে ধীরে সন্ধ্যা নেমে আসছে, কমলা রঙের সূর্যটা ক্রমশ লাল বর্ণ ধারণ করে পশ্চিম দিকে হেলে পড়ছে। আভা এখনো সেখানে বসে আছে। বাবা এসে বসলেন তার পাশে। সে তাকায়নি, তবে বুঝতে পেরেছে তার পাশে বাবা এসে বসেছেন।

শফিক সাহেব কিছু সময় চুপ করে রইলেন তারপর বললেন, “আমি তোর অপরাধী মা। তুই এখনো আমার উপর রাগ করে আছিস? এসেছিস পর্যন্ত কোন কথা বলিসনি। সেদিন আমি তোকে বলতে চেয়েছিলাম কেন এই বিয়েতে আমি রাজি হয়েছি। কিন্তু তুই শুনতে চাসনি।”

মেয়ের কাছ থেকে কোনো উত্তর না পেয়ে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন, ” বলেছিলি তোর বাবা যা করবে ভালোর জন্য করবে। তাই তুই তোর বাবাকে কোনো প্রশ্ন করবি না। তাছাড়া তুই এ-ও বলেছিলি এমন কাজের পেছনে নিশ্চয়ই কোনো যুক্তিযুক্ত কারণ ছিল, নয়তো আমি কেন করব। তারপরও আমি জানি তোর আমার উপর অভিমান জমে আছে। তাই এভাবে মনমরা হয়ে আছিস।”

বাবার কথায় কোনো প্রতিক্রিয়া দেখাল না আভা, চুপচাপ বসে রইল।

তিনি আবার বললেন, ” তোর মনে আছে মা? ছোট বেলায় তোর অভিমান হলে তুই বলতি, ” বাবা আমায় নৌকায় ঘুরতে নিয়ে যাবে? আমি শাপলা তুলব। আমি তোকে নিয়ে একটা নৌকা ভাড়া করে ডাকাতিয়া নদীতে চলে যেতাম। তুই শাপলা তুলতি, যে গুমোট অন্ধকার মুখ নিয়ে তুই বের হতি। সে অন্ধকার মুখটা মুহুর্তেই প্রভাতের মিষ্টি আলোর মতো ঝিকঝিক করে ওঠত।
গাল ফুলিয়ে বাচ্চাদের মতো বলতি, “আমার খুব অভিমান হয়েছিল তোমার উপর বাবা!”

তুই কোনোদিন অভিমানের কারণ বলতি না। আমি কারণ জিজ্ঞেস করলে বলতি, “থাক না বাবা যেটা চলে গেছে সেটা কেন জানতে চাইছো, পুরনো কথা কখনো শান্তি আনতে পারে না?”

তোর এমন গুছানো কথা শুনে মনে হত তুই বয়সের চেয়ে অনেক বেশি পরিণত। আমার গর্ব হত তোর জন্য। তোর বুদ্ধির ধার তরবারির চেয়েও অধিক। কিন্তু গত দুইদিন তোর নীরবতা আমাকে সবচেয়ে বেশি আঘাত করেছে। মনে হয়েছে তোর প্রতিটি দীর্ঘশ্বাস আমার বুকে তীরের মতো বিঁধেছে। তোর নীরব কথার ঝুলি আমাকে চূর্ণবিচূর্ণ করেছে। আমাকে দয়া কর মা। আমার ভুলের জন্য যা খুশি বল, কিন্তু চুপ থাকিস না।”

আভা বিষন্ন গলায় বলল, “আমাকে নদীতে নিয়ে যাবে বাবা?”

শফিক সাহেব বিশ্বজয়ের হাসি দিয়ে বললেন, “চল মা, এখনই চল আমি তোকে নদীতে নিয়ে যাব।”


আভার পরনে নীল রঙের সুতি শাড়ি, একটা টর্চ নিল। এখনই সন্ধ্যা নেমে এসেছে। ফিরতে ফিরতে রাত হয়ে যাবে। শফিক সাহেব নাফিজাকে বললেন, “তোর মা কই?”

বোনের দিকে আঁড়চোখে তাকিয়ে নাফিজা ক্যাটকেটে গলায় বলল, “আম্মা রাহেলা চাচির বাড়ি গেছে, কিন্তু আপনে কই যান বাবা?”

