#আকাশে_তারার_মেলা_২
#লেখিকাঃআসরিফা_সুলতানা_জেবা
#পর্ব_২৭
দ্বিপ্রহর কাটিয়ে প্রকৃতি সায়াহ্ন রূপে সেজে উঠেছে। দুপুর থেকে তুমুল বেগে হওয়া বর্ষণ নিজের তেজী রূপ কমিয়েছে বেশ কিছু সময় পূর্বে। ফলস্বরূপ গাছের পাতা বেয়ে ঝড়ে পড়ছে জলধারা। হাতে খাবারের প্লেট নিয়ে রুমে আসল আদ্র। দৃষ্টি বিছানার দিকে ফেলতেই চক্ষে ফুটে উঠল তুলির এলোমেলো রূপ। পড়নের শাড়ি টা গায়ের কিছু অংশ থেকে সরে গিয়ে ফ্লোর ছুঁয়ে আছে। চোখ বুঁজল আদ্র। অনুভব করল হৃদয়পটে হানা দেওয়া কাল বৈশাখীর তান্ডব। কীয়ৎক্ষণ বুঁজে রাখা নেত্রযুগল মেলে খাবারের প্লেট টা টি টেবিলের উপর রাখল।ফ্লোর হতে শাড়ির আঁচল টা হাতে নিয়ে তুলির শরীরে জড়িয়ে দিল অতি সন্তর্পণে। নয়তো মেয়েটা ঘুম থেকে জেগে নিজেকে এমতাবস্থায় দেখলে আঁতকে উঠতো। লজ্জায় উদ্বিগ্ন হয়ে উঠতো। এছাড়াও মেয়েটার বিধস্ত, এলোমেলো রূপে ঘোর লেগে আসছিল আদ্রর। ঘুমন্ত তুলি কে সম্মতি ব্যতীত স্পর্শ করার অপরাধ সে করতে চায় না। তুলির তৈলাক্ত মুখশ্রীর দিকে তাকিয়ে ক্ষীণ হাসির ঝলক দেখা দিল আদ্রর ঠোঁটের কোণে। লজ্জা যেন মেয়েটা নিজের মধ্যে প্রখরভাবে বহন করে চলেছে প্রতিনিয়ত।
তুলি দুর্বল প্রকৃতির। খুবই দুর্বল। গভীরভাবে ছুঁয়ে দেওয়ার কথা শুনে কেমন চুপসে গেল। লজ্জায় ঢলে পড়েছিল আদ্রর বুকে। জ্ঞান হারিয়েছিল অতিরিক্ত চিন্তায়। আদ্রর তখন পাগলপ্রায় হওয়ার অবস্থা। সায়েরা বেগম, আমরিন দৌড়ে এসেছিল রুমে। তুলি কে অচেতন অবস্থায় আবিষ্কার করে আঁতকে উঠেছিল। জ্ঞান ফেরার পর তুলি জড়তা-সংকোচ, লজ্জায় আবারও জ্ঞান হারানোর পথে। শেষমেশ সে কিনা লজ্জায় হুঁশ হারিয়ে বসল? সবাই কি না কি ভাবলো। আর আদ্র!আদ্রর মনোক্ষুণ্ণ হয় নি তো?চিন্তায় তুলি কারো সাথেই একটা কথাও বলে নি। ক্লান্ত শরীর নিয়ে পাড়ি জমিয়েছিল ঘুমের রাজ্যে।
