আঁধারে ঢাকা ভোর পর্ব-৭

0
1501

#আঁধারে_ঢাকা_ভোর
#অধ্যায়_সাত
প্রজ্ঞা জামান দৃঢ়তা

শফিক সাহেব চট্টগ্রাম যখন এসে পৌঁছেছেন তখন সকাল নয়টা। তিনি হায়দার বাড়ির ড্রয়িং রুমে বসে আছেন। বাড়ির কেউ এখনো ঘুম থেকে ওঠেনি। মর্জিনা বাসার কাজ করছে।

শফিক সাহেব এসে পরিচয় দেয়ার পর মর্জিনা তাড়াতাড়ি করে সালাম করল তাকে খুশি খুশি গলায় বলল, “আপনে ভাবীর বাপ? জানেন খালু আপনারে দেখার আমার অনেক ইচ্ছা ছিল। কন ভালা মাইনষের এতো ভালা মাইয়া, তারে তো দেখাই লাগতো কন? আপনের মাইয়াডা খুব ভালা, কেউ কিছু কইলে মাতে না। মাইনষের লাইগা বহুত টান। আমারেও বহুত ভালোবাসে।”

শফিক সাহেব স্মিত হেসে বললেন, “আপনিও অনেক ভালো আম্মা।”

মর্জিনা কথাটা শুনে খুব খুশি হলো। তার চোখ দুটি আনন্দে জ্বলজ্বল করে ওঠেছে।

মর্জিনা বলল, “আপনার মতোই আপনার মাইয়া ভালা হইছে খালু, আপনে থাকেন আমি বড় ম্যাডামরে ডাইকা আইছি, ম্যাডাম আসতে নাকি সময় লাগবো। আর বড় স্যার অহনি আইবো।”

শফিক সাহেব খুব ইতস্ততভাবে জিজ্ঞেস করলেন, “তোমার ছোট সাহেব বাসায় নেই?”

মর্জিনা গলা নিচু করে উত্তর দিল, ” হে থাকলেই কী আর, না থাকলেই কী, রাতভর ছাঁইপাশ খাইয়া দিনভর ঘুমাইয়া থাকে। তার তো সময়ের ওত জ্ঞান নাই।”

শফিক সাহেব মর্জিনার কথাটা স্পষ্ট না হলেও বুঝে নিলেন শাহিদের ড্রিংকস করার কথা।

মর্জিনার সাথে কথা শেষ করে তিনি অনেকটা সময় পর্যন্ত বসেছিলেন। ঘড়িতে তখন প্রায় সাড়ে দশটা। শাহেনা হায়দার বেরিয়ে আসলেন। কোনোরকম জোর পূর্বক হাসার চেষ্টা করে কুশলাদি বিনিময় করলেন।

শফিক সাহেব কোনো ভনিতা ছাড়া কী হয়েছে এবং আভা বাবার বাড়ি কেন গেছে সেটা জানতে চাইলেন।

শাহেনা বেগম যেন তাতেই তেলে বেগুনে জ্বলে ওঠে বললেন, “আপনার বেয়াদব মেয়েকে সেটা জিজ্ঞেস না করে এখানে চলে এসেছেন? ”

“না সেটা করিনি তাকে জিজ্ঞেস করেছি, তবে সে-তো শুধু নিজের কথা বলেছে। এমনও হতে পারে আপনাদের কথা তার থেকে আলাদা হবে। তাই শুধু জানতে চাইছি?”

“আপনার মেয়ে আমার ছেলের কাছে সবকিছুর কৈফিয়ত চায়। আপনার মেয়ে মুখেমুখে কথা বলে। সারাক্ষণ পড়াশোনা নিয়ে পড়ে থাকে, সংসারের প্রতি মন নেই, এসব কোন পরিবার মেনে নিবে?”

শফিক সাহেব বললেন, ” আপনার ছেলে সারারাত কোথায় থাকে? তাছাড়া আভার প্রতি তার দ্বায়িত্ব কতটা পালন করেছে?”

