আকাশে তারার মেলা সিজন 2 পর্ব-৩১

0
2720

#আকাশে_তারার_মেলা_২
#লেখিকাঃআসরিফা_সুলতানা_জেবা
#পর্ব_৩১

” বিয়ের রাতে তোকে স্পর্শ করেছিলাম বলে তুই আমাকে চরিত্রহীন উপাধি দিয়েছিলি। অবাক করা ব্যাপার নিজের বউয়ের গালে ভালোবেসে হাত রাখার কারণে চরিত্রহীনের খাতায় নাম লিখিয়েছিলাম আমি। বিয়ের মাধ্যমে নাকি পবিত্র বন্ধনে আবদ্ধ দুটো ছেলেমেয়ে। স্বামীর পুরো হক থাকে বউ কে ছোঁয়ার। কিন্তু আমাকেই দেখ গভীরভাবে না ছুঁয়েও বউয়ের কাছে আমি চরিত্রহীন। এতগুলো বছর ধরে তোকে ভালোবাসার অপরাধে আমি চরিত্রহীন রিমি। ”

কথাগুলো বলে ঠোঁট কামড়ে হাসল সাগর। কন্ঠে বিষাদের রেশ ছিল স্পষ্ট। রক্তিম আঁখি যুগল ছলছল করছে। পলক ফেললেই কার্নিশ ঘেঁষে জল গড়িয়ে পড়বে। নিজের দুর্বলতা দেখাতে রাজি নয় সাগর। সামনে দাঁড়িয়ে থাকা মেয়েটার প্রতি দুর্বলতার কারণেই তো এতগুলো বছর ধরে প্রতিনিয়ত দহন হচ্ছে হৃদপিন্ডে। মুখ ফিরিয়ে নিল তৎক্ষনাৎ। বিনা সময় ব্যতীত ওয়াশরুমে ঢুকে ঠাস করে দরজা লাগিয়ে দিল। সেদিকে তাকিয়ে ধপ করে বিছানায় বসে কান্নায় ভেঙে পড়ল রিমি। বদ্ধ রুমে ফুপিয়ে ফুপিয়ে কাঁদছে মেয়েটা। কান্নার শব্দ দেয়াল ভেদ করে সাগরের কর্ণে এসে বিঁধছে। চৌচির হয়ে যাচ্ছে অন্তর।

হঠাৎ করেই পারিবারিকভাবে বিয়ে হয়ে যায় রিমি সাগরের। সকাল অব্দিও বিয়ে সম্পর্কে অবগত ছিল না রিমি। ইন্টার থেকেই সাগরের সাথে বন্ধুত্বের সম্পর্ক। মেডিক্যাল লাইফ শেষ হতে না হতেই প্রিয় বন্ধুত্বের সম্পর্ক স্বামী -স্ত্রী তে পরিণত হবে তা কল্পনাতীত ছিল। প্রথমে বিয়ের জন্য নাকচ করলেও আদ্র,পায়েল,নিবিড় সবার কথায় ভেবে দেখল। আজ পর্যন্ত কাউকে ভালোবাসে নি,তাহলে সাগরের মতো ভালো ছেলে কে জীবনসঙ্গী হিসেবে রিজেক্ট করার প্রশ্নই উঠে না। তবুও মনের মধ্যে কোথাও একটা বাঁধা দিচ্ছিল। হুট করে বিয়েটা মানতে কষ্ট হচ্ছিল। বিয়ের রাতে সাগর জানায় কলেজ লাইফ থেকেই ভালোবাসতো রিমি কে। অপ্রকাশিত রেখে সর্বদা চেষ্টা করেছে রিমি কে বউ হিসেবে পাওয়ার। বাসর রাতে সাগরের ব্যক্ত করা অনুভূতি মেনে নিতে পারে নি রিমি। এতো কাল পছন্দ করে, না বলে বন্ধুত্বের ভ্রমে রেখে বিয়ে টা ধোঁকা ঠেকল রিমির কাছে। বিষাক্ত অনুভূতিতে ছেয়ে গেল মন,অন্তর। গালে রাখা সাগরের হাত টা ছিটকে সরিয়ে দিয়ে চিৎকার করে বললো,