কানের কাছে মুখ নিয়ে নরম স্বরে ডাকল আদ্র। বার কয়েক ডাকার পর তুলি নড়েচড়ে উঠল। নিজের অতি কাছে আকস্মিক আদ্র কে দেখে হকচকিয়ে গেল। নিজের দিকে তাকিয়ে দেখল শাড়ি ঠিক আছে কিনা। যখনই দেখল একদম ঠিকঠাক তুলি খুব করে চমকাল। কারণ শাড়ি পড়ে ঘুমানো এই প্রথম। নিজেকে এতোটা গোছানো দেখে অবাকের চরম পর্যায়ে পৌঁছতে বাকি নেই। আদ্র রুমের লাইট জ্বালিয়ে দিল। নীল আকাশটা লালিমায় ছেয়ে গেছে। কিছুটা দূর থেকে আযানের শব্দ ভেসে আসছে। শাড়ি সামলে ধীর পায়ে বিছানা ছাড়ল তুলি। ওয়াশরুম থেকে হাত মুখ ধুয়ে এসে দেখল আদ্র সোফায় বসে আছে দু’হাত কপালে ঠেকিয়ে। অন্তর টা মুচড়ে উঠল তুলির। আদ্রর পাশে বসে ব্যাকুল কন্ঠে ডাকল,
” ডাক্তার সাহেব। ”
“হুঁশ! ”
ঠোঁটে আঙুল দিয়ে তুলি কে চুপ করিয়ে দিল আদ্র। নরম ঠোঁটে আদ্রর স্পর্শে তুলির রন্ধ্রে রন্ধ্রে শিহরণ বয়ে চলেছে। ওষ্ঠদ্বয় এগিয়ে আনল আদ্র। তুলির হৃদস্পন্দন অস্বাভাবিক হতে লাগলো কাছে আসতে দেখে। আদ্রর হাতে নখ বিঁধিয়ে আঁকড়ে ধরল শক্ত করে। একটা শব্দও করল না আদ্র বরং অধর যুগল গভীরভাবে ছুঁয়ে দিল তুলির ললাটে। ধপ করে চোখ মেলল তুলি। লজ্জায় মাথা নত করতেই চোখে পড়ল আদ্রর ফর্সা হাতের পিঠে বিন্দু বিন্দু রক্ত। তুলির হৃদয়ে ব্যাথার সঞ্চার হলো। নিজের নখের দিকে চাইতেই স্তব্ধ হয়ে গেল। নখ গুলো খুব বড় হয়ে আছে। যে কেউ দেখলে বলবে কতকাল হয়তো নখ কাটে না মেয়েটা। মন খারাপ করে আদ্রর দিকে তাকালো। চক্ষুদ্বয়ে আটকালো আদ্রর মুগ্ধকর হাসি। মন জুড়িয়ে গেল নিমিষেই। পরক্ষণেই হাতের কথা ভেবে প্রশান্তি টা উবে গেল। অথচ আদ্র হাসিটা ধরে রেখেছে। তুলির পাশ থেকে উঠতে উঠতে বললো,
” মন খারাপ করো না বউ। ব্যাথা লাগে নি আমার। দুপুরের জন্যও রাগ করি নি আমি। হাত টা ধুয়ে আসি তোমাকে খাইয়ে দিব। খাওয়ানো শেষে তোমার ডাইনি নখ গুলোও কেটে দিতে হবে। এই নিয়ে দুই দু’বার হামলা করলো আমার উপর।”
মুহুর্তেই তুলির ঠোঁটে লজ্জালু রেখা দেখা দিল। মুখ অন্যদিকে ফিরিয়ে হাসল সে,যা আদ্রর চক্ষুগোচর হলো অনাসয়ে। হাত ধুয়ে এসে তুলির পাশে বসলো আদ্র। প্লেট হাতে নিয়ে ভাত মাখিয়ে এক লোকমা তুলির মুখের সামনে ধরলো। তুলি একবার ভাবলো এই অসময়ে খাবে না। কিন্তু তার ডাক্তার সাহেবের হাতে খাওয়ার সুযোগ টা সে কখনোই মিস করতে চায় না। হা করে মুখে পুড়ে নিল খাবার টা। কিছু একটা মনে পড়তেই চিবোতে চিবোতে বললো,
” আপনি খেয়েছেন?”