ভদ্রমহিলা প্রশ্নগুলো শুনে আরও বেশি রেগে গেলেন। বললেন, “আমার ছেলে কোথায় যায়, সেই কৈফিয়ত কী আপনাকে দিতে হবে? তাছাড়া আপনার মেয়ে এত বড় বাড়ির বউ হয়েছে, এই বা কম কিসের। চেহেরার যে বাহার তাও এত অহংকার কোথায় থেকে আসে? আমার ছেলের যা খুশি করবে তাতে আপনার মেয়ের কী সমস্যা। বড়লোকের ছেলে দেখে বিয়ে দিয়েছেন, আর তার এমন একটু আধটু দোষ থাকবেই সেটা মেনে চলতে হবে।”

শফিক সাহেবের রাগ হলেও নিজেকে যথাসম্ভব নিয়ন্ত্রণ করার চেষ্টা করে কাঠকাঠ গলায় বললেন, ” বড়লোকের ছেলেরা বুঝি মদ খেয়ে পড়ে থাকে? মেয়ে নিয়ে ফুর্তি করে? আর এতে স্ত্রী কিছু জিজ্ঞেস করলেই দোষ হয়ে যায়, স্ত্রীর গায়ে হাত তুললে দোষ হয় না?”

শফিক সাহেবের কথা শুনে রাগে গর্জে উঠলেন শাহেনা হায়দার। তার মুখের উপর এমন কঠিন কথা কেউ শোনাতে পারেন এ যেন বিশ্বাসই হচ্ছে না! বরাবরই তিনি অহংকারী, দাম্ভিক, কুচুটে স্বভাবের মানুষ। তিনি কখনো তার বিরুদ্ধে কেউ কিছু বললে সহ্য করেন না। আজও তার বাইরে কিছুই হলো না।

তিনি প্রায় চিৎকার করে বললেন, “এত বড় সাহস আপনার আমার বাড়িতে এসে আমার ছেলেকে নিয়ে বাজে কথা বলছেন? আমাকে অপমান করছেন? আমার ছেলে কেমন সেটা আপনার স্ত্রীকে আগে থেকে জানিয়ে দেয়া হয়েছে। আপনাকে জানানোর কথা বলায় তিনি বলেছেন আমি আপনাকে যেন না বলি। এখানে আমরা কোনো প্রতারণা করে বিয়ে দেইনি।”

একটু থেমে দম নিয়ে আবার বললেন, “তাছাড়া আপনার স্ত্রী বলেছেন বড়লোকের ছেলেদের এমন একটু আধটু সমস্যা থাকতেই পারে এতে দোষের কিছু নেই। আপনার মেয়ের মতো কুৎসিত মেয়েকে আমার রাজপুত্রের মতো ছেলের বউ করে নিয়ে এসেছি এই কী অনেক না আপনার জন্য? আপনার মেয়ের কী এমন ঘরের বউ হওয়ার কোনো যোগ্যতা আছে? তারপরও তাকে বিয়ে করে এনেছিলাম, কেন জানেন? কারণ যার এত দূর্বলতা আছে সে নিশ্চয়ই আমার ছেলের সামান্য সমস্যা মেনে নিবে। নয়তো এমন অনেক ধনী পরিবার মেয়ে দেয়ার জন্য লাইন দিয়ে আছে।”

শফিক সাহেব হতবাক হয়ে যান এটা শুনে যে, রেহেনা বেগম সবকিছু জেনে বিয়েটা হতে দিয়েছেন! নিজের মেয়ে হলে সে কী এমন করতে পারত! তিনি জানেন আভাকে রেহেনা বেগম খুব একটা পছন্দ করেন না, তাই বলে এতটা অপছন্দও করেন না। কোথাও একটা আভার প্রতি তার মমতা আছে। কিন্তু আজ এই মুহুর্তে যা শুনলেন এরপর এটা বলার অপেক্ষা রাখে না যে, তিনি আভাকে নিজের ঘাড় থেকে নামাতে কেমন নোংরা খেলা খেলেছে! কী করে পারলেন তিনি এতটা নিচে নামতে! শফিক সাহেব নানা ভাবনায় এতো বড় একটা ধাক্কা সামলাতে পারেননি। দাঁড়ানো থেকে বসে পড়েন। তার শরীরে প্রতিটি রন্ধ্রে রন্ধ্রে অসাড়তা ভর করেছে। এমন অবাক তিনি জীবনেও হননি।

নিচে চিৎকার চেঁচা-মেচি শুনে শাহিদের ঘুম ভেঙে যায়, নিচে নেমে আসে কী হয়েছে দেখতে। শফিক সাহেবকে দেখে তার বিরক্তি চলে আসে। মাকে জড়ানো গলায় বলল, “কী হয়েছে মা?”