” চরিত্রহীন। আমার অনুমতি ব্যতীত কিভাবে স্পর্শ করলি তুই আমাকে?আমার কাছে আসবি না একদম। খুন করে ফেলবো তোকে। ”

চরিত্রহীন!হ্যাঁ এই শব্দটাই কেবল সাগরের হৃদয় রক্তাক্ত করে দিয়েছিল সেই মুহুর্তে। লন্ড ভন্ড করে দিয়েছিল বছরের পর বছর জমিয়ে রাখা ভালোবাসা। রিমির বাড়ি থেকে বেরিয়ে গিয়েছিল সেই মুহুর্তে। অভিমান সত্যিই কখনও কখনও ভালোবাসা কে হারিয়ে দেয়। নয়তো কেন সাগর অভিমান টা কেই বড় করে দেখল!রিমি বিয়ের কয়েকদিন পরেই বুঝতে পেরেছিল তার রাগ টা ছিল অযৌক্তিক। কিন্তু মানুষ রাগে হিতাহিত জ্ঞান হারিয়ে বসে। সাগরের মা অনেকবার নিতে চাইলেও যায় নি রিমি। তার তীব্র আশা সাগর সব ভুলে আবারও ভালোবাসা দিয়ে আগলে নিবে তাকে। বধূবেশে শশুড় বাড়িতে পা রাখবে স্বামীর ভরসার হাত টা আঁকড়ে ধরে।

দরজা খোলার শব্দে রিমি মুখ তুলে তাকালো। মেয়েটার মুখ একদম লাল হয়ে আছে। চোখ গুলো ফুলে আছে কান্নার প্রকটে। বুকটা মোচড় দিয়ে উঠল সাগরের। এমনিতেই মেয়েটার বেহায়াপনায় মনটা আজকাল গলে যাচ্ছে, দাবিয়ে রাখা প্রণয় শিখা বার বার জ্বলে উঠছে। পরক্ষণেই বিয়ের প্রথম রাতের দৃশ্য মনে পড়লেই দেয়াল তুলে দেয় কষ্ট,অভিমানগুলো। এক পলক চেয়ে মুখ ফিরিয়ে নিল। নয়তো আজ আবারও চরিত্রহীন তকমা লাগিয়ে বসবে সে এই মেয়েটার কারণে। শার্ট ঠিক করে রিমির পাশ কাটিয়ে যেতে নিলে বলিষ্ঠ হাত টা রিমির নরম হাতের দুর্বল বাঁধনে বাঁধা পড়ল। অগ্নি দৃষ্টি নিক্ষেপ করতেই রিমি হামলে পড়ল বুকে।

” সাগর আমার সহ্য হচ্ছে না আর তোর অভিমান। মরে যেতে ইচ্ছে করছে। একটু একটু করে না মেরে একেবারে মেরে ফেল প্লিজ। নয়তো একটু ভালোবাসা দে। প্রমিজ করছি কোনোদিনও ফিরিয়ে দিব না তোকে। কয়েকটা মাসে খুব ভালোবেসে ফেলেছি। জানি তোর বছর খানেকের ভালোবাসার কাছে আমার ভালোবাসা টা খুবই নগন্য তবুও আমায় ফিরিয়ে দিস না। আমায় আপন করে নে। একটু সুযোগ দে। তোর কষ্ট ভরা দৃষ্টি আমার ভিতর টা ছিন্ন ভিন্ন করে দিচ্ছে। এতো কষ্ট কেন হচ্ছে সাগর?”

