#আঁধারে_ঢাকা_ভোর
#নয়
প্রজ্ঞা জামান দৃঢ়তা
বাড়ি পৌঁছে আভা মায়ের কাছে গেল। ভেবেছে এই কয়দিনে হয়তো মায়ের রাগ কমেছে, কিন্তু না তাকে দেখে তা একদমই মনে হলো না। সে নানা বাহানায় কথা বলতে চাইলেও, তিনি সুযোগ দিলেন না। যে ভালো লাগাটা তার ট্রেনে যাত্রাপথে ছিল তা যেন মুহূর্তে হাওয়া হয়ে গেল।
অনেকটা পথ পাড়ি দিয়ে এসে আভা ক্লান্ত হয়ে কখন বিছানায় ঘুমিয়ে পড়েছে বুঝতেই পারেনি। ঘুম ভাঙে মায়ের চেঁচা-মেচিতে।
শোনা যাচ্ছে তিনি বলছেন, ” ভর সন্ধ্যা বেলায় ঘুমাইতেছে অলক্ষী মাইয়া শান্তি দিল না। ”
সে চুপচাপ উঠে হাঁস মুরগির খোঁয়াড়ের দরজা বন্ধ করে এসে নামাজ শেষ করল।
শাহিদদের বাড়ি থেকে আসার পর কেউ তাকে একটা কলও দেয়নি। এই বিষয়টা কয়দিন ধরে মনে থাকলেও পরীক্ষার জন্য খুব একটা পাত্তা দেয়নি সে।
এখন ভাবছে, “সেদিন বাবা হায়দার বাড়িতে গিয়েছিলেন। কিন্তু ফিরে এসে তাকে কিছুই বলেননি। কী এমন হয়েছে যে তিনি কিছুই বললেন না।”
রাতে খেয়ে যখন সবাই ঘুমিয়ে গেল। আভা বসে অরুন্ধতী রায়ের লেখা ‘ঘাস ফড়িংয়ের শব্দ শোনা যায়’ উপন্যাসটি পড়ছে। এমন সময় শফিক সাহেব তার ঘরে কড়া নাড়লেন। দরজা খুলে দিতেই তিনি খাটের উপর এসে বসলেন। সে বলল, “কিছু হয়েছে বাবা?”
তিনি কোনো ভণিতা না করেই পাঞ্জাবির পকেট থেকে একটা কাগজ বের করলেন এবং স্পষ্ট স্বরে বললেন, “এখানে সই করে দে?”
আভা কাগজটা হাতে নিয়ে পড়ে দেখল। এই কাজটার পর সমাজ তাকে কী বলবে সে ভয় তার ভেতর তিল পরিমাণ ছিল না। সে বাবাকে বলল, “যা করছো, ভেবে করছো বাবা? মা জানে?”
তিনি বললেন, “আমার উপর তোর আস্থা আছে এটাই অনেক। বাকি কে জানল, কে জানল না সেটা দেখার দ্বায়িত্ব আমার। তবে হ্যাঁ তোর মতামত যদি এতটুকুও পাল্টে তুই আমাকে নির্দ্বিধায় বলতে পারিস? তোর মনে যদি একটুও দ্বিধা থাকে তবে তুই স্বাক্ষর করিস না।”
সে বাবার দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে । তারপর সই করে দিল কাগজটায়।
শফিক সাহেব সেদিন হায়দার বাড়িতে কী কী হয়েছিল সব বললেন তাকে। আভা সবটা শুনে খুব একটুও অবাক হয়নি। কারণ, সে জানে ওই বাড়ির লোক ঠিক কী কী করতে পারে। কিন্তু শ্বশুরের জন্য তার বড্ড মন খারাপ করল। ওই বাড়িতে উনিই একমাত্র ব্যাক্তি যার মধ্যে মানবিকতা আছে। ঐশ্বর্য বা টাকার অহংকারে মনুষ্যত্বকে ভুলে যাননি। যিনি সবসময় তাকে সাপোর্ট করে গেছেন।
আভা বাবাকে বলল, “বাবা জানো ও বাড়িতে আমার শ্বশুর আমাকে খুব পছন্দ করতেন। ব্যবসায়ের জন্য খুব একটা বাসায় থাকতে না পারলেও। আমি তার চোখে আমার জন্য স্নেহ দেখেছি। তোমার পর তিনিই আমাকে গায়ের রঙ দিয়ে নয়, একজন মানুষ হিসেবে বিবেচনা করেছেন।”
“তোকে বলা হয়নি মা, সেদিন হায়দার বাড়ি থেকে বেরিয়ে আসার পথে অন্যমনস্ক হওয়ায় একটা গাড়ির নিচে পড়ে যাচ্ছিলাম। পেছন থেকে কেউ ধাক্কা দিয়ে আমাকে সরিয়ে দেয়। তিনি আর কেউ না, হায়দার সাহেব ছিলেন। তিনি আমাকে তোর ওই বাড়িতে কাটানো দিনগুলোর কথা সব বলেন। তুই নিজেও যা আমাকে বলিসনি তিনি তাই বলেছেন। তিনি সত্যি তোকে খুব স্নেহ করেন।”
“কী বলেছেন বাবা?”
