#আকাশে_তারার_মেলা_২
#লেখিকাঃআসরিফা_সুলতানা _জেবা
#পর্ব_২৫
” তুমি বেশ সুন্দর হয়ে গেছো তুলি। তোমার ঘর্মাক্ত চেহারা টা প্রকৃতির এই নির্মল সৌন্দর্যের চেয়ে অসম্ভব নজরকাড়া। ”
সামনে বসা ব্যক্তির মুখে উচ্চারিত বাক্যে তুলির মাথা ঝিমঝিম করে উঠল। কিছুটা রুক্ষ কন্ঠে আওড়ালো,
” পূর্ব ভাইয়া! ”
অপ্রস্তুত হাসলো পূর্ব। ঘাড় ফিরিয়ে পরিবেশ টা চোখের পাতায় বন্দী করে নিল একবার। সুন্দর, কোলাহল বিহীন একটা জায়গা। মাথার উপর খোলা নীল আকাশ,লেকের একপাশে সারি বেঁধে কয়েকটা গাছ উঁচু হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। হয়তো উত্তপ্ত রৌদ্রময় প্রহর হতে মানুষকে রক্ষা করাই এদের দায়িত্ব। যেমনটা করছে তুলি কে। কতো সুন্দর করে তুলির চোখে মুখে বিলীন করে চলেছে নিজেদের ছায়া। হতে পারে শ্যামবতী কন্যার গরমে অস্বস্তি মাখা চেহারা খানা দেখে তাদের ভীষণ মায়া হচ্ছে। অহেতুক কথাগুলো ভেবে আরেকটু হাসলো পূর্ব। লেকের পাশে দুটো বেঞ্চিতে মুখোমুখি বসে আছে তুলি ও পূর্ব। তুলি হাসফাঁস করছে। কেন যে তখন আসার জন্য রাজি হয়ে গেল সেটা ভেবে নিজেকে মনে মনে হাজারো গালি দিচ্ছে। ফের বোকামি করে বসলো এমনই বলছে মন।
” সামনের মাসে আমি বিয়ে করছি তুলি। মেয়েটার নাম তিশা। কানাডা তে থাকে।”
ম্লান স্বরে বললো পূর্ব। দৃষ্টি নিক্ষেপ করল তুলির দিকে। এ কথাটা বলার জন্যই এতো অনুরোধ করে আনা হলো?তুলি ঠোঁটের কার্ণিশে মৃদু হাসির রেখা ফুটিয়ে আনন্দিত কন্ঠে বলে উঠল,
” বাহ!এটা তো খুব ভালো খবর ভাইয়া। কানাডা গিয়ে বেশ উন্নতি করলেন। আমরা তাহলে একটা ভাবী পেতে চলেছি।”
” তুমি কি বিন্দু মাত্র কষ্ট অনুভব করো নি তুলি?”
অকস্মাৎ এমন একটা প্রশ্নে তুলি বিস্ময়কর দৃষ্টিতে তাকালো পূর্বর পানে। গায়েব হয়ে গেল ঠোঁটের কোণ ঘেষে থাকা হাসি টা। নিমেষ চোখের পাতায় ধরা পড়ল পূর্বর চক্ষে চিকচিক করা জলের ধারা। তুলির নরম মন কিছুটা অনুশোচনায় ভুগতে আরম্ভ করল। পরক্ষনেই বলে উঠল-‘ আমি তার জন্য নয়,তবে তার মন কেন আমাকেই চাইল?’ মন মানুষের জীবনের একটা বিষাক্ত অংশ। তার স্বভাবই যেন সর্বদা নিষিদ্ধ জিনিসের প্রতি ঝুঁকে পড়া। মাঝে মাঝে ভীষণ বেইমানি করে মন টা। যাকে পাওয়া দুষ্কর, তার প্রতিই করে দেয় আসক্ত। একটা সময় কাঁদায়,বিষাক্ত বেদনা ছড়িয়ে দেয় আনাচে-কানাচে। তুলি মৌন মুখ রইল। কি বলবে সে আমি একটুও কষ্ট পাই নি? কেন পাবো, আমার তো ডাক্তার সাহেব কে ছাড়া অন্য কাউকে ভাবাও পাপ। কষ্টে চৌচির হয়ে মানুষ টা কে জেনে শুনে কথার আঘাত করা অন্যায়। তা অত্যন্ত ভালো বুঝে তুলি। কারণ তার নিজের দ্বারা কখনও কথার আঘাত সহ্য করা হয়ে উঠে নি। যখনই কেউ কথার তীর ছুঁড়ে মেরে রক্তাক্ত করেছে হৃদয়, তখনই তুলি খুব কেঁদেছে। বিন্দু বিন্দু করে হাজারো অশ্রু দিয়েছে বিসর্জন। তুলির ভাবনায় বিভোর মুখশ্রী তে চেয়ে তাচ্ছিল্য হাসল পূর্ব। কন্ঠে তাচ্ছিল্যের স্বর ধরে রেখেই বললো,