“আমরা নদীতে যাচ্ছি, ফিরতে দেরি হবে তোর মাকে বলে দিস।”

” আমিও যামু বাবা,সবসময় তো ওরে লইয়া যান, আজ আমারে লইয়া চলেন?”

“না, আজ তোকে নিতে পারবো নারে মা, পরে একদিন নিয়ে যাব।” শফিক সাহেব নাফিজার মাথায় হাত রেখে বললেন।

নাফিজা কী একটা বলতে নিলে, পাশের রুম থেকে অনিক বেরিয়ে এসে ধমকের সুরে বলল, ” নাফিজা চল পড়তে বসবি, আজকে আমি তোকে পড়াব, কাল মাহবুব স্যার বললেন তুই নাকি পড়াশোনা একদম করিস না। চল এখনি পড়তে বসবি।”

শফিক সাহেব যেন হাফ ছেড়ে বাঁচলেন। আভাকে নিয়ে বেরিয়ে পড়লেন। নদী খুব বেশি দূরে নয়, বাড়ি থেকে মিনিট পাঁচেক হাঁটলেই ডাকাতিয়া নদী। অক্টোবর মাস নদীতে পানি ভরপুর।

এই মৌসুমে নানা জায়গা থেকে মানুষ নৌকায় ঘুরতে আসে। পুরো একদিনের খাবার নিয়ে আসে তারা। মাইক মিউজিক সব নিয়ে এসে গান ছেড়ে নাচে। সেসব দেখতে নদীর পাড়ে কত উৎসুক জনতা এসে ভীড় করে তার কোনো হিসেব নেই। পাড়ার মেয়েরা দৌঁড়ে ছাদে চলে যায় দেখার জন্য, কারণ তাদের রাস্তায় বেরুতে দেয় না পরিবার এমন সময় গুলোতে।

আভা ভাবছে স্বপ্নপুর গ্রামটা খুব সুন্দর। এর নয়নাভিরাম সৌন্দর্য দেখলেই মনে আলাদা একটা শান্তি আসে। শফিক সাহেব নৌকা ভাড়া নিয়েছেন দুই ঘন্টার জন্য।

আভা নৌকায় বসে আছে চুপচাপ, নদীর স্বচ্ছ জলে নিজের প্রতিচ্ছবি আনমনে দেখছে আর ভাবছে, “এই যে জলের আয়নায় মানুষের যে প্রতিচ্ছবি দেখা যায়, সেটা কতটুকু সত্যি! দেহের আয়নায় কী মনের ছায়া দেখা যায়? মানুষের মনের শুদ্ধতা কিংবা অশুদ্ধতা! সবকিছু কেন দেহের আরশিতে স্পষ্ট অবলোকন করা যায় না। তাহলে তো এত এত মুখের আড়ালে মুখোশগুলো নিমিষেই পড়ে ফেলা যেত। তাহলে তো কাউকে বিশ্বাস করে আর ঠকতে হত না।”

শফিক সাহেব মেয়ের দিকে অনিমেষ দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলেন, তীরের মতো জোড় ভ্রুযুগলের নিচে, সুদীর্ঘপল্লব যুক্ত নয়নে অতলান্তিক গভীরতা, সেই গভীর চোখ দুটোতে যেন কত-শত লুকানো কথা বলে যাচ্ছে অনায়াসে। সুন্দর মুখশ্রীতে মায়ার ঝলকানি। সে মায়া মিশে গেছে গভীর চোখের তাঁরায়। তিনি মনে করেন তার মেয়ের মুখে সেই সব সৌন্দর্য আছে যা অন্য শ্বেতাঙ্গ মেয়েদের চেহেরায়ও থাকে না। তারপরও একদল মানুষ কত সহজে তাকে নিয়ে উপহাস করে! তাদের কাছে গায়ের রঙটাই যে সব। এর বাইরে গেলে বর্ণবাদীদের যে সম্মান খোয়া যাবে। বড্ড অদ্ভুত এই পৃথিবীর মানুষগুলো, তারা মনের চোখ দিয়ে না দেখে শুধু বাইরের রঙচঙ দেখতেই ব্যস্ত। অথচ নির্দ্বিধায় অন্যকে কথার আঘাতে ক্ষতবিক্ষত করতে এতটুকু চিন্তা করে না। ধিক্কার সেসব মানুষদের যারা মানুষকে মানুষ হিসেবে না দেখে নিচু চোখে দেখে।