তিনি সব বললেন যা হয়েছে, তার সাথে আরও নানা রঙের ছটা দিয়ে বলায় মায়ের অন্ধভক্ত ছেলে রেগে যেন আগুনের কুন্ডলি হয়ে গেল।

অগ্নি মিশ্রিত গলায় বলল, “আমি যেমন এমনই থাকব সারাজীবন, আপনার মেয়ে এত বড় বাড়িতে বউ হয়ে এসেছে এটা আপনাদের চৌদ্দ পুরুষের ভাগ্য। আমি কারো জন্য নিজেকে এক চুলও পরিবর্তন করব না। এখন আপনারা যা খুশি করতে পারেন। যদি মনে হয় আপনার মেয়ে আসবে তবে নিজে এসে দিয়ে যাবেন। এত বড় বাড়িতে একজন মানুষের জায়গার অভাব হবে না। কিন্তু তাকে জানিয়ে দিবেন আমার জীবনে যাতে সে দখল না দেয়। আর একটি কথা আমার মায়ের কাছে ক্ষমা চেয়ে নিবেন, কারণ আপনি তাকে অপমান করেছেন। সব মেনে মেয়েকে দিয়ে গেলে যাবেন। নয়তো আপনার মেয়ের জন্য কেউ কান্নাকাটি করবে না।”

শাহিদের তিরিক্ষ মেজাজ যেন ফুলেফেঁপে উঠেছে সামনে থাকা মানুষটিকে কথার তরবারিতে কেটে টুকরো টুকরো করে দিল। শফিক সাহেব যেন এতগুলো ধাক্কা একসাথে নিতে পারলেন না। চুপচাপ বেরিয়ে গেলেন বাসা থেকে। কিন্তু মনে মনে একটা কঠিন সিদ্ধান্ত নেয়া হয়ে গেছে তার। চাইলে তিনি এদের প্রতিটি কথার উত্তর দিতে পারতেন। তিনি মনে করেন মূর্খদের সাথে তর্কে যেয়ে লাভের লাভ কিছুই হবে না। তাই ধীর পায়ে হেঁটে ফিরতি বাস ধরলেন।

পুরো রাস্তায় একটাই জিনিস মাথা ঘুরেছে রেহেনা বেগম কী করে এত খারাপ কাজ করতে পারেন। যে মেয়েকে পেয়ে মা হওয়ার প্রথম স্বাদ পেয়েছিল, আজ সে মেয়ের সাথে এতটা অমানবিক নিষ্ঠুর কাজ কী করে করতে পারে? তবে কী এত বছরের জীবনে মানুষ চেনায় তার কোথাও ভুল হয়েছে?

মনে পড়ে যায় বিয়ের পরের বছরগুলোর কথা। একটা সন্তানের জন্য রেহেনা বেগম কত হাহাকার করেছেন। মানুষের দ্বারে দ্বারে ঘুরেছেন একটা সন্তান দত্তক নেয়ার জন্য। পাড়া প্রতিবেশিদের দেয়া বন্ধ্যা নাম থেকে নিষ্কৃতি পেতে কত মানত করেছেন।

যে যেভাবে বলেছে সেভাবেই করেছেন। তারপর যখন আভাকে পেল, সারাক্ষণ আদর যত্নে রাখত। আল্লাহর কাছে শুকরিয়া জানিয়েছে বারংবার, অথচ সেই মানুষটি এর বছর দুই তিনের ভেতর কেমন পুরোটাই বদলে গেল। নিজের সন্তান পেয়ে যাকে পরম আরাধ্য মনে করত তাকে ছুড়ে ফেলে দিতে তার খুব বেশি সময় লাগল না। মানুষ কীভাবে পারে এতটা পাল্টে যেতে? অবশ্য যে মানুষ ছোট্ট বাচ্চাটাকে এভাবে দূরে সরিয়ে দিতে পেরেছে, সে এমন জঘন্য অপরাধ করতেই পারে। হয়তো তিনিই ভুল ভেবেছেন।

ইনশাআল্লাহ চলবে

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here