” না।”
আদ্রের জবাবে তুলি করুন চাহনি নিক্ষেপ করল। আর আদ্র উপহার দিল ঠোঁটের উষ্ম ছোঁয়া। তুলির গালে পরশ বুলিয়ে বলে উঠল,
” হসপিটালের ক্যান্টিনে নাস্তা খেয়েছিলাম। রাতে খেয়ে নিব।”
তুলি মৃদু হাসল। আদ্রর হাতে প্লেটের পুরো ভাত খেয়ে শেষ করল। প্লেট নিচে রেখে এসে আদ্র নেইল কাটার নিয়ে তুলির সামনে হাঁটু গেড়ে বসলো। যত্নসহকারে সবগুলো নখ কাটতে কাটতে বলে উঠল,
” আমাকে দেখার তৃষ্ণা যেন তোমার কখনও না ফুরায় তুলা। ”
তুলি স্তম্ভিত হয়ে পড়ল। এতোক্ষণ তার নয়ন দু’টো গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করছিল আদ্র কে। ইশ!ধরা পড়ে গেল।
_______________
ড্রইংরুমে পিনপন নীরবতা। রাদিফ সাহেব, সায়েরা বেগম, আমরিন,আফসানা,তৌফিক সাহেব বসে আছেন। তুলি আড়ষ্টতা নিয়ে বসে আছে মায়ের পাশে। দশ মিনিট অতিবাহিত হয়েছে আদ্র কে ডেকে পাঠানো হয়েছে এখনও আসার কোনো নাম নেই। আদ্র তো এমন উচ্ছৃঙ্খল নয়,এটা সবারই জানা। তবুও কেন আসছে না বুঝতে পারছেন না রাদিফ সাহেব। সায়েরা বেগম ফের ডাকতে যাওয়ার জন্য উঠতে যাবে,ঠিক তখনই সিঁড়ির দিকে চোখ গেল সবার। বড় বড় পা ফেলে নেমে আসছে আদ্র। সিংগেল সোফা টায় বসে বলে উঠল,
” সামান্য লেট করার জন্য দুঃখিত আমি। কয়েকটা পেশেন্টের ফাইল গুলো চেক করা খুব জরুরি ছিল,শেষ না করে উঠতে পারছিলাম না।”
তৌফিক সাহেবের কপট রাগ হলেও মুখে কিছু বললেন না। ওনার রাগ একটা জায়গায় এভাবে কেন নিয়ে আসলো তার মেয়ে কে। যদিও আদ্রর সম্পূর্ণ অধিকার আছে তার মেয়ের উপর তবুও তার রাগ হচ্ছে। আদ্র ভালো ছেলে হলেও ওনার কাছে এখন আদ্র কে একরোখা, ঘাড়ত্যাড়া মনে হচ্ছে। সবাইকে মৌন মুখে বসে থাকতে দেখে আদ্র নিজেই সবার উদ্দেশ্যে বললো,
” আপনাদের সিদ্ধান্ত কে আমি শ্রদ্ধা জানিয়েছি। আপনাদের কি উচিত নয় এখন আমার অতি সামান্য একটা সিদ্ধান্ত মেনে নেওয়ার? আমি চাই কালই আমাদের বিয়ের রেজিস্ট্রি হোক।”
উপস্থিত সকলে চমকিত নয়নে চাইল আদ্রর দিকে। কাল মানে!সবার চমকপ্রদ দৃষ্টি দেখে আদ্র তুলির দিকে তাকাল। ঝটপট দৃষ্টি সরিয়ে নিল তুলি। তৌফিক সাহেব কিছুটা উঁচানো স্বরে বলে উঠলেন,
” এতো জলদি!মেনে নিতে পারছি না তোমার সিদ্ধান্ত আদ্র।”
বুকে চিনচিনে ব্যাথা অনুভব করল তুলি। বাবার দিকে কাতর চোখে চাইতে গিয়েও পারল না সংকোচে। আদ্র দু’ ঠোঁট প্রসারিত করে বললো,
” কেন পারবেন না খালু?আপনার কি আমাকে আপনার মেয়ের জন্য বিশ্বাসযোগ্য মনে হয় না?যদি নাহয় তবে আমি আজ আপনাকে কথা দিচ্ছি আপনার মেয়ে কে আমি নিজের সবটুকু দিয়ে আগলে রাখব। একটা মেয়ের জন্য তার বাবা-ই রাজা। আমি না-হয় আপনার রাজকন্যার রাজপুত্র হয়ে দেখাবো। সর্বশেষে এটাই বলবো আমার কাছ থেকে তুলি কে আর দূরে রাখবেন না প্লিজ।”