★★★

“আহ! বাবা কী করছো বৈঠা হাত থেকে চলে যাবে তো। শক্ত করে ধরো।”

নানারকম ভাবনায় আভার কথায় তার হুস ফিরে আসে। খেয়াল করে দেখলেন তার হাত আলগা হয়ে আছে, সত্যিই আরেকটু হলে স্রোতের টানে বৈঠা চলে যেত ঢেউয়ের সাথে।

আভা একের পর এক শাপলা তুলে নিচ্ছে, ক্রমশ তার ঠোঁটের কোণে মিষ্টি হাসি ঝিলিক দিচ্ছে। বাবা হয়ে সন্তানের মুখের হাসি দেখা যে কতটা সুখের তা কেবলমাত্র এক বাবাই বুঝতে পারেন। তিনি মেয়েকে কিছুই জিজ্ঞেস করলেন না, কারণ তিনি জানেন সে এবার নিজ থেকে সব বলবে। হলোও তাই সন্ধ্যা নামতেই সে কম্পিত গলায় বলল, “বাবা?”

তিনি এই ডাকের সাড়া দিতে পারলেন না। কারণ তার মনে হচ্ছে এই মুহুর্তে এই শব্দটা পৃথিবীর সবচেয়ে সুখের শব্দ! এতদিন যেন তিনি এই সুমধুর ডাকের অপেক্ষায় ছিলেন। তাই চেয়েও তিনি উত্তর দিতে পারেননি। কিন্তু মন প্রাণ দিয়ে অনুভব করলেন নিজের পিতৃত্বকে।

সে আবার বলল, “ও বাবা।”

এবার অপর পাশ থেকে মৃদুস্বরে উত্তর আসলো,”জি আম্মা।”

“আমি যদি আর ওই বাড়ি না যাই, তুমি কী রাগ করবে?”

শফিক সাহেব থমকালেন কথাটা শুনে। কিন্তু একটুও উত্তেজিত হলেন না। মৃদুস্বরে বললেন, “কী হয়েছে মা, সব আমাকে খুলে বলো?”

“বাবা আমার শাশুড়ি আমার গায়ের রঙ নিয়ে সর্বক্ষণ কথা শোনান। উনার ছেলে মদ খেয়ে এসে পড়ে থাকে, আমি কিছু বললে গায়ে হাত তুলে। সেদিন তো বলল আমাকে বিয়ে করেছে যাতে আমি তার সব দেখেও চুপ থাকি। কেননা আমি দেখতে সুন্দর না, আমার বাবার টাকা নেই তাদের মতো। তাদের পরিবারে খেতে, পরতে পাচ্ছি এইতো অনেক। তাছাড়া এমন অনেক কথা বলেছেন যা আমি বলতে পারছি না। আর এমন অনেক বিষয় আছে যা আমার পক্ষে তোমাকে বলাও সম্ভব নয় বাবা।”

মেয়ের কথা শুনে তিনি হতবুদ্ধি হয়ে গেলেন! এমনটা যেন তিনি স্বপ্নেও ভাবেননি। রেহেনা বেগম তাকে বলেছিলেন, ছেলে ভালো, আর্থিক অবস্থা ভালো, তাছাড়া আভার পড়াশোনায় কোনো ব্যাঘাত ঘটবে না। তাই তিনি বিয়েতে রাজি হয়েছেন, তাছাড়া আরও একটা বিশেষ কারণ আছে যা তিনি কোনোদিনও মেয়েকে বলতে পারবেন না। বাবা হিসেবে আজ নিজেকে খুব অসহায় মনে হলো তার।

যে মেয়েকে সবসময় সমাজের কটাক্ষের থেকে রক্ষা করার জন্য ঘর থেকে শুরু করে বাইরের মানুষের সাথে লড়াই করে গেছেন, সেই মেয়েকে কিনা আজ এমন একটা ঘরে পাঠালেন, যেখানে তাকে সম্মান তো দূর, প্রতিনিয়ত অপমানে জর্জরিত করেছে।

