আকাশে তারার মেলা সিজন 2 পর্ব-২২

0
2716

#আকাশে_তারার_মেলা_২
#লেখিকাঃআসরিফা_সুলতানা_জেবা
#পর্ব_২২

চারদিকে পিঠার স্টল দেখে পুলকিত হয়ে উঠল তুলি। খানিকক্ষণ আগের ভয়,কষ্ট ভুলে পাশে দাঁড়ানো মানুষটার এক হাত চেপে ধরল শক্ত করে। আনন্দিত কন্ঠে বলে উঠল,

“এতো পিঠার দোকান? এখানে কি পিঠা উৎসব হচ্ছে ডাক্তার সাহেব? ”

আদ্রর ছোট্ট জবাব,

“হু।”

খুশিতে তুলির চোখ চকচক করতে লাগল। আদ্রর হাতে চাপের প্রভাব বাড়িয়ে বললো,

” জানেন ডাক্তার সাহেব, আমি কখনও পিঠা উৎসব দেখি নি। এতো সুন্দর সুন্দর পিঠাও দেখি নি। ”

আদ্র কোনো প্রকার প্রতুত্তর করলো না। শুধু সূক্ষ্ণ একটা হাসি ফুটিয়ে তুলল অধর কার্ণিশে। প্রাণ প্রিয় বান্ধবী তুলির খুশি দেখে আমরিনের মনে প্রশান্তি জড়ো হলো। আদ্রের উদ্দেশ্যে বললো,

“ভাই,তুলি কে নিয়ে আমি স্টল ঘুরে ঘুরে দেখি?”

সম্মতি জানালো আদ্র। তৎক্ষনাৎ তুলির হাত আঁকড়ে ধরে আরেকটু ভিতরের দিকে চলে এল আমরিন। কিন্তু ভুলবশত একটা ঘটনা ঘটে গেল। আমরিন ও তুলি একে অপরের সাথে কথা বলতে বলতে সামনের দিকে চেয়ে হাঁটতেই যেনো ভুলে গেল। ফলস্বরূপ তুলি বেসামাল ভাবে ধাক্কা খেল একটা ছেলের বুকের সাথে। ঘটনায় হতভম্ব হয়ে গেল তুলি, আমরিন দু’জনেই। চট করে সরে এলো তুলি ছেলেটার বুকের কাছ থেকে। ব্যস্ত গলায় বললো,

” আ’ম স্যরি। ক্ষমা করবেন ভাইয়া। ভুল টা আমারই, আমি দেখে চলি নি। সত্যি আমি খুবই দুঃখিত। ”

তুলি একনাগাড়ে কথাগুলো বলে কিছু টা স্থির হলো। বুক প্রচন্ড জোরে ঢিপঢিপ করছে। কি করে এতোটা বেখেয়ালি হতে পারলো? যদি আদ্র দেখে ফেলতো?তুলি নত মস্তক তুলে দেখলো ছেলেটা বাঁকা হেসে নির্নিমেষ চেয়ে আছে তার দিকে। দৃষ্টি টা অন্যরকম। আরেকটু সচকিত নয়ন ফেলতেই চোখে পড়ল পিছনে দাঁড়ানো আরও তিন টা ছেলের দিকে। ছেলেগুলো ওদের দিকেই তাকিয়ে। আদ্র ব্যতীত অন্য পুরুষের এহেন চাউনিতে তুলির গা গুলিয়ে আসতে লাগল। পাথরের ন্যায় সম্মুখে দাঁড়িয়ে আছে ছেলেটা। না কিছু বলছে,না এক দন্ড নড়ছে। আমরিনের কাছে চাহনি টা ভালো ঠেকলো না। ছেলেগুলো কে কেমন বাজে,বিগড়ে যাওয়া মনে হলো। সামনের ছেলেটা কে মনে হলো বড়লোক উম্মাদ। যার বর্ণনা হলো এমনটা- বড়লোক বাপের বিগড়ে যাওয়া পোলা। মন মানসিকতা অস্বাভাবিক অর্থাৎ বদ,পাগল,উম্মাদ। তুলির হাত টা চেপে ধরে আমরিন ছেলে গুলো কে পাশ কাটিয়ে চলে এলো। একটা বারও পিছু ফিরে দেখলো না। তবে বাতাসের সাথে মিলিত হয়ে কানে এতটুকু আসলো-” মেয়ে দুইটা জোস।” এরকম এক তিক্ত বাক্যে কান গরম হয়ে উঠেছে আমরিনের। অনুভব করলো মেজাজ প্রচন্ড অগ্নি তেজে জ্বলে উঠেছে। আমরিন নির্বাক থাকল। কথার প্রেক্ষিতে দিল না জবাব। এ মুহুর্তে কোনো প্রকার সিন ক্রিয়েট হোক চায় না। তুলির চোখের, মুখের খুশি বিলীন হয়ে যাবে এতে। দুর্বিষহ হয়ে উঠবে সময়টা। দাঁতে দাঁত চেপে নিচু স্বরে বললো,