“জানি কষ্ট হয় নি তোমার। হবেই বা কেন?তুমি তো আমার নও। ”
পূর্বের কথার পৃষ্ঠে মুখ দিয়ে একটা শব্দও উচ্চারণ করার ইচ্ছে হলো না তুলির। পূর্ব ঘাড় ঘুরিয়ে লেকের দিকে চেয়ে বলে উঠল,
” তুমি আমার হলেই পারতে তুলি।”
বক্ষস্থল কেঁপে উঠল তুলির। হুট করে দাঁড়িয়ে পড়ল বেঞ্চি ছেড়ে। এখানে থাকা কোনো ক্রমেই আর সম্ভব নয়। পূর্বর কষ্টের জর্জরিত ভারী ভারী বাক্য সে কেন শ্রবণ করবে?তুলির নিজেকে বিরাট সার্থপর লাগছে। কাউকে ভালো না বাসলেও তার কষ্টজনক কথাগুলো তো শোনা যায়! তুলি মনে মনে বলে উঠল- ‘আমি সার্থপরই। কারণ আমি আমার ডাক্তার সাহেব কে খুব বেশি ভালোবাসি। অন্যের কষ্টের ভাগিদার নাহলেও আমার জীবন থেমে থাকবে না। কিন্তু আদ্র ভাইয়া কে ছাড়া আমার নিঃশ্বাসও আমার সঙ্গ ছাড়তে সময় নিবে না।’ পূর্ব গম্ভীর গলায় বললো,
” চলে যাবে?”
” হ্যাঁ। দেরি হয়ে যাচ্ছে। ”
” তোমাকে বলা হয় নি তুলি। আমি তোমাকে ভীষণ ভালোবাসি। কানাডা গিয়ে একটা দিনও স্বস্তির নিশ্বাস ফেলা হয় নি আমার। দাদী কে কথা দিতে বাধ্য হয়েছিলাম সেদিন তোমার পিছু ছেড়ে দিব। তাই মনের বিরুদ্ধে গিয়ে কানাডা পাড়ি জমিয়েছিলাম। আমার কানাডার দিনগুলো তোমাকে দেখানো তো পসিবল না, তবে এটুকু বলবো আমি ভালো ছিলাম না তুলি। একদম ভালো ছিলাম না। দাদীর পায়ে পড়ে ওয়াদা ভঙ্গ করে ছুটে এসেছি আমি আজ। তবে জানো তার পিছনেও শর্ত জুড়ে দিয়েছিল দাদী। তিশা কে বিয়ে করতে রাজি হবার শর্ত। তোমাকে এক পলক দেখতে পাবার বদলে যদি সারাজীবন ধুঁকে ধুঁকে মরতে হয় আমার তবু্ও আমি রাজি। এই যে আজ তোমার ঘর্মার্ত মুখ টা দেখে আমার হৃদয় জুড়ে প্রশান্তি অনুভব করছি তার জন্য আমি পাহাড়সম কষ্ট সহ্য করতে দ্বিধান্বিত হবো না। যদি তোমায় কষ্ট দিলে আমার কষ্ট না হতো, তাহলে আমি জোর করে হলেও তোমাকে আমার করে নিতাম তুলি।”
রুদ্ধশ্বাসে কথাগুলো বলে নিস্তব্ধ হয়ে গেল পূর্ব। তুলির স্থবির হয়ে চেয়ে রইল জল রাশির দিক। এর মধ্যে পূর্ব এক মুহুর্তের জন্যও পাশ ফিরে চায় নি। তুলি কিংকর্তব্য বিমূঢ়। কথার ভান্ডারে আজ শব্দের ঘাটতি। নিশ্চুপ, নিস্তব্ধ মুহুর্ত ভঙ্গ করে তুলির ফোন টা পুরো উদ্যমে বেজে উঠল। কিঞ্চিৎ কম্পন অনুভত হলো তুলির। ফোনের স্ক্রিনে দৃষ্টি নিবদ্ধ করতেই ভয়ের ছাপ ফুটে উঠল নেত্রে। স্ক্রিনে জ্বলজ্বল করছে ‘ ডাক্তার সাহেব। ‘ ভয়ে ভয়ে কল টা কেটে যাওয়ার আগে রিসিভ করলো। কর্ণে এসে ধাক্কা খেল অপর পাশের মানুষ টার তীর্যক কন্ঠ।
” কোথায় তুমি?”