বিয়ের মাত্র দুই মাস না হতেই এই অবস্থা তাহলে বাকী জীবন তারা তো মেয়েকে পিষে ফেলবেন। আজকাল এমন কত হচ্ছে শ্বশুরবাড়ির লোকেরা মেরে পর্যন্ত ফেলছে মেয়েদের। সেখানে বাবা মায়ের কান্না ছাড়া কিছুই করার থাকছে না। তবে কী এমন কিছু তার জীবনেও ঘটতে চলেছে। না এটা হতে পারে না। তিনি কিছুতেই এসব হতে দিবেন না। ওই পরিবারের সাথে কথা বলবেন, কালই কথা বলবেন। তারা সব জেনে শুনে কেন বিয়ে হতে দিয়েছেন। ছেলের মা তো প্রায় এসে বসে থাকতেন, অথচ কতদিন উনি উপেক্ষা করে গেছেন এই মহিলাকে। কিন্তু ভালো মানুষীর মুখোশ পরে সুন্দর সুন্দর বুলি আওড়াতেন তিনি।

তার মনে হয়েছিল এরা মানুষ ভালো। তবে সেসব মিথ্যে ছিল! মানুষ এমন হয় তিনি জানতেন। তবে তার সাথেই এমন কিছু হবে এটা যেন ভাবতেই পারেননি। একইসাথে তার রাগ ও দুঃখ দুটোই হচ্ছে।

মুখ ও মুখোশের যে এতো আড়াল তিনিই বুঝতেই পারেননি। সমাজের একদিকের কথা থেকে বাঁচাতে গিয়ে, অন্য পথের দিকে মেয়েকে ঠেলে দিয়েছেন। সবকিছুর জন্য নিজেকে দায়ী বলে মনে হচ্ছে তার।

সেদিন যদি স্ত্রীর কথামতো বিয়েতে রাজি না হতেন তবে এইদিনটি কোনোদিন তাদের জীবনে আসতই না। এক পিতার কাছে সন্তানের এমন কষ্টের জীবন অভিশাপ বৈ আর কিছু না। শফিক সাহেবের হাত আলগা হয়ে আসছে, বৈঠা ধরার শক্তি ক্রমশ হ্রাস পাচ্ছে। তার বুকের ভেতর বয়ে যাচ্ছে এমন আরেকটি স্রোতস্বিনী নদী। সেই নদীতে যেন প্রলয়ঙ্কারী ঘূর্ণিঝড়, জলোচ্ছ্বাস, সিডর বয়ে যাচ্ছে অবিরত। অভিজ্ঞতা বলছে তার ভালো মেয়েটার কপালে গায়ের কালো রঙের দণ্ড হিসেবে অপেক্ষা করছে হাজার ভৎসনা, ও বঞ্চনা। এই সমাজের মানুষগুলো যে মেয়েটাকে আবার ভেঙে টুকরো টুকরো করে দিবে ভাঙা কাঁচের মতো! সেই ছোটবেলা থেকে মেয়েটা মানুষের কটুবাক্যের দ্বারা প্রতিনিয়ত জর্জরিত হয়েছে। অনেকগুলো বছর লেগেছিল তখন সব সামলাতে। যখনই সব সামলে নিজেকে শক্ত করে সামনে এগিয়ে যেতে চেয়েছে তখনই বিয়ে নামক শিকলে আষ্টেপৃষ্ঠে তাকে জুড়ে দেয়া হয়েছে।

আজ পর্যন্ত মেয়েটা শুধু কষ্টই পেল। না পেয়েছে জীবনে সুখ, না শান্তি! আজ বাবা হিসেবে নিজেকে অতি নগন্য বলে মনে হচ্ছে, অক্ষম বলে মনে হচ্ছে।

ছোটবেলা থেকে না পেয়েছে মায়ের আদর, ভালবাসা। পেয়েছে শুধু কথার আঘাত, কিংবা বেতের প্রহার। তার অনুপস্থিতিতে রেহেনা বেগম প্রায় মারতেন আভাকে। সারাক্ষণ সুযোগ খুঁজতেন কীভাবে মেয়েটাকে প্রহার করা যায়। অদ্ভুত শক্তি ছিল মেয়েটার কোনোদিন বাবাকে বলত না এসব বিষয়ে। কিন্তু অনিক বাবার কানে চুপিচুপি সব বলে দিত। তাইতো সবসময় চেয়েছেন মেয়েটাকে অন্য সন্তানদের থেকে আগলে রাখতে। কারণ ওদের তো মা আছে আগলে রাখার জন্য, কিন্তু আভা যে সে স্থানটি কোনোদিন পায়নি।