হায়দার সাহেব বলেছেন, ” আভার মতো মেয়ে খুব কম আছে বেয়াই সাহেব। আপনার মেয়েটা খাঁটি সোনা। তাই আমি চাই না আমার ছেলের সাথে থেকে তার মতো স্বর্ণ ক্ষয় হয়ে যাক।”
একজন বাবা কতটা কষ্ট পেলে এমনটা বলতে পারে বুঝতে পেরেছিস? তিনি আরও বলেছেন,
“আমি গত দশ বছর ধরে চেষ্টা করে শাহিদকে ঠিক করতে পারিনি। তাই আর কেউ পারবে বলে মনে হয় না। কারণটা বলতে আমার লজ্জা করছে কিন্তু এটাই সত্যি। আমি চাই আপনি তাদের ডিভোর্সের ব্যবস্থা করেন। আমার স্ত্রী আমাকে না জানিয়ে বিয়ে দিয়েছে ছেলের। সে জানতো আমি জানলে এই বিয়ে হতে দিতাম না। তাই সে গ্রামে গিয়ে তার ভাইয়ের সাহায্য নিয়ে এই বিয়ে দিয়েছে। পরে অবশ্য আমি আপনাদের পুরো পরিবার সম্পর্কে খোঁজ নিয়েছি। বৌমার সম্পর্কে সব জেনেছি। তাই আমি চাই মেয়েটা অনেক কষ্ট পেয়েছে, এখন একটু ভালো থাকুক। যা আমার পরিবারে থাকলে কখনোই হবে না।”
তিনি আরও বলেছেন, “জানেন ভাই সাহেব যদি আমার ঘর ঠিক থাকত তবে আমি আমার মাকে কখনোই যেতে দিতাম না। কিন্তু আজ স্বার্থপর হতে পারছি না। আমি চাই আমার মা সুখে থাকুক। এখন সে আমার ঘরে নাকি অন্যকারো ঘরে সেটা দেখার বিষয় না। আপনি অনেক ভাগ্যবান এমন একটা মেয়ে পেয়েছেন। আমি প্রথম দিনেই তাকে চিনে ফেলেছি, কেমন সহজ, সরল ভাবে কথা বলে তবু মনে হয় প্রতিটি বাক্য কঠিন ও অধিক শক্তিশালী। যার মুখের আদলে স্নিগ্ধ, সারল্য ভাব, কিন্তু চোখে অগ্নির তেজ। যাকে সবাই আঘাত তো করে, কিন্তু কেউ ভাঙতে পারে না।”
হায়দার সাহেব চশমাটা খুলে চোখ মুছলেন একটু থেমে আবার বলেছিলেন,
“জানেন ভাই আমি দেখেছি প্রতিনিয়ত আমার স্ত্রী ও ছেলের দ্বারা অপমানিত হয়েও কেমন স্থির থেকেছে। তাদের নিন্দাকে অনুপ্রেরণা ভেবে সারাদিনের সব কাজ শেষে, সারারাত জেগে পড়েছে। কারো কোনো কটুকথা তাকে থামাতে পারেনি। যে সবসময় নিজের লক্ষ্যে অবিচল থেকেছে। তাই আমি নিজে বলছি আপনি আপনার মেয়েকে স্বাধীন করে দিন। এই সম্পর্ক থেকে মুক্ত করে দিন। জীবনে সবসময় আমি তার পাশে থাকব। যদি কোনোদিন ওর কাজে লাগতে পারি তবে এই অসামান্য ক্ষতির অপরাধের জন্য কিছুটা হলেও শান্তি পাব।”
হায়দার সাহেবের বলা কথাগুলো শেষ করে মেয়ের মাথায় হাত বুলিয়ে দেন শফিক সাহেব। আভা বাবার বুকে পোষা বিড়ালের মতো গুটিশুটি হয়ে কাঁদছে। তিনিও কাঁদছেন কিন্তু সে চোখের জল মেয়ে থেকে আড়াল করলেন।
শফিক সাহেব ভাবছেন, ” তোর সামনের পথ খুব কঠিন মা। তোকে আরও শক্ত হতে হবে। এই সমাজ কৃষ্ণ বর্ণের মেয়েদের জন্য খুব কঠিন, সেখানে যদি ডিভোর্সি ট্যাগ লেগে যায় তবে তো আরও বেশি কঠিন হয়ে যায়। মানুষ যতই আধুনিকতার কথা বলুক আসলে সব চলনা।”
আভার চোখ দিয়ে নীরবে অশ্রু ঝরছে। শফিক সাহেব আবিষ্কার করলেন, যে মেয়েটি সবার কাছে কঠিন, খুব শক্ত ও দৃঢ় মনের। সে মেয়েটিই তার কাছে বাচ্চা, সহজ,অবুঝ,ও বড্ড অভিমানী! যেমন একটা খোলা বই! যেমন ইচ্ছে পড়ে ফেলা যায়। এই সুক্ষ্ম বিষয়গুলো তাকে খুব শান্তি দেয়। তিনি চান মেয়ে যেন বাবার কাছে সারাজীবন এমন ছোটই থাকে।
ইনশাআল্লাহ চলবে