অজানা ভয়ে সেটে গেল তুলির মন। কিছুক্ষণ নিশ্চুপ থাকার পর কাঁপা কাঁপা কন্ঠে জবাব দিল,
” ক,,কলেজে।”
” কলেজ তো এতোক্ষণে শেষ হয়ে যাওয়ার কথা। ”
অনবরত ঘাম ঝরতে লাগল তুলির সারা দেহ হতে। কথা বলতে গিয়ে খেয়াল করছে গলা প্রচন্ড কাঁপছে।
” এক্স,,এক্সট্রা ক্লাস আছে।”
” তা তোমার এক্সট্রা ক্লাস কি পূর্বর সাথে?”
হাত ফস্কে ফোন টা মাটি স্পর্শ করলো। পূর্ব দাঁড়িয়ে কিছু বলতে যাবে তার আগেই ফোন টা হাতে তুলে দৌড়ে রাস্তার কাছে চলে এলো তুলি। একটা গাড়ির দরজা মেলে দিল কেউ তার উদ্দেশ্যে। যেতে নিয়েও বাঁধা পড়লো। ছুটে আসার ফলে হাঁপাচ্ছে তুলি। গাড়ির দিকে দৃষ্টি তাক করতেই ভয় টা দ্বিগুণ বেড়ে গেল। দ্রুত বেগে গাড়িতে বসে পড়ল। ড্রাইভিং সিটে বসে থাকা সুদর্শন যুবক তার দিকে ফিরেও তাকাচ্ছে না। সামনের দিকে তাকিয়ে ড্রাইভ করছে। তুলি ভয়ার্ত দৃষ্টিতে তাকালো। চোয়াল শক্ত আদ্রর। সারা মুখ রক্তিম আভায় ছেয়ে আছে। নীলাভ চোখগুলো রক্তবর্ণের ন্যায় টকটকে লাল হয়ে আছে। তুলির ভয় টা তীব্র থেকে তীব্রতর রূপ ধারণ করলো। হৃদপিণ্ড ছোট্ট হয়ে গেল যেন। সারা রাস্তা একটা ‘চ’ শব্দ করলো না আদ্র। আর না একবারও তাকিয়েছে তুলির দিকে। বাড়ির গ্যারেজে এনে গাড়িটা থামালো। সিটে মাথা এলিয়ে চোখ বুঁজে গায়ের কালো শার্টের উপরের দু’টো বোতাম খুলে নিল। তুলি কন্দন মিশ্রিত স্বরে ডেকে উঠল,
” আদ্,!”
” স্টপ। ”
ঝাঁঝালো কণ্ঠে বাঁধা প্রদান করলো আদ্র। তুলির চোখ থেকে এক ফোঁটা অশ্রু গড়িয়ে গেল। আদ্র তাকালো না একটুও। গাড়ি থেকে নেমে তুলির পাশের দরজা টা খুলে ডান হাত টা চেপে ধরল শক্ত করে। অগ্নি দৃষ্টি নিক্ষেপ করল তুলির দিকে, যা তুলি কে ভস্ম করে দেওয়ার জন্য যথেষ্ট। ভয়ে থেকে থেকে কেঁপে উঠছে তুলি। রাগে ধপ করে জ্বলে উঠল আদ্রর পুরো মস্তিষ্ক। রোষ পূর্ণ চাহনি ছুঁড়ে দিয়ে তীক্ষ্ণ কন্ঠে বলে উঠল-
” যদি আর এক ফোঁটা অশ্রু ঝরাতে দেখেছি, তাহলে আজ খুন করবো তোকে।”
#চলবে,,,
(ভুল-ত্রুটি ক্ষমার দৃষ্টিতে দেখবেন।)
P.c:Nusrat Tabassum Dighi💜