আকাশে তারার মেলা সিজন 2 পর্ব-২৪

0
2850

#আকাশে_তারার_মেলা_২
#লেখিকাঃআসরিফা_সুলতানা_জেবা
#পর্ব_২৪

আজ সকাল বেলায় রৌদ্র তার তেজী রূপে প্রকৃতি কে জ্বলসে দেওয়ার প্রচেষ্টায় নেমেছে। প্রখর তাপে মাথা ঝিমঝিম করছে তুলির। গেইটের দিকের বাম পাশে উঁচু হয়ে দাঁড়িয়ে আছে কৃষ্ণচূড়া। রোদ থেকে বাঁচার জন্য তুলি নিজেকে কৃষ্ণচূড়া গাছের ছায়ায় আড়াল করে নিল। হাত ঘড়িটার দিকে অস্থির আঁখিদ্বয় বুলাতেই দেখল ৯টা বেজে ৫ মিনিট। চোখ উঠিয়ে ডান পাশে তাকাতেই একটা সাদা গাড়ি হর্ণ বাজিয়ে থেমে গেল। কাঁধের ব্যাগ টা হাতে নিয়ে তুলি গাড়ির দিকে এগিয়ে গেল দ্রুত পায়ে। ড্রাইভার পিছনের দরজা খুলে দিল গাড়ি থেকে নেমে। গাড়ির মধ্যে কাউকে দেখতে না পেয়ে ভ্রুঁ কুঁচকালো তুলি। নরম স্বরে জিজ্ঞেস করলো,

” আমরিন কলেজে যাবে না? ”

” আমরিন মামণির জ্বর। আজ যাইবো না। আপনারে দিয়ে আসতে পাঠাইলো বড় ম্যামে।”

আমরিনের জ্বর শুনে তুলির মন ব্যাথিত হলো। ব্যাগটা গাড়িতে রেখে বললো,

” আপনি অপেক্ষা করুন। আমি একটু পর যাবো।”

কথাটা বলে এক মুহুর্তের জন্য স্থির হলো না তুলি। পায়ের বেগ বাড়িয়ে ছুটে এল আমরিনদের বাড়িতে। সায়েরা বেগম, রাদিফ সাহেব ড্রইং রুমে বসে কথা বলছিলেন। তুলি কে এগিয়ে আসতে দেখে সায়েরা বেগম কাছে ডাকলেন। দ্রুত গতিতে কাছে এসে দাঁড়াল তুলি। রাদিফ সাহেবের উদ্দেশ্যে বললেন,

” আসসালামু আলাইকুম খালু।”

সালামের জবাব দিয়ে বিস্তৃত হাসলেন রাদিফ সাহেব। বললেন,

” সম্পর্কে আমি তোর শশুর। শশুর কে খালু বলছিস? প্রিন্সেসের মুখ থেকে আদৌও কি আমি বাবা ডাক শুনব?”

লজ্জিত মুখ করে স্মিত হাসল তুলি। চিন্তিত স্বরে বললো,

” আমরিন নাকি অসুস্থ খালা মণি? আমি ওকে দেখে আসি।”

সায়েরা বেগম সম্মতি জানালেন।

” যা দেখে আয় তোর ননদ কে। এতো খারাপ হয়েছে মেয়েটা। আমার কোনো কথায় শুনে না। আজ নাকি ক্লাস টেস্ট আছে?সামান্য একটা টেস্টের জন্য টেনশন করতে করতে জ্বর বাঁধিয়েছে। মেয়েটা কখনও শুধরাবে না। পরীক্ষার আসলেই টেনশনে জ্বর বাঁধিয়ে বসে থাকবে। ”

” চিন্তা করো না খালামণি। ঠিক হয়ে যাবে।”

তুলি সিঁড়ি বেয়ে উপরে উঠে এল। আমরিন স্টাডির ব্যাপারে একটু বেশিই সিরিয়াস। স্টুডেন্ট হিসেবে বেশ ভালো মেয়েটা। ক্লাসে ফার্স্ট হয় সবসময়। তার স্বপ্ন ভাইয়ের মতো একজন বড় ডাক্তার হবে। তুলির আবার এমন কোনো লক্ষ্য নেই। তবে ইদানিং আদ্রর সাথে সুন্দর একটা সংসারের স্বপ্ন তাকে তাড়া করে বেড়ায়। দরজা ঠেলে ভিতরে প্রবেশ করল তুলি। বিছানার দিকে নজর গেল প্রথমে। এই গরমেও আমরিন কাঁথা জড়িয়ে দিব্যি ঘুমোচ্ছে। টেবিলের উপর থেকে ফোনের আওয়াজ ভেসে আসছে। সেদিকে পা বাড়াল তুলি। স্ক্রিনে দেখল “নিবিড়” লিখা। কেটে গেল কলটা। আবার বেজে উঠতেই তুলি দ্বিধায় পড়ে গেল কল তুলবে কিনা!আমরিন অসুস্থ বিধায় তাকে জাগানোর ইচ্ছে পরিহার করলো। অনবরত বাজতে থাকা ফোন টা রিসিভ করে কানে দিয়ে নম্র কন্ঠে বলে উঠল,

” আসসালামু আলাইকুম ভাইয়া। আমি তুলি। আমরিন ঘুমোচ্ছে। ”

” ওয়ালাইকুমুস সালাম ভাবী। আমরিনের জ্বর কমেছে?”