কাঁদতে কাঁদতে সাগরের পড়নের শার্ট টা খামচে ধরেছে রিমি। হাত উঠিয়ে রিমি কে জড়িয়ে ধরতে গিয়েও গুটিয়ে নিল সাগর। নিজের স্ত্রীর ভালোবাসার জন্য এতো আকুলতা তার হৃদয় দ্বিখণ্ডিত করতে লাগল অনবরত। রিমি কাতর নয়নে সাগরের মুখ পানে চাইল। থমকাল সাগর। দৃষ্টি টা তার মনে জমানো এতো মাসের রাগ ক্ষোভ, অভিমান, কষ্ট সব বুলিয়ে দিল। এতোকাল কোথায় ছিল এই দৃষ্টি!রিমি কে উপেক্ষা করে চলছিল বলেই কি চোখে বিঁধে নি?আফসোস হলো সাগরের। কর্ণধার হলো রিমির আবেদনময়ী স্বর।

” প্রত্যেক টা মানুষ মনের মাঝে অফুরন্ত ভালোবাসা লুকিয়ে রাখে। তোমার অফুরন্ত ভালোবাসা থেকে আমায় একটু দিলে কি খুব বেশি ক্ষতি হয়ে যাবে সাগর?”

সাগর নির্বাক,নিস্তেজ। ভিতরে তোলপাড় হচ্ছে। তীব্র তোলপাড়! রিমি কে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে বুকে মিশিয়ে নিল। এই মেয়ে কে ফিরিয়ে দেওয়ার সাধ্যি আর তার নেই। ক্ষীণ স্বরে বললো,

” আজ তোকে আপন করে নিলে আমি সত্যিই চরিত্রহীন হয়ে যাবো রে রিমি৷ মেনে নিতে পারবি,,”

সাগরের বাক্য টা শেষ করার তর সইলো না রিমির। গলা জড়িয়ে চুমু একে দিল সাগরের বুকে। দ্রুত গতিতে আওড়ালো,

” পারবো,পারবো,পারবো।”

সাগর গভীর নয়নে চেয়ে রিমি কে কোলে তুলে বিছানায় শুয়ে দিল। সম্পূর্ণ ভর রিমির উপর দিয়ে গলায় মুখ গুঁজে আলতো চুমু খেল। আবেশে চোখ নির্মলিত হয়ে এলো রিমির। সাগরের হাত টা আঁকড়ে ধরতেই কানের পাতায় চুমু খেয়ে মৃদু হাসল সাগর। কন্ঠে দুষ্টমির রেশ ধরে ফিসফিস করে বলে উঠল,

” তুই তো ভারী নির্লজ্জ মেয়ে রিমি।”
________

ক্ষেতের লাইল ধরে হেঁটে চলছে সবাই। কিন্তু হাঁটতে গিয়ে বার বার বাঁধাগ্রস্ত হচ্ছে পায়েল, রিমি। কখনো ক্ষেতের লাইল দিয়ে হাঁটা হয় নি তাদের তাও শাড়ি পড়ে। গ্রামে আগেও গিয়েছে তবে সেটা মেডিক্যাল ক্যাম্পেইনের জন্য। জমিতে পানি দেওয়ার ফলে লাইল ভিজে কাঁদা কাঁদা হয়ে আছে। সকাল সকাল হাঁটতে বের হওয়ার স্পৃহা জেগেছিল তুলির মনে। নিজের মন বাসনা পূর্ণ করতে সাথে নিয়ে এসেছে সবাইকে। নিজেদের গ্রাম টা ঘুরে দেখাতে চায় তুলি। পায়েল,রিমি,আমরিন,ইনশিতার কাছে আহ্লাদী স্বরে অনুরোধ করেছে শাড়ি পড়ার। এই মায়াবিনীর অনুরোধ ফেলে দেওয়ার মতো মন যে কারো নেই।

সামনে কাঁদা চোখে পড়তেই পা থেকে জুতা খুলে হাতে তুলে নিল তুলি। এই পিচ্ছিল মাটিতে শাড়ি পড়ে জুতা পড়ে হাঁটা সম্ভব নয়। পরে দেখা যাবে চিৎপটাং হয়ে পড়ে আছে ধান ক্ষেতের মাঝে। অগ্রিম বিপদের কথা ভেবে এক হাতে শাড়ি ধরে অন্য হাতে জুতা জোড়া নিয়ে ঘাড় ঘুরিয়ে বললো,