” জানোয়ারের দল।”
_________

তুলি ও আমরিন দু’জন মিলে পাটিসাপটা পিঠা কিনেছে। পিঠা দেখে মুখে পানি চলে এসেছে তুলির। কিন্তু আমরিন তাকে খেতে দিচ্ছে না। একটু সবুর করতে বলে মোবাইল বের করলো পার্স থেকে। দু’জন মিলে সুন্দর কয়েকটা সেলফি তুললো। এতোক্ষণ পিঠা খাওয়ার লোভ সামলাতে পারছিল না তুলি,অথচ এখন নিজের হাতের পিঠের বাটি আমরিনের হাত ধরিয়ে দিল। ফোনের স্ক্রিনে চোখ রেখে স্মিত হাসল। ছোট্ট একটা নিঃশ্বাস ফেলে মনে মনে বলে উঠল-,

” মানুষের নিঃশ্বাস একটা সময় সঙ্গ ছাড়ে,স্মৃতি হিসেবে রয়ে যায় ছবির ন্যায় কত-শত মুহুর্ত ও এক আকাশসম বেদনা। ”

আমরিনের পার্সে মোবাইলটা রেখে দিল তুলি। বাটি থেকে পিঠা তুলে মাত্র কামড় বসাবে তখনি কর্ণধার হলো চেনা-পরিচিত স্বর। দ্রুত পিছন ফিরল দু’জনে। আরো একবার হাসি মুখের কথা শুনলো।

” ভাবী আমাদের ফেলে একা একা খেয়ে ফেলছেন,এটা কিন্তু ঘোর অন্যায়। কতো কষ্ট করে হসপিটাল থেকে ছুটে এলাম শুধু আপনাদের জন্য। ”

“ভাবী?” এটা না ডাকলে কী হতো না?অন্তুর মুখে ভাবী ডাক কর্ণপাতে চরম লজ্জা অনুভব করছে তুলি। লজ্জিত ভঙ্গিতে বললো,

” আসলে,,,”

” আসলে নকলে পরে হবে তুলি। আগে পিঠা খাওয়া জরুরি। ”

প্রফুল্ল মনে কথাটা বলে অন্তু তুলির বাটি থেকে পিঠা খেয়ে নিল। তুলি ভ্যাবাচেকা খেয়ে গেল। মস্তিষ্ক বলে উঠল-“এটা কি হলো?শেষমেশ পিঠা তোর পেট ফেলে অন্তু ভাইয়ার পেটে চলে গেল?”
তুলি চমৎকার একটা হাসি হাসল। হাসির কারণ, সামনে আদ্র,নিবিড়, পায়েল,সাগর,রিমি আসছে। ওরা দু’জনে হলুদ শাড়ি পড়ে এসেছে। ওদের আসার অপেক্ষাতেই কি ডাক্তার সাহেব গাড়ির কাছে দাঁড়িয়ে ছিলেন?তুলির হুট করে মনে হলো আদ্র তাকে সারপ্রাইজ দিতে চেয়েছে। আদ্রর পাশাপাশি তার বন্ধুমহলও এখন খুব পছন্দের তুলির। পায়েল,রিমি কে বড় বোন হিসেবে খুব ভালোবাসে। পছন্দের মানুষ গুলো কে এমন এক উৎসবে একসাথে পাওয়া সারপ্রাইজ নাহলে আর কি হবে!তুলির এখন ইচ্ছে করছে, ভীষণ ইচ্ছে করছে আদ্র কে শক্ত করে জড়িয়ে ধরতে। আশেপাশে মানুষের ভিড়ে দমে গেল সদ্য জেগে উঠা ইচ্ছে টা। পায়েল,রিমি এগিয়ে এসে অন্তুর থেকে বাটি ছিনিয়ে নিল। কপট রাগ দেখিয়ে বললো,