এতো বড় বড় ছেলেদের মুখে আজকাল ভাবী ডাক শুনে তুলির ভীষণ লজ্জা পায়। আড়ষ্ট হয়ে পড়ে জড়তায়। জড়তা-সংকোচ কাটিয়ে বললো,

“আমি মাত্র এসেছি ভাইয়া।”

” আচ্ছা। রাখছি তাহলে।”

” আচ্ছা। ”

নিবিড় কল টা কেটে দিল। তুলি ধীরস্থভাবে হেঁটে এসে শব্দহীন আমরিনের খানিকটা কাছে দাঁড়াল। গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন মেয়েটা। হয়তো জ্বরের প্রভাবে এতো ঘুমোচ্ছে। আমরিনের মায়া ভরা মুখ টা কিছু পলক দেখে চলে এলো তুলি। আমরিন ও নিবিড় রিলেশনে আছে,এটা আমরিন নিজেই তুলির কাছে প্রকাশ করেছে। কথাটা শুনে তুলি প্রচন্ড খুশি হয়েছিল। কারণ নিবিড় নিঃসন্দেহে একজন ভালো ছেলে। প্যাসেজওয়ে দিয়ে যাওয়ার সময় তুলির চোখ আটকালো আদ্রর রুমের দরজায়। দরজা টা হালকা ভেজানো। অযাচিত মনে হুট করেই আদ্র কে এক পলক দেখার তীব্র ইচ্ছে জাগল। আদ্রর রুমে যে কারো হুটহাট ঢুকা নিষেধ। সুপ্ত জন্মানো আকাঙ্ক্ষা কে দমিয়ে নিল তুলি। চলে যাওয়ার জন্য পা বাড়িয়ে ও থেমে গেল। মনের অনুভূতি গুলো প্রবলভাবে বাধ্য করছে শুধু একটা বার আদ্র কে দেখে তৃষ্ণা মিটানোর। মস্তিষ্কের চিন্তা ধারা চাপা দিয়ে মনের টা-ই শুনলো তুলি।দুরুদুরু মন নিয়ে ভেজানো দরজা টা আওয়াজ বিহীন অতি সাবধানে কিছুটা খুললো। তৎক্ষনাৎ চক্ষুদ্বয়ে ভেসে উঠল আদ্রর কপালে হাত ঠেকিয়ে রাখা ঘুমন্ত মুখ টা। কয়েকটা চুল হাতের উপরে উপচে পড়ছে। সটান হয়ে কপালে হাত ঠেকিয়ে শুয়ে আছে। কারো ঘুমের ভাবভঙ্গি এমনও হতে পারে? তুলির চোখ, মন জুড়িয়ে আসছে। আদ্র যদি হার পেয়ে যায় কী জবাব দিবে?তাই দ্রুত সরে আসার উপক্রম হলো। ঠিক তখনই একটা পুরুষালি গম্ভীর স্বরে তুলির বুক টা ধুক করে কেঁপে উঠলো। আদ্র চোখ বুঁজেই হাঁক ছাড়ল,

“ভিতরে এসো তুলি।”

বুকের দুরুদুরু অশনি নিয়ে কয়েক মুহুর্ত পার হলো তুলির। কম্পিত হস্তে দরজা পুরোপুরি ঠেলে প্রবেশ করল। বিস্ময়ে,লজ্জায় হতবিহ্বল তুলির আবেগি মন। চোখ বুঁজে থেকেই আদ্র পুনরায় নরম কন্ঠে বললো,

” কাছে এসো।”

লজ্জায় তুলির এক পা ও নড়ছে না। নড়বড়ে প্রত্যেক টা কদম। বিছানার কাছাকাছি এসে ঘনঘন নিশ্বাস ফেলতে লাগল, যা সম্পূর্ণ রুপে আছড়ে পড়ছে আদ্রর মুখে।

” আমার দিকে ঝুঁকে দাঁড়াও। কপাল টা আমার অধর বরাবর যেন হয়।”

তড়িৎ বেগে চমকে উঠল তুলি। আদ্রর কথার মানে ঠাওর হলো না তার। তবে ঝুঁকতে হবে ভাবতেই সারা দেহ থরথর করে কাঁপছে। এসির অতিরিক্ত হিম তুলির শরীরের কাঁপুনি বাড়িয়ে তুলছে। তুলি ঝুঁকল। মনে প্রাণে দোয়া করলো আদ্র যেন চোখ না মেলে। আদ্রর উম্মুক্ত বুকে নজর পড়তেই তুলির অন্তস্থলে তোলপাড় শুরু হলো। চেয়ে রইল অনিমেষ। আকস্মিক ললাটে গাঢ় স্পর্শে বেহায়া দৃষ্টিভঙ্গ হলো নিমিষেই। বরফ ন্যায় জমে গেল দেহের সর্বাঙ্গ। সেই সাথে কেটে গেল কয়েক মুহুর্ত বিনা বার্তায়। শ্রবণ গ্রন্থিতে তরঙ্গিত হলো শুধু নিঃশ্বাসের শব্দ। তুলি লজ্জাবতী গাছের ন্যায় চুপসে যাওয়ার আগে দ্রুত বেগে সরে আসল। টলমলে পায়ে বেরিয়ে আসার সময় শুধু কর্ণগোচর হল,