ঝড় আসলে মুরগির বাচ্চাগুলো যেমন মায়ের ডানার নিচে আশ্রয় খুঁজত, তেমনি বাকি দুই ছেলেমেয়ে তাদের মায়ের ডানায় আশ্রয় পেলেও, এই মেয়েটি পেত না। প্রবল ঝড়ে সে একমাত্র আশ্রয় খুঁজে নিয়েছে বাবা নামক ব্যাক্তিটির ডানার আড়ালে। কিন্তু বাবা হয়ে কী আজও তিনি পেরেছেন মেয়েকে সব ঝড় থেকে রক্ষা করতে! জীবনের এই মুহুর্তে এসে তার সমস্ত জীবনটাকেই ব্যর্থ বলে মনে হচ্ছে।

আভা বাবার অবস্থা বুঝতে পেরেছে। তার ভেতর এখন কী চলছে সে তার জানা। তাই হাসার চেষ্টা করে বলল, “ও বাবা কী ভাবছো এত? আমি সব সামলে উঠতে পারব। শুধু তুমি আমার পাশে থেকো।”

তিনি জোর পূর্বক হাসার চেষ্টা করলেন, কিন্তু সে হাসি আর ফুটে উঠতে পারল কই!

তিনি মেয়েকে শুধু এটাই বললেন, “আমার উপর আস্থা রাখ মা, তোর বাবা থাকতে তোর আর কোন ক্ষতি হতে দিবে না।”

জানি না এই কথায় আভা কী পেল, অন্ধকার রাতের শেষে সূর্যদয় যতটা উজ্জ্বল হয়ে ওঠে, ঠিক ততোটাই আলোকিত ঝলমলে এক চওড়া হাসি ফুটে উঠল তার ঠোঁটের কোণে। বাবা মেয়ে আর কোনো কথা বলল না। তারপরও দুজন দুজনকে বুঝে নিলো অব্যক্তরূপে। এই দুজন মানুষ জানে তাদের ভেতরে বয়ে যাচ্ছে সমুদ্রের গর্জন। তারপরও দুজন দুজনের প্রতি এতটা ভরসা করে, যা সাধারণ আট দশটা বাবা মেয়ের মধ্যে দেখা যায় না।

রাত নেমে এসেছে স্বপ্নপুর গ্রামের সেই ডাকাতিয়া নদীতে। অন্ধকার মেঘলা আকাশে সব মেঘকে দূরে ঠেলে আবির্ভাব হয়েছে থালার মতো গোলাকার একটা চাঁদ। সে চাঁদের আলোয় স্পষ্ট হয়ে আছে আভার হাস্যজ্বল মুখ। তিনি সে মুখে বিশ্বজয়ের আকাঙ্ক্ষা ও সাহস দেখতে পাচ্ছেন। নিমিষেই তার অন্তর আত্মা যে ভয়ে ভীত ছিল, সে ভয় যেন কর্পূরের মতো উড়ে গেল। তার পরিবর্তে জায়গা করে নিল এক আকাশ স্বপ্ন, আর সেই স্বপ্ন পূরণের জন্য দরকার একটা সুযোগ । সেই সুযোগ মেয়েকে তিনি দেবেন। তার জন্য এই পৃথিবীর সবকিছুর সাথে লড়তে রাজি আছেন। মনে মনে স্থির করলেন আগামীকাল ভোরেই চট্টগ্রামের উদ্দেশ্য রওনা দেবেন। কথা বলবেন আসাদ হায়দারের সাথে। যদিও বিয়ে নিয়ে তার সাথে শফিক সাহেবের কথা হয়েছে খুবই কম। তারপরও এমন একটা সিরিয়াস বিষয়ে হায়দার সাহেবের সাথেই কথা বলা জরুরি। তার সম্পর্কে যা শুনেছেন মানুষ ভালো। তবে এবার নিজের ছেলেকে নিয়ে কতটা কী বলেন তা দেখার অপেক্ষায়।

ইনশাআল্লাহ চলবে

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here