“তুলির পিঠে খেয়ে ফেললি পেটুক অন্তু,দেখিস আদ্রর কেলানি না আবার খাস।”

ঢোক গিলল অন্তু। বছর চারেক আগে সাজেকের কেলানির কথা মনে পড়ে গেল তার। সাজেক ঘুরতে গিয়ে ওখানকার এক আদিবাসীর সাহায্যে বিয়ারের যোগাড় করে পুরো এক বোতল সাবাড় করেছিল। বিয়ার খেয়ে মাতলামো করে রুমে গিয়ে পায়েল কে রিমির সামনে বলেছিল,” তোকে একটা চুমু খাবো।” পায়েল তো রাগিণী। রাগ সর্বদা তার নাকের ডগায় উপস্থিত থাকে। অন্তুর অবস্থা বেগতিক দেখে সে নিজে কিছু করে নি বরং কথাটা তুলেছিল আদ্রর কানে। এতে বেচারা অন্তু চুমু তো পেলোই না উল্টো কনকনে শীতের মাঝে সারারাত কটেজের সামনে ঘাসের উপর কাটিয়েছিল শাস্তি সরূপ।

অন্তু অতীব দ্রুত পিঠা কিনে তুলির দিকে বাড়িয়ে দিয়ে বললো,

” তুলি ভাইয়া কিন্তু মাত্র একটা খেয়েছি। নাও তার বদলে তিন তিনটা কিনে দিলাম তোমায়।”

অন্তুর কান্ডে তুলির ভীষণ হাসি পেল। কোনে ক্রমেই চেপে রাখতে পারলো না। এই মুহুর্তে উপলব্ধি করলো হাসি চেপে রাখা বড়ই কষ্টসাধ্য। আদ্র এগিয়ে এসে তুলির পাশে দাঁড়ালো। নিচু স্বরে বললো,

” গাড়ির কাছে এসো।”
_____________

সাগর,রিমি দু’জন অন্তু,পায়েলের দুই পাশে দাড়িয়ে আছে। এমনভাবে দু’জন দু প্রান্তে উপস্থিত যেনো চক্ষুদ্বয়ে দৃষ্টি নিবদ্ধ হলেই দু’জনের হৃদপিণ্ডে ছেদ করে ধারালো কিছু বেরিয়ে যাবে। দীর্ঘ সময়ের বন্ধুত্ব হয়েও আজ দু’জন খুবই অচেনা। দেখা হলেও, আড্ডা হলেও কথা হয় না দু’জনের মাঝে গত একটা বছর ধরে। পাশাপাশি থাকা সত্বেও কথা না বলতে পারার মতো পীড়াদায়ক কিছু কি হয়?এই অসহনশীল পীড়ায় যে ভুগে কেবলমাত্র সেই বুঝে। পায়েল আঁড়চোখে সবটা চেয়ে গলা খাকারি দিয়ে বলে উঠল,

” স্বামী স্ত্রী হয়েও দু’জন কেন দু’জনের মাঝে এতো দূরত্ব আনছিস? তোরা কি ভুলে গেছিস স্বামী -স্ত্রী হওয়ার আগে তোরা বন্ধু। এইবার তো কথা বল দু’জন, মানিয়ে নে সম্পর্ক টাকে। বলতে বলতে আমরা হাঁপিয়ে যাচ্ছি রিমি,সাগর। ভালোবাসা না পাওয়ার আফসোসে তিলে তিলে শেষ হবার আগে শেষ করে দে দূরত্ব। ”