প্রচন্ড অবাক হলো সবাই। আদ্রের শান্তস্বরের কথাগুলো তৌফিক সাহেবের মন গলিয়ে দিলেন। ঠোঁট ছাড়িয়ে হাসলেন তিনি। তুলির সুখে কাঁদতে ইচ্ছে করলো। আদ্রর মতো একটা পুরুষ তার কল্পনায়ও ছিল না। অথচ না চাইতেও পেয়ে গেল। ভাগ্য! তুলির ভাগ্যে এতো সুখ তুলির কাছে অনাকাঙ্ক্ষিত। আদ্রর দিকে নিষ্পলক তাকিয়ে রইল। তৌফিক সাহেব, রাদিফ সাহেব কালকের অনুষ্ঠান নিয়ে আলোচনায় বসে পড়লেন। কম সময়ে বিরাট আয়োজন করতে হবে। একমাত্র ছেলে ও মেয়ে বলে কথা। আজ তুলির বাবা,মা-ও এখানে থাকবেন। অনুষ্ঠান এ বাড়িতেই হবে। নিকট আত্মীয় স্বজন সবাইকে ফোন করে কাল সকালে উপস্থিত হতে বলা হয়েছে। রেজিস্ট্রি হবে কাল রাতে। ইনশিতা কে এখনই চলে আসার জন্য বলে দিয়েছেন সায়েরা বেগম। মেয়েটা তো শুনেই খুশিতে আত্মহারা। ড্রাইভার কে নিয়ে বেরিয়েও গেছে। রনক কে বলে দিয়েছে ব্যাগ প্যাক নিয়ে যেন পরে চলে আসে। শুনেই সায়েরা বেগম কয়েক দফা বকেছে ইনশিতা কে। কিন্তু বিশেষ লাভ হয় নি। প্রিয় মানুষ, প্রিয় ভাইয়ের বিয়ে এটা তার জন্য জীবনের সবচেয়ে বড় খুশির খবর। ইনশিতা ও আমরিনের জীবনে ভালোবাসার মানুষ থাকলেও প্রিয় মানুষ কেবলই তাদের ভাই।
_________
সারা বাড়িতে উৎসব মুখর পরিবেশ। সময় এগারোটার কাটায় এসে স্থির হলো মাত্র। পায়েল,অন্তু,সাগর,রিমি সব দশটার দিকে এসে হাজির। আসা মাত্রই অন্তু,সাগর কাজে লেগে পড়েছে।রিমি,পায়েল আমরিনের রুমে আড্ডা জমিয়েছে জমপেশ। উপর থেকে হাসির কলরব ভেসে আসছে খুব। সাগর ডেকোরেশনের কাজ দেখছিল। অন্তু আফসোসের সহিত বিড়বিড় করল,
” ছেলে হয়ে ফেঁসে গেলাম। নয়তো আমিও আড্ডা দিতে পারতাম। ”
কথাটা কর্ণগোচর হলো সাগরের। ফিক করে হেসে উঠল। অন্তুর কাঁধ চাপড়িয়ে বললো,
” পায়েল ডাকিনীর মতো কেউ না আসুক তোর জীবনসঙ্গী হয়ে। নাহলে বউয়ের হাতে মার খেতে খেতে পটল তুলতে হবে তোর।”
মাথা দুলিয়ে হাসল অন্তু। কাজ দেখতে দেখতে আনমনে আওড়ালো-” ডাকিনী টা-ই ভীষণ প্রিয়।”
স্টেজ সাজানোর আয়োজন দেখে ঘরে আসল আদ্র। রুমের কোথাও তুলি কে দেখতে পেল না। আমরিনের রুম থেকে শোরগোল কানে আসতেই সেদিকে পা বাড়াল। দরজার সাথে হেলান দিয়ে গাঢ় দৃষ্টি নিবদ্ধ করলো পা গুটিয়ে বসে থাকা তুলির পানে। রিমি ব্যঙ্গ স্বরে প্রশ্ন ছুঁড়ল,
” কি চাই? ”
“বউ চাই।”
আদ্রর নির্বিকার জবাবে চোখ কপালে উঠে গেল সবার। তুলি লজ্জায় পা দিয়ে বিছানার চাদর আঁকড়ে ধরল। চিৎকার করে বলতে ইচ্ছে হলো ডাক্তার সাহেব আপনি এতো লজ্জাহীন, বেহায়া কেন?পায়েল ভ্রুঁ কুঁচকে বললো,
“নিতে হলে আমাদের ট্যাক্স দিতে হবে।”
” ওকে ডান। চোখ বন্ধ কর তোরা সবাই। সারপ্রাইজ আছে তোদের জন্য। ঠিক পাঁচ মিনিট পর খুলবি।”
সবাই খুশিতে গদগদ হয়ে চোখ বন্ধ করে নিল। আঁখিদ্বয় বুজতেই তুলি শূন্যে ভাসতে লাগল। ঠাওর করে নিল আদ্রর চাল। আদ্রর গলা জড়িয়ে ধরে আমতাআমতা করে বলে উঠল-
” এটা ঠিক হয় নি ডাক্তার সাহেব। ”
” তোমার জন্যই বেঠিক নিয়মে চলতে হলো বউ।”
#চলবে,,,
(ভুল-ত্রুটি ক্ষমার দৃষ্টিতে দেখবেন।)