“তুমি চাইলে আমার উম্মুক্ত বুকে তোমার নরম ঠোঁটের গভীর প্রলেপ একেঁ দিতে পারতে তুলা। আমি বাঁধা দিতাম না,লজ্জায় ফেলতাম না তোমায়। শুধু অনুভব করতাম আমার হৃদয়ে সৃষ্ট ঝড়।”

তুলি গাড়িতে বসে ঠোঁটে ঠোঁট চেপে বার কয়েক হাসি আটকানোর ব্যর্থ প্রচেষ্টা চালালো। আদ্রর বলা বাক্য গুলো ক্ষণে ক্ষণে মনের কোণে উঁকি দিচ্ছে। যতবার মনে হচ্ছে ততবারই ব্রীড়া বেড়ে চলেছে। হাত দিয়ে মুখ ঢেকে তুলি কল্পনার রং তুলিতে আদ্র কে রাঙিয়ে নিল। ঘোর লাগা হাসি টুকু কল্পনা করে মিনমিন করে বলে উঠল-

” বড্ড অসভ্য আপনি ডাক্তার সাহেব। ”
________________

রৌদ্রজ্বল দিন মধ্যাহ্ন গড়ালো। ক্লান্ত ভঙ্গিতে ছোট্ট নিঃশ্বাস ছেড়ে তুলি কলেজ গেইট থেকে বেরিয়ে এলো। গুমোট ভাব,ভ্যাপসা গরমে তুলির অবস্থা নাজেহাল। কলেজ ড্রেস টা ঘামে আংশিক ভিজে গেছে। কপালে ফোঁটা ফোঁটা ঘাম বিন্দুর সমারোহ। গাড়ির কাছে আসতেই আদ্রর কিনে দেওয়া নতুন মোবাইল টা এগিয়ে দিল ড্রাইভার। কলেজে মোবাইল নেওয়া নিষেধ বিধায় ড্রাইভার আংকেলের কাছে মোবাইলটা রেখে গিয়েছিল। তুলি মোবাইলটা টা নিয়ে গাড়িতে উঠতে যাবে তার পূর্বেই ডেকে উঠল কেউ। থমকে গেল তুলি। পিছন ফিরে অবিশ্বাস্য চাহনি নিক্ষেপ করল। এতোগুলো মাস পর মানুষ টা কে দেখবে তাও কলেজের সামনে তা ছিল তুলির কল্পনাতীত। সংকোচে পড়ে গেল মন। ছেলেটা ঠোঁট দুটো প্রসারিত করে প্রশ্ন ছুঁড়ে দিল তুলির দিকে।

” কেমন আছো? ”

গলা শুকিয়ে কাঠ হয়ে এলো তুলির। শুকনো কন্ঠে বিড়ম্বনা কাটিয়ে প্রতুত্তর করলো,

” জ্বি, ভালো। আপনি কেমন আছেন? ”

ছেলেটা মুখে কিছুই উচ্চারণ করল না। বরং জবাবে ঠোঁটের কোণে স্মিত হাসি ফুটিয়ে তুলল। অস্বস্তিতে পড়ে গেল তুলি। ফের প্রশ্ন করলো,

” কানাডা থেকে কবে এলেন?”

“আজ সকালেই। ”

” আচ্ছা। বাসায় আসবেন। এখন যাই তাহলে।”

যাওয়ার কথা শুনে অস্থির কন্ঠে ডেকে উঠল ছেলেটা। গলার জোর বাড়িয়ে বললো,

” তুলি!তোমার সারাদিনের সময় থেকে আমায় এই মুহুর্তে একটু সময় দিবে প্লিজ?শুধু একটুখানি। কিছু কথা ব্যক্ত করার জন্যই সূদুর কানাডা থেকে আমার ছুটে আসা।”

হকচকালো তুলি। বিস্মিত না হয়ে পারল না। ভয়ার্ত হয়ে উঠল আঁখি যুগল। সম্মুখে ব্যক্তির আকুল কন্ঠের আবেদন অগ্রাহ্য করার মতো নয়। কিন্তু আদ্র!তুলির ভয় হচ্ছে। দুমনায় ভুগছে অন্তর। শেষমেশ অস্ফুটস্বরে বেরিয়ে এলো,

“হু।”

#চলবে,,

(ভুল-ত্রুটি ক্ষমার দৃষ্টিতে দেখবেন।)

P.c: Rubi ❤️

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here