কথাটা সাগরের বুকে গিয়ে বিঁধল। চকিতে তাকাল সে রিমির দিকে। রিমির চোখে চোখ আটকালো ক্ষণিকের জন্য। অস্থির হয়ে চোখ সরিয়ে নিল রিমি। এক মুহুর্তও স্থির থাকতে পারলো না সাগরের সামনে। সে কি করে পায়েল কে বুঝাবে, ভালোবাসা না পাওয়ার কষ্টে প্রতি রাতের অর্ধেক সময় একাকী আকাশ দেখে পার হয় তার?পৃথিবীতে সবচেয়ে কষ্টকর বিষয় হলো মনের সুপ্ত কোণে জমায়িত কষ্ট কাউকে দেখানো যায় না। যদি কষ্টগুলো দৃশ্যমান হতো তবে হয়তো মানুষ গুণেও শেষ করতে পারত না। রিমির নিকট দীর্ঘ শ্বাস বৈকি কিছুই রইল না।


তুলি গাড়ির কাছে দাঁড়িয়ে আছে একা একা। একটু আগে আদ্রর সাথে গাড়ির কাছে এসে জানালো তার তৃষ্ণা পেয়েছে। আদ্র গাড়িতে চেইক করে দেখলো পানি নেই। তুলি কে গাড়িতে বসিয়ে গালে পরশ বুলিয়ে বলে গিয়েছিল গাড়িতে বসে থাকতে। গাড়িতে দম বন্ধ হয়ে আসছিল তুলির। তাই আদ্র যাওয়ার এক মিনিটের মাথায় শরতের নাতিশীতোষ্ণ ভাব অনুভব করতে নেমে দাঁড়ালো গাড়ি থেকে। প্রাণ ভরে নিঃশ্বাস নিল। ভিতর থেকে গানের উচ্চ আওয়াজ ভেসে আসছে। পরিবেশ টা জমজমাট হয়ে উঠেছে ইতিমধ্যে। তুলি বুঝতে পারছে না আদ্র কেন এখানে নিয়ে এলো। পানি নিয়ে এসে যদি গাড়ির বাহিরে দেখে তাহলে আজ মোবাইলের মতো করে তার হাড়গুঁড়ও ভাঙতে পারে ভেবে ভয়ে আঁতকে উঠল। উল্টো ঘুরে গাড়ির দরজা খুলে বসার জন্য উদ্যোত হতেই একটা হাত তুলির কোমল হাত টা শক্ত করে চেপে ধরল। অজানা ভয়ে বুক টা মোচড় দিয়ে উঠল তুলির। ঘাড়ে গরম,উত্তপ্ত নিঃশ্বাস ভারি খেতে লাগল। অন্তরস্থ কম্পন নিয়ে তুলি ভয়ে ভয়ে ফিরল। নিমিষেই তুলির চক্ষুকোটর তীব্র ভয়ের প্রলাপে অশ্রুসিক্ত হয়ে উঠল। পায়ের তলা থেকে শুরু করে সারা শরীরে কম্পন ছড়িয়ে পড়ল। নিস্তব্ধ, বাক্যহীন তুলি। নাসারন্ধ্রে দোলা দিয়ে যাচ্ছে বাজে এক গন্ধ। ভয়ের তাড়নায় তুলি স্তম্ভিত। স্পর্শ টা তুলি কে নিঃশেষ করে দিচ্ছে। সম্মুখে দাঁড়ানো ব্যক্তি দূরত্ব কমিয়ে আনতেই তুলির অশ্রুভেজা কন্ঠ চিৎকার করে বললো,

” ডাক্তার সাহেব!”

#চলবে,,,!

(ভুল-ত্রুটি ক্ষমার দৃষ্টিতে দেখবেন।)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here