” আপু, আমরিন সবাই জুতা খুলে নাও। শাড়ি আকড়ে ধরো। সামনে কাঁদা অনেক।”

তুলির কথা কর্ণপাত হতেই সামনে এগিয়ে যাওয়া আদ্র,অন্তু সবাই দাঁড়িয়ে পড়ল। পিছু ফিরতেই আদ্রর চোখ নিবদ্ধ হলো এক হাতে শাড়ি,অন্যহাতে বেসামাল হয়ে হেঁটে আসা তুলি কে। দেখে উপলব্ধি করা সহজ মেয়েটার দু হাত ব্যস্ত রাখায় হাঁটতে সুবিধা হচ্ছে না। কেমন হেলে দুলে হেঁটে আসছে। প্যান্ট ফোল্ড করে এগিয়ে এলো আদ্র। সূক্ষ্ম একটা নিঃশ্বাস ছেড়ে তুলির হাত থেকে জুতা নিজের হাতে নিয়ে নিল। বিরক্তিকর স্বরে বলে উঠল,

” বলেছিলাম জুতা বাড়িতে রেখে আসতে। বাট অলওয়েজ মেয়েরা ওভার পাকনা। ”

আদ্রের তিক্ত বাক্যে ধ্যান নেই তুলির। তার সকল ধ্যান মগ্ন আদ্রের পায়ের দিকে। প্যান্ট ফোল্ড করার জন্য পায়ের অনেকাংশ দেখা যাচ্ছে। কি ফর্সা পা!ফর্সা পায়ে লোমশ গুলো দেখে তুলির মেরুদণ্ড বেয়ে শীতল স্রোত নেমে গেল। ইচ্ছে করল ছুঁয়ে দিতে। কাঁদা লেগে আছে পায়ে। তুলির বুক টা ছ্যাঁত করে উঠল। কেন লাগল এতো সুন্দর পায়ে কাঁদা। বিড়বিড় করল, ” আমার শাড়ির আঁচল দিয়ে মুছে দিতে পারতাম যদি অসভ্য,লুচু কাঁদা কে!”

আমরিনের হাত থেকেও জুতা নিয়ে নিল আদ্র। ইনশিতার হাত থেকে নিতে নিলে রনক এগিয়ে এসে বললো,

” আমি নিতে পারব ভাইয়া। ”

কোনো রূপ প্রতিক্রিয়া করল না আদ্র। তুলি ও আমরিনের জুতা নিয়ে সামনে চলে গেল। প্রচন্ড অবাক হল তুলি। একটা মানুষ কত পারফেক্ট হতে পারে তুলির জানা নেই। তবে তুলির দেখা সবচেয়ে পারফেক্ট মানুষ টা তার ডাক্তার সাহেব। বোনদের প্রতিও ভালোবাসার কোনো ত্রুটি রাখে না। সাগর রিমির কাছ থেকে জুতা নিতে দেখে বিস্ময়কর দৃষ্টিতে তাকালো সবাই। এ যেনো স্বপ্ন সবার নিকট। অতঃপর রিমির লজ্জা রাঙা মুখ প্রমাণ করে দিল ইহা স্বপ্ন নয়। সত্যি! সাগর হাত বাড়িয়ে পায়েলের কাছ থেকে জুতা নিবে তার আগেই সবাইকে পাশ কাটিয়ে হাজির হলো অন্তু। আমতা আমতা করে বললো,

” আমার তো হাত খালি। আমি নিবো। ”

অন্তুর কথা শুনে রিমি কে নিয়ে অভিমুখে এগিয়ে গেল সাগর। পিছন থেকে উচ্চ শব্দ কর্ণে আসতেই দ্রুত বেগে ফিরে তাকাল। যা দেখল তাতে সবার মাথায় হাত।

#চলবে,,,

(ভুল-ত্রুটি ক্ষমার দৃষ্টিতে দেখবেন।)

p.c: Md Hemonto🖤

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here